মিঠা রোদ পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
735

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৪৮
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“সহস্র কোটি বছরের দূরত্ব তোমার-আমার লিটল চেরী।আমাদের ভালোবাসাকে তুমি কীভাবে সঙ্গায়িত করবে?যেখানে বয়স,সম্পর্কের অসীম মতভেদ?”

“জীবনে সবথেকে অদ্ভূত বিষয় কী কবীর শাহ?বাবার বন্ধুকে প্রেমিক বানানো,বয়সের দ্বিগুণ পুরুষকে প্রেম নিবেদন?নাকী একজনকে ভালোবাসা, সম্পর্কের দোহায় দিয়ে ঠকানো?যা অন্যরা করে।অথবা সমবয়সী বিয়ে গুলো ভেঙে যাওয়া?আমার মা-বাবার মধ্যে কতো প্রেম ছিল একসময় সেটা আপনি দেখেছেন।আজ তারা দুই মেরুর মানুষ।সেখানে ভালোবাসা শব্দটা আমি ব্যবহার করলেও ভীষণ মেকি লাগে কথাটিকে।বস্ততপক্ষে ভালোবাসা ত্যাগ শিখায়।আমি পারবো না ত্যাগ করতে।”

“কথায় আছে যে ভালোবাসায় পূর্ণতা নেই তাতে খাদও নেই।আমি কিন্তু কথাটির সাথে সহমত নই তোশামণি।তুমি?”

তিমিরে দৃষ্টি রেখে একমনে দেখছে তোশা।মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।যুবতীর কাঁধে ঝুলতে থাকা একগুচ্ছ চুলকে দুলিয়ে দিচ্ছে বাতাস।আনমনে সে দেয়ালটিতে মাথাটি ঠেকিয়ে আছে।ধারণা করা যায় সে মোহমায়া এবং ইহজাগতিক সব বিষয় থেকে উর্ধে কিছু একটা ভাবছে।কবীরের গাঢ় শিকারী দৃষ্টি মেয়েটির মুখে আলোকছটা খুঁজে চলেছে।

” চাওয়া থেকে পাওয়া না হলো তা কীসের মায়া কবীর শাহ।মায়া তো সকলকে করা যায়।কিন্তু কাছে পাওয়ার মায়া কয়জনকে করা যায়?”

“তুমি ভীষণ বড় বড় কথা বলছো তোশামণি।যেটা এক কালে ছিলনা।”

তোশা হেসে বলল,

“খেয়াল করুন আমি একুশে পা দিতে চলেছি।”

“আর আমি একচল্লিশে।”

বাক্যের শেষটিতে কবীরের অন্ত:করণ হতে দীর্ঘ এক শ্বাস বের হয়ে এলো।কী দারুণ য’ন্ত্র’ণা কথাটিতে।তোশার কান্না পায়।আরো সন্নিকটে যায় কবীরের।বাহিরে থেকে হৈচৈ এর শব্দ শোনা যাচ্ছে।আসিফ মানুষটা এমন যখুনি পার্টির আয়োজন করে তখন হৈ-হুল্লোড় থাকবেই।

“আমরা একসাথে অনেক বছর বাঁচবো কবীর শাহ।হোক না দুজনের আলাপ স্বল্প সময়ের।তাছাড়া আপনি এখনও যা ফিট। দেখবেন আহনাফের ছেলের বিয়ে দেখে যেতে পারবেন।আর আমাদের মেয়ের মেয়ের বিয়েও।”

“তাই?তুমি কীভাবে জানলে আমাদের মেয়ে হবে?”

“জানি জানি।আচ্ছা বলেন তো এতো বয়সে আপনার চুলগুলো কীভাবে কালো থেকে গিয়েছে।গোপন রহস্যটি বলুন। ”

“হেয়ার ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি নিয়মিত।”

“এর মানে আপনিও নিজেকে গ্রুমিং করান। বাহ এজন্য তো বলি দেখতে নায়কের থেকে কম না।উল্লাস তো বলে চল তোকে আর তোর প্রেমিককে দিয়ে রহিম -রুপবান সিনেমা নতুন করে তৈরী করি।কিন্তু আমি চিনিনা এরা কারা।আপনি বলুন না কারা?”

“একটা মিথ আছে রুপবান নামক বারো বছরের বালিকার সাথে বারো দিনের বয়সী রাজপুত্র রহিমের বিয়ে হয়।এরপর বনবাসে পাঠানো হয় তাদের।নানা সময় অতিক্রমের পরে দুজনে বড় হয়।কিন্তু রহিম শেষে রুপবান বয়সে বড় হওয়ায় বিয়েটা মেনে নিতে পারেনা। মাঝে কিছু একটা হয় রুপবান যৌবন ফিরে পায়।এটা নিয়ে বহু বাংলা সিনেমা আছে।”

“আমরা কী ওরকম?আর বলবেন না যে একটা মিরাকেল হবে আর আপনি যৌবন ফিরে পাবেন।”

“সম্ভব নয়।এই কারণে তো নিজেকে গ্রুমিং করি।আমি কখনো চাইনা কেউ আমাদের দেখে বলুক ছি:মেয়েটা বেশী বয়সের লোককে বিয়ে করেছে।”

“যা সকলে আপনি না বললেও করবে।দেখুন না আপনার সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক না থাকার পরেও সুগার গার্ল বলে।এটা মানুষের স্বভাব।”

তোশার বড় মানুষের মতোন কথাবার্তা কবীরকে অবাক করে।সেই ছোট্ট কন্যাটি আজ কতোকিছু বুঝতে সক্ষম হয়েছে।মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমি ছোট্ট,মাসুম এবং আহ্লাদী এক তোশাকে ভালোবেসেছি।তোমার বড় হতে হবেনা।শুধু নিজেকে সব ঝড়ের থেকে সামলে রেখো। কবীর শাহ নামক বিশাল বাজপাখি তোমাকে ছায়া দিবে সবসময়।”

(***)

“রাস্তাঘাটে রোজ তো কতো মানুষ ম’র’ছে কবীর শাহ।দেখবেন কোনো একসময় মৃ’তের তালিকায় আপনার নাম না উঠে যায়।”

ছোটখাটো হু’ম’কি স্বরুপ চিঠি এসেছে।কবীর তোয়াক্কা করলো না তা।কাগজটিকে দুমড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।তার জীবনে বড় হওয়ার গল্পে এরকম বহু চিঠি এসেছে।পাশ কাঁটিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছে।

“স্যার, আপনার জুয়েলারিটা ডেলিভারি দিয়ে গিয়েছে।আপনি কী দেখবেন?”

“সিওর।”

এসিসট্যান্ট মেয়েটি একটা ব্যাগ কবীরের দিকে এগিয়ে দিলো।সেখান থেকে একটা বক্স বের করে নিলো।তাতে দামী একটি চুড়ি রাখা।যার গাঁয়ে ডায়মন্ড বসানো।এই বহুমূল্য জিনিসটি সে ক্রয় করেছে তোশার জন্য।যেদিন তাদের মিলনের রাত হবে সেদিন প্রেম নিবেদন করে মেয়েটির হাতে পরিয়ে দিবে।

“থ্যাংক ইউ ইয়ামিনা।তুমি আসতে পারো।”

“স্যার এটা কোনো স্পেশাল মানুষের জন্য?”

“জি তোমাদের ম্যামের জন্য।”

তোশাকে নিজ জীবন সঙ্গীনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াতে আলাদা প্রশান্তি পেলো কবীর।মিষ্টি হেসে হাতের জিনিসটা পকেটে ভরে বের হয়ে গেলো।তার প্ল্যান খুব সাদাসিধা।দুদিন পর মায়ানের বাড়ীতে অনুষ্ঠান।সেদিন সবার সামনে তোশাকে চাইবে সে।সাধারণ বিষয় অনেক কান্ড ঘটবে।কিন্তু কবীর জানে তাহিয়া রাজি হলে অন্য কারো অভিমত কী দরকার?কবীর অফিস বিল্ডিং এর নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গে জোরে একটা ফায়ারিং এর আওয়াজ হলো।প্রচন্ড ধাক্কায় বিশাল দেহটি নিচে পড়ে গেলো।আশেপাশে কোথা থেকে শ্যু’ট করা হয়েছে সেটি বুঝা গেলো না।হট্টগোল শুরু হলো মুহূর্তের মধ্যে।ফিনকি দিয়ে র’ক্ত মুহুর্তে ভূমিকে রঙিন করে তুললো।

(***)

তোশা হাত ভর্তি করে ব্রাইডাল মেহেদী দিচ্ছে।তার দাদী একটু পর পর উঁকি দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছে।অদ্ভূত বিষয়।দুদিন পর তাদের বাড়ীতে অনুষ্ঠান তাই বলে কী এভাবে মেহেদী দিতে হবে?তোশার অণুকরণ করে অন্যসব মেয়েরাও বায়নায় মেতেছে।

“তুমি এতো গর্জিয়াস মেহেদী কেন দিচ্ছো তোশা আপু?মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে যাবে।”

“হতেও পারে।কিন্তু তোমরা সবাই কেন দিবে?”

“দেখাদেখি।এক মিনিট দাঁড়াও কার নাম লিখেছো দেখি?”

“তুমি বুঝবে না।”

তোশা আগে থেকে আর্টিস্টকে কৌশলে শাহ লিখতে বলেছিল।এটা যদিও কেউ বুঝবে না তবুও সে কাওকে দেখাতে নারাজ।তারা সকলে বারান্দার কাছটায় বসে ছিল।হুট করে গেইটের সামনে একটি গাড়ী থামলো।তোশা চিনে গাড়ীটাকে।মিনিট খানেক বাদে তাহিয়া হন্তদন্ত বাড়ীর দিকে ছুঁটছে।মানুষটার ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে আছে।তোশা দুহাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁটলো।

“আম্মু,তুমি এখানে?কী হয়েছে?”

“তোমাকে নিতে এলাম তোশামণি।হসপিটালে যেতে হবে।”

“নানার কিছু হয়েছে?”

“নাহ কবীরের।ওকে কেউ শ্যু’ট করেছে।তুমি এতো মেহেদী কেন দিয়েছো হাতে?ধু্ঁয়ে এসো।”

তোশা নিস্তেত কণ্ঠে শুধালো,

“তিনি কেমন আছেন মা?”

“আইসিইউতে।তুমি ধুঁয়ে জলদি এসো।”

তোশা নির্বিকার হয়ে দুহাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অদ্ভূতভাবে ভেতর থেকে সে কাঁপছে।ভয় লাগছে।বুক ফেঁটে কান্না আসছে।মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।মানুষটা কী শেষ হয়ে যাবে?এই আশংকায় বুকের হৃদস্পন্দন বাড়ছে।আশ্চর্য এরকমভাবে কাঁদলে সে কৈফিয়ত দিবে কী?কবীর শাহ এর কী হয় তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা?

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৪৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমি তো বিচ্ছেদ চাইনি।কিংবা উপন্যাসের শুরুতে বিয়োগান্ত অধ্যায় শুরু হোক সেটাও চাইনি।তাহলে কবীর শাহ সাথে এরকম হলো কেন?”

তোশার মনে এমন হাজারও প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে।কিন্তু জবাবের আশায় কারো কাছে তা ব্যক্ত করতে পারছেনা।হসপিটালের নিচ তলায় সকলে বসে আছে।মায়ান অবশ্য উপরে গিয়েছে।তোশার খুব করে নিজ বাবার সাথে যেতে মন চাইলো।ক্ষণবাদে মায়ান হন্তদন্ত করে নেমে এলো।কবীরের বাবা সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কবীর সুস্থ আছে আঙকেল।গু’লিটা বাহুতে লেগেছিল ভাগ্যিস।ডক্টররা তো এমনিতে আইসিউ এর ভেতরে দিয়েছিল।”

“দেখা করা যাবে?”

“কেবিনে শিফট হোক আগে।”

সুখবর এলো তোশার জন্য।এখনও কান্না পাচ্ছে তার।অধরযুগল দ’ং”শ’ন করে তা থামানোর চেষ্টা করলো।মায়ের বাহুতে আস্তে করে মাথা ঠেকালো।তাহিয়া মেয়েকে যত্নে আগলে নিয়ে বলল,

“খারাপ লাগছে তোশামণি?বাড়ী যাবে?”

