#মীরার সংসার
#তিথি সরকার
#পর্ব-১
ফুলশয্যার খাটে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে মীরা।মনে একরাশ ভয়। সাথে মাথায় আসছে নানান উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা। বড়ো বোনের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া পাত্রের সাথে ঘটনাক্রমে নিজের বিয়ে হয়ে যাওয়ার স্মৃতিটা নিশ্চয়ই খুবই সুখকর নয়।মানে,জীবনটা কি তার পুরোই সিনেমা নাকি?বর্তমানে তার মনে চাইছে নীরা মানে তার বোনকে ধরে দুই গালে দুইটা ঠাস ঠাস করে চড় মারতে।বেয়াদবের আছাড়ি!তুই বিয়ে করবি না সেটা তো বাবাকে বললেই হতো।না,তিনি তার গর্ধভের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিয়ের আগের দিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।আর বলির পাঠা বানানো হয়েছে তাকে।ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সে।
যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে,এখন পর্যন্ত কোনোরকমে কথাবার্তা হয়নি তার সাথে। কে জানে মানুষটা কেমন হবে?যদি তাকে মেনে না নেয়?যদি নাটক সিনেমা মতো নকড়া করে?তখন কি হবে?এই চিন্তায় মাথাটা কয়েকবার চক্কর দিয়ে ওঠে মীরার। অবশ্য যে পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে!
*বিয়ের দিন*
“বিয়ের আসর থেকে বউ পালিয়েছে।ঘটনা তো এই,তাই না?”
বিরক্তির সাথে বলে উঠলো রোহন।
“আরে, এরা কারা?কোথা থেকে আসে এরা?বিয়ে করবি না তো রাজি হোস কেনো?আর বাঙ্গালি মা-বাবাদেরও আক্কেল! জানবে যে মেয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করে তবুও জোর করে ধরে বিয়ে দিতে চায়।আর উপায় না পেয়ে মেয়ে পালায় বিয়ের দিন।মাঝখান থেকে আমার মতো সুশীল – ভদ্র ছেলেদের মানসম্মান নষ্ট হয়।”
মেজাজ বিগড়ে আছে রোহনের খুব।বিয়ের আসরে এসে শোনে বউ পালিয়েছে। পাশ থেকে তার মামা বলে,
“আরে ভাগ্নে,ব্যাপার সেটা না।সবাই ভাবছে বউকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।কারণ মেয়ের তো মত ছিলো বিয়েতে।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে নাকি খুব খুশিই ছিলো।সবকিছু খুব আগ্রহের সাথেই করেছে।তো এই মেয়ে পালায় কি করে?”
“বুঝলে না?সব হলো অভিনয়। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।এখন চলো সব বরযাত্রী নিয়ে।এই বাড়িতে আর এক মূহুর্ত নয়।”
“একি বলো ভাগ্নে!বউ না নিয়ে বাড়ি ফিরি কি করে?দিদি আমার হাতে তোমার দায়িত্ব দিয়ে বলেছে যেনো বউ নিয়েই বাড়ি ফিরি।”
“তো এখন কি দোকান থেকে বউ কিনে নিয়ে যাবো নাকি?ধ্যাত!মায়ের কথায় রাজি হয়ে আমার সাতদিনের গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করে বিয়ে করতে এসে ছিলাম।নিশ্চয়ই ওর অভিশাপ লেগেছে আমার বিয়েতে।”
দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে রোহন।এমন সময় মেয়ের বাবা নিখিল বাবু করজোড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। তার মুখ লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আছে। তাকে দেখে রোহনের মামা বলে উঠে,
“এসব কি শুনছি মশাই!মেয়ে নাকি পালিয়েছে? তো এখন বিয়েটা হবে কি করে?এগুলো কোনধরনের প্রতারণা করলেন আমাদের সাথে? ”
“দাদা,আপনিই বলুন আমি কি জানতাম যে আমার মেয়ে এভাবে মুখে চুন কালি লেপে দিয়ে পালিয়ে যাবে?তাহলে আমি প্রতারণাটা করলাম কিভাবে? আমার অবস্থাটা একবার বুঝুন।বিয়ের আসর থেকে মেয়ে পালিয়ে গেছে। এটা কতটা অসম্মানজনক আমার কাছে।”
“তা তো বুঝতেই পারছি মশাই।এখন কি করণীয় সেটাই তো ভাবতে হবে।’
” আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তো বিয়ের কাজটা আমার মেজো মেয়ের সাথে সেড়ে ফেললে কেমন হয়?”
নিখিলবাবুর এই কথা শুনে যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো রোহনের মাথায়। মানে কি! এটা কি বাংলা সিরিয়াল নাকি?যে এক মেয়ে পালিয়ে গেলে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে?
