#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০১
আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিতুর। পাশ ফিরে দেখল শিহাব নেই। সে কয়েক রাত ধরে খেয়াল করছে মাঝরাতে শিহাব কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। আবার হুট করে তাকে রুমে দেখা যায়। প্রায়ই ঘুম ভাঙ্গলে সে শিহাবকে বিছানায় পায় না। আবার খানিক বাদে পুরুষালী একজোড়া হাত তাকে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয়।
শিহাবের নিঃশব্দ পদচারণা। যেন হাওয়ায় ভেসে চলাফেরা করে। নিতু এতোদিন বিষয়টা আমলে নেয়নি। কিন্তু আজ এই মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতে খটকা লাগল। সবকিছু একের পর এক মনে হতে থাকল।
শিহাব আর তার নতুন বিয়ে। সবেমাত্র মাস দুই গড়িয়েছে। পারিবারিক বিয়ে হলেও এই কিছুদিনে মানুষটা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। তাকে ছাড়া সে নিজের কথা ভাবতেই পারে না। শিহাবও তাকে খুব ভালোবাসে। তাকে প্রতিনিয়ত চোখে হারায়। তবুও মানুষটার কিছু কিছু বিষয় তাকে ভাবিয়ে তুলছে। সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শিহাব জেগে থাকে। ঘুম ভাঙতেও দেখে শিহাব জেগে আছে। আবার ভোরবেলা যখনি উঠুক দেখবে সে ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে।
এতকিছু ভাবতে নিতুর কেন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। ঘুমের রেশ কেটে গেছে। গায়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দ্রুত উঠে পড়ল সে। শিহাব কোথায়? সে ঘরে খুঁজল, আশপাশে খুঁজল, ওয়াশরুমেও খুঁজে দেখল শিহাব নেই।
তাদের দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে চারপাশ পরিষ্কার। নিতু পাশের রুমের দিকে এগোল। রুমের দরজা হাট করে খোলা। খা খা করছে। শিহাব নেই। বসার ঘর, রান্নাঘর কোথাও সে নেই। নিতু বুঝতে পারল শিহাব ফ্ল্যাটে নেই। হয়তো বাইরে গেছে। কোনো জরুরি কাজে। সে ঘুমাচ্ছিল দেখে হয়তো বলে যায়নি। ডেকে তুলেনি।
মনকে প্রবোধ দিয়ে সে ঘুমানোর কথা ভাবল। আচমকা তার নজর আটকে গেল ফ্ল্যাটের দরজায়। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। তার মনে পড়ল ঘুমানোর আগে সে নিজে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিল। তাহলে শিহাব বাইরে বের হলো কিভাবে?
নিতুর দেহে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেল। মনে হলো, দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। কোনো সমীকরণ মিলছে না। সে কোনো রকমে টলতে টলতে শোবার ঘরের দিকে এগোল। ঘরে ঢুকতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে এলো। আবছা আলোয় খেয়াল করল এক পুরুষ অবয়ব। বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আছে। শিহাব? নিতু জ্বরগ্রস্তের মতো কাঁপতে লাগল। তাকে দেখে শিহাবের কোনো ভাবান্তর হলো না। স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় গেছিলে?’
শিহাবের প্রশ্নে নিতু কয়েক সেকেন্ড কিছু বলতে পারল না। সে কুলকুল করে ঘামছে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিল। পরক্ষণে জড়ানো গলায় বলল,
‘ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খেয়ে আসলাম।’
‘পাশে আসো। শুয়ে পড়ো।’
নিতুর কেন জানি ভয় ভয় করছে। তবুও সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে বলল,
‘আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ঘুম ভাঙতে দেখি পাশে নাই।’
শিহাবকে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধান্বিত দেখাল কি? নিতু বুঝতে পারল না। তবে সে এবারো স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘কোথায় আর থাকব? বারান্দায় ছিলাম। একটা সিগারেট টেনে আসলাম।’
নিতুর শরীর আরো হিম হয়ে এলো। তার স্পষ্ট মনে আছে সে শিহাবকে বারান্দায় খুঁজেছে। বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা দু বার চোখ বুলিয়েছে। কোথাও সে ছিল না। তাহলে মিথ্যে কেন বলছে? শিহাব কোথায় ছিল? হঠাৎ করে রুমে উদয় হলো কী করে?
নিতু আর ভাবতে পারল না। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শিহাব হঠাৎ তার বাহুতে টান দিল। সে হুমড়ি খেয়ে তার বুকে গিয়ে পড়ল। শিহাব তাকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল,
‘আমায় পাশে না পেয়ে ভয় পেয়েছ নিতু?’
নিতু উত্তর দিতে গিয়েও পারল না। শিহাব তাকে আগলে নিয়ে বলল,
‘এতসব কী ভাবছ? কেমন যেন লাগছে তোমাকে। শরীর ঠিক আছে?’
‘হুঁ। একটু মাথা ধরেছে।’
‘আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘আপনার শরীর এতো গরম কেন? জ্বর এসেছে?’
নিতুকে বিচলিত দেখাল। সে চিন্তিত হয়ে শিহাবের চিবুকে, কপালে হাত বুলাল। শিহাব মুচকি হাসল। তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘জ্বর আসেনি। এমনি মাঝে মাঝে আমার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গোসল করলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এসব বাদ দাও। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’
নিতু বালিশে মাথা রাখল। খুব চেষ্টা করেও চোখমুখ থেকে আতঙ্কের ভাব সরাতে পারল না। সে চোখ বন্ধ করল। শিহাব তার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। নিতুর শ্বাস ভারী হয়ে আসতে উঠে পড়ল।
ওয়াশরুম থেকে পানি ছাড়ার শব্দ কানে আসতে নিতু ধপ করে চোখ খুলল। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? সে আস্তে করে উঠে গিয়ে আরেকবার বারান্দা পরখ করল। বারান্দার কোথাও সিগারেটের টুকরো নেই। শিহাবের গা থেকেও গন্ধ আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা। সে স্পষ্ট দেখেছে বারান্দায় কোনো জনমানবের চিহ্ন ছিল না।
সে আর ভাবতে পারছে না। খুব অসহায় লাগছে। এমন কি হয়েছে যে সে আসলে বারান্দায় আসেনি? শিহাব সত্যি সত্যি বারান্দায় ছিল? এটা তো হওয়ার কথা নয়। ওয়াশরুম দেখার আগে সে বারান্দায় খুঁজেছিল।
বড্ড অসহায়ত্ব নিয়ে সে ফের বালিশে মাথা রাখল। তার আর ঘুম এলো না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওয়াশরুমের পানে। ভেতর থেকে অবিরত পানি ছাড়ার শব্দ আসছে।
ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। নিতু চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করল। ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হলো। তারপর বরফ শীতল এক দেহ তাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। নিতু নড়েচড়ে উঠল। শিহাব তার কানের লতিতে চুমু খেয়ে ডাকল,
‘বউ!’
এতক্ষণের সন্দেহ, উসখুসানি সমস্ত কিছু কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। কর্পূরের মতো উবে গেল সমস্ত ভাবনা। নিতু পাশ ফিরে শিহাবের উন্মুক্ত শীতল বুকে মুখ লুকাল। শিহাব তার গালে, ঠোঁটে, বুকে, পিঠে নিজের স্পর্শ গাঢ়তর করল। নিতুও সাড়া দিল। এই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। মানুষটা জানে সেটা?
______
ভরদুপুর। নিতু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। গহীন অরণ্য! দুপুর সূর্যের আলো পড়ে বনের গাছপালা ঝিকঝিক করছে। মুক্ত বাতাস। নিতু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। যত দিন যাচ্ছে, এই সবুজ অভয়ারণ্য তত আপন হয়ে উঠছে তার।
শিহাব বাসায় নেই। তার নয়টা-পাঁচটা অফিস। সে বনবিভাগে কর্মরত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বে আছে। শিহাবের চাকরি সূত্রে তাদের এই সবুজ অরণ্যে বসবাস। খুব ছোটবেলা থেকে নিতুর সবুজের প্রতি আলাদা একটা টান। তার জন্যই কি শিহাবের সাথে তার পরিচয় হলো? অনাকাঙ্খিত ভাবে জীবন জড়িয়ে গেল? এতে সে অবশ্য ভীষণ খুশি।
দূর থেকে হঠাৎ পুলিশের গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। নিতু খানিক চমকে গেল। হঠাৎ পুলিশ এসেছে কেন? কারো কোনো বিপদ হয়নি তো? সে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল। পারল না। সরে এলো।
দুদিনের ময়লা জমে আছে। নিচে ফেলে আসার সময় নিতু ঘটনাটা শুনল। তাকে পুলিশ আসার কারণ জানাল সিরাজ সাহেবের স্ত্রী। সিরাজ সাহেব বনবিভাগে রিসার্চ সহকারী হিসেবে আছে। শিহাবের মুখ থেকে তার ব্যাপারে শুনেছিল একবার।
সে জানাল,
‘নিতু, শুনেছ কি না! বনে একটা লা শ পাওয়া গেছে। লা শের সারাদেহ ক্ষত বিক্ষত। হৃদপিন্ডটা কেউ যেন খু বলে খেয়েছে। মনে হচ্ছে হিং স্র কোনো জন্তুর কাজ।’
‘সে কি!’
নিতুর ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। এতগুলো দিন হলো এই জঙ্গলে আছে। এমন ঘটনা তো কখনো শুনেনি। সে কোনরকমে বলল,
‘লা শটা কার ভাবি? খোঁজ পাওয়া গেছে?’
‘এখনো পাওয়া যায়নি। চেহারা দেখে নাকি বুঝার উপায় নাই। পুলিশ এসেছে শুনলাম।’
নিতু আর দেরি করল না। তার শরীর টলছে। সে কোনরকমে রুমে চলে এলো। তার কপাল জুড়ে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে। মন কেন জানি কু ডাক গাইছে। কালরাতে সে শিহাবকে ঘরে পায়নি। আবার কালরাতেই বনে একজন মানুষ ম রতে হলো? এই দুটো ঘটনার মধ্যে কি কোনোভাবে যোগসূত্র আছে? ধুর ছাই! সে কিসব আবোল তাবোল ভাবছে।
মনে মনে নিজেকে বকা দিল নিতু। তার এইসব উদ্ভট ভাবনার জন্য এক ধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। শিহাব তার স্বামী। তারই মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাকে নিয়ে এসব কি ভাবছে সে! ছিঃ! নিজের সমস্ত ভাবনাকে দূরে সরিয়ে সে কাজে মনোযোগ দিল।
বিকেলের মধ্যে শিহাব প্রতিদিন বাসায় ফেরে। আজ নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। সে ফিরছে না। দেরি হচ্ছে দেখে নিতু আবার চিন্তায় পড়ে গেল। বার বার বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। শিহাব আজ এতো দেরি করছে কেন?
চারিদিক সন্ধ্যা নামছে। রক্তিম সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গেছে। তখন রাস্তা দিয়ে শিহাবকে আসতে দেখা গেল। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নিতু। অপলক তাকিয়ে রইল শিহাবের পানে। আবারো সুদর্শন, বলিষ্ঠ দেহের মানুষটার প্রেমে পড়ল।
নিতুর তাকিয়ে থাকা অবস্থায় শিহাব বিল্ডিং এ ঢুকল। সে চোখ ফেরানোর আগেই ডোরবেল বেজে উঠল। আকস্মিক শব্দে খানিক চমকে উঠল সে। শিহাব তো এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় পৌঁছানোর কথা নয়। এই অসময়ে আবার কে এলো?
সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দেখল, দরজার ওপাশে শিহাব দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের কোণায় অদৃশ্য এক হাসির রেখা ফুটে আছে।
(চলবে)