#মুক্তির_স্বাদ
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
#পর্বঃ৬
আরো ঘন্টা খানিক সময় অতিবাহিত হলো, কিন্তু শিখার কোনো উন্নতি নেই। আযান বউয়ের ঠান্ডা হাত-পায়ে গরম তেল মালিশ করছে, ক্ষণে ক্ষণে নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু সাড়া দেয়না শিখা। আরো ঘাবড়ে গেলো আযান। এবার কিছুটা মায়ের বিপক্ষে গিয়েই হসপিটালে নিয়ে গেলো নিস্তেজ শিখাকে। সাথে গেলো রেহেনা বেগম ছেলেকে তদারকি করার জন্য, না জানি ছেলেটা বউয়ের পিছনে অহেতুক টাকা খরচ করে! সেই চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মায়ের।
ততক্ষণাৎ ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের ডক্টর মেয়েটাকে পরিক্ষা করে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“লা’শ’টা নিয়ে আসছেন আপনারা? কম সময়ের মধ্যেতো এতো শোচনীয় অবস্থা হয়নি রোগীর। এতো দেরি করলেন কেনো?”
আযান আমতা আমতা করছে, শুকনো ঢোক গিলে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলো, “ডক্টর বেঁচে আমার স্ত্রী?”
“সৃষ্টিকর্তা করুণায় এখনো শ্বাস চলছে, তবে হার্টবিট খুব স্লো। বাচ্চাটা বেঁচে আছে কিনা বলা যাচ্ছে না, উনাকে এক্ষুণি অপারেশন দরকার। প্রচুর ব্লাডিং হয়ে গিয়েছে রোগীর, ইমারজেন্সি রক্ত জোগাড় করুণ।কুইক।”
সিজার লাগবে শুনে বেঁ’কে বসলেন রেহেনা বেগম। পাশ থেকে উনি ডক্টরকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“এতো দ্রুত সিজার করার দরকার নেই ডক্টর, কত টাকার ব্যাপার। আপনারা বরং নরমালে ডেলিভারির চেষ্টা করুণ।”
ডক্টর উনাকে দমক দিয়ে বললেন,
“আপনি কি মানুষ? দেখেতো মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের লোক, কিন্তু অসুস্থ মস্তিষ্ক! মেয়েটার জীবন-মরণ সংশয় রয়েছে আর আপনি এখনো টাকার চিন্তা করছেন। এই টাইমটাও দ্রুত মনে হচ্ছে আপনার কাছে?”
পাবলিক প্লেসে ডক্টরের দমক খেয়ে চুপসে গেলো রেহেনা বেগম। মনে মনে ডক্টরকে প্রাণ ভরে গালি দিচ্ছেন উনি। শ্লা’র ডাকাত এরা! কিচ্ছুটি হলেই সিজার করো, সব রোগী থেকে টাকা খাওয়ার ধান্দা! এগুলো ভালোই জানা আছে তার।
এরিমধ্যে আযানের অনুমতি নিয়ে ডক্টর ও নার্স মিলে শিখাকে নিয়ে গেলো ইমারজেন্সি অপারেশন থিয়েটারে। আযানও ব্যস্ত হয়ে পড়লো রক্তের সন্ধানে। ছেলেকে ব্যস্ত হতে দেখে মা আশ্বাস দিয়ে শুধালো,
” এতো তাড়াহুড়ো করার কিচ্ছু নেই আযান, রিলাক্স! তুই একা কেন এতো চাপ নিচ্ছিস, বউমার বাপকে কল দিয়ে এখানে আসতে বল। জানিয়ে দে, তাদের মেয়ে অসুস্থ অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার।”
আযান মা’কে কিচ্ছুটি জবাব না দিয়ে ততক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে গেলো। বাহিরে গিয়ে শ্বশুরকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো, শিখা অসুস্থ।
বাবা-মা এতো রাতে মেয়ের এমন খবর পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো, ততক্ষণাৎ সবাই বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
.
.
কোলাহল পূর্ণ একটি দুপুর। হসপিটালের বারান্দায় বসে রোগীর আপনজনেরা কেউ নতুন অতিথির আগমনে হাসছে,কেউবা হারানোর শোকে কাঁদছে। হসপিটালের সাদা বেডে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শিখা, হাতে হরদমে স্যালাইন চলছে তার। দু’দিন হলো এখনো চোখ খুলেনি মেয়েটা। মেয়ের মাথার পাশে ব্যকুল হয়ে আশপাশ করছে, শিখার মা-বোন। মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে মায়ের মন, মেয়েকে রেখে এক মিনিটের জন্য কোথাও নড়ছে না অসুস্থ মা।
অবশ্য হসপিটালে উনারা দু’জন ছাড়া এখন কেউ নেই। অসুস্থ মেয়েটা’কে রেখেই বাবা’কে বের হতে হয়েছে নিজের কাজে।মেয়েটার পিছনে দু’টো পয়সা ব্যয় করতে হলেও বাবা’কে দিনরাত খাটতে হবেই, বাবার জন্য যে একদন্ড বিশ্রাম নিষিদ্ধ!
আর রইলো স্বামী, শ্বাশুড়ি!
একদিন শিখার সাথে ছিলো আযান, সে-ও আজ নিজের অফিসে গিয়েছে। ব্যস্ত মানুষ কিনা! রেহেনা বেগম ওদিন রাতে যে বাড়িতে গিয়েছে, এরপর আর তাকে হসপিটালের চার সীমানায়ও দেখা যায়নি।
মাথার উপর শোঁ-শোঁ করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি। খটাখট আওয়াজে আস্তে আস্তে মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো শিখার।একটু সময় নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে, নিজেকে আবিষ্কার করলো হসপিটালের বেডে। পুনরায় আবারো চোখ বন্ধ করে নিলো শিখা। নিজেকে ধাতস্ত করতেই মনে পড়লো, সেদিন রাতের ভ’য়া’ব’হ ঘটনাটি।
রান্না ঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই মাথা ঘুরছিলো তার, ততক্ষণাৎ নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলো ফ্লোরে। এরপর, এরপর শুরু হলো প্রবাল র’ক্ত’পা’ত! দমবন্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো তার ছোট্ট দেহখানি, তবুও টের পেয়েছে তার সাথে পেটের বাচ্চাটাও ছটফট করছে। তবুও মুখ থেকে কোনো আওয়াজ করতে পারেনি শিখা। ক্রমশ নিস্তেজ হতে হতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে কখন জানি, এরপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই তার।
নিজের অনাগত জানটার কথা মাথায় আসতেই, পেটে হাত রাখে শিখা। কিন্তু, অদ্ভুত! পেটটা খালিখালি লাগছে। তবে কি বাচ্চাটা হারিয়ে গেছে, না! না! শিখা হঠাৎ করেই মৃদু আওয়াজে চিৎকার করে উঠে,
“আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা! ”
মা এগিয়ে আসে, আলতো হাতে মেয়ে’কে জড়িয়ে ধরলো। তার মেয়ে কথা বলছে, আনন্দে মায়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। উনি ভেজা চোখে কোমল কণ্ঠে শুধালো,
“মা তুই কথা বলছিস? এখন কেমন লাগছে তোর?”
শিখা একবার আশপাশ তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, “মা আমার বাচ্চাটা?”
শিখার মা মৃদু হাসলো। তান্মধ্যে শখা বোনের গাল ছুঁয়ে বললো,
“তোর বাচ্চা বেঁচে আছে আপা। তুই এতো হাইপার হোসনা, অসুস্থ তুই।”
স্বঃস্তির শ্বাস ছাড়লো শিখা। বাচ্চাটা ছুঁয়ে দেখার জন্য আকুপাকু করছে তার অবচেতন মন। হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তা বিশেষ কৃপায় দু’জনই ম’র’তে ম’র’তে বেঁচে গিয়েছে তারা। সেদিন রাত তিনটায় মেয়ে হয়েছে তার। তবে বাচ্চাটা ভীষণ অসুস্থ ছিলো, ডক্টর পেট থেকে বের করেই আইসিইউতে ভর্তি করিয়েছে তাকে।
ঘন্টাখানিক পর মেয়ে নিয়ে শিখার কেবিনে ঢুকলো নার্স। সাথেসাথে মেয়ে’কে কোলে তুলে নিলো শিখা। দু’হাতে জড়িয়ে মা প্রথমেই কপালে গভীর ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার। ছোট্ট বাচ্চাটার স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারাটা দেখে পরাণ জুড়িয়ে গেলো তার। শুকনো ওষ্ঠে এক চিলতে মিষ্টি হাসি হেসে বলে উঠলো,
“মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! আমার ছোট মা!”
ততক্ষণাৎ মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে আবারো বললো,
“আমার দুঃখবিলাস জীবনে তুই আমার এক চিলতে সোনালী আলো। তুই আমার একখন্ড সুখ!”
বাচ্চাটা কি বুঝলো কিছু? মায়ের পরশ পেয়ে, গোলগোল আঁখিদুটি ঘুরিয়ে কিঞ্চিৎ ঠোঁট এলিয়ে দিলো মেয়েটা। এদের মা-মেয়ের ভালোবাসার সাক্ষ্যী হয়ে রইলো, বাকিরা। উনারাও নিঃশব্দের হাসি হাসলো সবাই। কিয়াৎ ক্ষণ সময় নিয়ে শিখা মেয়ের নাম রাখলো, “আলো”।
.
.
সাতদিন হসপিটালে থেকে আলোকে নিয়ে আজ শ্বশুর বাড়িতে আসলো শিখা। তার সাথে রয়েছে মা-বোন। এই সাতদিনের মধ্যে একটিবারের জন্যও পুরবধূ বা নাতনিকে দেখতে যায়নি রেহেনা বেগম। আজ শিখা এসেও তার খোঁজ নেয়নি, বোনের সাহায্যে নিজের ঘরে গেলো মেয়ে’কে নিয়ে।
তার শরীর এখনোও অনেক দুর্বল, হাঁটতে পারছে না একা।
রেহেনা বেগম চা’পা রাগে ফুঁসছে, একে তো বউয়ের পিছনে হাজার হাজার টাকা নষ্ট করেছে তার ছেলে। তান্মধ্যে, দেখলে তো মেয়েটার তেজ কত! নাতনিকে নিয়ে আসছে বাড়িতে, কই দাদির কোলে তুলে দিবে, তা না একদম রুমে গিয়ে ঘাপটি মে’রে’ছে! এদের দে’মা’ক দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে তার, এর একটা বিহিত নিয়েই ছাড়বে সে।
এই বাড়িতে একদিন গত হতেই পরদিন রেহেনা বেগম শিখার মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আপা! বউমা তো এখন খুব অসুস্থ, আপনি বরং মাসখানেক মেয়েটাকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে রাখুন। দেখছেনই তো আমাদের বাড়িতে দেখা-শোনার জন্য কেউ নেই, আমি নিজেই অসুস্থ। আবার অন্য দিকে আপনাদের বাড়িতেও তো ভাই একা, বেচারা একার সবকিছু সামলাতেও না জানি কত কষ্ট হচ্ছে।”
শিখার সহজ-সরল মা আর না করলো না। কৌশলে রেহেনা বেগম শিখাকে পাঠিয়ে দিলো বাপের বাড়ি। অসুস্থ বউটাকে গাড়িভাড়াও করে দিলো না। আযান দিতে চাইলেও চোখ রাঙিয়ে গড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছে রেহেনা বেগম। উনি নিজেই ট্রেনের সীট বুকিং করে দিলো।
শিখার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ির দুরত্ব অনেকটাই, সাধারণত ট্রেনে করে যেতে হয়। রিজার্ভ গাড়ি না পেয়ে বাধ্য হয়ে, অসুস্থ শিখাকে বসতে হলো ট্রেনে। অপারেশনের আটদিনের মাথায় ওভার ব্রিজ ক্রশ করে ট্রেন জার্নির ধকল নিতে পারেনি মেয়েটার শরীর। সেলাইয়ের জায়গা গুলোতে টান লেগে, গড়িয়ে পড়ছে জল। অসহ্য যন্ত্রণায় সেই সাথে কেঁপে উঠছে শিখার রুহু।
বাড়িতে গিয়েও আবারো ডক্টরের কাছে নিতে হয়েছে তাকে। আর এটাই হচ্ছে রেহেনা বেগমের সূক্ষ্ণ ভাবে দেওয়া পরোক্ষ শাস্তি।
____________________
আজ ঈদের দিন। শিখার শ্বশুর বাড়িতে ঘরভর্তি মেহমান, হৈচৈ-আনন্দে কোলাহল পরিপূর্ণ একটি পরিবেশ। একই সাথে বাড়ির চার মেয়ে তাদের স্বামী সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। অনেকদিন পর একসাথে চার মেয়েকে পেয়ে খুশিতে বাক বাঁকুক রেহেনা বেগম। মেয়েদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নানি-জান। আশার ছেলেটা এখন আধোঁ আধোঁ বুলি শিখেছে, মধুর সুরে “নানি আপু” বলে ডাকছে রেহেনা বেগমকে। ডাক শুনে,প্রাণ জুড়ে যায় তার। বোনদের সবার মধ্যে তার বাচ্চাটাই ছোট।
আশা ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে, চারবোন মিলে খোশগল্প করছে। এতোগুলা মানুষের রান্না তবুও শিখা একা একাই রান্না ঘরে কাজ করছে। কেউ তাকে হাতে-হাত এতটুকু সাহায্য করছে না। উল্টো,
ননদরা একেক-জনের একেক-রকমের পছন্দের খাবার, একটার পর একটা অর্ডার করছে শিখাকে।
রেহেনা বেগম সোফায় বসে মেয়ের নাতনিদের এটা-সেটা গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে আর রুপকথার গল্প শুনাচ্ছে। বাচ্চা গুলো খিলখিল করে হাসছে।
এরিমধ্যে হঠাৎ করেই ফ্লোরে বসে আলো মেয়েটা কাঁদছে।সেদিকে হুঁশ নেই দাদির। মায়ের মতো এই মেয়েটাও পরিবারের অবহেলিত প্রাণী। হবেই না কেনো, বাবা নিজেই তাদের মা-মেয়ের প্রতি দায়িত্বহীন।
সংসার জীবনে একজন নারীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার স্বামীর “মেন্টাল সাপোর্ট”। আর এজন্য থাকতে হবে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান।
শ্বশুর বাড়িতে একজন নারীর গুরুত্ব ঠিক কতটুকু হবে, তা নির্ভর করে তার স্বামীর ভালোবাসা ও সম্মানের উপর।
যে পুরুষ সংসার জীবনে নিজের স্ত্রী, সন্তানকে গুরুত্ব দেয় না, পরিবারের বাকি সদস্যও তাদের বিন্দুমাত্র মূল্যয়ন করে না। এই স্ত্রী সন্তানেরা পরিবারের সবার কাছেই অবহেলিত হয় দিনের পর দিন। যেমনটা হয়ে আসছে, শিখা।
মেয়ের কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসছে শিখা। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে আতঙ্কে উঠলো, মা। মেয়েটা তার দাদির চুনের কৌটা থেকে চুন খাচ্ছে। যার ফলে এখন মুখ জ্বলে যাচ্ছে।
আলোর এখন আটমাস চলছ। হামাগুড়ি দিয়ে একজায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে সে। অবুঝ মেয়েটা কখন জানি দাদির পানের ডালা থেকে চুন নিয়ে খেলছে আর সেটাই খাচ্ছে। ভাগ্যিস চোখে যায়নি।
শিখা মেয়েকে সাথে সাথে কোলে তুলি নিলো, বিয়ের পর এই প্রথম উচ্চ স্বরে বললো,
“মা?”
পাশ থেকে রেহেনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“কি হয়েছে? এতো জোরে ডাকলে কেন?”
“তোমরা সবাই এখানে বসা অথচ আমার বাচ্চা মেয়েটা ঠান্ডা ফ্লোরে বসে চুন খেয়ে যা-তা অবস্থা করে কাঁদছে। এগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না মা? তুমি তো দিব্যি মেয়ের নাতি-নাতনীদের কোলে-পিঠে নিয়ে কত খাতির-যত্ন করছো। তবে আমার মেয়েটার প্রতি কেন এতো সবার অবহেলা। আলোও তো তোমার ছেলেরই মেয়ে মা। ওকে তো কখনো দেখি না, আদর করে একটু কাছে ডাকো বা যত্ন করে খাইয়ে দেও। মাঝেমধ্যে আমি কোলে দিলেও তোমার কোমড় ব্যথা করে, কত অসুখ হয়! এখন গেলো কই সেসব, কি করে পারো এগুলো?”
একদম কথাগুলো বলে শ্বাস ছাড়তেই তেড়ে আসলো রেহেনা বেগম। শিখার গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে উনি ক্রোধিত কণ্ঠে শুধালো,
“ফকিন্নির ঘরে ফকিন্নি! আমি কি করবো না করবো তাও এখন তোকে বলে-কয়ে করতে হবে? আমার মেয়েরা আসছে বলে, তোর ভাগে কম পড়েছে না! তুই আমার মেয়ে, নাতি-নাতনীদের হিংসা করছিস?”
শিখা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,
“আমি কখন তাদের হিংসা করলাম মা? সে যাইহোক তাই বলে, তুমি আমার গায়ে হাত তুলবেন? শেষমেষ মা’র…..”
শিখাকে থামিয়ে দিয়ে রেহেনা বেগম পুনরায় বলে উঠলো,
“তো কি তোমায় মাথায় তুলে নাচবো।
বহুকষ্টে গড়া এই সংসার আমার, আমার সংসারে এসে তুমি দু’দিনের মেয়ে মাতব্বরি করছো। কান খুলে শুনে রাখো, এসব মাতব্বরি এখানে মোটেও চলবে না। আমার যখন যা ইচ্ছে করবো, আমার মেয়েরা যখন খুশী আসবে যাবে। তুমি বলার কে?”
এরিমধ্যে চার ননদ এক হলো এখানে। মায়ের সাথে সুর মিলিয়ে কথা শুনাচ্ছে শিখাকে। তাদের পাশে দাঁড়ায়ি মুখ টিপে হাসছে নন্দন মশাইয়েরা।
এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জায়,কষ্টে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার। উনাদের সামনে টিকতে না পেরে, মেয়ে’কে নিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো শিখা।
.
.
কিয়াৎ ক্ষণ পরে বাহির থেকে বাড়িতে আসলো আযান। আসতে না আতেই মা বোনদের বিচার। কথা না বাড়িয়ে রুমে আসতেই, বউয়ের বিচার। এই প্রথম শ্বাশুড়ির নামে অভিযোগ তুললো শিখা। কিন্তু বিনিময়ে স্বামীর হাতে খেতে হলো আরো একটু শক্ত চড়। আযান সবার ক্রোধ উগড়ে নিলো শিখার উপর, চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
“তোমারা কি আমায় একটু শান্তি দিবে না? কেনো এতো অশান্তি করো শিখা? আরে বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে না, তো জন্ম দিয়েছো কেনো?”
আযান আর একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়ালো না, একরাশ রাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। ছেলেটারও একটু শান্তি নেই। সারাজীবন সবার দায়িত্ব নিতে নিতে কখনো নিজেকে একটু সময় দেওয়া ভাগ্যে জুটেনি।
সংসারের বড় ছেলে কিনা! ছোট বোনদের লেখাপড়া শেষ করিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এরপর নিজে বিয়ে করেও পড়লো আরেক অশান্তিতে। সারাদিন খেঁটে বাড়িতে আসলেই, শুরু হয় মায়ের এক কথা, বউ বাচ্চার আরেক কথা। মানুষ কেন যে বিয়ে করে?
লম্বা শ্বাস ছেড়ে, বড় মাঠের ঘাসে বসে পড়লো আযান। কিয়াৎ ক্ষণ পরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে লম্বা টান দিলো।
.
.
আযান যেতেই রুমের দরজা আঁটকে দিলো শিখা। সবার এরূপ আচরণে বিতৃষ্ণা এসেছে গিয়েছে জীবনের প্রতি। আদরের মেয়েটাকে ফ্লোরে রেখে, রাগের দুঃখে হাতে নিলো বি’ষে’র বোতল। না আর এই অশান্তি সহ্য করবে না সে,সবাইকে মুক্তি দিয়ে নিজেও মুক্তি নিবে এইবার, এই ন’র’ক থেকে।
চলেবে…..