এর মাঝেই তার মামা বলল,
“দেখুন মশাই,বিয়ে তো আর ছেলে খেলা নয়।মেয়ে তো আর বাজারের কোনো পণ্য নয় যে একটা না পেলে আরেকটা নিয়ে যাবো।”
“দেখুন, বিয়ের দিন আমার মেয়ে পালিয়ে গেছে। এটা আমার জন্য চরম অসম্মানের।আর আপনারাও যদি বউ না নিয়ে বাড়ি ফেরেন তো সেটা আপনাদের জন্যও লজ্জাজনক। তাই বলছিলাম কি,আমার মেজো মেয়েও বিয়ের উপযোগীই।চিন্তা ভাবনা ছিলো বড়োটার পর এই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার।এখন এই বিপদের মুহূর্তে এটাই কি ভালো সিদ্ধান্ত হবে না?”
নিখিল বাবুর কথা শুনে মাথা দোলালেন রোহনের মামা।
“কথাটা আপনি মন্দ বলেননি।মান-সম্মান বাঁচানোর এই একটাই রাস্তা। তাহলে আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ”
মামার কথা শুনে করুণভাবে বলে ওঠে রোহন,
“মামা তুমিও!এটা কি বিয়ে না বাংলা সিরিয়াল? জীবন সাথি না মরণ হাতি কি যেনো একটা আছে না?তেমন বানিয়ে ফেলছো কেনো তোমরা আমার জীবনটাকে?”
“আহ্,ভাগনে!এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই। বিয়েটা আগে হয়ে যেতে দাও পরে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। ”
তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রোহনকে বর বেশে ছাদনা তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হলো।যখন কনের মুখ থেকে পান পাতা সরানো হলো তখন সে ভালোভাবে দৃষ্টি দিলো তার সামনে বিরাজমান কন্যাটির দিকে।গায়ে একটা হালকা বেনারসি শাড়ি জড়ানো,গায়ে গুটিকয়েক গয়না।মুখে কোনো সাজ নেই।তবে অতিরিক্ত কান্না করার ফলেই হয়তো চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। পুরো বিয়ের সময়টা এবং বিয়ে শেষ হয়ে যাবার পরও দুজনের কেউই কারো সাথে কোনো কথা বলে নি।
রোহনের মীরাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।কেননা,তার কাছে নীরাও যা মীরাও তাই।কারণ, সে এই মুহূর্তে বিয়েই করতে চাইছিলো না।পাত্রী সম্পূর্ণ তার মায়ের পছন্দ। তাই এখন বদলে যাওয়া কনেকে দেখে তার মায়ের কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটাই ভাবচ্ছে রোহনকে।
বাড়ি এসে বরণের সময় কোনো রকম চোটপাটের মাঝে পরতে হয় না নতুন বর- বউকে।কেননা,বরযাত্রীরা রাতে এসেই রোহনের মায়ের কানে বউ ভেগে যাওয়ার খবরটা তুলে দিয়েছে।
প্রমিলা দেবী অর্থাৎ রোহনের মা, কতক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলেছে,
“বেশ করেছে ছোট বোনকে বিয়ে করেছে!কতো বড় বেহায়া ওই মেয়ে, যে কিনা আমার ছেলের মতো সোনার টুকরো ছেলেকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। ”
তিনি বেশ আনন্দের সঙ্গেই ছেলের বউকে বরণ করেছেন।তবে বরণের সময় নতুন বউকে এই বলে শাসিয়েছেন যে,সে যদি একটুও উল্টাপাল্টা করে তো তাকে ঘাড় ধরে বাপের বাড়ি রেখে আসবেন।
এই কথা শোনার পর থেকেই মীরা সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঢোক গিলছে।
২.
প্রায় মাঝরাতে ঘরে প্রবেশ করে এক দীর্ঘাকায় পুরুষ। তার ছায়া দেখেই মীরা বুঝতে পারে যে এটাই ওর স্বামী। যার সাথে পরশুদিন সাত পাকের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।এবার এই বেটা এসে নিশ্চয়ই সিনেমার ডায়লগ ছাড়বে।তাকে কি গল্পের মতো করে সোফায় শুতে বলবে?কিন্তু এই রুমে তো কোনো সোফা দেখতে পাচ্ছে না সে।তবে কি তাকে মাটিতে শুতে বলবে?বলবে যে আপনাকে আমি মেনে নিতে পারবো না,হজংভজং,ভুংভাং!
“দেখো মীরা!তুমি.. ..
” আপনি কি বলতে চাইছেন আমি জানি। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন দিদির বদলে আমায় আপনি বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবেন না। আপনি বলবেন যে চাপে পরে আপনি এই বিয়ে করছেন।এখন কি আপনি আমায় আলাদা জায়গায় শুতে বলবেন?আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি বলুন আমি কোথায় ঘুমুবো।”
মীরার একদমে বলা কথা গুলো শুনে বেক্কল হয়ে গেলো রোহন।কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বেশ জোরেই ধমকে উঠলো সে,
“এসব আজগুবি চিন্তাভাবনা কোথা থেকে এসেছে তোমার মাথায়?এসব উদ্ভট কথা কোথায় শুনেছো তুমি। ”
“গল্পে। আমি গল্পে পড়েছি। জোর করে বিয়ে দিলে বর প্রথম দিন এসব কথা বলে।”
মীরার এই কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে রোহন,
“এসব উদ্ভট গল্প কোথায় পাও তুমি? ”
“ফেসবুকে। আমি ফেসবুকে পড়েছি।”
রোহন বুঝলো যে এমন হঠাৎ হয়ে যাওয়া বিয়ের শকটা ঠিক নিতে পারে নি মীরা। তাই এসব উদ্ভট কথাবার্তা বলছে।সে আলতো করে মীরার হাতটা ধরে তাকে বিছানায় বসায়।একটা ছোট শ্বাস ফেলে বলে,
“দেখো মীরা।মানুষের জীবন কোনো গল্প, উপন্যাস নয়।যদিও আমাদের জীবনে যেটা হয়েছে তা কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম নয়।আর এমন কোনো ব্যাপার নয় যে আমি তোমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিনা।কেননা,তুমি হয়তো জানো বিয়ের আগে আমি তোমার বোনকে দেখিনি।আমার মায়ের পছন্দের উপরই ভরসা করেছিলাম আমি। তাই আমার কাছে, নীরা,তোমার বোনের নাম নীরা তাই তো।আমার কাছে নীরাও যা মীরাও তাই। আমি মূলত বিয়েটাই করতে চাইছিলাম না।তাই তোমার বোন পালানোতে বেশ খুশিই হয়েছিলাম আমি। কিন্তু বিয়ের মন্ডপে তোমায় দেখে বুঝলেন, বিয়েটা না করলে আমি বিরাট কিছু মিস করতাম।আচ্ছা, তোমাকে কি জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে? মানে তোমার কি এই বিয়েতে মত ছিলো না?দেখলাম বিয়ের দিন কেঁদে কেটে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছিলে তুমি।
রোহনের কথা শুনে পিটপিটিয়ে চাইলো ওর দিকে। বলল,
” বড়ো বোনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা পাত্রের সাথে আপনার বিয়ে হবে।এটা শুনে আপনি নিশ্চয়ই খুশিতে ঢেং ঢেং করতেন না?
রোহন ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে।
“ওহ,এই কথা।আমি আরও ভাবলাম, প্রেমিককে ছেড়ে বিয়ে করতে হচ্ছে বলে কেঁদে কেটে সাগর-নদী বানাচ্ছো তুমি। ”
মীরার কপাল কুঁচকে এলো।চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“প্রেমিক নামক কোনো বস্তু আমার জীবনে কখনও ছিলো না। ”
“তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর।তোমার মতো একটা সুন্দর বউ মিস করে যেতাম আমি। এইজন্য তো তোমার বোনকে একটা থ্যাংকস দিতে হচ্ছে। পালিয়ে ভালোই করেছেন উনি।”
হঠাৎ লোডশেডিং এ অন্ধকার হয়ে গেলো পুরো রুম।বিছানায় পা গুটিয়ে শুয়ে পড়লো মীরা।একটু পর সে তার ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাসের উত্তাপ টের পেলো সে।তার কোমর আঁকড়ে ধরলো শক্ত পুরুষালী হাত।
মীরা আস্তে করে বললো,
“কম্বলটা কোথায় গেলো?ঘুমালে আমার জামা কাপড় ঠিক থাকে না।”
রোহন তার গলায় মুখ গুজেই বললো,
“না থাকুক ঠিক। এভাবেই ঘুমাও।”
গভীর রাত।দুজন নর-নারীর নিঃশ্বাসে আশপাশ ভারী হয়ে আছে।ঠিক এমন সময় মীরার ফোনে টুং করে মেসেজ টোন বাজলো।
“নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা। তোমার বোন ভালোই আছে। তবে এখনও কিছু চোটপাট করছে।বশে আনতে বেশি সময় লাগবে না।রোহন এখন থেকে শুধুই তোমার। ”
মেসেজটা দেখে ঠোঁট কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠে মীরার মুখে।
চলবে…