#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____৫ (শেষ পর্ব)
‘আমি পিশাচ। পিশাচ মিত্রাভান থানোস।’
বলে লোকটা হা হা করে হাসতে লাগল। র ক্ত হিম করা সে হাসির শব্দ। ভয়ে নিতুর গায়ের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। সে এসব কী শুনছে? এই পৃথিবীতে পিশাচের কোনো অস্তিত্ব আছে? থাকার কথা নয়! সে এ ব্যাপারে কোনোদিন কিছু শুনেনি। আবার চোখের সামনে যা দেখছে সেটা অবিশ্বাস করে কী করে? তার সামনে থাকা লোকটি কি সত্যি সত্যি পিশাচ?
নিতু আর ভাবতে পারছে না। এক লহমায় এতোদিনের সমস্ত ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেল যেন। শিহাবের মাঝরাতে উধাও হওয়া, হঠাৎ আবার ভূতের মতো উদয় হওয়া, তার শব্দহীন চলাফেরা। সমস্ত কিছু মনে পড়ল নিতুর। তার আরো আগে বোঝা উচিত ছিল। এসব কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এখন সে কী করবে? কীভাবে এই পিশাচের হাত থেকে রক্ষা পাবে!
নিতুর মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শিহাব কোথায়? তার স্বামী শিহাব! তাকে কি লোকটা মে রে ফেলেছে? সে থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে পেছাতে লাগল। মিত্রাভান ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। নিতুকে স্পর্শ করার আগেই নিতু মেঝেতে ঢলে পড়ল। জ্ঞান হারাল।
______
নিতুর যখন জ্ঞান ফিরল তখন মধ্যরাত। চোখ খুলে বুঝতে পারল না, সে কোথায় আছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শরীরের তলায় শক্ত মাটি মনে হচ্ছে। সে হাতড়ে বুঝতে পারল সত্যি মাটি। ঘাস, লতাপাতার মধ্যে সে শুয়ে আছে। পিঠের নিচে মরা ডাল পড়েছে হয়তো। ব্যথা করছে। সে চোখ ডলে আশপাশটা ভালোমতো খেয়াল করল। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে কিংকর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। শরীর হিম হয়ে এলো।
সে ঘন জঙ্গলের মাঝে শুয়ে আসে। একা! সম্পুর্ণ একা!
নিতু উঠে বসল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হচ্ছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে। খানিক আগে সে পাশের রুমে যা যা ঘটতে দেখেছিল সব সত্যি? সত্যিই কি সে এতোদিন একজন পিশাচের সাথে সংসার করেছিল? আবারো শিহাবের কথা মনে পড়ল তার। শিহাব কোথায়? তার শিহাবকে কি ঐ পিশাচটা মে রে ফেলেছে? নিতু কেঁদে ফেলল।
শুকনো গলায় কয়েকবার শিহাব শিহাব করে ডাকল। কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। মাথার উপর উঁচু উঁচু গাছপালা। পায়ের নিচে ছোট ছোট ঘাস। সেগুলো মাড়িয়ে নিতু এগিয়ে চলল। তাকে যে করেই হোক এই জঙ্গল থেকে বের হতে হবে। তাকে পালাতে হবে। ওই পিশাচের হাত থেকে বাঁচতে হবে।
নিতুর খালি পা। কয়েক পা এগোতে কাঁটা ফুটে গেল। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সে। পরক্ষণে নিজের মুখ চেপে ধরল। এই গহীন জঙ্গলে নিশ্চয়ই অনেক হিং স্র জন্তু আছে। যখন তখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সে সতর্ক ছুটে চলল।
কিছুদূর এগোতে খোলা জায়গা চোখে পড়ল। অনেকটা মাঠের মতো। গাছপালা কম। নেই বললেই চলে। সে এগিয়ে গেল। পায়ের তলায় নরম ঘাস। শেষরাতের শিশির পড়ে আর্দ্র হয়ে আছে। মাঠের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদ। ফকফকা জোসনা। চাঁদের আলোয় এদিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিতুর হঠাৎ কেমন ঘোর লাগল। মনে হলো, এসব কিছু তার স্বপ্নে ঘটছে। খানিক বাদে তার ঘুম ভাঙ্গবে। শিহাব তাকে জাগিয়ে তুলবে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আদর করবে, ভালোবাসবে।
সময় পেরিয়ে যেতে লাগল। তার কিছুই হলো না। নিতু বেশ বুঝতে পারছে, এসব কোনো স্বপ্ন নয়। বরং ঐ পিশাচটা এতোদিন তাকে ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। মিথ্যে মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছিল। আজ সব মায়াজাল ছিন্ন হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে অনেকগুলো পশুর গর্জন কানে ভেসে এলো। চেনা শব্দ। এর আগে শুনেছে। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাল। তখন পাখির মতো কিছু একটা উড়ে এলো। তার খুব কাছাকাছি এসে থেমে গেল। নিতু কিছু বুঝে উঠার আগে সেটা একটা পুরুষ অবয়বে রূপ নিল।
নিতু ভয়ে ঢোক গিলে। কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কোনরকমে উচ্চারণ করল,
‘মিত্রাভান!’
মিত্রাভানকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। দুচোখ থেকে আগুন ঠিকড়ে বের হচ্ছে। ঠোঁটে ক্রুর হাসি। হাসির ফলে তার সামনের র’ক্তমাখা দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়েছে। নিতু বুঝতে পারল তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই পিশাচ তাকে বাঁচতে দিবে না। তার চোখ জ্বলে উঠল। কন্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
‘শিহাব কোথায়?’
‘মেরে ফেলেছি।’
‘কতদিন হলো?’
‘এই জঙ্গলে আসার কয়েকদিন পরেই।’
নিতু শিউরে উঠল। এতগুলো দিন হলো শিহাব তার কাছে নেই। অথচ সে কিচ্ছু টের পায়নি। সে চিনতে পারেনি এই বহুরূপী পিশাচটাকে। নিজের উপর রাগ হলো তার। সেই সাথে ভেতরে চাপা ক্রোধ ফুটে উঠল। সে চেঁচিয়ে উঠল।
‘কেন করলে তুমি এমন? কেন আমাদের পিছু নিয়েছ? কেন শিহাবকে মেরে ফেলেছ? আমরা কী ক্ষতি করেছি তোমার?’
কোনো উত্তর নেই। শুধু ক্রুর হাসি। হাড় হিম করা হাসি। নিতুর সহ্য হলো না। সে ছুটে গিয়ে মিত্রাভানের গলা চেপে ধরল। হিতে বিপরীত হলো। পিশাচটা পিছিয়ে গেল। পরমুহুর্তে একহাতে নিতুর গলা চেপে ধরল। শূন্য থেকে কয়েক হাত উঁচু করে ফেলল। নিতুর চোখ বড়বড় হয়ে গেল। জিহ্বা বেরিয়ে এলো। বাঁচার জন্য ছটফট করতে লাগল সে। কয়েক মিনিট পর পিশাচটা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নিতু ছিটকে পড়ল। দূরে, বহুদূরে! গাছের গুঁড়ির সাথে লেগে মাথা ফেটে গেল। পেটে সুঁচালো কিছু একটা বিঁধল। ম রণ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
মাকে মনে পড়ল নিতুর। ক্ষীণ গলায় দু বার মা, মা করল। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ধীরে ধীরে চোখ বুঁজে আসছে। পেট দিয়ে গলগল করে র ক্ত পড়ছে। শরীর নেতিয়ে আসছে। নিতু খুব করে টের পাচ্ছে, সে মা রা যাচ্ছে! শরীরটা সামান্য নাড়িয়ে সে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের পানে তাকাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের নরম আলো তার চোখেমুখে এসে পড়ছে। চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিতুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। সে ক্ষীণ আওয়াজ তুলে উচ্চারণ করল,
‘মা!’
তারপরই মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
________
জঙ্গলের শতবর্ষী প্রাচীন এক বৃক্ষের ডালে বসে আছে মিত্রাভান। মৃদু বাতাসে তার চুল উড়ছে। গায়ের আলখাল্লা উড়ছে। তার চেহারা কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট। তাকে আবার কিছুদিন ছুটতে হবে। নতুন কোনো দম্পতি খুঁজতে হবে। তাকে আবার এই সংসার সংসার ছেলেখেলা শুরু করতে হবে। তবেই তার এই অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাবে।
-সমাপ্ত