মীরার সংসার পর্ব – ৬

0
1178

#মীরার সংসার
#তিথি সরকার
#পর্ব – ৬

১১.
জীপের জানালা দিয়ে মাথা বের করতেই এক ঝাঁক উদ্দাম, বুনো, পাহাড়ি বাতাস ছুয়ে যায় মীরার মুখ।সে প্রাণভরে টেনে নেয় সেই মেঘে সিক্ত জংলী বাতাস।পাশের সিট থেকেই রোহন মৃদুস্বরে ধমক দেয়,

“কী করছো কী?পাহাড়ি রাস্তায় এভাবে মাথা বের করতে হয় না।কখন মুখে এসে গাছের ডালের আঘাত লাগবে!”

“ইশশ,এখানে এসেও বকাঝকা, তাই না?”

রোহন একগাল হেঁসে বলে,

“দার্জিলিং শহর পৌঁছে নেই।তারপর মন ভরে বাতাস খেয়ে নিও,কেমন?”

মীরা কোনো জবাব না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।পাহাড়ি রাস্তা চিড়ে তাদের জীপ ছুটে চলেছে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পথে।যদিও এখন দুপুর, তবুও আশেপাশে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের ছড়াছড়ি।
চলন্ত জীপগাড়িটা যখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঁক নিচ্ছে সাথে সাথে যেন প্রকাশিত হচ্ছে পাহাড়ের গায়ের বুনো সৌন্দর্য। আহা!কী অপরুপ পাহাড়ের দৃশ্যাবলি!

রোহনী রোড ধরে যখন জীপ কার্শিয়ং গ্রাম পেরুলো ঠিক তখনই আড়াল থেকে উঁকি দিলো কাঞ্চনজঙ্ঘা। পুরু রাস্তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা তাদের সাথে লুকোচুরি খেললো।মীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই রুপ!

রোহন মীরার দিয়ে তাকিয়ে বললো,

“এখনও তো কিছুই দেখোনি তুমি, ম্যাডাম।নিজের মুগ্ধতাকে সংরক্ষণ করো।এখনও অনেক মুগ্ধ হওয়া বাকি।”

“তুমি কি করে জানলে পাহাড় আমার এতো পছন্দ! ”

উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চায় মীরা।

“তোমার যে পাহাড় এতো পছন্দ তা আমি তো জানতাম না। তবে বছর তিনেক আগে বন্ধুরা মিলে দার্জিলিং ট্যুরে এসেছিলাম।তখনই টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম।তাই এটা আমার প্ল্যানই ছিলো,বউকে নিয়ে তো আরেকবার আসতেই হবে এখানে।”

“তাই বলে তুমি আমার দুদিন আগে জানাবে।এতো তাড়াতাড়ি প্ল্যান করার কি ছিলো?”

“কই তাড়াতাড়ি? বললাম না তিন বছর আগে থেকে আমার ইচ্ছে বউকে নিয়ে ঘুরতে আসার। তবে বিয়ের পর পর অফিসে এতো কাজের চাপ ছিলো!আর মাঝে একটা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে গেলো।তারউপর আবার মাঝে ছিলো ডিসেম্বর – জানুয়ারি মাস।দার্জিলিং এ অফ সিজন।”

“কেনো,কেনো?অফ সিজন কেনো?”

“কারণ এই দুই মাস এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়।যদিও তখনও অনেক টুরিস্ট আসেন।তবে আমি বাদই দিলাম।আর এখন দেখো,মার্চ মাস মানে বসন্ত কাল।আর বসন্ত কাল হচ্ছে হানিমুনের জন্য পার্ফেক্ট!”

“ইশশ,কি জ্ঞানী লোক আমার! ”

“একজন মহাপুরুষ বলেছেন,তুমি যদি বিয়ের এক বছরের মাঝে হানিমুন না সারো,তো তোমার আর হানিমুন হবে না। ”

“চুপ করো তো!” এই বলে মীরা আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।তাদের জীপ চলেছে সবুজ চা বাগানের আঁকাবাকা সরু রাস্তা ধরে। জীপের ভেতর অনেকেই নিজেদের মাঝে গুটুর গুটুর করছে।

একটা বড়ো বাজারের মতো জায়গাতে পৌঁছাতেই বোর্ডে বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা আছে ‘ঘুম’।মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ঘুম কি গো!”

“এই জায়গাটার নামই ঘুম,মীরা।”

মীরা যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে ভাবলো,”জায়গার নাম ঘুম!”

সে জাক গে।গাড়ি যখন ঘুম স্টেশন ক্রশ করলো তারপরই কাঞ্চনজঙ্ঘার পার্ফেক্ট ভিউ পাওয়া গেলো।যাকে বলে অপূর্ব দর্শন।

বিকেল চারটার দিকে জীপ তাদের চকবাজার বলে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলো।মীরা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো,প্রচুর মানুষের ভিড়।পাহাড়ি উপজাতিদের সাথে অনেক বাঙালিরাও রয়েছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা সবাই প্রায় টুরিস্ট।

রোহন আগেই চকবাজারের কাছেই দুদিনের জন্য হোটেল রুম বুক করে রেখেছিলো।সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তারা হোটেলে চেক ইন করে নিলো।

হোটেলটাকে রীতিমতো সুন্দরই বলা চলে।পুরো হোটেলটাই কাঠের তৈরি। কাঠের দেয়াল,মেঝে,সিলিং।তাদের রুম ছিলো দোতলায়। রুমটা বেশ পরিপাটি। মাঝারি সাইজের রুমে দুজনের একটা বেড।সাথেই বড়ো জানালা।তার সাথে বসার জন্য দুটো বেতের সোফা,মাঝে একটা সেন্টার টেবিল।টিভি,ওয়াইফাই সহ যাবতীয় সুবিধাদি রয়েছে রুমে।

রুমে এসেই আগে হিটার অন করলো মীরা।কারণ ঠান্ডা যে কতো প্রকার ও কী কী তা দার্জিলিং শহরে ঢুকেই তার বোঝা হয়ে গেছে।ভীষণ ক্লান্তিতে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।ঢাকা থেকে এতোটা জার্নি করে শরীরে আর কোনো এনার্জি অবশিষ্ট নেই তার।রোহন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলে,

“ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।সন্ধ্যার দিকে বাইরে যাবো।”

বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো রোহন।এদিকে তাকালেই চোখে পড়ে দূর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট জনবসতি।পাহাড়ের গায়ে মেঘের লুকোচুরি খেলা।

১২.
সন্ধ্যা নেমে এসেছে শহরের বুকে।খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে পাহাড়িয়া বাতাস ঘরে ঢুকে পরছে।রোহন মীরাকে ডেকে তুললো।বলল,

“চলো,বাইরে থেকে ডিনারটা সেরে আসি।”

মীরা অবাক হয়।বলে,

“এখুনি!মাত্র তো ছ’ট বাজে!”

“জি, ম্যাডাম।কেননা,রাত আটটার পর দার্জিলিং শহর ঘুমিয়ে যায়।তখন না কিছু খেতে পাবে আর না কি দেখতে পাবে।তাই জলদি রেডি হও।আর ভারী জ্যাকেট আর একটা শাল নিয়ে নাও।বাইরে কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা। ”

রোহনের কথা মতো মীরা তৈরি হয়ে বাইরে আসে।ততক্ষণে রোহন এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলে কাল সকালের জন্য ট্যাক্সির দুটো সিট নিজেদের জন্য ঠিক করে রাখলো।আজ রাতেই ট্যাক্সি ঠিক না করলে কাল এতো ভোরে টাইগার হিল পৌঁছাতে পারবে না।

মীরা একটা ব্লু ডেনিমের প্যান্টের সাথে হাটু অব্দি লম্বা সুতির স্কার্ট পরেছে।তার উপর চড়িয়েছে মোটা লেদার জ্যাকেট।লং লেয়ার চুল গুলোকে পনিটেইল করা। পায়ে হাই নেক কেডস।রোহন মীরাকে এক নজর দেখে বললো,

“উফফ,আমার এই বউটাকে যে আমি কোথায় লুকোই!”

প্রতিউত্তরে মীরা একটা প্রশ্রয় মিশ্রিত হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

রাস্তার বাঁকটা নিতেই দেখা গেলো গোধূলির শেষ আলোয় বিষণ্ণ দুটো কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের মধ্যে এক ঝাঁক নেপালি মুখ তাদের লাল লাল গাল, তাদের চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি, তাদের চ্যাপ্টা ঠোটের মিষ্টি হাসি। সামনের রেলিং এর গায়ে মত্ত দুজন প্রেমিক প্রেমিকা, সারা পৃথিবীর এই ব্যাস্ততার মাঝে তারা যেন হারিয়ে গেছে নিজেদের প্রেমের তীব্র গভীরতায়।আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ের বুকে, দুরের কাঠের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলা শুরু হয়েছে, চোখের সামনে শুধুই নীল মেঘের দল তাতে ডুব দিয়েছে কিছু সুন্দরী পাহাড়ি কন্যা।

ম্যালের সমস্ত আলো জ্বলে উঠেছে, সেই হলুদ সোডিয়ামের আলোর তলায় সাদা কুয়াশার কনা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘোড়া ওলারা তাদের খুচরো পয়সার থলি নিয়ে ঘরে ফিরছে। ম্যালের পাশের মহাকাল মার্কেট আর ম্যাল লোকাল মার্কেট বসেছে তাদের হাজার রকমের সোয়েটার , টুপি হরেক জিনিস নিয়ে। ম্যালের প্রধান রাস্তা ধরে watch tower এর দিকে পথে যাবার পথে হটাত নাকে আসলো চকলেট পেস্ট্রির তীব্র গন্ধ আর কানে কোন জ্যাজ অথবা পপ ইংলিশ গানের সুর ধাক্কা খেলো। রোহন এক হাতে মীরার কোমর শক্ত করে ধরে আছে।মীরার এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে রোহনের হাত।হেঁটে চলেছে দুজন ফুটপাত ধরে।

রাত বাড়ছে দার্জিলিং শহরে। মেঘের দল আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে দার্জিলিং কে।দার্জিলিং বিগ বাজারের দিকে পথে যেতে পরলো পেন্নাং রেস্টুরেন্ট আর Washington restaurant দার্জিলিং এর সেরা মোমও এরাই বানায়। আর মোমও খেতে গেলে অবশ্যই কিন্তু পর্ক মোমও।
রোহন ছ’টা মোমও অর্ডার করলো।সাথে দুই ধরণের চাটনি।আশেপাশে অনেক স্ট্রিট ফুডের কার্ট।দার্জিলিং এর অন্যতম প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে এখানকার স্ট্রিট ফুড।

মোমও খেয়ে একটু পর তারা ঢুকলো আরেকটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার সারতে।রোহন গরম গরম ভাত আর ঝাল ঝাল চিকেন অর্ডার করলো।তবে বসতে হবে কিছুক্ষণ। মীরা এবার রোহনকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কিন্তু এখনও আমায় সব খোলসা করে বলোনি।আজ সময় আছে, আজ বলো।”

“মানে,কি বলিনি আমি তোমায়?”

“ওইদিন আমায় কি করে ওই লোকটার থেকে ফিরিয়ে এনেছিলে তা কিন্তু তুমি আমায় বলোনি।”

“বেড়াতে এসেও এসব নিয়ে পরে থাকবে তুমি!এই চ্যাপটারটা দিলে হয় না?”

“তোমার মনে হয় না,যে সব কিছু আমার জানা উচিত?”

রোহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“আহনাফ যে একটা সাইকো এটা তো আমি ভালো করেই জানতাম। কেননা,যে কি তোমার বোনকে কিডন্যাপ করতে পারে শুধু মাত্র আমায় বিয়ের আসরে অপমান করতে।সে আরও অনেক কিছুই করতে পারে। সেদিন যখন ওর ফোন এলো আমার কাছে এরপর পরই আমি লেগে যাই তোমার ফোনের লোকেশন ট্রেক করতে।কিন্তু এটা তো একা আমার পক্ষে সম্ভব না। পুলিশের হেল্প লাগবে।কিন্তু অফিসিয়াল ওদের কিছু জানাতেও পারবো না।আমার একজন বন্ধু আছে, ঢাকা মেট্রোপলিটনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।আমি ওকে সব কিছু জানাই।সেও জানতো আহনাফের কথা।তাই আমরা আনঅফিশিয়ালি ব্যাপারটাকে নিয়ে এগুই।ওর টিম এক ঘন্টার মধ্যে তোমার লোকেশন খুঁজে বের করে ফেলে।তোমায় রাখা হয়েছিলো কমলাপুর রেলস্টেশনের আশেপাশে। সিভিল ড্রেসে তিনচার জন পুলিশ মিলে তোমায় ওখান থেকে বের করে আনে।তুুমি তখন চেতনাহীন। আর যেহেতু আহনাফ মেন্টালি আনস্টেবল তাই ওকে জেল হাজতে না পাঠিয়ে এসাইলামে পাঠানো হয়েছে। ”

“আচ্ছা, ওই আপুটা কেমন আছে? মানে নীলিমা আপু?”

“ও এখনও অক্ষম হয়ে বিছানায় পরে রয়েছে।তবে চিন্তার কারণ নেই।আহনাফের বড়োলোক বাবা ওকে নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না।শুধুমাত্র আহনাফের খামখেয়ালি পনার জন্য কতোগুলো প্রাণ সংকটের মুখে।”

“আর নীরার কিডন্যাপিং এর ব্যাপারটা?”

“উফফ,এতো প্রশ্ন করো না তুমি? সব জানতে পারবে বলেছি তো!এখন খাও তাড়াতাড়ি। রাত আটটার পর কিন্তু এখানে রেস্টুরেন্ট,দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যায়।সো ফাস্ট! ”

এই বলে রোহন খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।হোটেলে ফিরে এসে বললো মীরা,

“এখন কি করবো,সবে তো সাড়ে আটটা বাজে?”

“কাল সকালে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

এই বলে লাইট অফ করে মীরাকে টেনে কম্বলের নিচে নিয়ে আসে রোহন।

চলবে…
® তিথি সরকার
[আপনাদের কি মন্তব্য করতে ইচ্ছে হয় না?😒😒 সবাই #মীরার সংসার (৬)
১১.
জীপের জানালা দিয়ে মাথা বের করতেই এক ঝাঁক উদ্দাম, বুনো, পাহাড়ি বাতাস ছুয়ে যায় মীরার মুখ।সে প্রাণভরে টেনে নেয় সেই মেঘে সিক্ত জংলী বাতাস।পাশের সিট থেকেই রোহন মৃদুস্বরে ধমক দেয়,

“কী করছো কী?পাহাড়ি রাস্তায় এভাবে মাথা বের করতে হয় না।কখন মুখে এসে গাছের ডালের আঘাত লাগবে!”

“ইশশ,এখানে এসেও বকাঝকা, তাই না?”

রোহন একগাল হেঁসে বলে,

“দার্জিলিং শহর পৌঁছে নেই।তারপর মন ভরে বাতাস খেয়ে নিও,কেমন?”

মীরা কোনো জবাব না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।পাহাড়ি রাস্তা চিড়ে তাদের জীপ ছুটে চলেছে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পথে।যদিও এখন দুপুর, তবুও আশেপাশে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের ছড়াছড়ি।
চলন্ত জীপগাড়িটা যখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঁক নিচ্ছে সাথে সাথে যেন প্রকাশিত হচ্ছে পাহাড়ের গায়ের বুনো সৌন্দর্য। আহা!কী অপরুপ পাহাড়ের দৃশ্যাবলি!

রোহনী রোড ধরে যখন জীপ কার্শিয়ং গ্রাম পেরুলো ঠিক তখনই আড়াল থেকে উঁকি দিলো কাঞ্চনজঙ্ঘা। পুরু রাস্তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা তাদের সাথে লুকোচুরি খেললো।মীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই রুপ!

রোহন মীরার দিয়ে তাকিয়ে বললো,

“এখনও তো কিছুই দেখোনি তুমি, ম্যাডাম।নিজের মুগ্ধতাকে সংরক্ষণ করো।এখনও অনেক মুগ্ধ হওয়া বাকি।”

“তুমি কি করে জানলে পাহাড় আমার এতো পছন্দ! ”

উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চায় মীরা।

“তোমার যে পাহাড় এতো পছন্দ তা আমি তো জানতাম না। তবে বছর তিনেক আগে বন্ধুরা মিলে দার্জিলিং ট্যুরে এসেছিলাম।তখনই টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম।তাই এটা আমার প্ল্যানই ছিলো,বউকে নিয়ে তো আরেকবার আসতেই হবে এখানে।”

“তাই বলে তুমি আমার দুদিন আগে জানাবে।এতো তাড়াতাড়ি প্ল্যান করার কি ছিলো?”

“কই তাড়াতাড়ি? বললাম না তিন বছর আগে থেকে আমার ইচ্ছে বউকে নিয়ে ঘুরতে আসার। তবে বিয়ের পর পর অফিসে এতো কাজের চাপ ছিলো!আর মাঝে একটা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে গেলো।তারউপর আবার মাঝে ছিলো ডিসেম্বর – জানুয়ারি মাস।দার্জিলিং এ অফ সিজন।”

“কেনো,কেনো?অফ সিজন কেনো?”

“কারণ এই দুই মাস এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়।যদিও তখনও অনেক টুরিস্ট আসেন।তবে আমি বাদই দিলাম।আর এখন দেখো,মার্চ মাস মানে বসন্ত কাল।আর বসন্ত কাল হচ্ছে হানিমুনের জন্য পার্ফেক্ট!”

“ইশশ,কি জ্ঞানী লোক আমার! ”

“একজন মহাপুরুষ বলেছেন,তুমি যদি বিয়ের এক বছরের মাঝে হানিমুন না সারো,তো তোমার আর হানিমুন হবে না। ”

“চুপ করো তো!” এই বলে মীরা আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।তাদের জীপ চলেছে সবুজ চা বাগানের আঁকাবাকা সরু রাস্তা ধরে। জীপের ভেতর অনেকেই নিজেদের মাঝে গুটুর গুটুর করছে।

একটা বড়ো বাজারের মতো জায়গাতে পৌঁছাতেই বোর্ডে বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা আছে ‘ঘুম’।মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ঘুম কি গো!”

“এই জায়গাটার নামই ঘুম,মীরা।”

মীরা যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে ভাবলো,”জায়গার নাম ঘুম!”

সে জাক গে।গাড়ি যখন ঘুম স্টেশন ক্রশ করলো তারপরই কাঞ্চনজঙ্ঘার পার্ফেক্ট ভিউ পাওয়া গেলো।যাকে বলে অপূর্ব দর্শন।

বিকেল চারটার দিকে জীপ তাদের চকবাজার বলে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলো।মীরা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো,প্রচুর মানুষের ভিড়।পাহাড়ি উপজাতিদের সাথে অনেক বাঙালিরাও রয়েছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা সবাই প্রায় টুরিস্ট।

রোহন আগেই চকবাজারের কাছেই দুদিনের জন্য হোটেল রুম বুক করে রেখেছিলো।সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তারা হোটেলে চেক ইন করে নিলো।

হোটেলটাকে রীতিমতো সুন্দরই বলা চলে।পুরো হোটেলটাই কাঠের তৈরি। কাঠের দেয়াল,মেঝে,সিলিং।তাদের রুম ছিলো দোতলায়। রুমটা বেশ পরিপাটি। মাঝারি সাইজের রুমে দুজনের একটা বেড।সাথেই বড়ো জানালা।তার সাথে বসার জন্য দুটো বেতের সোফা,মাঝে একটা সেন্টার টেবিল।টিভি,ওয়াইফাই সহ যাবতীয় সুবিধাদি রয়েছে রুমে।

রুমে এসেই আগে হিটার অন করলো মীরা।কারণ ঠান্ডা যে কতো প্রকার ও কী কী তা দার্জিলিং শহরে ঢুকেই তার বোঝা হয়ে গেছে।ভীষণ ক্লান্তিতে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।ঢাকা থেকে এতোটা জার্নি করে শরীরে আর কোনো এনার্জি অবশিষ্ট নেই তার।রোহন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলে,

“ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।সন্ধ্যার দিকে বাইরে যাবো।”

বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো রোহন।এদিকে তাকালেই চোখে পড়ে দূর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট জনবসতি।পাহাড়ের গায়ে মেঘের লুকোচুরি খেলা।

১২.
সন্ধ্যা নেমে এসেছে শহরের বুকে।খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে পাহাড়িয়া বাতাস ঘরে ঢুকে পরছে।রোহন মীরাকে ডেকে তুললো।বলল,

“চলো,বাইরে থেকে ডিনারটা সেরে আসি।”

মীরা অবাক হয়।বলে,

“এখুনি!মাত্র তো ছ’ট বাজে!”

“জি, ম্যাডাম।কেননা,রাত আটটার পর দার্জিলিং শহর ঘুমিয়ে যায়।তখন না কিছু খেতে পাবে আর না কি দেখতে পাবে।তাই জলদি রেডি হও।আর ভারী জ্যাকেট আর একটা শাল নিয়ে নাও।বাইরে কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা। ”

রোহনের কথা মতো মীরা তৈরি হয়ে বাইরে আসে।ততক্ষণে রোহন এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলে কাল সকালের জন্য ট্যাক্সির দুটো সিট নিজেদের জন্য ঠিক করে রাখলো।আজ রাতেই ট্যাক্সি ঠিক না করলে কাল এতো ভোরে টাইগার হিল পৌঁছাতে পারবে না।

মীরা একটা ব্লু ডেনিমের প্যান্টের সাথে হাটু অব্দি লম্বা সুতির স্কার্ট পরেছে।তার উপর চড়িয়েছে মোটা লেদার জ্যাকেট।লং লেয়ার চুল গুলোকে পনিটেইল করা। পায়ে হাই নেক কেডস।রোহন মীরাকে এক নজর দেখে বললো,

“উফফ,আমার এই বউটাকে যে আমি কোথায় লুকোই!”

প্রতিউত্তরে মীরা একটা প্রশ্রয় মিশ্রিত হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

রাস্তার বাঁকটা নিতেই দেখা গেলো গোধূলির শেষ আলোয় বিষণ্ণ দুটো কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের মধ্যে এক ঝাঁক নেপালি মুখ তাদের লাল লাল গাল, তাদের চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি, তাদের চ্যাপ্টা ঠোটের মিষ্টি হাসি। সামনের রেলিং এর গায়ে মত্ত দুজন প্রেমিক প্রেমিকা, সারা পৃথিবীর এই ব্যাস্ততার মাঝে তারা যেন হারিয়ে গেছে নিজেদের প্রেমের তীব্র গভীরতায়।আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ের বুকে, দুরের কাঠের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলা শুরু হয়েছে, চোখের সামনে শুধুই নীল মেঘের দল তাতে ডুব দিয়েছে কিছু সুন্দরী পাহাড়ি কন্যা।

ম্যালের সমস্ত আলো জ্বলে উঠেছে, সেই হলুদ সোডিয়ামের আলোর তলায় সাদা কুয়াশার কনা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘোড়া ওলারা তাদের খুচরো পয়সার থলি নিয়ে ঘরে ফিরছে। ম্যালের পাশের মহাকাল মার্কেট আর ম্যাল লোকাল মার্কেট বসেছে তাদের হাজার রকমের সোয়েটার , টুপি হরেক জিনিস নিয়ে। ম্যালের প্রধান রাস্তা ধরে watch tower এর দিকে পথে যাবার পথে হটাত নাকে আসলো চকলেট পেস্ট্রির তীব্র গন্ধ আর কানে কোন জ্যাজ অথবা পপ ইংলিশ গানের সুর ধাক্কা খেলো। রোহন এক হাতে মীরার কোমর শক্ত করে ধরে আছে।মীরার এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে রোহনের হাত।হেঁটে চলেছে দুজন ফুটপাত ধরে।

রাত বাড়ছে দার্জিলিং শহরে। মেঘের দল আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে দার্জিলিং কে।দার্জিলিং বিগ বাজারের দিকে পথে যেতে পরলো পেন্নাং রেস্টুরেন্ট আর Washington restaurant দার্জিলিং এর সেরা মোমও এরাই বানায়। আর মোমও খেতে গেলে অবশ্যই কিন্তু পর্ক মোমও।
রোহন ছ’টা মোমও অর্ডার করলো।সাথে দুই ধরণের চাটনি।আশেপাশে অনেক স্ট্রিট ফুডের কার্ট।দার্জিলিং এর অন্যতম প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে এখানকার স্ট্রিট ফুড।

মোমও খেয়ে একটু পর তারা ঢুকলো আরেকটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার সারতে।রোহন গরম গরম ভাত আর ঝাল ঝাল চিকেন অর্ডার করলো।তবে বসতে হবে কিছুক্ষণ। মীরা এবার রোহনকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কিন্তু এখনও আমায় সব খোলসা করে বলোনি।আজ সময় আছে, আজ বলো।”

“মানে,কি বলিনি আমি তোমায়?”

“ওইদিন আমায় কি করে ওই লোকটার থেকে ফিরিয়ে এনেছিলে তা কিন্তু তুমি আমায় বলোনি।”

“বেড়াতে এসেও এসব নিয়ে পরে থাকবে তুমি!এই চ্যাপটারটা দিলে হয় না?”

“তোমার মনে হয় না,যে সব কিছু আমার জানা উচিত?”

রোহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“আহনাফ যে একটা সাইকো এটা তো আমি ভালো করেই জানতাম। কেননা,যে কি তোমার বোনকে কিডন্যাপ করতে পারে শুধু মাত্র আমায় বিয়ের আসরে অপমান করতে।সে আরও অনেক কিছুই করতে পারে। সেদিন যখন ওর ফোন এলো আমার কাছে এরপর পরই আমি লেগে যাই তোমার ফোনের লোকেশন ট্রেক করতে।কিন্তু এটা তো একা আমার পক্ষে সম্ভব না। পুলিশের হেল্প লাগবে।কিন্তু অফিসিয়াল ওদের কিছু জানাতেও পারবো না।আমার একজন বন্ধু আছে, ঢাকা মেট্রোপলিটনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।আমি ওকে সব কিছু জানাই।সেও জানতো আহনাফের কথা।তাই আমরা আনঅফিশিয়ালি ব্যাপারটাকে নিয়ে এগুই।ওর টিম এক ঘন্টার মধ্যে তোমার লোকেশন খুঁজে বের করে ফেলে।তোমায় রাখা হয়েছিলো কমলাপুর রেলস্টেশনের আশেপাশে। সিভিল ড্রেসে তিনচার জন পুলিশ মিলে তোমায় ওখান থেকে বের করে আনে।তুুমি তখন চেতনাহীন। আর যেহেতু আহনাফ মেন্টালি আনস্টেবল তাই ওকে জেল হাজতে না পাঠিয়ে এসাইলামে পাঠানো হয়েছে। ”

“আচ্ছা, ওই আপুটা কেমন আছে? মানে নীলিমা আপু?”

“ও এখনও অক্ষম হয়ে বিছানায় পরে রয়েছে।তবে চিন্তার কারণ নেই।আহনাফের বড়োলোক বাবা ওকে নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না।শুধুমাত্র আহনাফের খামখেয়ালি পনার জন্য কতোগুলো প্রাণ সংকটের মুখে।”

“আর নীরার কিডন্যাপিং এর ব্যাপারটা?”

“উফফ,এতো প্রশ্ন করো না তুমি? সব জানতে পারবে বলেছি তো!এখন খাও তাড়াতাড়ি। রাত আটটার পর কিন্তু এখানে রেস্টুরেন্ট,দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যায়।সো ফাস্ট! ”

এই বলে রোহন খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।হোটেলে ফিরে এসে বললো মীরা,

“এখন কি করবো,সবে তো সাড়ে আটটা বাজে?”

“কাল সকালে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

এই বলে লাইট অফ করে মীরাকে টেনে কম্বলের নিচে নিয়ে আসে রোহন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে