মিত্রাভান থানোস পর্ব-০৪

0
4

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০৪

নিতু অবাক চোখে শিহাবের পানে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। এসব কী ঘটছে তার সাথে? কোনটা সঠিক? সে নিজের চোখে যা দেখেছে সেটা? নাকি শিহাব যা বলছে তাই? সে কি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে?

নিতু হাঁসফাঁস করতে লাগল। তার অস্থির লাগছে। খুব করে কান্না পাচ্ছে। এই দুঃসময়ে মায়ের মুখটা বার বার মনে পড়ছে। এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর ভালো লাগছে না। সে আর কথা বাড়াল না। নির্বিকারে বলল,

‘আমি এখন ঘুমাব। বসে থাকতে পারছি না।’

‘একটু অপেক্ষা করো। আমি খাবার নিয়ে আসছি। কিছু খেয়ে মেডিসিন খাও। তারপর ঘুমাও। কেমন?’

নিতু কোনো উত্তর দিল না। শিহাব উঠে গেল। পেছন থেকে তার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করল সে। গতকাল রাতে যেটা ঘটেছে সেটা এতো বেশি জীবন্ত যে স্বপ্ন হিসেবে মানতে পারছে না। আবার শিহাবকে অবিশ্বাস করে কী করে? মানুষটা যে তাকে চোখে হারায়। তার দুঃখে দুঃখ পায়। কষ্টে কষ্ট! সে তো মিথ্যে বলবে না।

নিতু আবার কাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। সে কখন শিহাবের জন্য ঘরের দরজা খুলে দিল? কিছুতেই মনে পড়ছে না।

খানিক বাদে প্লেটে খাবার নিয়ে শিহাব ঘরে ঢুকল। বিছানায় বসে বলল,

‘আমি খাইয়ে দেই?’

নিতু বাধা দিল। তার মস্তিষ্ক জুড়ে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শিহাবের থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে নিল। বলল,

‘আমি নিজে খেতে পারব।’

সে খাওয়া শুরু করল। ঢোক গেলার সময় গলায় ব্যথা অনুভূত হলো। এতটা ব্যথা যে তার চোখে জল চলে এলো। খাবার সব বিস্বাদ লাগছে। খেতে কষ্ট হচ্ছে। হলে হোক! শরীরের দূর্বলতা কাটানোর জন্য খাওয়া দরকার। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, সম্মুখে একটা যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। সেই যুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। নিতু জোর করে খাবার শেষ করল। তারপর ওষুধ খেল।

খাওয়া শেষ হতে শিহাব প্লেট গুছিয়ে রাখল। নিতুকে শুইয়ে দিয়ে বলল,

‘একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

‘আপনি আজ অফিসে যাননি?’

‘তুমি এতো অসুস্থ। আমি কী করে যাব?’

নিতু বেশ অবাক হলো। ক্ষণিকের জন্য হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মস্তিষ্কের চিন্তার বহর থামল। সে গাঢ় চোখে শিহাবের পানে তাকাল। কি নিষ্পাপ চাহনি মানুষটার। দুচোখে তার জন্য গভীর ভালোবাসা। এইসব ভালোবাসা যে মিথ্যে নয়। তবে কি নিতুর বুঝতে ভুল হচ্ছে? সত্যি সত্যি তার মাথায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে? সে কি ধীরে ধীরে লাগল হয়ে যাচ্ছে?

নিতু বেশি সময় নিল না। আবেগ মিশিয়ে বলল,

‘সরি।’

‘সরি? সরি কেন বলছ?’

‘এই যে আমার জন্য আজ কাজে যেতে পারলেন না।’

শিহাব হাসল। নিতু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। কী সুন্দর করে হাসে মানুষটা! তার স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিতু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এতদ্রুত ঘুমিয়ে পড়ল যেন কেউ সম্মোহন করে ঘুম এনে দিল।
________

মাঝে সপ্তাহখানেক চলে গেছে। নিতুর জ্বর ছেড়েছে। তবে শরীরের দূর্বলতা কাটেনি। সে আগের থেকে আরো শান্ত আর ধীর হয়ে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে একদম। চোখ-মুখ শুকিয়ে এমন হয়েছে যে নিজেকে দেখে হঠাৎ করে চেনা যায় না। সাথে ভয় বেড়ে গেছে। এখন দিনের বেলাতেও তার ভয়ংকর সব ভাবনা আসে। ভয় করে। সেদিনের দেখা অদ্ভুত প্রাণীটা আর দেখেনি সে। তবুও সারাক্ষণ চোখের সামনে কিসব ভাসতে থাকে। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ ভয় কাজ করে।

নিজেকে ঘরে বন্দি করে ফেলেছে নিতু। তার কিছু ভালো লাগে না। কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে না। কোনো কাজে মন বসে না। এই গভীর অরণ্য আর জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যাবে? আর শিহাবকে ছেড়ে কিভাবে যাবে? কোনো উপায় খুঁজে পায় না। আবার মনে শান্তি নাই। সারাক্ষণ অদৃশ্য কিছু একটা যেন তাকে তাড়া করে চলেছে।

আজ বৃহস্পতিবার। মাঝরাতে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘর অন্ধকার। পাশে হাতড়ে সে শিহাবকে খুঁজল। শিহাব বিছানায় নেই। নিতু তেমন অবাক হলো না। যেন সে জানে, এই সময় শিহাব ঘরে থাকবে না।

অন্ধকারে বড়ো বড়ো চোখে সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। হঠাৎ তার কানে শব্দ এলো। অনেকগুলো জন্তু যেন একত্রে ডাকছে। কেমন ঘড়ঘড় শব্দ। বিদঘুটে। কানে লাগছে। শব্দটা আসছে পাশের ঘর থেকে। নিতু অনেক সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পা টিপে টিপে সে এগিয়ে চলল। বসার ঘরে আসতে রহস্যময় আলো দেখতে পেল। রান্নাঘরের পাশের রুম থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিসের আলো এইটা? নিতু শব্দহীন ভাবে এগিয়ে গেল।

দরজা অল্প একটু ফাঁক হয়ে আছে। সেই ফাঁকটুকু দিয়ে নিতু ভেতরের দিকে তাকাল। ভেতরের দৃশ্য দেখে তার দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। বুক চিঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল। নিতু সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মুখ চেপে ধরল।

রুমের ভেতর শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে লাল আভা ঠিকড়ে বের হচ্ছে। তার সামনে সেদিনের দেখা অদ্ভুত প্রাণীটা। হঠাৎ প্রাণীটা মানুষের রূপ নিল। ভয়ংকর এক নারী মূর্তি। বেশভূষা অদ্ভুত। অন্যরকম!

‘তুমি নিতুকে আক্রমণ করেছ কেন? তোমাকে নিষেধ করেছি না?’

শিহাব রুক্ষ স্বরে তাকে প্রশ্ন করল। নারীমূর্তি বলল,

‘তুমি ওকে মে রে ফেলছ না কেন? আর কতদিন ওর সাথে সংসার করবে?’

‘আমার যতদিন মন চায়। খবরদার! তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলাবে না। ভুলে যেও না আমার পরিচয়।’

‘আমি তোমার পরিচয় ভুলিনি। তুমি ভুলে গেছো। তুমি মানুষের রূপ ধরে আর কতোদিন থাকবে? ফাদার গ্রেগরিস তোমার তলব করেছেন।’

‘তুমি এখন দূর হও।’

‘তার আগে বলো। এই মেয়েটিকে কবে মে রে ফেলবে? আমি আর অপেক্ষা করব না। যেকোনো সময় ওর শরীর থেকে সমস্ত র ক্ত শুষে নিব। ওকে মে রে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলব।’

হুট করে শিহাবের কি যেন হয়ে গেল। চোখের পলকে তার চেহারা পাল্টে গেল। অন্য এক পুরুষ অবয়ব দেখতে পেল নিতু। যে পুরুষ শিহাবের চেয়ে বলিষ্ঠ, লম্বা আর শক্তিশালী। যার চোখেমুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। প্রচন্ড রাগের কারণে তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তার এই রূপ দেখে নারীমূর্তি হেসে উঠল। সে হাসির শব্দে নিতু শিউরে উঠল। নারীমূর্তি বলল,

‘যাক! নিজের স্বরূপে ফিরেছ মিত্রাভান। মিত্রাভান থানোস। আমি তো তোমার আসল রূপটা ভুলে যেতে নিয়েছিলাম।’

নিতু বিড়বিড় করে নামটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করল। পারল না। দুর্বোধ্য ঠেকল। এরা কারা? কী হচ্ছে এসব তার চারপাশে? সে কি আবারো স্বপ্ন দেখছে? সামনে যা ঘটছে সব তার চোখের ভ্রম? মস্তিষ্কের সাজানো কল্পনা?

নিতু থরথর করে কাঁপতে থাকল। ততক্ষণে মিত্রাভান নামের লোকটা নারীমূর্তির গলা চেপে ধরেছে। চেঁচিয়ে বলছে,

‘আমাকে রাগাবে না লিলিথ। তার ফল ভালো হবে না। তোমাকে এই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে দু’বার ভাবব না কিন্তু। এক্ষুণি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।’

বলে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নারীমূর্তি খানিক দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। রাগান্বিত চোখে লোকটার দিকে তাকাল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিতু ভয় আর বিস্ময় নিয়ে সব দেখছে। এই লোকটা কি বহুরূপী কেউ? কখনো শিহাবের রূপ নিচ্ছে। কখনো আবার মিত্রাভান? তারমানে এতোদিন সে যা সন্দেহ করেছিল সব ঠিক। শিহাবকে নিয়ে বার বার যে খটকা লাগছিল সব ঠিক। শিহাব মানুষ নয়? অন্যকিছু? কিন্তু সেই অন্যকিছু কী?

নিতুর মুখ থেকে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো। শব্দ পেয়ে লোকটা দরজার দিকে তাকাল। মুহূর্তে একজোড়া লাল চোখের সাথে নিতুর দৃষ্টি বিনিময় হলো। ভয়ে সে চুপসে গেল। মুখ দিয়ে আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে গেল। ছুটে পালিয়ে যেতে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।

নিতুকে দেখে লোকটা অবাক হয়নি। বরং সাবলীলভাবে এগিয়ে আসছে। তবে তার চোখে-মুখের হিংস্র ভাব দূর হয়নি। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে নিতু ভয়ে পিছাচ্ছে। সে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কে তুমি?’

‘মিত্রাভান থানোস।’

‘তোমার পরিচয়?’

‘আমি পিশাচ। পিশাচ মিত্রাভান থানোস।’

বলে লোকটা হা হা করে হাসতে লাগল। রক্ত হিম করা সে হাসির শব্দ।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে