#মুক্তির_স্বাদ
লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
#পর্বঃ৩
বিয়ের মাস পেরোতে না পেরোতেই বাচ্চার জন্য রেহেনা বেগম পাগল করে দিচ্ছিলো শিখাকে। কথায় কথায় একটা বাচ্চার আবদার করতো, রেহেনা বেগম। শিখা ভাবলো, বাচ্চা আসলে বোধহয় পাল্টে যাবে উনি। নাত/নাতনির পেলে ভালোবাসবে শিখাকে। আর উনি ভালোবাসলেই স্বামীর ভালোবাসা পাবে মেয়েটা।
বিয়ের তিনমাস পেরোতেই আজ যখন শুনলো শিখা প্রেগনেন্ট, মুহুর্তেই সবার চোখের রঙ বদলে গেলো। শিখার বড় ননদ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
” বিয়ে হলো মাএ কয়েকটা দিন হলো, এরমধ্যে তুমি প্রেগনেন্ট হলে কি করে ভাবি? এই বাচ্চা আমার ভাইয়ের তো, নাকি অন্যের পাপ আমার ভাইয়ের বলে চালিয়ে দিলে?”
বড় মেয়ের যুক্তি শুনে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো রেহেনা বেগম। এরিমধ্যে উনি মেয়ের সাথে সায় দিয়ে শিখার দিয়ে আঙুল উঁচু করে বললো,
” হ্যাঁ তাইতো। সত্যি করে বলো বউমা, এই বাচ্চা কোথায় পেলে তুমি?”
এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে অশান্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা হৃদয়। অবাক হয়ে দেখছে সবাইকে। আচ্ছা এরাও কি মানুষ? শেষমেষ নিজের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিলো সবাই। শিখা মাথা চেপে বসে পড়লো, শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে কান্নার কণ্ঠে শুধালো,
” মা, আল্লাহর দোহাই লাগে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন কইরো না! তুমি না খুউব করে বলতে, একটা বাচ্চা নেও বউ মা, আমার নাত/নাতনীর প্রয়োজন। তাহলে আজ কেন, এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করছো মা?”
কেউ শুনছে না অষ্টদশী মেয়েটার কাকুতি-মিনতি করা আহাজারি। চার ননদ, শ্বাশুড়ি মিলে চিরুনী তল্লাশী করা শুরু করে দিলো। একেকজন একেকরকম মন্তব্য করছে। মেয়েটা দিশেহারা হয়ে শেষ ভরসা নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটলো। ভাবলো বাবা হওয়ার আনন্দে শিখাকে সাপোর্ট করবে তার স্বামী। শিখার হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে উনি। কিন্তু, আযান মেয়েটাকে আরো এক ধাপ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলো শিখা। এতো দ্রুত আমার বাচ্চা চাই না।”
শিখা অবাক হয়ে বললো,
“কি বলছেন আপনি? এটাই আমাদের প্রথম সন্তান। না, না এটা আমি পারবো না। এটা অন্যায়, এটা পাপ!”
“আমি ঠিকই বলছি শিখা। আজই আমার সাথে হসপিটালে যাবে তুমি।”
শিখার বয়স অল্প হলেও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না সে। অদ্ভুত এক মায়ার কারণে নিজের সাথে বেড়ে উঠা অস্তিত্বকে বিলীন করতে নারাজ মেয়েটা। মা হয়ে কি করে খু’ন করবে নিজের অনাগত সন্তানকে? বাচ্চাকে এভাবে খু’ন করে সারাজীবন অপরাধী হয়ে বাঁচতে চায় না সে। নিরুপায় হয়ে,স্বামীর হাতে পায়ে ধরে কাঁদছে মেয়েটা। বুক ভরা আহাজারি নিয়ে বললেন,
“আমার সাথে এমন অন্যায় কাজ করবেন না আপনারা। প্লিজ! এই অসহায় মেয়েটার উপর একটু দয়া করুণ। ”
অসহায় এক মা, অনাগত সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু আযান নিজের কথায় অটল।
শিখা দিশেহারা হয়ে যায়। না এই অসভ্য সমাজে থাকবে না শিখা! বাচ্চা সহ এক সাথে ম’রে যেয়ে মুক্তি দিবে সবাইকে। সবার প্রতি অভিযোগ, একরাশ কষ্ট নিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগলো মেয়েটা।
কিন্তু, বেঁচে গেলো সে। কিছু করার আগেই দেখে ফেললো আযান। তাকে সেইবার বাঁচিয়ে নিলো তার স্বামী। কিন্তু, বাচ্চা রাখার অপরাধে স্বামীও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো যেন। অসুস্থ মেয়েটাকে কেউ একচুল শান্তি দিচ্ছে না।
_____________
কেটে গিয়েছে আরো দু’টো মাস। শিখার এখন তিন মাস চলছে।
আজ শিখার শ্বশুর বাড়িতে বিশাল আয়োজন চলছে। আজ শহর থেকে আযানের বাবা ও ছোট বোন “আশা” আসছে বাড়িতে। আযানই বোনের শ্বশুর বাড়ি যাবে আশাকে আনতে। তার ছোট্ট বোনটাও আট মাসের প্রেগনেন্ট,এখন থেকে এখানেই থাকবে। স্বামী ও ছোট মেয়ে আসার খবর পেয়ে মা তাদের সকল পছন্দের খাবারের আয়োজন করছে। কিন্তু নিস্তার নেই এই অল্প বয়সী অসুস্থ মেয়েটার।
শিখা রান্না করছে, রেহেনা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে।এরিমধ্য আযান রুম থেকে হুং’কা’র ছাড়লো,
“শিখা, আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করতে বলেছিলাম না তোমাকে? এখনো করোনি কেন? কেনো করো’নি? এখন পড়বোটা কি আমি?”
আযানের কথা কানে আসতেই মাথায় হাত রেখে ফাঁকা ঢোক গিলে শিখা। রান্না ঘরে কাজের চাপে একদম সে কথা ভুলে গিয়েছিলো মেয়েটা।
ছেলের কথা শুনতে পেয়ে পাশ থেকে রেহেনা বেগম দাঁত কটমট করে শিখাকে বললেন,
“বউমা! আমার সংসারে কিন্তু এসব হেয়ালি চলবে না, আমার ছেলেটার একদম খেয়াল রাখো না তুমি। পরবর্তীতে এগুলো কিন্তু সহ্য করবো না আমি। যাও রুমে গিয়ে দেখো, বাবুর কি প্রয়োজন।”
“আমার একদম মনে ছিলো না মা। আপনি একটু তরকারিটা দেখুন, যাচ্ছি আমি।”
“মনে ছিলো না ছাই! সব কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা।”
শ্বাশুড়ির কথা শুনে আর কথা বাড়ালো না শিখা।
চঞ্চল পায়ে রুমে চলে গেলো। ভেজা হাতটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে অপরাধীর ন্যায় শুধালো,
“সরি, সরি!কাজের চাপে আপনার শার্টের কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম আমি। আপনি একটু অপেক্ষা করুণ, আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি।”
মেয়েটার এসব হেয়ালি দেখে মুহূর্তেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো আযানে। বিছানায় রাখা শার্টটা শিখার গায়ে ছুঁড়ে মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“কি এমন কাজ করো তুমি সারাদিন?তোমার মন আজকাল থাকে কোথায়, হ্যা? সময় মতো, একটা কাজ ঠিক মতো করো তুমি? এখন আর করার প্রয়োজন নেই এগুলো, এটা দিয়ে তুমি এখন পূজা করো।”
স্বামীর আচরণে ভারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিখা। মাথার উপর থেকে শার্ট সরিয়ে হেয়ালি করে বললো,
“আসলেই, আমি করিটা কি সারাদিন? আপনার সংসারে আমাকে তো আপনি রাণীর মতোই রেখেছে। এইতো অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটাও, ভোর থেকে রাত দশটা অবধি গরুর গোয়াল পরিষ্কার অবধি শুরু করে, পানি গ্লাস একেক-জনকে ঢেলে খাওয়াতে হয়। এটা কোনো কাজ হলো? মেয়ে মানুষ বাড়িতে তো শুধু সুয়ে বসেই খায়। কাজ তো করেন আপনি, আপনার মতো পুরুষেরা।”
এখানে আর দাঁড়ালো না শিখা, তড়িঘড়ি করে রুম ত্যাগ করলো। মেয়েটার কথা আযানের গায়ে খুব লেগেছে। মুহূর্তেই মাথায় র,ক্ত চাপলো তার, রাগের চো’টে নিজের হাত দিয়ে দেয়ালে বার কয়েক ঘুসি মা’র’লো। মুখে বার কয়েক উচ্চারণ করলো,
“বেয়াদব মেয়ে! বেয়াদব!”
শিখা কাছে থাকলে বোধহয় এই আঘাত গুলো আজ তার গায়েই পড়তো। ভাগ্যিস ছিলো না।!
.
.
শিখাকে দেখে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্যানের নিচে আরামসে বসলো রেহেনা বেগমে। যে গরম লাগছে না। বড্ড জল তৃষ্ণা পেয়েছে তার। সোফায় শরীর এলিয়ে হাঁক ছেড়ে বললেন,
“বউমা! আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে এসেতো। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।”
পর মুহুর্তেই ছেলেকে ডাকলেন, “আযান এদিকে আয় তো বাবা। কখন বের হবি? ”
আযান রুম থেকে বের হতে হতে কমল কণ্ঠে বললেন, “এই তো মা, এক্ষুনি যাচ্ছি।”
রেহেনা বেগম রুম থেকে কয়েকটা চকচকে হাজার টাকার নোট ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা রাখ। আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ভালো দেখে পাঁচ কেজি মিষ্টি আর ব্যাগ ভর্তি ফল নিয়ে যাস। আরো কিছু প্রয়োজন হলে নিয়ে যাস, ও বাড়িতে আশার যেন কোনো অসম্মান না হয়।”
“পাঁচ কেজি মিষ্টির কি প্রয়োজন মা? সচতা দেখে দুই কেজি মিষ্টি নিলেইতো হয়ে যায়।”
শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে পিছন থেকে শিখা তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো। শিখার কথা শুনে রেহেনা বেগম এক গাল হেসে বললেন,
“কি যে বলো বউমা? আযান বড় ভাই যাচ্ছে বোনের শ্বশুর বাড়িতে, ওর একটা সম্মান আছে না।”
“হ্যা মা।তোমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঁচ কেজি মিষ্টি, ব্যাগ ভর্তি ফল নিতে হয়। না নিলে তোমাদের সম্মান থাকে না। আর ছেলের শ্বশুর বাড়িতে সচতা দেখে দুই কেজি মিষ্টিই, যথেষ্ট!আচ্ছা, তখন তোমার ছেলের সম্মান যায় না?”
অপমানে মূর্চ্ছা যাচ্ছেন রেহেনা খানম। মেয়েটার মুখে বুলি ফুটেছে বেশ। আযান ক্রো’ধি’ত চোখে একবার চাইলো শিখার পানে, শক্ত একটা চড় বসিয়ে বলে উঠলেন,
“তোকে বলছিলাম না, মায়ের মুখে মুখে তর্ক করবি না? তবুও কেন কথা বলছিস? আমার বোনদের কি দিবো না দিবো তাও তোকে জিজ্ঞেস করে দিতে হবে? টাকা কি তুই কামাই করিস নাকি তোর বাপ দিয়ে যায়। দু’দিন হলো না এ বাড়িতে আসছিস, তারমধ্যে সংসার নিয়ে মাতব্বরি করছিস তুই? এসব এখানে চলবে না। নেক্সট টাইম এমন করলে না, বাসা থেকে একদম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।”
পাশে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে রেহেনা বেগম। থামানোর নাম নেই, বরং খুশীই হয়েছে সে। এটাই না হলো, তার ছেলে। একেবারে কাজের মতো একটা কাজ করছে।
শিখা গালে হাত দিয়ে, অবাক চোখে দেখছে নিজের অপদার্থ স্বামীকে।
শেষমেশ তার অসুস্থ অবস্থায়ও গায়ে হাত তুললো লোকটা? এতো অধঃপতন হয়েছে আজকাল! সবসময় তার ভুল গুলোই চোখে পড়ে তার? মায়ের প্রতি এতো সম্মান , তবে বউয়ের প্রতি কেনো এতো অবিচার?
তার গায়ে হাত তুললেও খ্যান্ত নেই, তার বাবা’কেও টানছে। আচ্ছা, তার বাবা গরীব, তাই বলে কি তার সম্মান নেই? ফুঁসে উঠলো শিখা। আযানের হাতটা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিয়ে আঙুল উঁচু করে শুধালো,
“মেরুদণ্ডহীন পুরুষ! আমার বাবা’কে নিয়ে আর একটা কথা বললে আপনাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আপনার সাহস কি করে হয়, আমার গায়ে হাত তোলার?”
আযান গা-ঝাড়া দিয়ে মৃদু হেসে বললো, “তোর গায়ে আবার হাত তুলবো। কি করবি তুই, শুনি?”
” অন্যাকে অন্যায়, ভুলকে ভুল বলার সাহস কি আপনার আছে? আপনার মতো মেরুদণ্ডহীন পুরুষ দিয়ে আর কিইবা আশা করা যায়। নিজের স্ত্রীকে যারা সম্মান করতে জানে না, তাদের বিয়ে করা উচিৎ নয়। আপনার উচিৎ ছিলো, মায়ের আঁচলের তালায় বসে থাকা।”
শ্বাশুড়ির পাশে শরবতের গ্লাসটা রেখে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শিখা। তা দেখে রেহেনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“দুইটার রিকশাওয়ালার মেয়ে হয়ে দেমাক কত! এই মেয়ে খুব বাড় বেড়েছে বাবু।”
রুমের দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে শিখা। এ কোথায় বিয়ে দিলো বাবা? এই বাড়িতে এসে বড্ড হাঁপিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। হাসতে ভুলে গিয়েছে সেই কবেই।
আজ ভীষণ ক্লান্ত! এতো বড় ঘর, টাকা পয়সার কি খুউব বেশি দরকার ছিলো তার? বাবার আনা ডাল-ভাতেই তো দিব্যি দিন চলতো তার।
পরমুহূর্তেই দলা পাকিয়ে আসা কান্না গুলো গিলে বিড়বিড় করে বলে উঠলো মেয়েটা,
“বাবা! কেন বুঝলো না তুমি? গরীব ঘরের মেয়েদের এতো উঁচু ঘরে বিয়ে দিতে নেই। উঁচু ঘর, টাকাপয়সা ওয়ালা লোক গুলো গরীব ঘরের মেয়েকে সবসময় অবহেলা আর অসম্মানই করে। তুমি চাইলে নিচু ঘরেও আমি আজ প্রাণ ভরে শ্বাস ছেড়ে বাঁচতে পারতাম। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বাবা। এখান থেকে আমাকে নিয়ে নেও।”
বাবার কথা মনে পড়তেই, শিখা তড়িঘড়ি করে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো বাবার নাম্বারে। রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না বাবা। একবার, দুইবার, তিনবারের বার ফোনটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে আসলো মায়ের হাস্যজ্জল কণ্ঠ, “কেমন আছিস আম্মা?”
মায়ের কোমল কণ্ঠ শুনে, আহ্লাদী কান্না গুলো আবারো দলা পাকিয়ে আসছে তার। লম্বা শ্বাস টেনে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে শুধালো,
” উনি আমার গায়ে আজ হাত তুলেছে মা। এ বাড়িতে সবাই কথায় কথায় আমাকে গাল-মন্দ করে। আমাকে তোমার এখান থেকে নিয়ে যাও মা, নিয়ে নেও আমাকে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। ”
চলবে….