#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_______০২
নিতু দেখল, দরজার ওপাশে শিহাব দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের কোণায় অদৃশ্য এক হাসির রেখা ফুটে আছে।
নিতু ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। টের পেল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে এসেছে। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না সে। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? চোখের পলক ফেলতে কয় সেকেন্ড সময় লাগে? শিহাব তার আগেই তিন তলায় আসল কী করে?
‘কী হয়েছে নিতু? চোখ-মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন?’
শিহাবের কণ্ঠজুড়ে কৌতূহল। কপালে চিন্তার বলিরেখা। নিতু তাকে কিছু বুঝতে দিল না। দরজা থেকে সরে গিয়ে শিহাবকে জায়গা করে দিল। আপাতত সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিল। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘আমি ঠিক আছি। আপনি ভেতরে আসুন। আজ এতো দেরি হলো যে?’
‘পুরোনো কিছু কাগজপত্র চেক করছিলাম। সময়ের দিকে একদম খেয়াল ছিল না। পরে বাইরে বের হয়ে দেখি ইতোমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে।’
‘ইশ! ঘেমে-টেমে একদম নেয়ে উঠছেন। ভেতরে এসে বসুন। আমি পানি নিয়ে আসছি।’
শিহাব ভেতরে ঢুকল। শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে গায়ের শার্ট খুলে ফেলল। তখনি তার পিঠের ক্ষতটার দিকে নজর পড়ল নিতুর। সে তৎক্ষণাৎ শিহাবকে দাঁড় করিয়ে দিল। তীক্ষ্ম চোখে পিঠের ক্ষত পরখ করল। ক্ষত তেমন গভীর নয়। কিন্তু লাল হয়ে আছে। অনেকটা গভীর আঁচড়ের মতো।
‘এখানে কাটল কী করে? আমাকে বলেন নি কেন?’
সে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। প্রত্যুত্তরে শিহাব বলল,
‘তেমন কিছু না! ছেড়ে দাও।’
‘ছেড়ে দিব মানে? কী বলছেন আপনি? কতখানি কেটে গেছে। ইনফেকশন হতে পারে। এদিকে এসে বসুন তো।’
‘এইটুকুতে কিছু হবে না। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।’
নিতু কোনো বারণ শুনল না। শিহাবকে টেনে একপ্রকার জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিল। ফার্স্ট এইড বক্স এনে ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। কেমন লাল হয়ে র ক্ত জমাট বেঁধে আছে। অথচ শিহাব নির্বিকার! কোনো আহা উঁহু নেই। এই মানুষ কি ব্যথা, বেদনা অনুভব করে না? অথচ তার আঘাত দেখে নিতুর অন্তর পুড়ে যাচ্ছে।
নিতু খুব নরম মনের মানুষ। অল্পতে দুঃখ পায়। কষ্ট হয়। শিহাবের ব্যথায় তার দু চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরিষ্কার শেষে খুব যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিল। তারপর আবার প্রশ্ন করল,
‘কী করে এমন হলো বললেন না তো?’
‘আজকে স্যারের সাথে বের হয়েছিলাম। অফিসের আশপাশটা দেখছিলাম। ওখানে হুট করে কিছু একটা উড়ে এসে আক্রমণ করে। পাখি-টাখি হবে কিছু। আচমকা এসে আঁচড় দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগে আবার উধাও হয়ে যায়।’
‘এতখানি কেটে গেছে আপনি কিছু করেননি কেন? ডাক্তারের কাছে যাবেন না?’
‘ডাক্তার তো ঘরেই আছে। আমার সকল রোগের ওষুধ। তাই তো ছুটে ঘরে চলে এলাম।’
নিতু লজ্জা পেল। চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। এভাবে কেউ বলে? তার বুঝি লজ্জা করে না! সে লাজুক স্বরে বলল,
‘হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি নাস্তা দিচ্ছি।’
বলে সে রান্নাঘরে গেল। চায়ের জন্য চুলায় পানি গরম বসাল। তার চোখেমুখে উপচে পড়া খুশি। সে শিহাবের সকল রোগের ওষুধ! এতো সুন্দর কথাটা! কানে এখনো বাজছে। শিহাব তাকে এতো ভালোবাসে? পাতিলের ফুটন্ত গরম পানির দিকে চেয়ে সে মুচকি মুচকি হাসল। তার মনে পড়ল শিহাবের সাথে বিয়ের ঘটনা।
নিতু বাপ-মা মরা মেয়ে। বড় হয়েছে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে। বড় অনাদরে আর অবহেলায়। ও বাড়িতে কত গঞ্জনা আর বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে! উপেক্ষিত হতে হয়েছে। একমুঠ ভাতের জন্য সারাদিন ফাই-ফরমাশ খাটতে হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করার সুযোগ পর্যন্ত হয়নি। আরেকটু বয়স হতে যখন বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকল, বাড়ির সবাই ঝামেলা বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। ভাগ্যিস মামা তাকে একটু স্নেহ করতেন। তিনিই তো শিহাবের সাথে তার সমন্ধ এনেছিলেন। তাকে শিহাবের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
শিহাব অনেকটা তারই মতো। সাত কূলে আপন বলতে কেউ নেই। বড় হয়েছে ইয়াতিমখানায়। অনেক কষ্টে পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো চাকরি পেয়েছে। একসময় যখন বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে থাকে, তখন সৃষ্টিকর্তার উসিলায় নিতুর সন্ধান পায়। সোমবারের এক বিকেলে তাকে দেখে যায়। প্রথম দেখায় বোধ হয় ভালো লেগে গেছিল। কারণ তার পরের শুক্রবারে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।
শিহাবের প্রতি নিতুর এই প্রগাঢ় আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সব বিয়ের পরে সৃষ্টি হয়েছে। আস্তে আস্তে! মানুষটা এতো ভালো! তার প্রচুর যত্ন নেয়। ভালোমন্দ খেয়াল রাখে। আদর করে, ভালোবাসে। কত সুন্দর করে কথা বলে। সে বার বার মুগ্ধ হয়ে যায়।
নিতুর মুখের হাসি আস্তে আস্তে উবে গেল। চায়ের কাপে চিনি মেশানোর সময় তার আবার মনে পড়ল। সন্ধার ঘটনাটা। শিহাব এতদ্রুত তিনতলায় পৌঁছাল কী করে? নাকি তার দেখার ভুল ছিল? গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সে।
‘এতো অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?’
শিহাবের আচমকা আগমনে দেহ কেঁপে উঠে নিতুর। চাপের কাপ ছলকে উঠে। গরম চা হাতে পড়তে সে মৃদু আর্তনাদ করে। সঙ্গে সঙ্গে শিহাব ছুটে আসে। নিতুর হাতটা মুঠোয় নিয়ে ট্যাপের পানি ছেড়ে দেয়। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘একটা কাজ মনোযোগ দিয়ে করো না নিতু! তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কোনোদিন বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটে যায় যদি?’
শিহাব মৃদু স্বরে তাকে ধমকায়। হাতটা পরখ করে বলে,
‘কেমন লাল হয়ে গেছে। বেশি জ্বালাপোড়া করে?’
‘না!’
‘আসো বার্ন ক্রিম লাগিয়ে দেই।’
তাকে নিয়ে শিহাবের ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা নিতুর ভালো লাগে। বেশ উপভোগ করে। সে মনে মনে হাসে। আর গভীরভাবে উপলব্ধি করে। এই মানুষটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।
______
রাত্রি যত গভীর হচ্ছে নিতুর তত ভয় বাড়ছে। শিহাব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অথচ নিতুর বার বার মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়লেই মানুষটা উধাও হয়ে যাবে। সে খুব করে চেষ্টা করছে জেগে থাকার। কিন্তু পারছে না। ক্রমেই শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। যেন কেউ দু চোখে যত্ন করে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়েছে।
মন ও মস্তিষ্কের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করেও নিতু জেগে থাকতে পারল না। একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
______
নিতুর গাঢ় ঘুম ভাঙল পরদিন সকালবেলা। তখন ঘরময় আলো। চোখ খুলে শিহাবকে পাশে পেল না। নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। অনেকটা বেলা হয়েছে যে। সে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়ল। মেঝেতে পা রাখতে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। পড়ে যেতে নিতে দ্রুত বিছানা চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিল। মাথার ভেতর এমন করছে কেন? ধপ করে সে বিছানায় বসে পড়ল। এতো দূর্বল দূর্বল লাগছে!
সে দীর্ঘক্ষণ বিছানায় আধ শোয়া হয়ে রইল। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। শরীর কাঁপছে। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কিছু খেলে শক্তি ফিরবে হয়তো। সে আস্তে ধীরে উঠে ওয়াশরুমে গেল।
দুপুরবেলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিল নিতু। মাথার ভেজা চুলে চিরুনি করছিল। তখন তার প্রথম নজরে এলো। ঘাড়ের কাছে একটা সূক্ষ্ম দাগ মনে হচ্ছে। কামড়ের দাগ। সূচালো মুখের কোনো জন্তু কামড়ে দিয়েছে যেন! তার কপাল কুঁচকে গেল। বার কয়েক ঘাড়ে হাত বুলাল। এখানে কখন, কী কামড় দিল? তার তো স্মরণে নেই।
(চলবে)