মিঠা রোদ পর্ব-৭০ এবং শেষ পর্ব

0
1016

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:শেষ পর্ব(একাংশ)
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“মায়ান আজ চলে যাচ্ছে।তুমি কী ওর সাথে দেখা করবেনা তাহিয়া?”

আসিফের প্রশ্নে ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকালো তাহিয়া।গম্ভীর সুরে বলল,

“ওনার সাথে দেখা করতে হবে কেন?আমাদের সম্পর্ক নেই।”

“এরপর জীবনে কখনো নাও দেখা হতে পারে।আমি শুনেছি মায়ান দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”

তাহিয়ার মুখ বিবরে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলো না।বরং অদৃশ্য হাসি খেলে গেলো যেন।কিছু জিনিস প্রতিক্রিয়া জানানো মানুষ বন্ধ করে দেয়।মায়ানও সেরকম কেউ।আসিফ আরাম করে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“সারাজীবন তাহলে একা থাকবে?”

“আশ্চর্য।এখন আমি নানী হয়ে গিয়েছি।তো একা থাকবো না?”

“তা ঠিক।একা থাকা আসলে খারাপ নয়।বরং ভালো বলা চলে।এক আলাদা ধরণের এনার্জি পাওয়া যায়।”

“আপনি চাইলে জীবনসঙ্গী গ্রহণ করতে পারতেন।”

“একটা সময় পর মন উঠে যায় তোমার কথাটা বললাম।তোশা কেমন আছে?মরিশাসে ছুটি কেমন কাঁটাচ্ছে?”

“ভালো।সকালে ফোন করেছিলো একবার।মেয়েটাকে এতো খুশি কখনো আমি দেখিনি।”

“তুমি রাজী হলে কেন বিয়েতে?যেহেতু প্রথম থেকে মানতে নারাজ ছিলে।”

“আহনাফের জন্য।আমি বিষয়টা কাওকে বলিনি।”

একটু উশখুশ করতে লাগলো তাহিয়া।তবুও ছোট্ট করে বলল,

“আহনাফ একদিন আমার অফিসে এসে অনেক কান্নাকাটি করেছে।যদিও এটা নিয়ে আমার বাচ্চাটা অনেক লজ্জায় ভুগে এখনও।তোশার সাথে বুঝলেন আসিফ ভাই আমি কতোগুলো নতুন কথা বলার মানুষ পেয়েছি।এরমধ্যে সবার প্রথমে ছোট শাহ একজন।”

“তোমাকে এখন অনেক হাসিখুশি লাগে।ঠিক যেমন তেইশ চব্বিশ বছর পূর্বে লাগতো।ছোট্ট খরগোশের মতোন।”

“আপনার আমাকে সেসময় কেমন লাগতো সব মনে আছে?”

“মানুষ সব মনে রাখতে সক্ষম নয়।কিন্তু বেশীরভাগ মনে আছে।তুমি যেভাবে কথা বলতে যেভাবে হাসতে সবই।মায়া খুব কঠিন জিনিস বুঝলে।সেটা এক জীবন হলেও কাঁটানো যায়না।”

প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য তাহিয়া বলল,

“আপনাকে ইদানীং সুন্দর লাগে দেখতে আসিফ ভাই।মেয়েরা এমনি ভোট দিয়ে দিবে।”

“তুমি ভালোভাবে কথা ঘুরিয়ে নিতে জানো।তবে একথার জবাবে বলবো আমাকে সবথেকে বেশী ভোট পুরুষেরা দিবে।”

তাহিয়া হেসে ফেললো।ফাইল থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলল,

“আসিফ ভাই সকলে আমাকে খুব জাজ করে মেয়ের বিয়ে নিয়ে।কিন্তু জানেন এখন খারাপ লাগেনা।বরং মনে হয় মাথার উপর শক্তিশালী এক অভিভাবক আছে।”

“শুনো তাহিয়া মন যেটা বলবে জীবনে ঠিক সেটা করা উচিত।এবং মন তুমি কোথায় কম্ফোর্টেবল বোধ করো সেই জায়গা চিনিয়ে দিবে।জীবন নিয়ে আর কোনো আক্ষেপ আছে?”

“নেই।”

“আচ্ছা তাহলে উঠি আমি তাহিয়া।”

“সে-কি?এখুনি কেন?”

“ধরে নাও কথা শেষ।”

আসিফকে একটু উশখুশ করতে দেখা গেলো।ধীর কণ্ঠে বলল,

“আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল তাহিয়া।কিন্তু বলবো না।”

কৌতুহলী তাহিয়া কিছুক্ষণ সফেদ ত্বকের ব্যক্তিটির পানে তাঁকিয়ে রইলো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

“যে কথার জবাব আমাদের কাছে থাকে না।সেকথা বোধহয় না বলা ভালো আসিফ ভাই।আমাদের মন একটা সময় তিক্ততায় ভরে যায়।যেখানে মিষ্টতাকে গ্রহণ করতে ভয় অনুভব হয়।যদিও সেটা উপকারী কিংবা সুফল বয়ে আনা হোক না কেন।”

“ভালো থেকো তাহিয়া।”

“আপনিও।”

আসিফ অবর্ণনীয় ভাবে হেসে ফেললো।তার গমন পথে তাঁকিয়ে থাকতে তাহিয়ার চোখ দুটো ভরে উঠলো।সে চাইলে জীবনের অন্য পথ অবলম্বন করতে পারতো।কিন্তু এক্ষেত্রে মন কেন মানছেনা?তাহিয়া জানেনা।

(***)

তোশার ঘুম ভাঙলো একলা রুমে।নিভন্ত দৃষ্টিতে সে চারিধার দেখলো।কোথাও কবীর নেই।হুট করে উঠে বসলো সে।ঘুম ছুটে যেতে মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলো।কম্পমান কণ্ঠে শুধালো,

“কবীর শাহ!কবীর শাহ!কোথায় আপনি?”

কিন্তু জবাব নেই।রুমের লাগোয়া বারান্দায় ভালো করে দেখে মূল দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো তা বাহির থেকে লাগানো।জোরে জোরে তা শব্দ করলো তোশা।

“কবীর শাহ?”

হঠাৎ কী হলো মেয়েটির শক্তি পাচ্ছে না।দরজাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো।ফোনের কাছে গিয়ে কল করবে সেই শক্তিও পাচ্ছে না।মনে হচ্ছে সব অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে।অকস্মাৎ পিঠে চাপ অনুভব করলো।সূর্যের অনুরুপ উজ্জ্বলতা নিয়ে উঁকি দিলো কবীর।তোশার কান্নারত মুখ দেখে শুধালো,

“কী হয়েছে বেলাডোনা?তুমি কাঁদছো কেন?”

“আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন?জানেন কতো ভয় পেয়েছিলাম আমি।”

তোশা জড়িয়ে ধরলো কবীরকে।নাকটা বুকে ঘষে বলল,

“আমার মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে।”

“কোনো ভয় নেই।আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম।তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

“আমার জন্য?সেটা কী?”

“সেটা তো সময় হলে জানবে।এখন তৈরী হবে।আমরা বীচে যাবো।”

“দারুণ কিছু আছে আমার জন্য?”

“অনেক দারুণ কিছু।”

তোশা উচ্ছাসিত হয়ে অতি দ্রুত তৈরী হতে লাগলো।যেন চড়ুই পাখি।কবীর ভেবে পায়না মেয়েটা কে সে কীভাবে ভালোবাসবে।এখনও এতোটা বাচ্চা।

“আমি তৈরী কবীর শাহ।দেখেন তো কেমন লাগছে?সুন্দর না?”

ছোট বাচ্চার মতোন পোশাকের এক পাশে ধরে ঘুরে দেখালো।হলুদ রঙা পোশাকে মেয়েটাকে দারুণ লাগছে।চেহারার উজ্জ্বলতা শতগুণে বেড়ে গিয়েছে যেন।কবীর হুট করে তোশার দিকে গভীরভাবে তাঁকালো।এক আশংকায় চমকে গেলেও তা ফিরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।নিজেও তৈরী হওয়া শেষ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর কপালে চুমো খেলো।

“চলো যাওয়া যাক।”

তোশার হাতটা ধরে তাকে নিয়ে সী বীচে এলো কবীর।দুজনের চোখে মুখের ভালোবাসার গান ভেসে বেড়াচ্ছে।হুট করে তার চোখ দুটো হাতের সাহায্য আঁটকে দিলো কবীর।

“সারপ্রাইজকে এভাবে দেখতে হয় বেলাডোনা।ভয় নেই আমি তোমার চোখ হয়ে আছি।”

“একদম সিনেমার মতোন সবকিছু করছেন।”

“বলতে পারো।”

উল্লেখিত এক জায়গায় এনে কবীর তোশার চোখের সামনে থেকে হাত সরালো।চারিধার পানসে হলদে আলো ও নানা ফুল দিয়ে সাজানো।

“সী-বীচ ডেট বেলাডোনা।খুব সাধারণ কিন্তু আমি তোমার জীবনে সব সাধারণ ও অসাধারণকে একত্রে এনে দিবো।”

তোশার চারিধার মুগ্ধ হয়ে দেখলো।তার চোখে পানি এসে গিয়েছে।কবীরের বুকে মাথা রেখে বলল,

“অনেক সুন্দর।এই সারপ্রাইজের কথা বলছিলেন?”

“জি।একটু সময়ে এতোটা পসিবল হয়েছে।”

“তাও দারুণ।”

কবীরকে ছেড়ে তোশা এগিয়ে গেলো সফেদ কাপড়ের আড়ালে থাকা টেবিলটির দিকে।যেখানে একটি রেড ভেলভেট কেক রাখা।তোশা হঠাৎ কোনোকিছু চিন্তা না করে তা খেতে লাগলো।কবীর হেসে বলল,

“তোমার কী খুব খুদা লেগেছে?আমি ডিনার ডেকে দিচ্ছি।”

“ঠিক আমার নয়।তর্নির খুদা লেগেছে।”

“তর্নি?”

“আপনি চিনেন ওকে তামাটে পুরুষ।”

কবীর কিছুক্ষণ দ্বিধা নিয়ে তাঁকিয়ে রইলো।তোশা শুধালো,

“বুঝলেন না তো?”

“না।তবে নাম শোনা মনে হচ্ছে।”

“আসলেও মনে নেই?”

কবীর ঋণাত্মকবোধক মাথা দুলালো।এরপর তোশার মনে হলো সে বিষয়টা নিয়ে বোধহয় খুব কম কবীরের সাথে আলাপ করেছে।একটু কেঁশে বলল,

“আমার মায়ের নাম তাহিয়া।তার যখন মেয়ে হলো তখন রাখলো তোশা।সেই তোশার যখন মেয়ে হবে নাম কী হবে তার?তর্নি।ইশ,আপনি কিছুই বুঝেন না।”

“কিন্তু তুমি তো প্রেগনেন্ট নও?কিংবা…।”

তোশার মুখে ফুল ফোঁটার হাসি ফুটে উঠলো।সামনের চেয়ারে বসে সমানতালে কেক খেয়ে চলেছে সে।ফিসফিস করে বলল,

“আমাদের বিয়ের তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কবীর শাহ।”

কবীর বুঝতে পারছে না ঠিক কী বলবে?এ সময়টা তার জীবনে দ্বিতীয়বার এলো।কিন্তু দুজন ভিন্ন নারীর সাথে।কিন্তু অনুভূতি তো ভিন্ন নয়।সেই শব্দ ভুলে বসার অনুরুপ শূন্যতা।কবীর অবাক হয়ে তোশার সামনে বসে বলল,

“কিন্তু আমাদের কথা হয়েছিল এটা নিয়ে।”

“আমি আপনার কথা কবে শুনেছি বলুন তো?আমার একটা ছেলে আছে।বলবেন না ছোট।হুহ আই এম এ বিগ গার্ল।এন্ড এ ভেরি গর্জিয়াস ওয়াইফ।আমি জানি আপনি অনেক খুশি লাফাতে হবেনা।”

তোশার ব্যবহার এখনও অনেকটা বাচ্চা ধরণের।কবীর হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো তার সামনে।হাত দুটো ধরে বলল,

“আমি ঠিক কী বলবো সেকথা জানিনা।কিন্তু আমি অনেক খুশি।”

“তাহলে বড় করে হাসেন।আমি না কবীর শাহ অনেক বড় ফ্যামিলি তৈরী করবো।এরপর আমাদের নতুন বাড়ীটাতে সকলকে নিয়ে থাকবো।আমাদের ছেলের বিয়ে হবে।মেয়ের বিয়ে হবে তাদের বলবো পরিবার অনেক বড় করে তুলতে।”

“সেই অবধি আমি বেঁচে থাকবো?”

“আরে থাকবেন তো।বাকীটা শুনেন…।”

তোশা চেয়ার থেকে নেমে কেক নিয়েই মাটিতে বসে পড়লো।এতোক্ষণে অর্ধেক তার পেটে।কবীরের মুখোমুখি বসে জীবন নিয়ে তার সমস্ত আলাপকে বলে দিচ্ছে একদমে।যেখানে আছে শুধু প্রাপ্তির মেলা।কবীরকে ঠিকঠাক ভাবে মেয়েটা নতুন বাবা হওয়ার অনুভূতিও জাহির করতে দিলো না।সে নিজ খেয়ালে বলে চলেছে।

“তোশা আস্তে এতো কথা নয়।আমি বুঝেছি তোমার অনেক প্ল্যান।কিন্তু নিজের হেলদ কন্ডিশন দেখে তো…।”

“আমি সুস্থ তো কবীর শাহ।আপনাকেও শক্তিতে হারিয়ে দিতে পারবো।”

“আচ্ছা?তবে হবে নাকী একবার।মনে আছে একদিন হারিয়ে দিয়েছিলাম।”

“এখন আমরা দুজন।এক মিনিট খাওয়া শেষ করি।”

কেকের বাকী অংশ দ্রুত খাচ্ছে তোশা।হ্যামেস্টারের মতোন গাল গুলো ফুলে গেলো।হুট করে থামিয়ে বলল,

“আমি তো একবার আপনাকে সাধলাম না।ব্যাপার না আমি খেয়ে ফেলি।ইয়াম্মি জিনিস একটু খেলে পেট খারাপ হয়।”

উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো কবীর।তোশার এমন উল্টোপাল্টা কথাগুলো সে আগে থেকে ভালোবাসে।এ কথাগুলোই তো তার মনে ছাঁপ সৃষ্টি করে গিয়েছিলো।কপালে আঙুলের ছোঁয়া দিয়ে বলল,

“তুমি আমাকে দিতে চাওনা সেটি হলো আসল কথা।”

“ঠিক ধরেছেন।এতে রাগ করলে করুন।কিন্তু ইদানীং আমার সব খেতে ভালো লাগে।মনে হয় ওইযে আকাশের চাঁদটাকে খেয়ে ফেলবো।”

“ওয়েল।তাইতো তুমি কয়েকদিন ধরে খুব খাও।আর আমি বোকা খেয়াল করিনি।যদিও একটু আগে রুমে তোমার পেটটা দেখে মনে হয়েছিল।”

“ব্যাপার না।এখন প্রত্যেক বছর একই এক্সপিরিয়েন্স পাবেন।আমি সিরিয়াস।চলুন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে।শক্তির পরীক্ষা হবে।”

কবীরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তোশার।মাথার উপর চাঁদ পাশে মৃদু গর্জন করা সমুদ্র এ লড়াইয়ের দর্শক।তারা কার পক্ষে আছে?একবার জানতে ইচ্ছা হলো তোশার।কিন্তু পূর্বের অনুরুপ সে এবারও জিততে সক্ষম হলো না।

“এটা কী হলো?আমি হেরে গেলাম।”

“যা হলো তাই হওয়ার ছিল।কবীর শাহ এর সঙ্গে তার বেলাডোনা কখনো জিততে পারবেনা।”

“আমার রাগ হচ্ছে কিন্তু।”

“করো রাগ।আমি তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে দেখি।”

তোশা সত্যি রাগ করলো।হেঁটে ঠান্ডা বালুতে বসে সমুদ্র দেখতে লাগলো।মেয়েটার বাচ্চামো তে কবীর মুগ্ধ হয়।অবশ্য মন বলল এটা তো সেই ছোট্ট মেয়েটা।সে খাবার আনতে বললে তা কিছুক্ষণের মধ্যে দিয়ে গেলো।তোশার পছন্দ মতোন পদ নিয়ে কবীর তার পাশে গিয়ে বসে বলল,

“চাঁদ পরে খেলেও চলবে।আপাতত এটা নাও।নাকী রাগ করে থাকবে?”

“রাগ আপনার সাথে?কখনো সম্ভব নয়।আমি একটু ভাব নিলাম।”

হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে এবার খাওয়ার আগে কবীরকে খাওয়ালো।পুরুষটি বিদ্রুপ করে বলল,

“ভাগ্যিস দিলে।কিন্তু আমার সাথে খুব কম রাগ করো তুমি।”

“আপনি এতো সুন্দর কবীর শাহ রাগ করে থাকা দুস্কর।ঠিক ওই সমুদ্রের মতোন।”

কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে অন্য কোনো আলাপ হয়না।নিশ্চুপ খেতে খেতে সমুদ্র দেখতে থাকে।

“কবীর শাহ,আমি একসময় ভাবতাম আমাদের পথ শেষ।আর কখনো দেখা হবেনা।শাহবাগে একসময় পানি ছুঁড়ে মে’রে’ছিলাম।মনে আছে?”

“আছে।সেদিন তোমাকে প্রায় চার বছর পর দেখেছিলাম।সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি মেয়েটা ওই মাধ্যমে জীবনে ফিরে আসবে।”

“আমিও না।পরবর্তী তে অপ্সরার সঙ্গে প্ল্যান করে আপনাকে ভালোবাসায় ফেলতে চেয়েছিলাম।দেখেন তো আমাদের কোনকিছু ঠিকঠাক হয়নি।কোনো প্ল্যান কাজে লাগেনি কিন্তু আমরা একসাথে আছি।”

“থাকার কথাটাও ছিল।”

প্লেটটা একপাশে রেখে মাটিতে শুয়ে পড়লো তোশা।অনুকরণ করে কবীরও শুয়ে পড়লো।তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো তোশা।হঠাৎ বিভ্রম হলো।তারা দুজন ভিন্ন।আলাদা রুপে এই সমুদ্রের কিনারাতে শুয়ে আছে।এক সুন্দর মিঠা রোদ দুজনকে ভাসিয়ে চলেছে।তাদের মুখে স্মিত হাসি।যা বর্ণনা করা দুস্কর।তোশা ফিসফিস করে বলল,

“আমরা সব রুপে,সব সময়ে শুধু একে অপরের।আপনি বেলাডোনার বাজপাখি।এবং শুধু তার বাজপাখি।”

কল্পনাতে মিঠা রোদ আরো উজ্জ্বলিত হয়ে চারিধার আলোকিত করতে লাগলো।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:শেষ পর্ব(বাকী অংশ)
#লেখা:সামিয়া খান প্রিয়া

“গল্পটি আমার নয়।আমাদের ছিল।যেখানে তোশা তার তামাটে পুরুষকে একান্ত নিজের করে পেয়েছিলো।”

“পেয়েছিলো?কথাটি তে অতীতকাল কেন?কবীর শাহ এখন কোথায়?”

প্রশ্নের ফলে তোশা মিষ্টি করে হাসলো।নিজের আর্লি থার্টিসেও সে ঠিক যেন মোলায়েম পদ্ম।কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে বলল,

“আমার সাথে আছে।অতীতকাল নয়।কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন?সে থেকেও নেই।অথবা আমাকে বুঝতে পারেনা।এখনও যখন আমাদের দেখা হয়,কথা হয় তার চোখে থাকে একরাশ বিস্ময়।দৃষ্টির প্রশ্নগুলো কিন্তু আমি অনুধাবন করতে সক্ষম।সে মনে মনে কী বলে জানেন?”

“কী?”

“এই নারীটি তার খুব চেনা।কিন্তু সে চিনতে পারেনা।যেমনটা তাঁকিয়েছিল প্রথমবার তাকে ভালোবাসি বলার সময়।চোখে অবর্ণীয় রুপকথা।সেভাবে তাঁকায়।আমাকে যখন সবার সামনে কবুল বলে নিজের করেছিলো তখনও চোখে এমন বিস্ময় ছিল।”

“আপনাদের তর্নি জন্মেছিল?”

“হাঁ।আজ থেকে চৌদ্দ বছর পূর্বে।এখন সে কিশোরী।মা বলে ঠিক আমার মতোন।স্বপ্নবিলাসী, বোকা, সরল মনের।তার সবথেকে প্রিয় ব্যক্তি হলো নিজের ভাই।”

“তাহলে আপনাদের বিশাল পরিবারের চিন্তা?”

“কবীর শাহ এর সাথে আমার সেই ডিলটা চলেনি।কিন্তু তর্নি ওয়াদা করেছে।সে একদিন পূরণ করবে।”

সামনের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ হয়ে গেলো।তোশা চোখে একরাশ মায়া নিয়ে পরবর্তী প্রশ্ন শোনার অপেক্ষায় আছে।এ কথাগুলো সে রোজ বলে এই ব্যক্তিকে।একই প্রশ্ন ও জবাব ফিরে আসে।কিন্তু তাও তোশা ক্লান্ত হয়না।অবশেষে মৌনতা ভেঙে বলল,

“আপনাদের কী বিচ্ছেদ হয়েছে?”

“না।এমনটা কখনো হওয়ার নয়।”

“তাহলে আপনার কথাতে কেন মনে হয় আপনারা কাছে থেকেও নেই?”

প্রশ্নটির সঙ্গে আঁধার নেমে এলো।এখন সন্ধ্যার সময়।শীতের কুয়াশায় চারিধার ভরে গিয়েছে।তোশা উষ্ণ শ্বাস ফেলে ব্যক্তিটির গায়ে চাদর জড়িয়ে বলল,

“ভেতরে চলুন কবীর শাহ।আপনার ঠান্ডা লাগবে।”

ব্যক্তিটি বিস্ময়ে শুধালো,

“আমি কবীর শাহ?”

“আপনি কবীর শাহ।”

কবীর এতোক্ষণে তোশার দিকে তাঁকালো।যে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু চোখদুটোতে কতো না বেদনা লুকিয়ে আছে।তবে এ ভাবনাও হয় কবীর নামের ব্যক্তিটি এই সুন্দর দেখতে নারীকে কীভাবে পেলো?কিন্তু সে নিজেই তো কবীর।কিছু মনে হচ্ছে না কেন?

“কী ভাবছেন তামাটে পুরুষ?ভেতরে চলুন।তর্নি ও আহনাফ অপেক্ষা করছে।”

“আমার জন্য?”

একদম বাচ্চার অনুরুপ প্রশ্ন।তোশা আস্তে করে বলল,

“সবার আপনার জন্যই অপেক্ষা।”

কবীরের হাতটি শক্ত করে ধরলো তোশা।মানুষটি হয়তো মনের দিক থেকে উদাসীন।কিন্তু আজও সেই কঠিন শিলার অনুরুপ দৃঢ় ও সুগঠিত।কুয়াশা গুলো তাদের উপর বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে।তাদের জীবনে মিঠা রোদের ক্ষণস্থায়ী আভাস তো হয়েছিল।এখন ঝড়ের সময় চলছে।হয়তো আবার একদিন ছোট করে সেই পানসে হলুদ রঙ ধরা দিবে।

পরিশিষ্ট:

“শুনেছি আমার জন্মের অনেক আগে মা নাম রেখেছিলো তর্নি।তিনি নাকী আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলো।আমি জন্মের এতো আগে আম্মুকে সিগন্যাল দিয়েছিলাম?ভাবতে অবাক লাগে।আম্মু বলে আমি খুব দুষ্ট।তবে শাসন করেন না।তাছাড়া আম্মু নিজেও এখনও নানুর কাছে ব” কা খায়।আমি আসাতে বলে নানুর সাথে তার সম্পর্কের বদল ঘটেছে।আগে বকতো না।কিন্তু এতো বড় বয়সে তাকে শাসন করে।আমি অবশ্য সেটা মনে করিনা।নানু,নানা,আসিফ নানা,দাদা,দাদু, বাবা ও আহনাফ ভাইকে নিয়ে তর্নি শাহ দুনিয়া।সবথেকে সুন্দর, সবথেকে মেধাবী মেয়ে আমি।কবীর শাহ এর সবথেকে মূল্যবান বস্ত।জীবনে কাওকে অপছন্দ করিনা।একজন গ্রহণ কে ছাড়া।তাকে গ্রহণ বলার কারণ হলো আমার জীবন পার্ফেক্ট ছিল।সেখানে এসে সব এলেমেলো করে কেন দিলো?ভাইয়ের ওই বন্ধুটাকে আমি ভীষণ অপছন্দ করি।সত্যি কী তাই?

আম্মু বলে আমি যখন জন্ম নিলাম সেদিন নাকী অনেক বৃষ্টি হয়েছিলো।প্রাণের ঢাকা শহর প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল প্রায়।আমার মনে হয় আম্মু ভুল বলে।এতোটাও কী বৃষ্টি হয়েছিল?কিন্তু আমার সেরা বাবা যে আমাকে কোলে নিয়ে কেঁদে দিয়েছিল সেই দৃশ্য সত্য।কতোবার যে আমি ভিডিওটি দেখেছি।

আমি আমার মায়ের মেয়ে।সবকিছুতে সেরা।কিন্তু মনে হয় কোথাও একটা কষ্ট আছে জীবনে।আমার ছোট্ট এই শরীরটাতে কতো দায়িত্ব কেউ জানেনা।আমার নানু কে আসিফ নানার সাথে বিয়ে দিতে হবে।মায়ান নানার মাথায় করা নতুন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টটা নষ্ট করতে হবে।বৃষ্টি আপুর সাথে কল্লোল মামার বিয়ে দিতে হবে।আমার মনে হয় এরা সিক্রেট প্রেমিক-প্রেমিকা।তা নয় একই হসপিটালে থেকে অভিমানে কথা বলে না কেন?আবার দিশা মামুনির কাছেও ঘুরতে যেতে হবে ভার্জিনিয়ায়।তিনি নাকী এখন দারুণ কেক বানাতে পারে।আহনাফ ভাইয়ের জন্য মেয়েও তো খুঁজতে হবে।সে বলে বিয়েকে ভয় পায়?বিয়ে ভয়ের জিনিস নাকী?আমি জানি এসব বোকা কথা ওই তার বিশেষ বন্ধুটি ঢুকিয়েছে।একদিন অপছন্দের ভাইয়ের বন্ধুটাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নিবো আমি।সে যতো বলুক আমি ছোট।থোড়াই মানবো তা?

তবে সবথেকে সেরা যে কাজটি করতে হবে সামনে আম্মু-আব্বুর বিবাহ বার্ষিকী তে আবারও তাদের বিয়ে দেওয়া।যারা রোজ প্রেমে পড়ে তাদের একবার মাত্র বিয়েতে হয় নাকী?

আমার বান্ধুবীরা বলে তর্নি, “তোমার সবথেকে প্রিয় জিনিস কী?”আমি তাদের ফিসফিস করে জবাব দেই,”আমার বাবার সেই গোপন চিঠিটা যেটা আমার মা সবসময় লুকিয়ে রাখে।কিন্তু আমি চুরি করে ফেলি।”

এজন্য কতো বকা খেতে হয় কেউ জানেনা।আমার দিনের একটা সেরা মুহুর্তে আছে।ঠিক সন্ধ্যার সময়।যখন বাবা রোজকার মতোন নিজেকে ভুলে যায় এবং মা তাদের কাহিনী বলে।বেলাডোনা ও বাজপাখির কাহিনি শোনায়।তখন তার মুখের উজ্জ্বলতার সামনে বোধহয় সব মলিন হয়ে যাবে।মোট কথা কবীর শাহ এর মেয়ে তর্নি শাহ এর জীবনে সবকিছু দারুণ পার্ফেক্ট।”

ডায়ারি তে নিজের কথাগুলো লিখে উঠে দাঁড়ালো তর্নি।লিখতে লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার।সন্ধ্যা নামছে দেখতে পেয়ে দ্রুত জানালার কাছটায় এলো।তার মা অতি সন্তপর্ণে বাবাকে নিয়ে রুমে ফিরে আসছে।এই তীব্র ভালোবাসায় তার বুকটা ভরে উঠে।ইশ, সে যদি তার মায়ের মতোন প্রেমিকা হতে পারতো।

গোপন জায়গা থেকে চিঠিটা বের করলো তর্নি।তার বাবার শেষবার সজ্ঞানে মা কে বলা কথাগুলো।সে সহস্রবার পড়েছে।আবার পড়তে লাগলো,

প্রিয় বেলাডোনা,

আমি জানি এ চিঠিটা যখন তোমার কাছে পৌঁছাবে তখন কিছু খারাপ হয়ে যাবে আমার সাথে।কানাডার এক হসপিটালে বসে কথাগুলো লিখছি।সামনে বলার সাহস নেই।হবে কীভাবে?মায়ান যখন আজ ডক্টরের রিপোর্ট পেলো তখন থেকে কাঁদছে আড়ালে।চোখ মুছে এসে অবশ্য সে ভাব প্রকাশে বিরত রেখেছে।দেখেছো কী পাগল তোমার বাবা?আমি হয়তো ওকে ভুল বুঝেছিলাম।কিন্তু মায়ান সেই চিরবন্ধুর মতোন সারাজীবন রয়ে গেলো।

আমার সমস্যা কী জানো বেলাডোনা?ফ্রান্সিসকো এতোদিন সেক্রেটারির মাধ্যমে স্লো পয়জন দিয়ে গিয়েছে।আমি বিষয়টা যখন জানলাম তখন দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।এ কারণে কানাডায় এতোটা নিয়মিত যাতায়াত ছিল।কিন্তু বোধহয় দেরী হয়ে গিয়েছিলো।জানে বেঁচে গেলেও কিছু একটা হবে।হয় আমি পুরোপুরি কোমায় চলে যাবো তা নয় প্যারালাইসিস।কিন্তু সবথেকে খারাপ হবে আমি নিজের অতীত ভুলে যাবো।সব স্মৃতি ভুলে যাবো।আমি এটা চাইনা।কিন্তু জীবনে এতো সুখ পেয়েছি যে বোধহয় এটা হবে আমার সাথে।তুমি ভয় পেওনা।ফ্রান্সিস্কো কিংবা আমার সেক্রেটারির ব্যবস্থা আমি করে গিয়েছি।শুধু তুমি ভালো থাকবে।আমার দেওয়া অনেক গুলো দায়িত্ব তোমার উপর এসে পড়লো।এতে কী তুমি আমাকে ঘৃ”ণা করবে?

লিটল চেরী তুমি আমার জীবনে সেই সময় এসেছিলে যখন আমি বোধহয় যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।সেখানে ফুল হয়ে ধরা দিলে।আমি খুব কম প্রকাশ করতে পারি এই বিষয়টাতে।তবে তোমাকে ধন্যবাদ কবীর শাহ এর জীবনে আসা।

একটা অনুরোধ রাখবে?আমি যদি সব ভুলে যাই রোজ আমাকে মনে করিয়ে দিবে?বোধহয় তুমি দিবে।

আমাদের শেষ কথা হয়তো এটা বেলাডোনা।আমি তোমার সাথে থাকবো কিন্তু আগের মতোন নয়।আমার ডাকটা আগের মতো থাকবেনা।আমাদের সংসারটা আগের মতো থাকবেনা।কিন্তু একসাথে থাকবো।এটা কী বেশী আনন্দের?স্বস্তির?তর্নি ও আহনাফকে দেখে রাখিও।ওদের নিজের মতো করে বড় করবে।এবং তাহিয়াকে বলিও ও অনেক দারুণ মা সঙ্গে বন্ধুও।আসিফ ভাইকে একবার যেন জীবনে আসার অনুমতি দেয়।বাবা,মা,আহনাফ,বৃষ্টি, ভাই, ভাবী ও দিশার জন্য আলাদা চিঠি আছে।তুমি পৌঁছে দিও।

আমার কিশোর বয়সে পত্রের প্রচলন ছিল।তখনকার মতোন এ চিঠিরও শেষ লাইন টেনে দিলাম লিটল চেরি।আমি তোমাকে সব রুপে,সব সময়ে কাছে চাই বেলাডোনা।জানি খুব স্বার্থপর।চেয়ে গেলাম কিন্তু দেওয়া হলো হলো না তেমন।

ভালো থেকো
তাইয়ুবা চৌধুরী তোশাকে কবীর শাহ এর ভালোবাসা।

(সমাপ্তি)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে