মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৫

0
425

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৫)

অনুভবের সকালটা বড়ো দেরিতে শুরু হয়। সে ভীষণ অনিয়ম করে চলে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতন করে না। রাতের ঘুম দিনে ঘুমায়। সেই জন্যেই সে রোগা পাতলা। তবে এটা সত্য সে শক্তিশালী। ওর বাবা আমিন সাহেব আবার সচেতন মানুষ। যৌবনে ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবে ও কাজ করেছেন। তবে ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলেন না। তিনি রেগে অগ্নি হয়ে আছেন। একটু পর পর মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে ছেলের ঘরের দিকে তাকাচ্ছেন। তবে ছেলেটার কোনো খবর নেই!

“এই তোমার চা।”

চা নিতে নিতে আমিন সাহেব বললেন,”এত বেলা হয়ে গেল অথচ তোমার ছেলের ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই!”

“ছেলে কী আমার একা?”

স্ত্রীর কথায় একটু মৌন হলেন আমিন। কিছু সময় পর চায়ে চুমুক দিলেন। এই চা ছাড়া ওনি হয়তো এক মুহূর্তও চলতে পারবেন না। কি এক আশ্চর্য স্বাদ মিশে আছে!

“ছেলেকে ডেকে ওঠাও।”

স্বামীর আদেশ পেয়ে যেতে হলো রূপবান কে। তার এই নামটি দিয়েছেন আমিন সাহেব। তার চোখে সবথেকে সুন্দর নারী রূপবান।

ছেলে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু সময় আগেই ঘুমিয়েছে। এমন কাঁচা ঘুম ভা ঙা তে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবে কিছু করার নেই। আমিন সাহেব রেগে আছেন আজ। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলালেন।

“অনুভব, অনুভব, বাবা ওঠ তো।”

অনুভবের মুখশ্রী জুড়ে বিরক্তি ছেয়ে গেল। ও মৃদু সুরে বলল,”এখন প্লিজ যাও মা।”

“তোর বাবা রেগে আছে। ওঠ বাবা। কতবার বলি ঠিক ঠাক ঘুমা, খাওয়া দাওয়া কর।”

“উফ মা।”

“ওঠ না বাবা।”

“মা।”

অনুভব বিরক্ত হয়ে ওঠল। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,”একটু ঘুমাতে দাও না। আমি মাত্রই ঘুমিয়েছি।”

“তোর বাবা রেগে আছেন। যা এখন।”

“প্লিজ মা।”

“অনুভব, ওঠ বলছি।”

ছেলেকে একপ্রকার টেনেই ওঠিয়ে দিলেন রূপবান। অনুভব লম্বায় বিশাল। তার ওপর দেহ পাতলা। তাই তাকে আরো বেশি লম্বাটে লাগছে। ছেলেকে এক নজর দেখে রূপবান বললেন,”দ্রুত যা।”

এমনিতে চটপটে স্বভাবের হলেও বাবার সামনে অনুভব কিছুটা মিইয়ে যায়। আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। ছেলেকে আসতে দেখে আমিন সাহেব মুখের চোয়াল শক্ত করলেন।

“বোসো।”

বাবার বরাবর ডিভানে বসল অনুভব। চোখে মুখে ঘুমের ভাব।

“জি বাবা?”

“এত বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তুমি জানো না?”

“জানি বাবা।”

“তবে?”

“আর হবে না।”

“সব সময় ই তো এমন বলো। তবে ফল তো একই।”

অনুভব চুপ করে রইল। আমিন সাহেব হতাশ। তবে তিনি এই বিষয়ে আর কিছু না বলে বললেন,”বয়স হচ্ছে আমার। একমাত্র সন্তান তুমি। দায়িত্ব নিতে হবে নিশ্চয়ই।”

ভবঘুরে স্বভাবের অনুভব দায়িত্বের কথা বলতেই কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমিন সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,”দায়িত্ব নিতে হবে না? এখন বিজনেসের দায়িত্ব নিবে। ভবিষ্যতে বউ পোলাপানের দায়িত্ব নিবে। কি নিবে না? নাকি বিয়ে করবে না কখনো?”

ছেলেকে সরাসরিই কথা টা বললেন তিনি। অনুভব মৌনই রইল।

“ঠিক আছে। নিয়মের মধ্যে আসো। আর এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। পরে আরো আলোচনা হবে।”

গলায় ঝোলানো তোয়ালে, মুখে ব্রাশ। অনুভব এভাবেই ছাদে যাচ্ছে। ওদের ফ্ল্যাট চার তলায়। বিল্ডিং নয় তলা। লিফ্টের বাটনে প্রেস করে দাঁড়িয়ে রইল অনুভব। তার বয়স কত? এইটুকু বয়সেই বাবা তার ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপাতে চায়। এদিকে সে গান বাজনা ভালোবাসে। ভার্সিটির ফাংশনে এটেন্ট করে। সে তো দায়িত্ব নিতে চায় না। ও এসব ই ভাবছিল। লিফ্ট এসে খুলে গেল। অনুভব আনমনেই ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর অন্যমনস্ক থেকেই বলল,”অসহ্য!”

ওর থেকে এক হাত দূরে থাকা মেয়েটি বড়ো চোখে তাকাল। অনুভব তখনো মেয়েটিকে দেখে নি। হঠাৎ করেই গ্লাসে মেয়েটির মুখশ্রী দেখতে পেল। ও তাকাল ঝটপট।

“সরি, আপনাকে বলি নি।”

ব্রাশ মুখে, তোয়ালে গলায়, লম্বাটে দেহের একটি ছেলে! সায়রার কেন যেন হাসি পাচ্ছে। অনুভব কে আজ অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

“ইটস ওকে।”

লিফ্ট পুনরায় খুলে গেল। সায়রা গেল আহনাফদের ফ্ল্যাটে। আর অনুভব, ওঠল ছাদে।

আহনাফকে পড়িয়ে বাজারে এসেছে সায়রা। আমিরার জন্য গিফ্ট কিনতে হবে। কাল বাচ্চাটার পছন্দের খাবার রান্না হবে। সেটার জন্য ও কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে। সব মিলিয়ে ভালোই সময় লাগবে। ও ফোন বের করে আগে লিস্ট তৈরি করল। তারপর একে একে জিনিসপত্র কিনল। হাত ভরাট হয়ে আছে সরঞ্জামে। রিকশায় ওঠবে ওমন সময় দেখা মিলল সাঈদের। ও দূর থেকে আসছে।

“মামা একটু অপেক্ষা করুন।”

সায়রা নিজেও এগিয়ে গেল। সাঈদ এসে ওর হাতের জিনিসপত্র গুলো ধরল।

“কল দিয়েছিলাম, ধরলে না যে।”

“আমি দেখি নি। পড়ানোর সময় মিউট করে রেখেছিলাম।”

“ঠিক আছে, চলো।”

“কোথায়?”

“তোমার বাসায়।”

“এখন? কেন?”

“কথা বলতে।”

“কী কথা?”

“ভাবি কে বলব, আমিরার সাথে ঠিক মতন আচরণ করতে।”

“আশ্চর্য! এটা কোনো কথা হলো? এভাবে বললে সে অপমানিত হবে না?”

“কেন কথা হবে না? সে যদি একটু স্বাভাবিক হয় তবেই তো আমাদের সমস্যাটা মিটে যায়।”

“সমস্যাটা এখানে নয় সাঈদ।”

“তবে কোথায় সমস্যা?”

“সমস্যা আমার ভাগ্যে। আর ভাবি কে কিছু বলতে পারব না। যতই হোক সংসারটা তার। নানান সমস্যা রয়েছে। আমি তোমায় বোঝাতে পারছি না।”

এ কথা বলেই মিইয়ে গেল সায়রা। সাঈদের শরীর কাঁপছে।

“আমি বুঝতে পারছি না। আমি ক্লান্ত সায়রা। বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

সায়রা চুপ। ওর চোখ টলমল করছে। ও শুকনো ঢোক গিলে বলল,”তুমি চলে যাও সাঈদ। আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো।”

সাঈদ গেল না। বরং দাঁড়িয়ে রইল। রিকশা অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে। তাড়া দিচ্ছে। সায়রা ওঠে পড়ল। মৃদু হেসে বলল,”ভালো থাকো।”

না সাঈদ ভালো থাকল, আর না সায়রা। একটা শোক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সায়রা দু চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদু সুরে বলল,”তুমি ভালো থাকো সাঈদ। ভালো থাকো।”

বাসায় পৌছে সব গুলো জিনিস রাখল সায়রা। আমিরা ঘরের এক কোণে বসে। মেয়েটির তো আর কাজ নেই। ওর খোঁজ খবর নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বসল সায়রা। তারপর ভাবল আজ সকালের কথা। সাঈদ তার পরিবারের সাথে খুব ঝামেলা করছে বেশ কদিন হলো। সায়রাকে ভীষণ ভালোবাসে সে। এদিকে তারা বলেছে আমিরা সমেত কিছুতেই মানবে না তারা। মুখে এ কথা বললেও অন্তরের চিন্তাটি ভিন্ন। সকালেই সাঈদের মা কল করেছিলেন। সোজাসাপ্টা বলেছে সাঈদের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে। তাদের মুক্তি দিতে। শুধুমাত্র সায়রার জন্য তাদের সংসার ভে সে যাচ্ছে। ছেলে পাগলামি করছে। তাছাড়া,আমিরা কোনো ইস্যু না। তাদের মতে সায়রার থেকে ভালো কাউকে পাবার যোগ্যতা রাখে সাঈদ। মেয়েও দেখা আছে। সব মিলিয়ে সায়রা যেন সাঈদের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা না করে। সায়রা অবশ্য প্রতিবাদ করেছিল। বলেছিল সে এসব কেন বলবে। তবে দিনশেষে সত্য, সায়রার কিছু করার নেই। সাঈদের পরিবারের সাথে সে মানাতে পারবে না। যো চেষ্টাই করুক মানুষ গুলো তাকে মেনে নিবে না। আর এর থেকেও বড়ো সত্য আমিরাকে নিয়েও কোথাও শান্তি পাবে না। সব মিলিয়ে এই বাস্তবতা ওকে ভে ঙে দিয়েছে। ওর সমস্ত ধ্যান জ্ঞান এখন আমিরাকে নিয়ে। মেয়েটিকে সুস্থ জীবন দেওয়াই ওর লক্ষ্য। একমাত্র চিন্তা।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে