মুখোশের আড়ালে

0
1029

(লোপা)

সকাল থেকে আজ অফিসে কাজের চাপে ত্রাহি মধুসূদন দশা। দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছিনা। একটা ফাইল শেষ করতেই আরো দুটো ফাইল এসে জমছে টেবিলে। ঠিকমত লাঞ্চও করতে পারিনি আজ। গত কয়েকদিনে ধরেই এনুয়াল ক্লোজিংয়ের কাজে সবার ওপরে অতিরিক্ত চাপ যাচ্ছে। এ মাসের অফিস মিটিংয়ে জানানো হয়েছে কাজের ফাঁকে খুব প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া কেউ মোবাইলে কল ধরতে পারবেনা। আর এদিকে সকাল থেকেই থেকে থেকে আমার মোবাইল ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। এই শহরে মাস ছয়েক আগে বদলী হয়ে আসাতক একলা মানুষ আমি। কার যে এতো দরকার পরলো আজ কে জানে? বাবা মা অন্য শহরে থাকে, বয়স হয়েছে, কোন সমস্যা হলো কি না বুঝতে পারছিনা? বাথরুমে যাবার নাম করে উঠে এসে দেখি আমার খুব ছোটবেলার বান্ধবী বেলীর ফোন। তুষার আর মায়ের একটা একটা মিসডকলও আছে।
‘ বিকেল বেলা ফোন দিব। দৌড়ের উপর আছি।’ বেলীকে মেসেজটা পাঠিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম। কাজে মনোযোগ দেয়া দরকার নয়তো আজও বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে।

অফিস শেষে ফোন অন করে বেলীকে ফোন দেয়ার এক রিংয়েই ফোন ধরলো।

– লোপা ম্যাডাম, তুমিতো বিরাট বড় কাজের লোক হইসো। ফোন করলে ধরতে পারো না। আবার ফোন বন্ধ করে রাখ। মেসেঞ্জারের গ্রুপ থেইকা লিভ নিয়ে নিছো। বলি তোর সাথে কি যোগাযোগ করার রাস্তা সব বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিস?

তুই একাই সব কথা বললে আমি বলবো কখন? অফিসে ভীষণ চাপ যাচ্ছে। মেসেঞ্জারে অনেকেই শুধু আমার পারসোনাল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চায়, এটা আমার ভালো লাগেনা। সেটাতো তোকে আগেই বলেছি। পৃথিবীতে কি আর কারো ডিভোর্স হয়না। অন্যের দোষে নিজে আলোচিত হতে ভালো লাগেনা। সে যাই হোক, এত জরুরী ফোন কেন, সেটা বল।

– আমি তোর শহরে এই মূহুর্তে। নিউমার্কেট এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। পারলে চলে আয়, আড্ডা হবে। কাল ভোরেই আবার চলে যাব।

আচ্ছা আসছি বলে ফোনটা ছাড়লাম।

আমার অবস্থান থেকে খুব বেশী দূরে না নিউমার্কেট। রিকশা চড়ে যেতে যেতে নিজের অতীতের কত কথা যে মনে আসছিল। শেষ বিকেলের সময়টা যেন কেমন। এই শহরে শীত শুরু হয়েছে একটু একটু করে। হাল্কা কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের শেষ বিকেলের রোদ যেন শীতটাকে আরো ভালোভাবে আমন্ত্রন জানাচ্ছে। গত মাসে বেশ দাম দিয়ে কেনা চাদরটা একটু ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। নিজের উষ্ণতা, নিজের ভালোলাগা গুলো আজকাল নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। জীবনের একটা লম্বা সময় অপাত্রে দিয়ে এ বেলা নিজেকে একটু নিজের মতো করে সুখে রাখার চেষ্টা
আর কি। তাতেও যে কত লোকের চোখ টাটায়। অথচ যখন দিনের পর দিন রাতের পর রাত নিজের সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্বামী নামক এক অমানুষের সবরকম অপকর্ম মেনে নিয়ে মুখ বুঁজে ভালো আছির মুখোশ ঝুলিয়ে ছিলাম, তখনো এই লোকেদের চোখে লাগতো; এতো সুখ কেন?

অনেকদিন পর বেলীর সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো। নিজের মানুষ বলতে তো সেই এক বাবা আর মা। আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব দেখা হলেই কেউ সুযোগ নিতে চায় নয়তো এমন হা হুতাশ শুরু করে যেন ঐ অমানুষটার সাথে জীবন না কাটানোয় আমার জীবনের ষোলআনাই বৃথা। অফিস শেষে অনেক ক্লান্ত থাকলেও বেলীর সাথে গল্পকথায় কোথা দিয়ে যে সময় পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। কথায় কথায় তুষারের কথাও বললাম।

তুষারের সাথে আমার পরিচয় সেই স্কুল থেকে। পাশাপাশি বাসা ছিল আমাদের। পরে ওর বাবা বদলী হয়ে যাওয়ায় আর দেখা বা যোগাযোগ হয়নি তেমন। এইচএসসির পর ওরা একবার বেড়াতে এসেছিল তখন আবার নতুন করে গল্পকথা হয়। তবে সমবয়সী হলে যা হয় তেমন ধরনের কথা যেমন কোথায় ভর্তি হবো, কেমন পরীক্ষা হলো ঐ টাইপ। পরবর্তীতে ভার্সিটির এক প্রোগ্রামে আবার দেখা হয় ও তখন বুয়েটে আর আমি ঢাকা ভার্সিটির ইকোনমিক্সের ছাত্রী। মাস চারেক আগে এই মার্কেটেই ঘুরছিলাম ঘরের কিছু কেনাকাটার জন্য। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো

– একদম বদলাওনি দেখছি। চিনতে পেরেছো?

– একটু সাস্থ্য ভালো হওয়া আর কপালের কাছে কয়েকটা কাঁচাপাকা চুল ছাড়া তুষারও বদলায়নি তেমন। জবাব দিলাম, তুমিও তো একই রকম আছো?

এই শহরে আমার আর পরিচিত কেউ নেই। অনেকটা ইচ্ছে আর জেদের বশেই এই বদলী পোস্টটা নিয়েছি। যে শহরে আমার সংসার ভেঙেছে সে শহরে আর মনে টেকেনি। তাছাড়া লোকের কথার উৎপাতও আর নিতে পারছিলাম না। জানলাম, তুষারের সংসারও আমার মতোই টেকেনি। কারণটা কখনো ওভাবে পরিস্কার বলেনি তবে এটুকু বুঝতে পারি মনের মিল ছিলনা। আমারো জানতে ইচ্ছে হয়নি। সেইতো এই নয়তো ঐ কাহিনী। একজন সত্যিকার বন্ধুর ছায়া আমি ওর মাঝে দেখি। কখনো অহেতুক আমার অতীত নিয়ে টানাহেঁচড়ামূলক কথা বা কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার মত মানসিকতা না থাকায় আমাদের বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠে। বিভাগীয় শহর হলেও এই এলাকাটায় এখনো বেশ একটা মফস্বলের গন্ধ আছে। লোকের কথায় ক্লান্ত আমি আর কোন নতুন বিতর্কে জড়াতে চাইনি। আর তাই আমরা আমাদের বন্ধুত্বকে একটা শালীন দূরত্বে রেখেই দুজনে চলেছি।

…………….

(বেলী)

কেন একটা মানুষ সবসময় ভালো থাকবে? নিজে ক্যারিয়ারে এতো প্রতিষ্ঠিত কেন হতে হবে ওকে? এইযে আমি ওর সমান পড়ালেখা করেও মুখ বুঁজে স্বামীর কটু কথা শুনেও ঘর করে যাচ্ছি, আমি কেন ওর মতো সব ছেড়ে নিজের মতো একটা জীবন কাটাতে পারিনা?
কেন তুষারের মতো ভালো একজন বন্ধু সহসা ওর জীবনে চলে আসতে হবে? দেখি কিভাবে ও ভালো থাকে?

টুং করে মেসেঞ্জারের শব্দ আসে। মোবাইলটা হাতে নিতেই রাত্রি দেখে তাদের স্কুলের ফ্রেন্ডদের গ্রুপ মেসেজ। বেলী পাঠিয়েছে, জব্বর খবর আছে তাড়াতাড়ি সবাই আয় গ্রুপে।
একের পর এক তারপর সবার উপস্থিতি জবর খবর শোনার জন্য। বেলী জানায়, ‘আমাদের ডিভোর্সী লোপা বেগমের তো আবার প্রেম হইসে। বিয়েও বোধহয় করে ফেলসে। ঐ যে বয়েজ স্কুলের আমাদের ক্লাসমেট তুষারের সাথে।’
লোপা গ্রুপ ছেড়ে চলে যাওয়ায় অনেকেরই বেশ ক্ষোভ ছিল। সবাই যে যার ক্ষোভ মিটিয়ে কথা বলে নিল লোপার নামে। শুধু লোপা জানলো না, ডিভোর্সী মেয়েদের বোধহয় অন্য কোন ছেলে নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে হয়না। কথা রটাতে লোকের অভাব হয়না। কখনো কখনো বন্ধু নামধারী কিছু মানুষ যেন এ ব্যাপারে আরো সরেস হয়। মেসেঞ্জারের এই মেসেজ শুধু গ্রুপে সীমাবদ্ধ না থেকে বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পরলো বাকী সবার বন্ধুমহলে।

…………………..

(লোপা)

অফিসের কাজেই পুরোনো শহরে আসতে হয় মাসখানেক পরে। থাকতেও হয় কিছুদিন। দেখা হয় এই শহরে যাদের বন্ধু ভাবি তাদের অনেকের সাথেই। সবার মুখেই এক কথা, তুই আর তুষার নাকি বিয়ে করেছিস? বেলী ছাড়া আর কাউকে আমি তুষারের ব্যাপারে কিছু বলিনি। সরাসরি তাই ওর কাছেই জানতে চাইলাম, কেন এমন করলো? কেন এমন একটা মিথ্যে কথা ছড়ালো আমার নামে? কতক্ষণ আমতা আমতা করে হুট করে জবাব দিলো, ‘তুমি পরপুরুষের সাথে বেলেল্লাপনা করলে দোষ হয়না অন্য কেউ সেটা নিয়ে বললেই দোষ।’

কোন জবাব দিতে পারিনি ওর এই কথার, চুপ করে থাকা ছাড়া। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বন্ধু নামের মানুষ চিনতে যে আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে।

……………

বছর না ঘুরতেই আমার ফোনটা আবার বেজে ওঠে, বেলীর নাম্বার স্ক্রিনে। ধরবোনা ধরবোনা করেও ফোনটা ধরি।

– সরি লোপা দোস্ত, আমার আসলে সেদিন ওভাবে তোকে হার্ট করা উচিত হয় নাই। কেমন আছিস তুই?

– ভালো আছি। তুই ভালো আছিস বেলী?

– না রে দোস্ত। জামাইর একটা সমস্যা হইসে ইনকাম ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে। তোর অফিসেই ফাইলটা গেছে। তুই যদি একটু দেখে দিতি।

আচ্ছা দেখবো বলে মৃদু হেসে ফোনটা রেখে দেই। ফোনটা স্পিকারে দেয়া ছিল। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমার হাসির লয়ে তাল মিলিয়ে আমার স্বামী তুষারও একচোট হেসে নিয়ে বললো, ‘ তোমার এমন হিংসুটে কিছু বন্ধু ছিল দেখেই বুঝি আমরা একসাথে জীবন চলার সিদ্ধান্তটুকু নিতে পেরেছি।’

কিছু কিছু লোকে জীবনে আসে
বন্ধুর মতো পাশে পাশে থাকে,
তাদের মাঝেও কিছু কেন যেন
মুখোশে তাদের মুখ ঢেকে রাখে।

কখনো স্বার্থ কখনো বা ক্রোধে
মুখোশে ঢাকা মুখটা যখন,
বলে দেয় সব লুকানো কথা
কোথায় লুকাই মুখটা তখন?

কি হয় যদি সব দ্বেষ ভুলে
মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ায়,
একটা জীবন কারো কারো বুঝি
হিংসা করেই যায় কেটে যায়।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে