Body shaming পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধ। আর দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে এর শুরুটা হয় পরিবার থেকেই। কিছু পরিবার, কিছু বাবা মা, আত্মীয় স্বজন আছেন যারা এক দু বছরের বাচ্চার গায়ের রঙ, চুলের পরিমান, উচ্চতা, দাঁত, ঠোঁট, চোখ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাচ্চার সামনেই এসব আলোচনা করতে থাকেন। একবারও ভাবেন না এর কতটা খারাপ প্রভাব পড়ে ঐ শিশুটির মানসিক গঠনে। সারাজীবন ঐ শিশুটি শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির ভাবনাতে আটকে পরে যায় আপনাদের ভুল চিন্তা ভাবনার খেসারত দিতে যেয়ে। আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে সে।
আমার আব্বু আম্মু কোনোদিনও আমরা বোনেরা কে কালো কে ফর্সা, কে লম্বা কে খাটো এসব নিয়ে কথা বলেনি। মানবিক হতে বলতো। আমাদের ছোটবেলাতে বড়দের সম্মান করতে শেখাত। মুরুব্বিদের দেখলে সালাম দিতে হয়। দাঁড়িয়ে যেতে হয়। বড়দের মধ্যে কথা বলতে হয়না। এসব শিখিয়েছে। কষে লেখাপড়া করতে বলতো। আল্লাহকে বিশ্বাস করতে বলেছে। এগুলোই ছিল আমাদের বাল্যশিক্ষাতে। এমনকি আব্বু আম্মুর সাথে সম্পর্ক ভালো না এমন কোন আত্মীয়কেও যদি ঠিকমতো সালাম না দিতাম বাসায় ফিরে আম্মুর “স্পেশ্যাল ছ্যাঁচা মাইসিন” খেতাম। ভুলটা যেই বোনই করি না কেন মাইর পাঁচ জনকেই খেতে হতো। যাতে জীবনে বেয়াদবী করার সাহস কেউ করতে না পারি। বাল্যশিক্ষা প্রতিটি মানুষের জীবনে অত্যন্ত জরুরী। তখন আম্মুর উপর রাগ লাগলেও এখন বুঝি বাল্যশিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের জীবনে।
খালি স্পার্ম আর ওভাম ডেলিভারি দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেললে তো হবে না। মা বাবা হতে হলে এফোর্ড দিতে হবে। টাকা দিয়ে না। সময় দিয়ে। আদর, শাসন,নৈতিকতা, মূল্যবোধ নিজে করে শেখাতে হবে সন্তানকে।
আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি তখন সদ্য মা হয়েছি। আমার উচ্চতা কম, গায়ের রঙ কালো। আমার সন্তানের biological father এর চৌদ্দ গোষ্ঠীর সবাই আবার বিশাল লম্বা আর সাদা চামড়ার অধিকারী। পুরো প্রেগন্যান্সী পিরিয়ডে এই মানুষগুলো আমাকে পাগল বানাতে বাকি রেখেছিল বাচ্চার গায়ের রঙ আর উচ্চতার ইস্যু নিয়ে। আমি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকি। খাওয়ার, ঘুমের সমস্যা। তারমধ্যে প্রেগন্যান্সীর কমপ্লিকেশন তো আছেই। তাছাড়া মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার উপরেই থাকতে হয়। আইটেম ক্লিয়ার করব, প্রফে সাপ্লি খাব এসব ভাবব ? নাকি পেটের ভেতরে বেড়ে ওঠা বাচ্চা সাদা হবে না কালো, লম্বা না খাটো এসব ভাবা কি সম্ভব কোন হবু মায়ের পক্ষে? আমি তো শুধু এটাই ভাবতাম যে ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে আছি বাচ্চাটা সুস্হ হবে তো ? অথচ একজন শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার থেকেও তাদের কাছে জরুরী ছিল সাদা চামড়া, উচ্চতা এবং অবশ্যই ছেলে বাচ্চা। তো বাবু হবার পর তারা সবাই যেন 32 সপ্তাহ ধরে আটকে রাখা দমটা ফেলল। যাক বাবা বাচ্চা প্রত্যাশার থেকেও সাদা চামড়া নিয়ে জন্মেছে। বিশ্বাস করেন ওটি টেবিলে মানুষের মতো দেখতে জানোয়ারগুলোকে মনে মনে গালি দিয়েছিলাম — মনের রঙ যেন তোদের মত না হয় আমার সন্তানের।
জোরে দিতে পারলে ভালো হতো। পরে বলে দিতে পারতাম প্যাথেড্রিনের প্রভাবে ভুলভাল বকেছি ?। কেন যে তখন আমি এত ভীতু ছিলাম ?
এরপর বাবুর বয়স যখন পাঁচ ছয় মাস হতে শুরু করল তাদের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে উঠলো বাবুর উচ্চতা। এক বছর যখন হলো আমার মাথা নষ্ট করে ফেলল। যে এই ছেলে তো মায়ের মত খাটো হবে। ঐ সময়ে আমি তো এখনকার আমি ছিলাম না। বোকা আর সরল ছিলাম। আমার মনে আছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বসে বসে কাঁদতাম। একবার মন চাইল বাবুকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। যেখানে কেউ বলবে না ছেলে তো মায়ের মত খাটো!!!! ভাবতে পারেন তখন আমার ছেলের বয়স মাত্র এক কি দেড় বছর!
এই আমি শিশু বিশেষজ্ঞ দুজন স্যার আর ম্যামের মাথা আউলাইয়া দিয়েছিলাম। বারবার যেতাম তাদের কাছে। কত যে বিরক্ত করেছি বোকা বোকা সব প্রশ্ন করে। ম্যাম কত বুঝিয়েছেন আমাকে।
স্যার ম্যাম দুজনেই চমকে গেছিলেন একটা সুস্হ বাচ্চাকে নিয়ে তার মা যে নিজে মেডিকেল স্টুডেন্ট, ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছে বাচ্চা ভবিষ্যতে লম্বা হবে না খাটো হবে তা জানার জন্য।
স্যার একটা মজার কাজ করেছিলেন। বললেন সেকেন্ড ভিজিটে অবশ্যই পিতাকে আসতে হবে। তো পিতা যখন গেলেন স্যার বললেন— বাংলাদেশি পুরুষ হিসেবে আপনার হাইট তো মাঝারি ধরনের। আপনার পুত্র যদি শর্ট হয় তারজন্য আপনার জিনও দায়ী হবে। এই বাচ্চা সম্পূর্ণ সুস্থ । অযথা এত টেষ্ট ( পুত্রের বায়োলজিক্যাল aunt in law চিকিৎসক ছিলেন। তিনি লম্বা লিষ্ট লিখে দিয়েছিলেন টেষ্ট করতে। জানার জন্য আহু আসলেই খাটো হবে কিনা বড় হলে।) করানোর কোন মানে হয় না । আর বাচ্চাটার মা’টাকে এভাবে মানসিক টর্চার প্লিজ করবেন না। ও বাংলাদেশী মেয়ে হিসেবে সঠিক হাইট ই ক্যারি করছে। তারপরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হয়েছে আমাকে বাবুর । সব রিপোর্ট ওকে এসেছিল। তখন ডাক্তার বাংলাতে প্রেসক্রিপশন প্যাডে লিখে দিয়েছিলেন — বেবী আহ্ নাফ, son of
মিম্ মি (ভবিষ্যত ডাক্তার) একজন সুস্হ বাচ্চা। তার বয়সের সাথে শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত চিন্তিত হবার কিছু নেই।
ঐদিন খুব কেঁদেছিলাম আমি মেডিনোভার ওয়েটিং রুমে বসে একগাদা লোকের সামনে। ডাক্তার হতেই হবে আরো শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ঐদিন। পালাব না। পরিচিত জনেদের মাঝেই থাকব। দেখি যদি আমার ছেলে খাটোও হয় সমাজের তাতে কি কমতি ঘটে যায়।
আমার ছেলে এখন গ্রেড সেভেনে পড়ে। এখনো অনেকেই ওকে বলে হাইট নিয়ে। মন খারাপ করে মাঝেমধ্যে সে । আমি বলি —- বাবা খাটো হলে হবা। তুমি মায়ের ছেলে। মায়ের মতো হতে চাও বল না সব সময় ? আর দেখ আমাদের প্রিয় মুশফিকুর রহমান, মিরাজ, শ্রদ্ধেয় ডাক্তার দীন মোহাম্মদ স্যার, শচীন টেন্ডুলকার, বিল গেটস, স্টিফেন হকিংস, ম্যারাডোনা, আমির খান, সালমান খান কত শত গুণী মানুষ উচ্চতায় কম। তাতে কি ? কাজে তারা বড় হয়েছেন । তুমিও সেই চেষ্টা কর।
তোমার মা’ও তো খাটো তাতে কি আমি পচা মা হয়েছি বল ? পচা ডাক্তার হয়েছি ? পচা সন্তান, বোন হয়েছি বল ?
পুত্র পিটপিট চোখে মা ‘কে দেখে আর বলে আমার পিচ্চু মা’ই বেষ্ট, অনলি ওয়ান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড