#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০৩
আজ সন্ধ্যা বয়ে গেল। তখনো শিহাব ফেরেনি। নিতু উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বার বার দৌঁড়ে গিয়ে পথ দেখছিল। কিন্তু শিহাবের ফেরার কোনো নাম-গন্ধ নেই। কয়েকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া গেল না।
ইদানিং একা বাসায় থাকতে তার ভয় ভয় করে। কিসের ভয় সে বুঝতে পারে না। কিন্তু প্রচন্ড ভয় করে। মনে হয় অদৃশ্য কিছু একটা তাকে সারাক্ষণ নজরে নজরে রাখছে। তাকে দেখছে। দিনের বেলাতে ভয় অবশ্য কিছুটা কম থাকে। তবে অন্ধকার নামলে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। কোথাও কোনো খুটখাট শব্দ হলে সে ভয়ানক চমকে উঠে। তারপর দীর্ঘ সময় বুক ধড়ফড় করে। সহজে থামে না।
সন্ধ্যার আগে আগে সবগুলো আলো জ্বালানো হয়েছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। মুহূর্তে পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকারে ডুবে গেল। নিতু বেশ ঘাবড়ে গেল। এই সময় তো কোনোদিন বিদ্যুৎ যায় না। সে নিজেকে শান্ত রেখে ফোনটা খুঁজল। ফোন হাতের কাছে ছিল। পেয়ে গেল দ্রুত। রান্নাঘরে মোমবাতি রাখা আছে। আলো জ্বালিয়ে সেগুলো বের করল। তিনটে মোমবাতি জ্বালিয়ে সে ঘরময় আলো ছড়ানোর চেষ্টা করল।
শোবার ঘরে মোমবাতি হাতে ঢুকল সে। তখুনি জিনিসটা প্রথম দেখল। বাদুড়ের মতো পাখাওয়ালা একটা প্রাণী। ঘরের জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে আছে। ক্ষণে ক্ষণে পাখা ঝাপটাচ্ছে। মুখটা পেঁচার মতো। কাঠঠোকরার মতো সুঁচালো ঠোঁট। আকারে বড়সড়। অদ্ভুত। প্রাণীটার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠল নিতু। অবিকল মানুষের চোখের মতো চোখ। টকটকে লাল চোখের মণি। তার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ংকর সে দৃষ্টি। সে আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট সব দেখতে পেল।
মারাত্মক ভয় জেঁকে ধরল নিতুর। থরথর করে শরীর কেঁপে উঠল। তবুও সাহস সঞ্চয় করে বলল,
‘হুশ, হুশ!’
সে দূর থেকে হাত দিয়ে প্রাণীটা তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। আর তাতে বিপত্তি ঘটল। চোখের পলকে প্রাণীটা উড়ে এসে তাকে আক্রমণ করল। তার গলা পেঁচিয়ে ধরল। হাতের মোমবাতিটা ছিটকে কোথায় যেন পড়ল। নিতু দুহাতে প্রাণীটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। ক্রমশ সেটা আরো গলায় গেঁথে যাচ্ছে। ব্যর্থ হয়ে একসময় জ্ঞান হারাল সে।
_______
বাপের চেহারা নিতুর মনে নাই। মায়ের চেহারা একটু একটু মনে আছে। গোলগাল চেহারা ছিল মায়ের। হাসলে গালে গর্ত হতো। বেশ সুন্দরী ছিল। পাড়ার লোকেরা বলত, তার মায়ের বুদ্ধি শুদ্ধি একটু কম। তবে বড় ভালো মানুষ ছিল।
তার মা মরল তখন নিতুর বয়স কয় বছর? সাত-আট বছর হবে হয়তো। তারা থাকত গ্রামের ডালিম চাচার ভিটেতে। বহু পুরোনো ভিটে। প্রাচীন গাছপালায় ভরা। সেখানে দোচালা টিনের ঘরে তাদের যাবতীয় সংসার। ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের। মা সুতা কেটে, কাঁথা সেলাই করে রোজগার করত। দুজনের পেট আরামসে চলে যেত।
সেবার চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। তীব্র দাবদাহ। গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। হঠাৎ একদিন আকাশের উত্তর কোণে কালো মেঘ জমল। আস্তে আস্তে ভারী হতে লাগল। তারপর হঠাৎ ঝড় উঠল। কালবৈশাখী ঝড়। সে কি তান্ডব ঝড়ের। ঘরের চালা উড়িয়ে নিবে যেন। মড়মড় করে গাছপালা উড়ছে। ভয়ে নিতু এতটুকু হয়ে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদল।
মা সান্ত্বনা দিয়ে নিতুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাকে ঘুম পাড়িয়ে মা-ও ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আর উঠল না। মাঝরাতে গাছের ডাল ভেঙ্গে তার মায়ের গায়ের উপর পড়ল। ঘুমের মধ্যে মা মা রা গেল।
মায়ের থেকে কতটুকু দূরে ছিল নিতু? দুই কি তিন হাত হবে হয়তো। অথচ ওইটুকু দূরত্বের জন্য সে বেঁচে গেল। তার মা বাঁচল না। পুরোনো ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে মায়ের দেহটা আটকা পড়ে রইল সকাল পর্যন্ত। রুগ্ন, পরিশ্রান্ত আর ক্লান্ত দেহ!
আজ অনেকদিন পর নিতু মাকে স্বপ্নে দেখল। মায়ের ঝাপসা একটা ছবি। মা দূর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে। নিতু বুঝতে পারছে না। সে মায়ের দিকে ছুটছে। মা যেন ততই দূরে সরে যাচ্ছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও মায়ের নাগাল পাচ্ছে না। সে ছুটছে তো ছুটছেই! ছুটছে তো ছুটছেই!
ধপ করে চোখ খুলল নিতু। চোখ খুলতে দিনের কড়া আলো চোখে লাগল। কপাল কুঁচকে গেল তার। চোখের উপর হাত রাখতে গিয়ে সে টের পেল তার শরীর গরম। গা পুড়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড জ্বর উঠেছে। গলার গাছটায় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। শিহাবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। নিতু ক্ষীণ গলায় ডাকল,
‘শিহাব?’
দুই বার ডাকতে শিহাব ছুটে এলো। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘নিতু তুমি চোখ খুলেছ! আমি কি ভয়টা না পাচ্ছিলাম।’
ভয় শব্দটা কানে যেতে নিতুর কালরাতের কথা মনে পড়ল। সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। গলায় হাত চলে গেল। আয়না দিয়ে না দেখেও বুঝল, সারা গলায় আঁচড়ের দাগ। সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। শরীর মারাত্মক দূর্বল! শিহাব বাঁধা দিতে চাইল। নিতু মানল না। উঠে বসে শিহাবকে আঁকড়ে ধরল। রুগ্ন হাতজোড়া বার বার খুলে আসতে চাইল। সে ছাড়ল না। শিহাবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইল।
‘কী হয়েছে নিতু? এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমায় বলো।’
নিতু খানিক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। তারপর শিহাবকে ছেড়ে মুখোমুখি হলো। কাতর গলায় বলল,
‘আপনি কালরাতে কখন ফিরেছেন?’
‘একটু দেরি হয়েছিল বৈকি! আচ্ছা তার জন্য সরি। আর হবে না।’
‘ঘরে ঢুকলেন কিভাবে?’
‘কেন? দরজা দিয়ে।’
শিহাব কপাল কুঁচকে উত্তর দিল। যেন নিতুর ছেলেমানুষী প্রশ্নে খুব বিরক্ত। নিতু কিন্তু ভড়কাল না। আবারো প্রশ্ন করল,
‘দরজা খুলে দিল কে?’
এই প্রশ্নের উত্তরে শিহাব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। নিতুকে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘তুমি ঠিক আছো নিতু?’
‘হুঁ, ঠিক আছি। আপনাকে যা প্রশ্ন করছি তার উত্তর দিন। দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। তাহলে ভেতরে ঢুকলেন কীভাবে? কে খুলে দিল?’
‘কে খুলে দিবে? ঘরে তুমি ছাড়া আর কে আছে? তুমিই তো খুলে দিয়েছিলে।’
নিতুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। শিহাব এসব কী বলছে? সে তো কালরাতে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে ছিল। সে দরজা খুলল কখন? কই! মনে তো পড়ছে না।
সে সন্ধিহান চোখে শিহাবকে দেখল। বলল,
‘আমি আপনাকে এখন কিছু কথা বলব। আপনি কথা দিন।আমার সব কথা বিশ্বাস করবেন?’
‘কী কথা?’
‘আপনি আগে কথা দিন যে বিশ্বাস করব।’
‘আচ্ছা করব।’
নিতু কাল রাতের ঘটনা একদম শুরু থেকে বলল। কিছুই বাদ রাখল না। বলার পর শিহাবের মুখোভঙ্গি তীক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করল। শিহাবকে খানিক চিন্তিত দেখাল। বলল সে,
‘তোমার একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।’
‘ডাক্তার?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার। তুমি যা বলছ তার কিছুই ঘটেনি। এগুলো তোমার অস্থির মনের কল্পনা। কালরাতে একা ছিলে। তখন মস্তিষ্ক নানা রকমের ভয় দেখিয়ে ধোঁকা দিয়েছে। বা এমন হতে পারে স্বপ্ন দেখেছ। এগুলোকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, জানো তো?’
নিতু প্রচন্ড দুঃখ পেল। ভেতরজুড়ে হতাশা গ্রাস করল। বিয়ের পর এই প্রথম বোধ হয় শিহাবের প্রতি সে এতটা হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তাহলে আপনি বলেন। কালরাতে কি হয়েছিল?’
‘কাল বেশ রাত করে ফিরেছিলাম। বার দুই ডোরবেল বাজালাম। তুমি খুলতে একটু সময় নিচ্ছিলে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে হয়তো ঘুমিয়ে গেছো। এজন্য আরো ঘন ঘন ডোরবেল বাজাই। তারপর তুমি ঘুম থেকে উঠে এসে খুলে দিলে।’
‘আমার গলায় আঁচড়ের দাগ এলো কী করে?’
‘এটা তুমি নিজে করেছ নিতু। কালরাতে ঘুমের ঘোরে। শেষরাতের দিকে যখন তোমার জ্বর আসল, তখন জ্বরের ঘোরে এগুলো করেছ। আমি বাঁধা না দিলে অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে যেত।’
নিতু অবাক চোখে শিহাবের পানে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। এসব কী ঘটছে তার সাথে? কোনটা সঠিক? সে নিজের চোখে যা দেখেছ সেটা? নাকি শিহাব যা বলছে তাই? সে কি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে?
(চলবে)