#মীরার সংসার
#তিথি সরকার
#পর্ব-২+৩
“মীরা,কোথায় আছো তুমি? ”
রোহনের ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে মীরা।চোখে মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলে,
“কি সমস্যা? চিল্লাপাল্লা করে বাড়িঘর মাথায় তুলছো কেনো?”
রোহন তার চেয়েও বেশি বিরক্তি নিয়ে বলল,
“চিল্লাবো না?আমার ওয়ালেট কোথায়?ঘড়িটাই বা কোথায় গেলো?”
মীরা বুঝতে পারছে এসবই তাকে শুধু জ্বালানোর ধান্দা। তাই জলদি ক্যাবিনেট থেকে সব কিছু বের করে দিয়ে আবার রান্না ঘরের দিকে ছুট লাগাতে চায়। কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে তার দুই হাতকে নিজের করায়ত্ত করে নেয় রোহন।নিজের দিকে ঘুরিয়ে হাত দুটোকে নিজের বুকের উপর রেখে বলে,
“ছয় মাস হলো বিয়ের। এখনো আমার অভ্যেসগুলো রপ্ত করতে পারলে না?টাই বেঁধে দেবে কে আমার?”
“উফফ,এমন ভাব করে যেনো বিয়ের আগেই তার আরও দশটা-পাঁচটা বউ ছিলো।আমি তোমার গলার নাগাল পাই না দাঁড়িয়ে।কতো লম্বা তুমি! ”
অসহায় শোনালো মীরার আওয়াজ।
“তবুও বাঁধতে হবে।”
“নিচু টুলটা কোথায় গেলো?এটা তোমার ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই। ”
মীরা নজর ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাতেই ঝট করে তাকে কোলে তুলে নেয় রোহন।টাইটা তার হাতে দিয়ে বলে,
“এবার তো বেঁধে দাও!”
মীরা বিরসবদনে টাই বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু রোহনের নজর ঘুরঘুর করছে তার মুখশ্রীর মাঝে।সদ্য স্নান সেরে রান্নাঘরে যাওয়ার ফলে চুলগুলো থেকে এখনো জলবিন্দু পরছে।সে চোখ মুখ কুঁচকে টাই বাঁধায় ব্যস্ত।যেনো সে রাজ্যের বিরক্ত। সকাল বেলার স্নিগ্ধ আলো তার মুখশ্রীতে খেলা করে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অপরুপ দ্যুতি।
আর রোহনের হাত খেলা করছে তার কোমর জুড়ে। কখনও পেটে সুড়সুড়ি দিচ্ছে তো কখনও আবার কোমরে গোঁজা আঁচলে টান দিচ্ছে।
“উফফ,অসহ্য! ”
বলেই মীরা রুম থেকে গটগট করে হাঁটা দিলো রান্নাঘরের দিকে। এবার আর রোহন হাত বাড়িয়েও মীরার নাগাল পেলো না।
—————————
খাবার টেবিলে সবাইকে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত মীরা।টেবিলের দুপাশে রোহন,তার শাশুড়ি আর তার মামা শ্বশুর বসেছে।বলাবাহুল্য, এই তিনজন ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই মীরার।তার শ্বশুর মানে রোহনের বাবা একটা এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেছেন আরও বছর পনেরো আগে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রমিলা দেবী খুবই দক্ষতার সাথে ঘর ও বাহির দুটোই সামলেছেন।তখন রোহন সবে দশএগারো বছরের ছেলে।তাকে সামলে তিনি নিজের স্বামীর প্রতিষ্ঠিত ছোট ব্যবসার হাল ধরেছেন।আস্তে আস্তে এটাকে বড়ো করে তুলেছেন।উনার ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ার মতো।উনার ভাবগাম্ভীর্যের কারণে উনার ব্যক্তিত্ব ঘরে বাইরে সকলের কাছে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে। তাঁর সব কাজে তিনি সবসময় সহযোগী হিসেবে পেয়েছেন তার ছোট ভাইকে।
” মীরা মা।পরোটাতে কিছুটা কম তেল দিও।বোঝোই তো,এই বয়সেই যদি মুটিয়ে যাই তাহলে কি চলে বলো?”
মামা শ্বশুরের কথায় ঠোঁট টিপে হাসে মীরা।ভদ্রলোকের বয়স আটচল্লিশ ছাড়িয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। তবুও তিনি নিজেকে মনে করেন স্টিল ইয়াং।এখনও অবিবাহিত কিনা।তার মতে অবিবাহিত পুরুষদের কখনও বয়স বাড়ে না।তারা চিরকুমার। তাই এখনও তিনি নিজেকে টিপটাপ, ফিটফাট রাখেন।তবে তার চিরকুমার থাকার ইতিহাসটা বেশ করুণ।যাকে প্রথম বয়সে ভালোবেসেছিলেন,তাকে নিজের করে পাননি।তাই জীবনভর অবিবাহিত থেকেই গেলেন।
মীরা চোখে জল আসে উনার কথা ভাবলেই।কিভাবে উনি সারাটা জীবন কাটাচ্ছেন তার প্রেয়সীকে ছাড়া।রোহনকে ছাড়া একটা দিন থাকার কথা ভাবলেই যেখানে মীরার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।রোহনকে ছাড়তে পারবে না বলেই না এতো নাটক,এতো আয়োজন! কে বলেছে যে নিজের ভালোবাসাকে শুধু ছেলেরাই ছিনিয়ে নিতে জানে?নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পেতে একটা মেয়ে কতোটা বেপরোয়া হতে পারে,তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মীরা।
মীরা দুএকবার ফাঁকা ঢোক গেলে। কাল রাতে মা ফোন করে বলেছে নীরা ফিরে এসেছে।সাথে আছে তার হাসবেন্ড। এবার যদি সব কথা ফাঁস হয়ে যায়?কি হবে তবে?
তার ধ্যানভঙ্গ হয় তার শাশুড়ি মায়ের কথায়।
“শুনলাম, তোমার বড়ো বোন নাকি বাড়ি ফিরে এসেছে?”
মীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।সে একবার আড়চোখে তাকায় রোহনের দিকে। নাহ্।তার অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন নেই।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মীরা।
“তা বোনের সঙ্গে দেখা করে এসো গে।এতোদিন পর ফিরলেন উনি।তা দেখবে না,আমার রোহনকে বাদ দিয়ে কোন হীরের টুকরো ছেলেকে বিয়ে করেছেন উনি। ”
উনার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ আর বিরক্তির আভাস।
“আহ্,মা।বাদ দাও তো এসব। আর মীরা শোনো,তোমার যদি বোনের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয় তো তুমি যেতে পারো।আমার কোনো সমস্যা নেই।”
মীরা ইতস্তত করে বলে,
“আমার মনে হয় না যাওয়াটাই ভালো হবে।মানে তার হবু বরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ব্যাপারটা একটু কেমন না?আমি ওর সামনে কি করে গিয়ে দাঁড়াবো?”
“আশ্চর্য তো!পালিয়েছিলো ও।ভয়, সংকোচ যাই বলো সেটা থাকবে ওর।তুমি এতো সংকুচিত হচ্ছো কেনো?”
আশ্চর্যান্বিত স্বরে বলে রোহন।মীরা বারকয়েক ফাঁকা ঢোক গেলে। দ্বিধান্বিত হয় তার চোখের দৃষ্টি। সেদিকে খেয়াল করে বলে রোহন,
“আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি যদি যেতে না চাও যাবে না।এতে এতো কুন্ঠিত হওয়ার কি আছে? ”
৪.
শরতের দিনগুলো শেষের দিকে। স্বচ্ছ নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ছড়াছড়ি।মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে গাছের পাতা।আকাশে সূর্যের তাপ এতো বেশি না।একটা মিষ্টি আদুরে রোদ ছড়িয়ে আছে চারিপাশে।
শহরের অভিজাত একটি রেস্টুরেন্টের রুফটপে বসে আছে নীরা।রেস্টুরেন্টটা বলতে গেলে অনিন্দ্য সুন্দর। ভেতরে সাজের সাথে বাইরের সাজটাও অসাধারণ। এমন নামি দামি রেস্টুরেন্টে অবশ্য আগে কখনও আসেনি নীরা।বলতে গেলে আজই প্রথম।কিন্তু তার পোশাকাশাকে তা বোঝা যায় না। তার পরনে আছে নীল ডেনিমের প্যান্টের সাথে শর্ট কুর্তি।তার উপর ডেনিমের জ্যাকেট।চোখের রোদ চশমাটা আপাতত সামনের টেবিলের উপর রাখা।বাদামী লং লেয়ার চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। সে পায়ের উপর পা তুলে ফোন টেপায় ব্যস্ত থাকলেও তার নজর বার বার চলে যাচ্ছে দরজার দিকে।
একটু পরে ছাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে মীরা।এসে সরাসরি সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসে।সে বেশ তাড়াহুড়ো করে এসেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। ঘন লম্বা চুলগুলো একটা এলোমেলো হাত খোঁপা করা।মুখে সামান্য প্রসাধনের চিহ্ন।নীরাকে মানতেই হবে যে তার এই বোনটা সুন্দরী বটে।তার পড়নের একটা সিগনেচার কালেকশন শাড়ি।বড়োলোকের বউ বলে কথা!এসব শাড়ি তাদের কাছে ডাল ভাত।মূলত মীরার সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছে সে।
মীরার স্থির দৃষ্টি আপাতত নীরার কুটিল চাহনির উপর যা দিয়ে কিনা সে মীরাকে স্ক্যান করে চলেছে কখন থেকেই।মীরা শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই তোর?”
নীরা বসার ভঙ্গিটায় পরিবর্তন আনলো।হাতটা টেবিলের উপর রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়ে বলছিস আমার কি চাই? বড়োলোকের বউ হয়ে বসে আছিস, আমার সবকিছু দখল করে। যদি বলি তোর সবকিছু! ”
“দেখ,একদম ফাতুল কথা বলবি না।এসব কথা তোর পালানোর আগে মনে ছিলো না?বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছিলি তুই।তোর কোনো ধারণা আছে এতে বাবার কতটা অপমান হয়েছিলো?আবার এখন এসে বলছিস তোর সব কেড়ে নিয়েছি?লজ্জা করে না তোর?”
“ওহ,শাট আপ!তোর কি মনে হয়,আমি অবুঝ? কিছু বুঝি না আমি? তোর ওই সিক্রেট ক্রাশ যে রোহন ছাড়া আর কেউ নয় তুই কি ভেবেছিস সেটা আমি জানি না? ”
কথাগুলো বলে রাগে ফুসতে থাকে নীরা।এবার মীরার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে।
“তবেই বোঝ। কেমন নির্লজ্জ তুই! তোর ঋজু দার সাথে তিন বছরের সম্পর্ক। তার উপর তুই এটাও জানতি যে যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে সে তোর ছোটবোনের পছন্দ। তবুও তুই বিয়েতে রাজি হয়েছিলি।আচ্ছা,আমার কথা নয় বাদই দিলাম।ছোট থেকেই তো আমার সব জিনিসের প্রতি তোর নজর।আমার পছন্দের জিনিস, আমার প্রিয় জিনিসগুলো তোকে ছিনিয়ে নিতে হবেই।কিন্তু একটা বারও তোর ঋজু দার কথা মনে পড়লো না?কিভাবে পারলি তুই এতোটা লোভী হতে?”
“আমি খুব ভালো করেই জানি এটা তোর আর তোর প্রাণের ঋজু দার প্ল্যান।”
“দেখ নীরা!তুই স্বীকার কর যে তুই লোভে পরে রোহনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি।তুই বিয়ে করতে চেয়েছিস খুব ভালো কথা!তুই বলেছিলি তুই ওকে ভালোবাসিস।তুই যদি ওকে ভালোই বাসতি তবে এখানে ঋজু এলো কোথা থেকে? লজ্জা করে না তোর একজনকে ঠকিয়ে আরেক জনের সাথে সংসার বাঁধতে? ”
“লজ্জা মাই ফুট!চালচুলোহীন ঋজুর সাথে সম্পর্কে জড়ানোর চেয়ে রোহনকে বিয়ে করা অনেক ভালো। ”
“ছিঃ! এখনও তুই এই কথা বলছিস!তোর ভাগ্য ভালো।ঋজুদা তোকে এতোটা ভালোবাসে।ও তো তোকে আপন করে নিয়েছে।ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে তোর মুখে লাথি মেরে চলে যেতো।তোর ভাগ্যটা আসলেও খুব ভালোরে।লাস্ট মুহূর্তে তো আমিও তোকে সব ছেড়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা দেখ!ভগবান হয়তো আমার জন্যই রোহনকে বানিয়েছেন তাই লাস্ট মুহূর্তে তুই পালিয়ে গেলি।”
“আমি পালাইনি।তুই আর ঋজু মিলে আমাকে কিডন্যাপ করিয়েছিলি।”
“তোর এই গাঁজাখুরি আলাপ বাদ দে।আমরা সবাই তোর হাতের লেখা চিঠি পেয়েছি যে তুই পালিয়ে গেছিস।এখন তোর এইসব উল্টা পাল্টা কথাবার্তা বন্ধ কর।আর আমাকে ফোন দিয়ে আর কোনো রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না।”
“তুই কি ভেবেছিস এতো শান্তিতে সংসার করতে দেবো তোকে?তোর রোহনকে তোর থেকে আলাদা করতে দুদিনও লাগবে না আমার।আমি ওকে সব বলবো যে কিভাবে তুই আর ঋজু মিলে বিয়ের দিন আমায় কিডন্যাপ করিয়েছিলি।তার পর দেখবো কি করে তো সংসার টেকে?”
মুহূর্তের মধ্যেই মীরার চেহারা পাল্টে গেলো।টেবিলের উপর থেকে ক্ষিপ্রতার সাথে ছুড়িটা উঠিয়ে নীরার গলায় চেপে ধরলো।সাথে সাথে নীরার চোখে মুখে চরম আতংক ফুটে উঠলো।সে চোখ বড়ো বড়ো করে মীরার দিকে তাকালো।যাকে আপাতত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
“খুন করে ফেলবো।জাস্ট খুন করে ফেলবো তোকে আমি। সারাটা জীবন আমার সাথে কম্পিটিশন করে গেলি।মাত্র এক বছররে ছোট ছিলাম তোর চেয়ে। তবুও সবসময় আমার প্রিয় জিনিসটাই তোর ছিনিয়ে নেওয়া চাই।জানতি তুই যে রোহনকে আমি সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালোবাসি তবুও এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলি।তুই আসলে ঠিকই বলেছিস তোকে কিডন্যাপ করার প্ল্যানটা আমিই করেছিলাম।পারলে তখন তোকে খুন করে ফেলতাম তোকে। কিন্তু আমার মাথায় তুই কি ঢুকিয়েছিল?রোহন তোকে ভালোবাসে। ভালোবাসা মাই ফুট! ও তোকে ঠিকঠাক চেনেও না। ও তোকে ভালোবেসে ভেবে আমি নিজেই প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিয়েছিলাম।খুব কেঁদেছিলাম আমি সেদিন। কিন্তু ভগবানের কি লীলা দেখ! তুই নিজেই শেষ মেশ পালিয়ে গেলি।”
নীরার চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। ছুড়িটা মীরা এভাবে ধরে আছে যেনো মনে হচ্ছে এখুনি গলা কেটে রক্ত বেরুবে।নীরা কোনো মতে বললো,
“বিশ্বাস কর মীরা।আমি পালাইনি।সত্যি রোহন আমায় ভালোবাসতো।”
“আর একটা মিথ্যে কথা বললে না ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো একদম। জানিস তো এই রেস্টুরেন্টে রোহনের ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার আছে। সো, তোকে মেরে লাশ গুম করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই না।তুই যদি বিয়ের আগে আমার এভাবে ব্রেন ওয়াশ না করতি তাহলে হয়তো সত্যিই আমি বিয়েটা ভাঙ্গার চেষ্টা করতাম।জানিস কতোটা ভয় পেয়েছিলাম আমি। ফুলশয্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে আমি শুধু ভেবেছিলাম রোহন আমায় মেনে নেবে তো?কিন্তু ভুল ছিলি তুই। আরে ও তো তোকে ঠিক করে চেনেই না।শুধু মায়ের কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছিলো।”
কথাগুলো বলে মীরা কিছুটা শান্ত হয়।নীরাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। আর নীরা ঢকঢক করে এক গ্লাস জল পুরোটা শেষ করে।তার আত্মায় আর পানি নেই।
“তুই কি ভেবেছিস নীরা? কোনো প্রমাণ না রেখে আমি এতো কাচা কাজ করি নাকি?তোকে তো সত্যিই কিডন্যাপিং এর প্ল্যানই করেছিলাম।তোর আর ঋজুদার সব ছবি, ভিডিও আমার কাছে আছে।সো তুই বলবি আর রোহন তোর কথা বিশ্বাস করবে,তুই আমার সংসার ভাংবি তোর আশার সে গুড়ে বালি। আর সেদিন রাতে ঋজু দা নিজে আমায় জানিয়েছে যে তোরা পালিয়ে গেছিস।মনে রাখিস,এটা আমার সংসার। গত ছয়মাস যাবত তিলে তিলে আমি গড়েছি এটা।আমার সংসারের দিকে নজর দিলে তোকে খুন করতেও দুইবার ভাববো না আমি। ”
নীরার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর পায়ে বাইরে বেড়িয়ে আসে মীরা।সন্ধ্যা নামার পূর্ব মুহূর্তে গোটা আকাশ সূর্যের লালিমায় ছেয়ে আছে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। চারিপাশে তাদের কলরবে মুখরিত। মীরার মনে একটাই চিন্তা। সেও এই পাখিদের মতোই যত্নে নিজের সংসার আগলে রাখবে।এটা তার নিজের সংসার। মীরার সংসার।
চলবে….
®তিথি সরকার
[প্রিয় পাঠকগণ!গল্প পড়ে অবশ্য সাধ্যমতো রেসপন্স করবেন। আপনাদের অনুভূতি গুলো জানাবেন। ভুল ত্রুটি চোখে পরলে উল্লেখ্য করবেন দয়া করে।আমি তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো।]
#মীরার সংসার(৩)
৫.
রাত্রির প্রথমাংশ।হালকা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে পরিবেশ।রাস্তায় সোডিয়াম আলোর নিচে জমাট বাধা কুয়াশা।আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ। ফকফকে জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে পরিবেশ। বড়ো বড়ো মেঘ এসে মাঝে মাঝেই কিছুক্ষণের জন্য চাঁদকে ঢেকে দিয়ে তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।কিন্তু মেঘের আড়ালে কি চাঁদকে লুকানো যায়?একসময় ঠিকই তা আপন মহিমায় প্রকাশিত হয়।
ছাদের নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে হঠাৎই ঝিঁঝি পোকার একটানা আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই চমকে ওঠে মীরা।ছাদের কিনারায় নজর দিয়ে দেখলো বেশ কয়েকদিনের অবহেলায় ওইদিকটা ঝোপের মতো হয়ে আছে। ইদানীং সে কোনো কাজই ঠিকঠাক ভাবে করছে না।মনটা হয়ে আছে বিক্ষিপ্ত। সত্যিই যদি নীরা না পালিয়ে থাকে তাহলে? নীরার চোখ মুখ দেখে মনে তো হলো না ও মিথ্যে বলছে। নীরার ভাষ্যমতে তাকে কেউ কিডন্যাপ করেছিলো।কিন্তু মীরা তো তাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো। তবে কি ঋজুদা ওকে কিডন্যাপ করছিলো!কিন্তু সেন নীরার বিয়ের দিন হয়েছিলো কি?এটাই সে বুঝতে পারছে না। নীরার সাথে তার ভালোভাবে কথা বলা উচিত ছিলো। আসলে নীরা তখন ওইভাবে তার সংসার ভাঙার কথা বলায় হুট করেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো।সবকিছু খুব গোলমেলে লাগছে।
ধাতব দরজা খোলার শব্দে মীরা চমকে তাকায় সেদিকে।ছাদের দরজার সামনে তার মামা শ্বশুর গোবিন্দ বাবু দাঁড়িয়ে। মীরার দিকেই নজর পরতেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসেন উনি।হয়তো ছাদে সিগারেট খেতে এসেছিলেন।এতো রাতে ছাদে কেউ থাকবে তা ভাবেননি।
“বৌমা,এই হিমে ছাদে কি করছো?নিচে দেখলাম রোহন তোমায় খুঁজছে। অনেকক্ষণ হলো অফিস থেকে ফিরেছে।”
ওনার কথা শোনা মাত্রই মীরা তড়িঘড়ি নিচে নামতে লাগলো।ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলো রোহন জামা চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। মীরা সেদিকে নজর না দিয়ে বিছানার উপর থেকে রোহনের ল্যাপটপ ব্যাগটা সরিয়ে কাবার্ডের উপর রাখলো।এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শার্ট প্যান্ট গুলোকে ঝুড়িতে রাখলো।রোহন বিছানায় বসে নিঃশব্দে মীরার কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।কাজ শেষ করে পেছনে ফিরতেই রোহন তাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো।বিছানার কাছে যেতেই তাকে টেনে বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো রোহন।তার এহেন কাজে ভড়কালো মীরা।রোহন পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মীরার পেটে মুখ গুজে চুপচাপ পরে রইলো। তার এমন আচমকা আক্রমণের দরুণ মীরার শ্বাস আটকে রইলো কতক্ষণ। তবে একটু পরেই সে স্বাভাবিক রুপে ফিরে এলো।রোহনের এই কাজ নতুন নয়।অতিরিক্ত স্ট্রেস বা চাপে থাকলে সে ইদানীং এই কাজ করছে।
মীরার হাত চলছে রোহনের চুলের ভাঁজে ভাঁজে। রোহন চোখ বুঁজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে।লোকটা কি কিছুক্ষণেই ঘুমিয়ে গেলো নাকি!মীরা মৃদু করে ডাকলো,
“কি হয়েছে? ”
রোহন তাকালো তার দিকে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দৃষ্টি। হাত উঁচু করে মীরার গালে ছোঁয়ালো।আরেক হাত দিয়ে কোমর শক্ত করে আঁকড়ে বলল,
“আমি খুব ক্লান্ত মীরু!”
কেমন যেনো নির্জীব শোনালো রোহনের কন্ঠ। মীরার বুক কেঁপে উঠলো ভয়ে।রোহন এবার অনুনয়ের সুরে বলল,
“আমায় কখনও ছেড়ে যাবে নাতো মীরু?”
রোহনের কথা শুনে চমকে উঠলো সে। এগুলো কি ধরনের কথা!
“ধরো জানতে পারলে কোনোদিন আমি কোনো অন্যায় করেছি,তবে কি তুমি আমায় ভুল বুঝবে?”
রোহনের চোখে স্পষ্ট কাতরতা। মীরা দ্বিধান্বিত হয়। কি এমন করেছে রোহন যে এভাবে তার কাছে বলছে?
মীরা তপ্ত শ্বাস ফেললো।রোহন এখনও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে।মীরা ঝুঁকে এলো তার দিকে। দুচোখের পাতা ঝাপটিয়ে বলল,
“আমি মানুষটা একান্তই তোমার। তা কী বিশ্বাস হয় না?”
রোহন তার শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ালো মীরার কপালে।
“তুমি আমাকে খুবই অসহায় করে ফেলেছো মীরা। আমার প্রতিটা চিন্তা ভাবনা কেনো তোমার মাঝেই শুরু হয় আর তোমার মাঝেই শেষ? আমি কি তোমার আসক্তিতে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি? ”
রোহনের এমন কথার বিপরীতে মীরা কিছুই বলতে পারলো না।বরং লজ্জা পেলো,ভীষণ লজ্জা পেলো।তার লজ্জা আরক্ত কোমল গালে টুপ করে একটা চুমু খেলো রোহন।নিজের বুকে একটা হাত ঠেকিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,
“তোমার এই লজ্জা রাঙা মুখও আমায় আহত করেছে ভীষণভাবে।তুমি কি আমার প্রাণ হরণ করতে চাও,আমার প্রাণেশ্বরী?”
মীরা এবার আর টিকতে পারলো না।লোকটা হয়তো আজ তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে।রোহনকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে ছুটে চলে আসে বাইরে।মীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝংকার তুলে রোহন।
বিছানা থেকে নেমে এসে মীরার ফোনটা হাতে নেয়।দরজার দিকে খুব সাবধানে নজর বুলায়।তারপর ফোনের কন্ট্যাক লিস্ট থেকে মীরার নাম্বারটাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দেয়।তার সাথে সাথে সকল আননোন নাম্বারগুলোকেও ব্লক করে দেয়। যেনো কোনো আননোন নাম্বার থেকে কেউ মীরার সাথে যোগাযোগ করতে না পারে।সব শেষে ঋজুর নাম্বারটাকেও ব্লক লিস্টে ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রোহন।এবার আর মীরার সত্যিটা জানার কোনো উপায় রইলো না।
৬.
“মানুষ এতোটা নিচু মন মানসিকতার হতে পারে তা তোমাকে না দেখলে সত্যিই জানতে পারতাম না,নীরা।”
কথাগুলো বলে প্রচন্ড রাগে দপ করে জ্বলে উঠলো ঋজু।হাতের ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে আবার বলল,
“ছিঃ নীরা! তোমার এতোটা অধঃপতন হবে তা আমি ভাবতে পারিনি।তুমি কিনা এবার মীরার সংসার ভাঙতে উঠে পড়ে লেগেছো!আমার ভাবতে খুবই ঘৃণা হয় তোমার মতো একটা মেয়ে আমার ওয়াইফ।”
“তোমাকে কে বলেছিলো আমায় বিয়ে করতে?আমি তো ভালো ছিলাম। সেদিন আমার বিয়েটা হয়ে গেলে আজ আমি রাজরাণীর হালে জীবন কাটাতাম।তুমি আর মীরা আমার জীবনটাকে শেষ করে দিলে।”
“চুপ! একদম চুপ! এতোই যখন রাণীরা হালে জীবন কাটাতে চাও তো আমার সাথে প্রেম করেছিলে কেনো?তুমি তো সবই জানতে নীরা।আমি সামান্য বেতনের একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি।”
“ভুল করেছি। জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা করেছি আমি তোমার সাথে প্রেম করে।যেখানে মীরা হাজব্যান্ডের কিনা নিজস্ব বিজনেস রয়েছে,সাথে নিজের বাড়ি গাড়ি।সেখানে তুমি একটা সামান্য কোম্পানির এমপ্লয়ি। ”
নীরার কথায় আহত হয় ঋজু।সে তো এই মেয়েটাকে ভালোবাসতো।তাই তো তার শত অন্যায়ের পরও তাকে ছাড়তে পারে না।তবুও গলার স্বরের পারদ খানিকটা উঁচু করেই বলে,
“ভুল যখন করেছো তো তার মাশুল তো দিতেই হবে।তবে সাবধান! মীরাকে একদম এসবের মাঝে জড়াবে না।মীরা এই বিষয়ে কিছুই জানে না।যা করার সব আমি করেছি।”
নীরার নিজের রাগটা চেপে বসে রইলো গুম হয়ে। এক সময় তার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। কেনো?কেনো সবসময় তার সাথেই এমন হয়!সে কেনো সবসময় মীরার কাছে হেরে যায়।সবার কাছে মীরা কেনো এতো ভালো!
নিজের দোষটা তার নজরে পরে না।সে তো শুধু একটা সুন্দর জীবন চেয়েছিলো।হোক না সেটা কাউকে ঠকিয়ে!
এই পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ মানুষটার জীবনেরও একটা আলাদা গল্প রয়েছে। যে গল্পে সেই মূখ্য চরিত্র। সে চায় যেনো সব ভালো ঘটনা তাকে ঘিরেই আবর্তিত হোক।কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়?
.
রাতের খাওয়ার পর বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো রোহন। মীরা ঘরে ঢুকেই চট করে ল্যাপটপটা তার সামনে থেকে কেড়ে নিয়ে সূঁচালো দৃষ্টিতে রোহনের দিকে তাকায়।
“হোয়াট ইজ দিস মীরা?আমি কাজ করছি তো।”
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে রোহন।মীরা সাধারণত তার কাজের মাঝে কোনো রকম ইন্টারফেয়ার করে না।মীরা ল্যাপটপটাকে সাইড টেবিলের উপর রেখে দু হাত ভাঁজ করে সরাসরি রোহনের দিকে তাকালো।এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“তোমার না ক্লান্ত লাগছিলো?এখন এতো রাত জেগে কাজ কেনো করছো?”
রোহন অসহায় ভাবে বলে,
“আরে,ওটা তো মানসিক ক্লান্তির কথা বলছিলাম। আর এমনিতেও তোমার কাছে এলেই আমার ক্লান্তি কেটে যায়। এখন দাও তো ওটা।কাজ আছে আমার। ”
“কেনো?আপনার কি আমাকে ক্লান্তি রিমুভার মনে হয়? এখন কোনো কাজ নয়।সোজা ঘুম।”
এই বলে মীরা লাইট অফ করে বিছানায় এসে বসে পরলো।মীরার রাগী মুখ দেখে রোহনও চুপচাপ শুয়ে পরলো।মনে মনে ভাবলো,ব্যাপার কী?
রোহন চুপচাপ নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো।মীরা তার হাতের উপর মাথা রেখে গুম হয়ে শুয়ে রইলো।অন্য হাত দিয়ে মীরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়ো।জানো মীরা আমার না খুব ইচ্ছে প্রতিদিন কালো শাড়িতে তোমায় দেখা।জানো কালো শাড়িতে না তোমায় অপূর্ব লাগে।আমি তো চোখই ফেরাতে পারছিলাম না তোমায় দেখে।”
আস্তে আস্তে হালকা হয়ে এলো রোহনের গলার স্বর।মীরা বুঝলো রোহন ঘুমিয়ে গেছে।সে লজ্জায় রোহনের বুকে মুখ গুঁজলো।কিছু একটা মনে হওয়ায় মীরা চকিতে চোখ মেলে তাকালো।মীরা মনে পড়লো।বিয়ের এই ছয় মাসে তো সে কোনো কালো শাড়ি পরেনি।ইনফ্যাক্ট সে লাস্ট দশ/এগারো মাস আগে শাড়ি পরেছিলো ইউনিভার্সিটির ফাংশনে।হ্যাঁ,সেটা কালো শাড়িই ছিলো।কিন্তু সেটা রোহন কিভাবে দেখলো?আর দেখলেও মনে কেনো রাখলো!
চলবে…