#মীরার সংসার
#তিথি সরকার
#পর্ব-৯ (শেষ পর্ব)
১৭.
বেলা তিনটা।তকদা’র আকাশে সূর্য হেলে এসেছে অনেকটাই।রাস্তা পেরিয়ে তিস্তা নদীর পাশে এসে দাঁড়ায় ওরা চার জন।রোহন, মীরা,তৃষা আর তৃষার হাসব্যান্ড অমিত।বিবাহিত জীবনের দু’বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তারা দুইজনও একটা মিনি হানিমুনে এসেছে।কুলকুল ধ্বনিতে শ্রান্ত নীল জল বয়ে যাচ্ছে। আর পাশেই তারা উচ্ছসিত বাক্যালাপে মজে।কিন্তু মীরা কিছুতেই সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছে না।তার দৃষ্টি তখন অসীম নীল আকাশের পানে।ভেবে চলেছে একটু আগের তৃষার বলা কথাগুলো। তার আর রোহনের বিয়েতে যে কোনো একটা গড়বড় রয়েছে তা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।
“এই যে ভাবী জি!কি এতো ভাবছো?”
তৃষার ডাকে চমকে সেদিকে তাকায় মীরা।পাশের তিন জোড়া চোখের দৃষ্টিই তখন তার উপর।মীরা অপ্রস্তুত হাসে।রোহন তখন হালকা করে তার একটা হাত জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“তুমি ঠিকাছো?শরীর খারাপ লাগছে?”
মীরা দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে ঠিকাছে।তারপর আস্তে করে বলে,
“আচ্ছা, আপু।ওই সময় তুমি কি যেনো বলছিলে?আমার নাম নিয়ে? ”
মীরার প্রশ্ন শুনে ফিক করে হাসে তৃষা।তারপর বলে,
“ও,তাহলে এই ব্যাপার!এটা নিয়েই ভাবছো তুমি। ”
তারপর আবার রোহনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই,তুই ওকে কিছু জানাসনি?”
রোহন হালকা করে বললো,
“জানানোটা এতো প্রয়োজন মনে করিনি।”
“তুই কি কিছুই জানাসনি ওকে?তুই যে ওকে আরও তিন বছর আগে থেকেই চিনিস?”
এবার মীরার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার পালা।বলে কী!তিন বছর! মানে রোহন আগে থেকেই মীরাকে চিনতো।মীরার মনের ভেতর একসাথে হাজারটা রংমশাল জ্বলে উঠলো।রোহন ওকে আগে থেকেই ভালোবাসতো।তবে,তবে নীরার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো কেনো?
তৃষা আবারও বলা শুরু করে,
“ধন্যি ছেলে তুই,মাইরি!আরে মীরা শোনো না,তোমরা যেবার ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলে,তখন আমরা মাস্টার্সে।তা ক্লাসে কেউই বেশি একটা যাই না। একদিন কি হলো,ডিপার্টমেন্ট থেকে জরুরি তলব।যেতেই হবে।তো আমরা সবগুলো সেদিন জড়ো হলাম ডিপার্টমেন্টের সামনে।সবাই নিজেদের মধ্যে আড্ডায় ব্যস্ত।সেদিন আবার ছিলো তোমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান…
তৃষার কথার মাঝেই রোহনের মন এই পাহাড়ি আবহ ছেড়ে চলে গেলো আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের ভরা বসন্তের রৌদ্রজ্জোল দিনে।
ঘড়ির কাটা তখন বেলা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়াম থেকে ভেসে আসছে মৃদু কোলাহল। সূর্যের আগুনিয়া তাপ যেনো ঝলসে দিচ্ছে চারিপাশ। এমন সময়ই,এক হাতে শাড়ি সামলে তাড়াহুড়ো করে অডিটোরিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ালো এক নারী মূর্তি।আরেক হাতে পার্সটা শক্ত করে ধরে কপালের ঘাম মুছে নিলো।আর সাথেই পাতলা আঙ্গুল গুলো কপালের ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে আস্তে করে কানের পেছনে গুঁজে দিলো।
কালো শাড়িতে গায়ের ফর্সা রংটা যেনো দুত্যি ছড়াচ্ছে।লম্বা কালো চুলগুলো বেনী করে ঘাড়ের এক পাশে ফেলে রাখা।কালো কাজলে হরিণী চোখের অধিকারী সেই মেয়েটিকে জাস্ট ‘হা’ করে দেখে যাচ্ছিলো রোহন।ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকে গেছিলো মেয়েটি।সেই মেয়েটিই ছিলো মীরা।তারপর অজস্রবার ক্যাম্পাসে,ক্যান্টিনে,ভার্সিটির সামনে মীরার সঙ্গে দেখা হতো রোহনের। কিন্তু কখনও আই কন্ট্যাক হয়নি।কখন যে এই চুপচাপ, শান্ত মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে!গড নোউজ!
তৃষার কথায় নিজের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো রোহন।
“আরে জানো না তো মীরা!যে ছেলে কি না দরকার ছাড়া কোনো দিন পারতপক্ষে ক্যাম্পাসে পা দিতো না।তোমায় দেখার পর তো ক্লাস ছাড়া এমনিও এসে বসে থাকতো।আর আমরা সবাই হাসাহাসি করতাম এটা নিয়ে। তখনই কেউ একজন বললো যে তোমার নাম নাকি নীরা।”
“কেউ তোমাদের ভুল ইনফরমেশন দিয়েছিলো আপু।”
“সেটাই তো দেখছি।তা রোহন তোমায় এসব কিছুই বলেনি?”
সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তৃষা।
এবার মীরা কটমটে চোখে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে কোনো মতে বলে,
“নাহ্,আমাকে কেউ কোনো কথা জানানোর প্রয়োজন মনে করে না।”
মীরার কথা শুনে এক হাতে মাথা চুলকিয়ে একটা ক্যাবলা মার্কা হাসি দেয় রোহন। আজ তার কপালে কি আছে,কে জানে!
পাহাড় বড় রহস্যময়। একটু আগেই ঝকঝকে রোদ ছিলো। হঠাৎ চতুর্দিক কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। অতর্কিতেই যেন এক বিপদের সংকেত নিয়ে হাজির হল কালো মেঘের দল। হুহু করে বইতে লাগলো হিমশীতল হাওয়া। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তৃষাদের থেকে বিদায় নিয়ে ওরা আবারও গাড়িতে ওঠে বসলো।গন্তব্য ওদের হোমস্টে।এই আবহাওয়ায় বাইরে থাকা বিপদজনক। পাহাড়ি রাস্তায় দক্ষ হাতে ড্রাইভার গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। চারিদিকের সবুজের সমারোহ আর মেঘ-কুয়াশা আবার কখনও রোদ মন ও চোখকে বড়ই আরাম দিচ্ছিল ওদের । তারা যেনো ভেসে যাচ্ছিলো উতল হাওয়ায়!
কিন্তু মীরার মুখ তখনও বেজার।মনে চলছে সন্দেহের দোলাচল। মীরার দৃষ্টি আর্কষণ করতে রোহন খুকখুক করে গলায় আওয়াজ করলো।মীরা ওর দিকে না ঘুরেই সরু চোখে তাকালো।রোহন একটু বোকা বোকা হেসে বললো,
“ওরম তাকিও না আমি ক্যাবলা হয়ে যাই,
আমার চোখের ভাষা যায় হারিয়ে….
মীরা চোখ রাঙিয়ে কেটে কেটে বললো,
” দাঁড়াও না!তোমার ক্যাবলা হওয়া বের করছি আমি! ”
রোহন একটা ফাঁকা ঢোক গিলে বিড়বিড় করলো,
“আবহাওয়া সত্যিই বড়ো খারাপ! ”
ওরা রুমে পৌঁছানোর আগেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ঠান্ডায় হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। কোনোমতে রুমে পৌঁছেই রোহনের কলার চেপে ধরলো মীরা।বিছানায় ফেলে দিয়ে বললো,
“বলো,কি লুকোচ্ছো এতো দিন ধরে আমার থেকে। ”
মীরার দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ওকে উল্টে বিছানায় ঠেসে ধরলো রোহন।ওর চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠলো।হিসহিসিয়ে বললো,
“হ্যাঁ,লুকিয়েছি আমি তোমার থেকে অনেক কিছু। এন্ড আই নেভার রিগ্রেট ইট!”
“তুমি কি আজ আমায় অন্তত সবটা বলবে।প্লিজ,আজকে অন্তত কথা ঘুরিও না তুমি।
মীরার গলায় মুখ ডুবিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় রোহন।তারপর ভারী গলায় বলে,
“কেউ একজন আমায় জানিয়েছিলো তোমার নাম নীরা।এরপর থেকে আমি তোমার প্রতিটা স্টেপস ফলো করতাম।কিন্তু মীরা এবং নীরা ওয়ার্ড দুটো কাছাকাছি হওয়ায় তোমার নাম নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাইনি।বিয়ের আগে আমি লাস্ট তোমায় দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটি রিইউনিয়ন অনুষ্ঠানে। সেখানেও তুমি একটা কালো শাড়ি পরে গেছিলে।এন্ড ট্রাস্ট মি!আই মিসড এ হার্টবিট!”
মীরা এবার ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় পা গুটিয়ে বসলো।গায়ে কম্বল জড়িয়ে নিয়ে বললো,”তারপর? ”
“তারপর আর কি!বন্ধুরা বললো প্রোপোজ করে দে।আমি ভাবলাম,ধুর, প্রোপোজ করলে যদি রিজেক্ট করে দেয়। তাই সরাসরি বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটাই শ্রেয়।যেহেতু আমি জানতাম তোমার নাম নীরা,তাই অবিয়াস্যলি নীরার জন্যই প্রস্তাবটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”
রোহনের কথা শুনে মীরার মুখ জাস্ট হা হয়ে গেলো।এতো কিছু!
ওর মুখের ভঙ্গি লক্ষ্য করে আবারও বললো রোহন,
“আরে,এখুনই এতো অবাক হলে চলবে নাকি!পিকচার তো আভি বাকি হ্যা!আমি তো জানতামই না এতো কিছু। তোমাদের বাড়িতে মেয়ে দেখতে যায় মা আর মামা।আমি তাদের জানিয়েছিলাম যে তুমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ো।কিন্তু মামা এসে জানায় যে আমি ভুল জানি।অর্থাৎ, মেয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে না ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। তারপর আমি বললাম মেয়ের ছবি দেখাও তো একটু। এন্ড বিলিভ মি, নীরার ছবি দেখে আমি একটা হাজার ভোল্টের শক খাই।তুমি ভাবতে পারছ, ওরা মেয়েকে পছন্দ করে আশীর্বাদ করে এসেছে। এখন আমি যদি বলি যে আমি বিয়েটা করবো না, আমার মা হয়তো কিছু ভুজুংভাজুং দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেবে কিন্তু তোমার বাবাকে কিরে যদি বলি যে, আমি আপনার বড় মেয়েকে না আপনার ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, নিশ্চয়ই উনি ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। ”
মীরার তখন আর কিছু বলার নেই। এক নাম বিভ্রান্তির জন্য এতকিছু! ও মাই গড!
এবার মীরা চোখ সরু করে বললো,
” তাই তুমি নীরাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করলে।”
“অনেকটা সেই রকমই!কেননা,ঋজু নীরাকে অনেক বোঝানোর পরও নীরা এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল। তুমি হয়তো জানো না, ঋজু আমাদের অফিসেই চাকরি করে। ওই প্রথম আমাকে ওদের রিলেশনের ব্যাপারে জানিয়ে বলে যে বিয়েটা যেনো আমি ভেঙে দেই।কিন্তু ওই যে বললাম,নীরার সাথে বিয়ে তো ভেঙে দিতেই পারি।কিন্তু পরে তো তোমার বাবা তোমার সাথে আর বিয়েটা আমার দেবেন না।তাই সব দিক বিবেচনা করে নীরাকে কিডন্যাপিংটাই সব কিছুর সমাধান ছিলো।”
মীরা দুহাতে মাথার চুল খামছে ধরে বিছানায় সটান শুয়ে পরলো। মুখ থেকে না চাইতেও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।বিভ্রান্তের মতো শুধু এটাই বিড়বিড় করে যাচ্ছে,
“ও মাই গড! ও মাই গড! এতোটা ক্রিমিনাল মাইন্ডেড তুমি! ”
রোহন তার বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটা ক্লোজ আপ হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার মতো ডেঞ্জারাস সুন্দরীকে তুলতে হলে একটু ক্রিমিনালি তো করতেই হয়,বেব’স।”
১৮.
ব্ল্যাক সফট শিফন জর্জেট শাড়ি।বর্ডারে ভারী সিকুয়েন্সের কাজগুলো শাড়িটিকে করে তুলেছে আরও সুন্দর। সাথে ব্ল্যাক সিকুয়েন্সের ডিপ নেক ব্লাউজ।কানে ভারী কুন্দনের কাজ করা ঝুমকা।তবে এটাই ছিলো রোহনের সারপ্রাইজ। কাল দুপুরে মার্কেট থেকে এগুলোই কিনেছিলো ও।রোহনের পছন্দ আছে, মানতেই হবে। ফ্রেস হয়ে এসে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিলো মীরা।আর সাথে রোহনের পছন্দের পারফিউমটাও গায়ে মাখতে ভুললো না।
পুরো রুম জুড়ে ছোটো ছোটো মোমবাতি জ্বালানো।সাথে আছে পাহাড়ি বুনো ফুলের মাতাল করা গন্ধ। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকেছে ঘরে।হালকা বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছে।মোমের আলোয় মীরাকে লাগছে কোনো কল্পলোকের অপ্সরীর মতো।মুখের মৃদু হাসি আর সপ্রশংস দৃষ্টি দিয়ে রোহন বুঝিয়ে দিলো তার ভালোলাগা। মীরা লাজুক হেসে দৃষ্টি অবনত করে।তার অন্তরাত্মায় ক্রমাগত ধুকপুকানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।রোহনের ওই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেনো শুষে নিচ্ছে তার ভেতরটুকু অব্দি।
রোহন মৃদু হেসে এক হাতে মীরা কোমর পেচিয়ে ধরলো।তারপর হেঁটে চলো এলো জানালার কাছে। বৃষ্টির বেগ তখন কমে এসেছে। বাইরে থেকে আসা মৃদু বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওরা দুজনে।রোহন হালকা হাতে মীরার পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকা কালো সর্পিল চুলগুলোকে ঘাড়ের এক পাশে এনে রাখলো।তারপর ঠোঁট ছোঁয়ালো ওর উন্মুক্ত পিঠে।
বৃষ্টি ভেজা বুনো হাওয়াটা প্রাণভরে টেনে নিয়ে বললো মীরা,
“ব্যাপার কি?”
“লাস্ট নাইট অফ হানিমুন বলে কথা!ইট শ্যুড বি স্পেশাল। ”
হালকা হাসির দমকে একটু সরে গেলো মীরা। ওর দিকে এগিয়ে এসে একটু ঘনিষ্ঠ হলো রোহন।তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আই আম অল ইয়োর’স।তোমার তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা তো তোমার সংসার সেই শুরু থেকেই। এটা হলো আমার #মীরার_সংসার। বাই দ্য ওয়ে,তুমি কবে আমায় এতো ভালোবাসলে?”
রোহনের মুখে মিটিমিটি হাসি।মীরা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ লুকালো তার বলিষ্ঠ বুকে।থাকুক না কিছু অজানা। অন্তরালে ভালোবাসাটা থাক।
(সমাপ্ত)