#মীরার সংসার
#তিথি সরকার
#পর্ব-৪
৭.
চারিদিকে আবছা অন্ধকার।উঁচু দেয়ালের ভেন্টিলেটরের ফাঁক গলে ক্ষীণ আলোর রেখা লুটিয়ে পড়ছে মেঝেতে।মীরা বহু কষ্টে বুঁজে আসা চোখ মেলে তাকালো।তবে সামনে সে নিগূঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলে না।খানিকক্ষণ বাদে সে বুঝতে পারলো তার হাত দুটো চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে।মীরার মাথায় একটা সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা সূচের মতো বিঁধছে। মীরা বোঝার চেষ্টা করলো যে সে আছেটা কোথায়! সে তো দুপুরে কেনাকাটা করতে বাইরে বেরিয়েছিলো।হাতে তিন চারটা শপিং ব্যাগ নিয়ে বাসার পাশের গলিটা দিয়ে ফিরছিলো সে।এরপরে আর কিছুই মনে নেই তার।মীরা মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু তাতে তার মাথার যন্ত্রণা খানিকটা তীব্র হওয়া বৈ আর কিছুই হলো না।
মীরা ক্ষীণ গলায় কাউকে ডাকার চেষ্টা করলো।কোথায় আছে সে?এমন একটা জায়গায় তাকে আটকে রাখার মানে কী?হঠাৎ মাথার যন্ত্রণাটা খুব বেশি হয়ে উঠলো।মনে হচ্ছে যেনো মাথার পেছনের অংশে কোনো শক্ত আঘাত লেগেছে।তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে উঠেছে। তবুও গলার স্বরটা আরেকটু উঁচু করে বলল,
“কেউ আছেন? কেউ কি নেই এখানে? ”
কিন্তু কারোর সাড়া পাওয়া গেলো না।হতাশ হলো মীরা।হাতের বাঁধন গুলো খোলার চেষ্টা করলো।কিন্তু সেগুলো যেনো আরও দৃঢ় ভাবে কেটে বসে যাচ্ছে। কতক্ষণ এমন হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলো সে।নির্জীব ভাবে পিঠ এলিয়ে দিলো চেয়ারটাতে।তার মাঝে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই।
.
সময় প্রায় সন্ধ্যা সাতটা।ড্রইংরুমে একটা রকিং চেয়ারে বসে বই পড়ায় ডুবে আছেন প্রমিলা দেবী।ইদানীং তিনি আর তেমন অফিসে যান না।অফিসের সব কাজ রোহনের হাতে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিত হয়ে আছেন তিনি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সচেতন হলেন তিনি।সাতটা বেজে গেলো আর এখনও মীরার বাড়িতে ফেরার নাম নেই।কপাল কুঁচকে এলো তার।মীরা তো কখনও সন্ধ্যার পর বাইরে থাকে না।পাশ থেকে ফোন নিয়ে মীরাকে কল করলেন।কিন্তু ফোনটা বাজতে বাজতেই কেটে গেলো।পর পর তিনবার তিনি ফোন করলেন। প্রতিবারই একই ঘটনা ঘটলো।এবার তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন।প্রায় দুপুরের আগে মীরা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো।এখনও ফেরার নাম নেই।আবার ফোনটাও ধরছে না।মেয়েটার কোনো বিপদ হলো না তো!
প্রমিলা দেবী উঠে উপরে আসেন।তার ভাইয়ের দরজার সামনে দাড়িয়ে ডাকেলন,
“এই গোবিন্দ, ঘরে আছিস?”
তার গলা কাঁপছে।গোবিন্দ বাবু ঘরেই কিছু লেখালেখি করছিলো।বোনের ডাক শুনে উঠে আসে।
“কি হয়েছে রে,দিদি? তোকে এমন লাগছে কেনো?”
তিনি অস্থির হয়ে বলেন,
“মীরা কোথায় আছে জানিস?ওকে ফোনে পাচ্ছি না। ”
“দুপুরে না মার্কেটে গেলো।তোর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই না গেলো।”
“সেটাই তো।দুপুরে গেছে। আর এখন সাতটার বেশি বাজে।এখনও ফেরার নাম নেই।তার উপর ফোনটাও ধরছে না।কি একটা অবস্থা বল তো!”
“আহ্,এতো চিন্তা করিস না।হয়তো জ্যামে আটকা পরেছে।তাই দেরি হচ্ছে। এসে যাবে এক্ষুনি। আচ্ছা, এক কাজ কর,রোহনকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর ওর সাথে আছে নাকি।মীরা তো মাঝে মাঝেই অফিসে যায়।”
ভাইয়ের কথায় চিন্তা কমলো না প্রমিলা দেবীর।জ্যামে থাকলেই কি নিউমার্কেট থেকে আসতে এতো সময় লাগে! কতো করে বললেন উনি গাড়িটা নিয়ে যেতে। কিন্তু এই মেয়ে তো গাড়ি নিতেই চায় না। আজ গাড়িটা নিয়ে গেলেও এতো চিন্তা হতো না তার।রোহনকে ফোন দেবে কিনা এই চিন্তা করতে করতে কলিংবেলের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। মুখ থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।হয়তো মীরা ফিরে এসেছে।কিন্তু দরজা খুলে আশ্চর্য হন তিনি।কেননা,মীরা নয় দরজার বাইরে রোহন দাঁড়িয়ে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে রোহন,
“আমায় দেখে এমন ভুত দেখার মতো চমকে গেলে কেনো?সরো,ভেতরে যেতে দাও।”
তিনি সরে দাড়ালেন।রোহন ভেতরে ঢুকে বার কয়েক মীরার নাম ধরে ডাকলো।কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে কপাল কুঞ্চিত করে ফেললো।
“মীরা তোমার কাছে যায়নি?আমরা তো ভেবেছি ও তোমার সাথে। ”
মায়ের কথা শুনে অবাক হয় রোহন।
“মানে?মীরা আমার সাথে থাকবে কেনো মা?আর আমরা কোথাও গেলে তো তোমাকে জানিয়েই যাই।”
“মীরা বাড়িতে নেই রোহন।সেই দুপুরে বেরিয়েছিল এখনও ফেরেনি।”
মায়ের কথাটা রোহনের মস্তিষ্ক ঠিক ভাবে গ্রহণ করলো কি না বোঝা গেলো না। তার চোখ মুখের ভঙ্গি মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। মীরা বাড়িতে নেই মানে!কম্পিত হলো রোহনের বক্ষস্থল। একরাশ ভয় এসে ঠাই নিলো অন্তঃকরণে।মেয়েটা তো সন্ধ্যার পর একা একা কোথাও থাকে না।রোহন ফোন বের করে মীরার নাম্বার ডায়াল করলো। কিন্তু বিপরীত পাশ হতে কোনো জবাব এলো না।অধৈর্য্য হয়ে আবার সে কল করতে লাগলো।
“মীরা ফোন ধরছে না। আমি ফোন করেছিলাম।”
মুহূর্তেই রোহনের চেহারা যেনো রক্ত শূন্য হয়ে গেলো। তবে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো সে।ধীরে ধীরে মীরার বাবার বাড়িতে এবং কাছের সব বন্ধু বান্ধবীদের ফোন করলো রোহন।কিন্তু কোথাও কোনো রকম খোঁজ পেলো না সে।এবার মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় গিয়েছিলো ও?”
“আর বলিস না।কিছু টুকটাক কেনাকাটার জন্য দুপুরে নিউমার্কেট গিয়েছিলো।কতোবার বললাম গাড়িটা নিয়ে যাও।কিন্তু কে শোনে কার কথা! ”
রোহন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো।তার আগে মীরার ফোনের লোকেশন চেক করে নিলো।ফোনের লোকেশন সবসময় অন করে রাখতো মীরা।যেনো কোনো বিপদে পড়লে সহজেই তাকে কেউ খুঁজে পেতে পারে।
৮.
ঘরের পাশ দিয়ে মাত্রই যেনো একটা ট্রেন ছুটে গেলো।কেঁপে উঠলো পুরো ঘর।আর তার সাথে মীরাও।চেয়ারের উপর নেতিয়ে আছে সে।কখন থেকে চিল্লাতে চিল্লাতে গলার অবস্থা বেহাল।তবুও শেষবারের মতো ডাকলো সে,
“কেউ কি আছেন? আমায় একটু জল দেবেন।আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে।”
খট করে ঘরের দরজাটা খুলে গেলো।দরজা দিয়ে আবছা আলোর সাথে প্রবেশ করলো এক পুরুষ অবয়ব।ধীর পায়ে হেঁটে এসে মীরার কাছে বসলো সেই অবয়বটা।মীরার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে একটা বিশ্রী হাসি দিলো।মীরার গা ঘিনঘিন করে উঠলো।তারপর একটু দূরে দাঁড়িয়ে তকিব বলে কাউকে জোরে ডাক দিলো।
ডাক শুনে একটা বেটে খাটো ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“ম্যাডামকে তোরা এখনও কোনো খাতির যত্ন করিস নাই, হারামজাদারা।”
দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বললো লোকটা।
“মাফ কইরা দেন ভাই।আপনিই তো কইসিলেন ঘরের দরজা না খুলতে।”
মুহূর্তেই গলার স্বর পাল্টে বলল লোকটা,
“আহ হা!তাই বলে তোরা ম্যাডামরে পানিও দিবো না?জানোস উনি কার বউ?রোহন মজুমদারের বউ।পুরা শহর যারে এক ডাকে চিনে তার বউয়ের এতো অযত্ন! তাও আবার আমার ঘরে!মনে বড়ো কষ্ট পাইলাম।”
পাশ থেকে পানির বোতলটা উঠিয়ে তা নিয়ে মীরার দিকে এগিয়ে গেলো।মীরার হাতের বাঁধন গুলো খুলতে খুলতে বললো,
“ইশশ,কি শক্ত করে বেঁধেছিস রে!নরম হাত দুটোতে তো দাগ পরে গেলো।”
মীরা ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে।তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।কে এই লোক! কেনো তাকে এখানে এনেছে!
সে রীতিমত ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।তবুও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি? আর আমাকে এখানে কেনো এনেছেন? ”
লোকটা হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
“আরে কুল বৌদি।আপনার সব প্রশ্নের জবাবই আপনি পাবেন।তার আগে আপনার বরটিকে একটু ঘুরিয়ে নেই।”
মীরা বুঝতে পারলো যে রোহনকে তার বিজনেসে টেক্কা দেওয়ার জন্যই কেউ তাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে।তাই তাকে এখন শক্ত থাকতে হবে।সে যে ভয় পেয়েছে তা এই লোকগুলোকে বুঝতে দিলে চলবে না।
এরই মাঝে লোকটার ফোন বেজে ওঠে। কলকারী ব্যক্তির নাম দেখে লোকটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি থামিয়ে বলে,
“দেখেছেন বৌদি।আপনার পতিদেব কিন্তু বুঝে গেছেন যে আপনি আমার কাছে আছেন। ”
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কারো চিৎকার শোনা গেলো,
“মীরাকে কোথায় রেখেছিস আহনাফ? আমার আর তোর মাঝে আবার বাইরের কাউকে কেনো জড়ালি?সাহস থাকলে আমার সামনে এসে মোকাবিলা কর।ব্লা/ডি কাউয়ার্ড!”
“আরে! এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো,দোস্ত?এবার আর বউয়ের বদলে ভুলে তোর শালিকে তুলে আনিনি।তাই চিন্তা করিস না।তোর বউয়ের কোনো অযত্ন হবে না আমার কাছে। ”
“তুই শালা হা/রা/মি তো ওটাই থাকবি।তুই বারবার আমার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে এই একই কাজ করিস।দম থাকলে সৎ ভাবে আমায় হারিয়ে দেখা।”
“মাই ফ্রেন্ড!ভুলে যাস কেনো?এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”
“কি চাই তোর?”
“খুবই সিম্পল একটা জিনিস। তোর এইবারের টেন্ডার কোড যা দিয়ে তুই সরকারি হসপিটাল আর কোয়াটার্সের কন্ট্র্যাক্ট না নিবি।বা তুই এই টেন্ডারটা আমার জন্য ছেড়েও দিতে পারিস।”
“ইম্পসিবল! তোর মতো একটা বা/স্টার্ডের হাতে আমি সরকারি এতো বড়ো একটা কাজের কন্ট্র্যাক ছেড়ে দিতে পারি না।”
“তাহলে বউয়ের কথা ভুলে যা।গতবার তোর শালিকা, ও সরি,তোর না হওয়া বউকে আমার কাছ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলি।কিন্তু এবার মনে হয় তোর বউয়ের প্রতি তোর মায়া নেই।”
কথাটা বলেই মুখ দিয়ে একটা আফসোস সূচক শব্দ করে মীরার দিকে তাকালো আহনাফ।
“আই উইল জাস্ট কি/ল ইউ আহনাফ!”
বলেই রাগে পাশের দেয়ালে জোরে আঘাত করলো রোহন।
“তুই কতো বড়ো ভুল করলি এটা তুই এখন বুঝবি আহনাফ। তুই শুধু দেখ।”
“আ’ম ওয়েটিং ফর ইউ মাই ডিয়ার এনিমি।তবে মাথায় রাখিস পুলিশ নিয়ে এলে কিন্তু তোর বউকে আর জ্যান্ত পাবি না।”
বলেই কলটা ডিসকানেকট করে ফোনটা অফ করে দিলো আহনাফ।
চলবে…