“দেখা করে যাই আম্মু।”

“আজ এতো মানুষকে দেখা করতে দিবেনা।পরিবারের মানুষজন দেখা করুক আগে।”

“আমরা পরিবারের মানুষ নই?”

“ফ্যামিলি ফ্রেন্ড।”

তোশা অমীমাংসিত দৃষ্টি নিয়ে তাহিয়াকে দেখছে।সে তো নিজ মা কে জানাতে পারছেনা দুদিন পর কবীরের সবথেকে আপন সে হতো।

“আম্মু,আজকে বাবার বাসায় যাবো না।তোমার কাছে থাকবো।”

“তোমার জিনিসপত্র?”

“থাকুক।কাল তো আবার চলে যাবো।”

“দাদুবাড়ী ভালো লাগেনা তোশা?”

“একটুও না।মা কবীর শাহ ঠিক হয়ে যাবে তো?”

“যাবে।ও অনেক স্ট্রং একজন মানুষ।যখন তোমার বাবা ও আমার সম্পর্ক সকলে জানলেন তখন কতো কথা হতো।সবকিছুর জবাব কবীর নিজে একা দিতো।সেই বেপরোয়া মানুষটিকে এতো সহজে কেউ আঁটকাতে পারবেনা।দেখো না আমাদের মতোন দুজন অসহায় মানুষের সামনে ঢাল হয়ে থাকে সবসময়।তোমার সিয়া ম্যামও কিন্তু কবীরের আপন বোন নয়।এরকম বহু উদাহরণ আছে ওই মানুষটার।সব ভালো কাজের বিনিময় তো পাবে।”

তোশা শক্ত করে মা কে আঁকড়ে ধরলো।শব্দহীন তার ঠোঁট নড়তে লাগলো কবীর শাহ এর সুস্থতার জন্য।

(***)

সারাটি রাত ঘুমাতে পারেনি তোশা।সকালে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে বিছানাতে উঠে বসলো সে।কী অদ্ভূত কাঁদতে না পারার য’ন্ত্র’ণা।হসপিটালের নিয়ম অনুযায়ী সকাল দশটায় দেখা করা যাবে।এখন বাজে সবে সকাল সাতটা।তবুও তোশা রেডি হচ্ছে।মেয়ের এমন উৎসুকতাকে তাহিয়া সাধারণ কৌতুহল কিংবা সম্মান হিসেবে বিবেচনা করে নিলো।

“আম্মু আর কতোক্ষণ লাগবে তোমার?আমি তৈরী হয়ে নিয়েছি।”

“এতো সকালে যাবে তোশামণি?এখান থেকে হসপিটাল কিন্তু বেশী দূরে নয়।”

“চলো না মা।অল্প সময় না হয় বসে থাকবো।”

মেয়ের জোড়াজুড়িতে তাহিয়া রেডি হতে চলে গেলো।নারীটির বয়স একচল্লিশ হবে কয়েকদিন পর।কিন্তু দেখে উপায় আছে?মার্জিতভাবে শাড়ী পরে নিলো।কিন্তু সবথেকে অগোছালোভাবে আজ তৈরী হলো তোশা।ছোটখাটো অভিনেত্রী যাকে বলা যায় তার এমন সাজে বের হওয়া বেমানান লাগে।গাড়ীতে বসে তাহিয়া খেয়াল করলো তোশার মেহেদী ভীষণ লাল রঙ দিয়েছে সারারাত রাখার পর।সে হেসে বলল,

“জানো তো তোশামণি।মা আমাকে বলতো মেহেদীর এতো গাঢ় রঙ হওয়া মানে বিয়ের জীবনে সুখী হওয়া।যদিও কথাটি মিথ্যা।”

তোশা মায়ের বুকের দীর্ঘ শ্বাস উপলব্ধি করতে পারে।বিরস মুখে জানালার বাহিরে তাঁকালো।হসপিটালে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যকটি সময় গুণছে সে।

(***)

“তোর এতো বড় শত্রু কে কবীর?একদম সিনেম্যাটিক স্টাইলে কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।আমার মাথায় অবশ্য একজনের নাম আছে।”

“তুই যার নাম বলবি মায়ান।সেটা আমিও ভাবছি।ফ্রান্সিসকো!ও বলেছিল জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি যেখানে থাকি দেখে নিবে।”

“ভাগ্য ভীষণ সদয় ছিল তোর উপর।আন্টির দোয়া গুলো কাজে লেগেছে।তা নয় তোকে মীরা আপু হঠাৎ ডাকবে কেন?আর তুই পিছনে তাঁকাবি।”

“ঠিক।মা কোথায়?এখন যদি আসতে চায় বলবি ঘুমাচ্ছি।”

“বাড়ীতে পাঠিয়েছি।যদিও আমার ছোট্ট মা তোশামণি তোকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে।সেই ভোর পাঁচটায় আসতে চেয়েছিল।”

“কখন আসবে?”

কবীরের কণ্ঠে উত্তেজনা কিন্তু মায়ানের চোখ এড়ায় না।মৃ’ত হয়ে যাওয়া অভিশংকা সজীব হতে শুরু করে।

“আসছে বলল।”

কবীরের সঙ্গে আরো টুকটাক কথা হলো মায়ানের। পুরোটা ফ্রান্সিসকো কে নিয়ে।বছর পনের আগে কবীর যখন বিদেশে ছিল তখন লোকটার সাথে দেখা হয়। অনেক প্রাণবন্তু ও খোশমেজাজের লোক ছিল।এলাকার সকলের ভীষণ প্রিয়ও ছিল।কবীরের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হওয়ায় ফ্রান্সিসকো এর বাড়ীতে যাতায়াত ছিল।একদিন সেখানে গিয়ে কবীর দেখতে পায় লোকটা যদিও তখন যুবক ছিল এক শিশু কন্যাকে নি’র্যা’ত’ন করছে।সে তৎক্ষনাৎ পুলিশকে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দেয় লোকটাকে।ফ্রান্সিসকো কবীরকে অনেক অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলো।তাই গ্রেফতার হওয়ায় মনে করলো কবীর বেইমানি করেছে।সেদিন বলে গিয়েছিলো যেদিন সুযোগ পাবে দেখে নিবে কবীরকে।হয়তো এতো বছর পর সুযোগটা পেয়েছে।মায়ান চলে যাওয়ায় নির্জন কেবীনে এসব ভাবছিলো কবীর।দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাঁকালো।তাহিয়া ঢুকলো প্রথমে তার পিছনে চাঁদের আলো হয়ে এলো তোশা।মলিন মুখ,শুষ্ক অধর,ফোলা চোখ,ক্লান্ত তনু।তবুও যেন চাঁদের সব থেকে উজ্জ্বল আলোকরেখাটি।

“কেমন আছো কবীর এখন?সরি রাতে দেখা করার সুযোগ মিলেনি।”

“এখন ভালো।কিন্তু বহুদিন জিম করতে পারবো না।”

“আশ্চর্য।এই অবস্থায় জিমের চিন্তা আসছে কীভাবে?আহনাফ ফিরেছে সিলেট থেকে?”

“নাহ।ওকে বৃষ্টি আনতে গিয়েছে।আমার এই খবরটা জানেনা।”

“খুব কাঁদবে ছেলেটা।”

কবীরের স্বল্প দৃষ্টি তখন তোশার উপর।যে মেয়েটা অভিমানে শুভ্র দেয়ালের দিকে তাঁকিয়ে আছে।যুবতীর উদ্দেশ্যে কবীর শুধালো,

“কী খবর তোশামণি?অসুস্থ লাগছে তোমাকে।”

তাহিয়া মেয়ের হয়ে জবাব দিলো,

“তোমার জন্য ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।দেখো না সকাল সকাল এসে পড়েছি।”

“মায়ানেও সেটা বলছিলো।”

“সে এখানে?”

“বাহিরে গিয়েছে।এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে।”

তাহিয়া এবার নড়েচড়ে বসলো।কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে যেতে চাইলো।কিন্তু তোশা বেঁকে বসলো।কবীরও সায় দিয়ে বলল,

“তোশা থাকুক। আমার সঙ্গ হবে।তাছাড়া মায়ান এসে পড়বে একটু পর।”

“আচ্ছা।নিজের খেয়াল রেখো কবীর।তোশামণি আসছি আমার অফিস আছে।”

তাহিয়া চলে গেলে তোশা নিজের জায়গাতেই বসে থাকলো।কবীর মেয়েটার হাত দেখছে।শুভ্র হাতে থোকায় থোকায় গোলাপ ফুঁটেছে।

“কাছে এসো বেলাডোনা।এখন সিনেমার মতোন বলো না সব দোষ আমার।নিজের খেয়াল রাখিনি তাই এমন হয়েছে।”

“সেটা বলবো না।কিন্তু আমার খুব কান্না পাচ্ছে।ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে তাইনা?”

কবীর মাথা এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে বলল,

“না বেবি গার্ল।”

তোশা নিজ জায়গা থেকে উঠে অতি সন্তপর্ণে কবীরের পাশটায় বসলো।কতো আশংকা, কতো ভয়।এখনও যে শেষ হচ্ছে না।বাম হাতে ক্ষ’তটি হয়েছে মানুষটির।শুভ্র ব্যান্ডেজটা র’ক্তি’ম হয়ে আছে।

“আমি একটু স্পর্শ করি?”

“করো।”

তোশা আস্তে করে সেখানে স্পর্শ করে নিজে উহু করে উঠলো।যেন ব্যাথা সে পেলো।

“গু’লি লাগলে অনেক ব্যাথা করে তাইনা?”

“নো।ইঞ্জেকশনের অনুরুপ হালকা লাগে।”

“মিথ্যা।আপনার মনটা লোহা হলেও শরীরটা তো নয়।বাজপাখি কোধাকার।”

“কমপ্লিমেন্ট দিলে?”

“নাহ।খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি।”

কবীরের ঘাড়ে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে তোশা।সে এতো তাড়াতাড়ি ম’র’ণ নামক বিচ্ছেদের অংশীদার হতে চায়।কবীর ঘাড়ে সিক্ততার ছোঁয়া পেলো।মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমাদের কাহিনী এতো সহজে শেষ হয়ে যাবেনা বেলাডোনা।এখনও সুন্দর একটি সংসার হওয়া বাকী।”

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫০
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আপনার কী খুব ব্যাথা করছে?য’ন্ত্র’ণা লাগছে?ডক্টরকে ডাকবো?”

তোশা ব্যস্ত হয়ে কবীরকে প্রশ্নগুলো একের পর এক করে যাচ্ছে।অন্যদিকে মানুষটি ধীর, শান্ত মেজাজে এক মনে পাশে দাঁড়ানো যুবতীর উৎকণ্ঠা মেপে নিচ্ছে।সে কী ভেবেছিল ছোট্ট ফোলা ফোলা গালের মেয়েটিকে সে ভালোবাসবে?বরং খুব বেশীই ভালোবাসা তৈরী হবে?যে তার দুঃখে দুঃখিত হবে।াতার ব্যাথার চোটে যার মুখবিবর নীল আভা ধারণ করবে।

“আমার য’ন্ত্র’ণা করছে সেটা কীভাবে জানলে তুমি?”

“চোখের ভাষায়।”

“কীরকম বেলাডোনা?আমার চোখ কী বলছে?”

“বলছে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।ক্ষ’ত জায়গায় ব্যাথা করছে।”

কবীর হেসে ফেললো।এই সময় শঙ্খের মতোন শুভ্র দাঁতটা দৃশ্যমান হলো।হসপিটালের আকাশী রঙের পোশাকে কালো কবীরকে মানাচ্ছে না।বড্ড পানসে লাগছে দেখতে।

“ইয়াং ওমেন।ক্ষ’ত একজনের হয় ব্যাথা আরেকজনে পায়।তোমার -আমার তাহলে দুই প্রাণ এক শরীর।”

বিদ্রুপে তোশার মন খারাপ হয়।সে তো শুধু চিন্তা করছে মানুষটিকে নিয়ে।এই চিন্তা কী দোষের?এখনও মায়ান ফিরেনি।কবীরকে দেখতে বার কয়েক নার্স এসেছিল।সব বলে ঠিক আছে কিন্তু বারবার মানুষটি সিলিঙ ফ্যানের দিকে তাঁকিয়ে নির্জীব হয়ে যাচ্ছে।তোশা পাশে বসে কবীরের চুলের গভীরে আঙুলের সাহায্য স্পর্শ করলো।অন্য হাতটি বুকে রেখে বলল,

“বাচ্চামো বলুন কিংবা অল্প বয়সী উত্তেজনা কবীর শাহ।আমি ভীষণ চিন্তিত আপনাকে নিয়ে।যে কারণটি বললেন অসুস্থ হওয়ার তাতে ভয় আরো বেড়ে গেলো।লোকটি যদি ধরা না পড়ে?”

“পড়বে আমি বেঁচে না থাকলে হয়তো বেঁচে যেতো।মায়ান কিছু সন্দেহ করছে তোশা।”

তোশা চমকে উঠলো।সোজা হয়ে বসে বলল,

“কী দেখে?”

“ওর কথার মাধ্যমে বোঝা গেলো।তবে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।এমনিও তো আমরা কালকে সকলকে জানানোর ইচ্ছায় ছিলাম।বিষয়টি এখন যা পিছিয়ে গেলো।”

“হুঁ।”

“মন খারাপ করলে এরকম অসুস্থতায়?”

“আপনার এখানে কোনো হাত নেই।”

দরজার বাহিরে মায়ানের কণ্ঠ শুনে তোশা দূরে সরে গেলো।তখুনি তার বাবা ভেতরে প্রবেশ করলো।মেয়েকে দেখে একটু অবাক হলো সে।

“তোশা তুমি একা কেন?”

“আমাকে দেখতে এসেছিল তাহিয়া।ওকে রেখে গিয়েছে।তোর সঙ্গে বাড়ী ফিরবে তাই।”

মায়ানকে তবুও সন্তুষ্ট হতে দেখা গেলো না।সে কবীরের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে তোশাকে নিয়ে চলে গেলো।শূন্য রুমে এবার কবীরের মুখের রঙ বিবর্ণ হতে দেখা গেলো।বুকে খুব বেশী ব্যাথা করছে তার।চট জলদি নার্সকে ডেকে নিলো।সে সত্যিই খুব কষ্টে ছিল এতোক্ষণ।কিন্তু চায়না তোশা আরো কষ্ট পাক।

কবীরের মাথায় আরো একটি বিষয় উত্থিত হচ্ছে।যদি কাল সে ম’রে যেতো কিংবা গুলিটা ঠিক হৃদপিন্ড বরাবর এসে আ’ঘা’ত করতো তাহলে তোশা নিজেকে কীভাবে সামলে নিতো?দীর্ঘ এক জীবনে সব থেকে বড় কষ্ট তবে এটাই হতো মেয়েটির জন্য।কবীর যেহেতু জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করে এসেছে তাই তার কাছে এখন সূর্যাস্তের সময়টা বাকী আছে।সেখানে তোশার জীবনে কেবল উজ্জ্বল সকাল।এরমধ্যে নিজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সবথেকে স্বার্থপরের মতোন কাজ হবে।একটা আ’ঘা’তে কবীরের মন পরিবর্তন হচ্ছে।কিন্তু পরক্ষণে ভাবছে তোশাকে সুন্দর একটি সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছে সে একটু আগেও।সেই ওয়াদার কী হবে?কবীরের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।ডক্টর দেখে ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলো।শরীরের ব্যাথা কমে এলেও মনের ভেতর বয়ে যাওয়া আশংকার তীব্র ঝড় কমেনা।

(***)

মায়ানের বাড়ী তোশার নিজের হলেও ততোটা আপন মনে হয়না।কাল অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু এখানে এসে শুনতে পেলো কবীরের অসুস্থতায় তা হচ্ছে না।এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাচ্ছে।

“তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে তোশা।শরবত করে এনে দেই?খাবে?”

টিনাকে আন্তরিকতার সাথে না করে দেয় তোশা।মানুষটা তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী।এই কারণে কিছুটা এড়িয়ে চলে।বিষয়টি বুঝতে সমস্যা হয়না টিনার।সে হেসে বলে,

“আমাকে অপছন্দ করো তুমি তাইনা?”

“সেরকম নয়।আপনি ভুল ভাবছেন আন্টি।”

“তোমার মায়ের সাথে একদিন আলাপ করিয়ে দিবে?কথা বলার ইচ্ছে ছিল।”

“কেন?”

“এমনি।আলাপ করার ইচ্ছেটা।”

তোশা বার কয়েক চোখের পলক ফেললো।কিছু মানুষের অহেতুক কৌতুহল তার পছন্দ নয়।শক্ত কণ্ঠে বলল,

“আমার মা আপনার সাথে কথা বলার জন্য কম্ফোর্টেবল বোধ করবে না।সেক্ষেত্রে আলাপ না হওয়া ভালো।”

“শুনো দ্বিতীয় স্ত্রী যে হয় সে খারাপ হবে এমন কথা নেই।কখনো তাহিয়াকে নিজের কম্পিটিটর রুপে দেখিনি।”

“কারণ সে আপনার সাথে কম্পিটিশনে নামেনি।আমার বাবাও কোনো সুসজ্জিত ট্রফি নয়।”

ড্রয়িং রুম থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো তোশা।টিনা বার দুয়েক ডাকলো।কিন্তু সে উত্তর করলো না।ঘরে ঢুকে দরজাটি ভালো করে বন্ধ করে দিলো।হেলেদুলে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিলো।শব্দ করে চিকন ধারায় পানি ঝড়ছে।সঙ্গে বাড়ছে কান্নার বেগ।এক সময় মেঝেতে বসে আর্তনাদ করে উঠলো সে।কালো কেশগুচ্ছ পানির ছোঁয়ায় উজ্জ্বলিত হচ্ছে।ফর্সা মুখটা মুহুর্তে লাল হয়ে উঠলো।তোশার মনে অনেক দুঃখ।কিন্তু সেটা কেউ বুঝেনা।বি’ষ’ধ’র সাপের মতোন রোজকার জীবনে অনেকগুলো চিন্তা রোজ দ’ং’শ’ন করে চলেছে।কবীরের কিছু হলে সে কী করতো?মনে নানা ভয় উঠে।সেগুলোকে কান্নার সাথে গিলে নেয়।অনেকটাক্ষণ শাওয়ারের নিচে বসে কান্না করলো তোশা।মাঝে কেউ খোঁজের জন্যও এলো না।অথচ মায়ের বাসা হলে এতোক্ষণে দরজা ভে’ঙে ফেলতো তাহিয়া।মা তার ভীষণ ভালো একজন মানুষ।তাকে কীভাবে নিজের ভালোবাসার কথা জানাবে?কিন্তু তোশাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।কাপড় বদলে রুমে এসে সে উল্লাসের নাম্বারে ডায়াল করলো।

“উল্লাস!আমি আজকে নিজের শটটা আজকে দিতে চাচ্ছি।”

উল্লাস কিছুসময় নীরব থেকে বলল,

“তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস তোশা।ভয় নেই কবীর শাহ ঠিক আছে।হসপিটালে এতোক্ষণ ছিলাম আমি।”

“উহু,আমি দিবো।এক সপ্তাহের মধ্যে টেলিকাস্ট করতে বলবি।”

“বলবো।কিন্তু…।”

“উল্লাস কবীর শাহ জীবনের অনেকগুলো দিন অতিবাহিত করে ফেলেছে।আমি একা থাকতে চাচ্ছি না আর।”

“তাকে অনেক ভালোবাসিস তাইনা?”

“হ্যাঁ।”

এলেমেলো উল্লাস বেদনায় হাসে।বিনা শব্দে ফোন কেঁটে দেয়।ভালোবাসা কী অদ্ভূত জিনিস।তার মা ভালোবাসলো সে ডুবলো,তোশা ভালোবাসলো সে-ও ডুবলো।চারিধারে যারা ভালোবাসে তারা ডুবে যায় কষ্টের অতল সাগরে।এলেমেলো উল্লাস তাইতো ভালোবাসবে না।কখনো না।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে