#মিঠা_প্রেম
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৯
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষেধ)
মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী।সাথে অদ্ভুত এদের প্রত্যাশা। এরা সেই দুনিয়ায় ইই শান্তির সুখের খোঁজ করে যে দুনিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম(আ) ও হাওয়া(আ) কে শাস্তি সরূপ পাঠিয়েছিলেন।আনান ভুলে গেছিলো এই কথা।তাই জুঁই জীবনে আসার পর ভেবেছিলো অবশেষে জীবনে শান্তি এসেছে।সেদিনের পর আনানের প্রতিটা মুহুর্ত তীব্র পীড়াদায়ক লেগেছে। জুঁইকে হারানোর ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।সপ্তাহখানেকের মতো হলো জুঁইয়ের পরীক্ষা শুরু হয়েছে।যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাকে একেক্টা মুহুর্ত একেক্টা শতাব্দীর মতো লাগে আনানের।
_____💗
” দেখ ভাই কি সুন্দর মা**ল!”
” আয় বিয়ে করিয়ে দিই।”
” পারবা অন্য কারও পাশে আমায় দেখতে?”
টিপ্পনীর জবাবে টিপ্পনী কেটে বলে শালিক।কলেজ শেষে ঘুরতে এসেছিলো আহান শালিক।বাইকে হেলান দিয়ে ফটোসেশান করতে থাকা এক ছেলেকে দেখে শালিক এই মন্তব্য করে।তামিমের ঘটনাটার পর থেকে কেমন যেন চুপসে গিয়েছিলো শালিক।খুব একটা কথা বার্তা বলতো না। সবাই বয়সন্ধির ধরেই নিয়েছিলো বয়সন্ধির জন্যই শালিকের এই পরিবর্তন। আহানও বাকীদের মতোই ভেবেছিলো কিন্তু না সে ভুল ছিলো।শালিক একটুও বদলায় নি।নিজের সরলতা বাচ্চামি গুলোকে স্বার্থপর ভয়ানক পৃথিবী থেকে আড়াল করেছে।বাইরের রুক্ষতা দিয়ে সে নিজের ভেতরের কোমলতাকে রক্ষা করতে এক শক্তিশালী দেয়াল তৈরি করেছে।যেটা আহান নিজের অজান্তেই ভেদ করেছে।আসলে ইন্ট্রোভার্ট এক্সট্রোভার্ট বলে কোনো শব্দ নেই।সমাজে আমরা যাদের ইন্ট্রোভার্ট বা অসামাজিক বলে থাকি তারা আসলে মানুষের আসল রূপ দেখে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এবং একটা কমফোর্ট জোনের অভাবে মানুষের সাথে মিশতে পারে না।মোট কথা সবার মাঝে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে না।গুটিকয়েক মানুষ এদের জীবনে থাকে এবং তাদের মধ্যেই তারা নিজেদের কমফোর্ট জোন খুঁজে পায়।ঠিক যেমনটা শালিকের ক্ষেত্রে হয়েছে।আহানের মধ্যে নিজের কমফোর্ট জোন খুঁজে পাওয়ায় শালিকের অজান্তেই তার ভেতরের সরলতা বাচ্চামো প্রকাশ পেয়েছে।
দু’জনে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে।দুধ চা অর্ডার করে।অর্ডারের সময় চা ওয়ালা মামাকে শালিক বলে,,,
” মামা একটায় চিনি দিও না।”
আহান একটু অবাক চোখে শালিকের দিকে তাকায় শালিক ভাবলেসহীন ভাবে বলে,,,
” এভাবে তাকানোর কি হলো?”
” তুই…চায়ে চিনি খাস না?”
” উহু,চা কফি কিছুতেই চিনি খাই না।মিষ্টি জিনিস ভাল্লাগে না।বাসায় মিষ্টি আনলে চেপে রস বের করে পানি দিয়ে ধুয়ে খাই।অনেক মজা লাগে।ট্রাই করে দেখিয়ো।”
” তাই তো বলি এত তেঁতো কথা আসে কোথা থেকে।চিনি ছাড়া চা,ব্ল্যাক কফি খাওয়া মেয়ের মুখ থেকে মিষ্টি কথার আশা করা নেহাৎ ইই বাংলাদেশে তুষারপাত আশা করা।”
বিরবির করে বলে আহান।শালিক আহানকে প্রশ্ন করে,,,
” কিছু বললে ভাইয়া?”
” ডোন্ট কল মি ভাইয়া।বয়ফ্রেন্ডকে ভাইয়া ডাকে কোন গ র্দ ভে?”
রেগে গিয়ে বলে আহান।শালিক মুখ টিপে হাসে।আহান আরও বিরক্ত হয়।ঝাড়ি দিয়ে বলে,,,
” হাসবি না।”
” বাঁচতে হলে প্রচুর হাসতে হবে আর গার্লফ্রেন্ডকে তুই ডাকে কোন ছা গ লে?”
” ইদানীং মুখে খৈ ফুটেছে তোর।ভুলে যাস না আমি তোর বড়।”
” তুইও ভুলে যাস না আমি তোর গার্লফ্রেন্ড। ”
শালিকের মুখে তুই ডাক শুনে আহান অবাক না হয়ে পারে না।যে আহানের ভয়ে মানুষজন কাঁপে সেই আহানকে এই পুঁচকে মেয়েটা তুই বলছে!গম্ভীর গলায় বলে,,,
” পুচকে মেয়ের সাহস হয়েছে অনেক দেখছি।”
” মেয়ে পুচকে হলে কি হবে?বুকের পাডা আমার ইয়ায়ায়া বড়।”
ভাব নিয়ে বলে শালিক।এমন সময় ইই আনুমানিক তেরো-চৌদ্দ বছরের এক কিশোর চা নিয়ে আসে।একটা কাপ শালিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,,,
” আপা এইটায় চিনি নাই।”
শালিক চায়ের কাপটা নিয়ে আলতো করে চায়ে চুমুক দেয়।আহানও আরেকটা চায়ের কাপ নেয়।পাশের ব্রেঞ্চে কাপ খানা রেখে বলে,,,
” কত হলো?”
” চল্লিশ টাকা ভাইজান।”
ছেলেটার হাতে টাকা দিয়ে আহান চায়ের কাপ খানা হাতে নেয়।চুমুক দিতে যাবে ঠিক সেই সময় শালিক,,,
” দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও! ”
আহান চমকে যায়।বিরক্তি নিয়ে বলে,,,
” কি হলো? ”
” ফার্স্ট টি ডেটে এসেছি।ছবি তুলবো না?”
কথাটা বলে চায়ের কাপটা আহানের হাতে দেয় শালিক।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে টুক করে চায়ের কাপ দুজন হাতে নিয়ে ছবি তোলে।আহান বিরক্তি নিয়ে বলে,,,
” এটা পোস্ট দিবি নাকি?”
” পাগল নাকি!”
” তাহলে ছবি তুললি যে!”
” এমনি,স্মৃতি হিসাবে রাখার জন্য।পার্সোনাল মেটার স্পেশালি লাভ লাইফের বিষয়গুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করলে মানুষ বদনজর দেয়। এজন্য অনেক মানুষের ডিভোর্স পর্যন্ত হয়েছে!”
কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছা মাত্রই শালিকের প্রতি আলাদা নতুন করে মুগ্ধতা আসতে লাগে আহানের।সৃষ্টিকর্তার রহস্যময় সৃষ্টির মধ্যে নারী জাতি অন্যতম।কখনো বাস্তবতাকে ঘিরে এরা সত্তরোর্ধ বৃদ্ধার ন্যায় ম্যাচিউর কথা বার্তা বলে বা কখনো পাঁচ বছরের শিশুর ন্যায় আচরণ করে।কখনো হয়ে যায় হৃদয়হীনা আবার কখনো মমতাময়ী।একটা দেহের ভেতর এরা অগণিত ব্যাক্তিত্ব ধরে রাখতে জানে। আহানের চাহনি দেখে শালিক তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।ফাজলামো করে আহানের হাতে গরম কাপ ছোঁয়ায়। উত্তাপ পেয়ে ” উউ” বলে আহান লাফ দিয়ে উঠে। শালিক হেসে দেয়।আহান বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলে,,,
” এত ফাজলামো করিস কেন তুই?”
” আমি মোটেও এত ফাজলামো করি না।শুধু তোমার সাথেই এত ফাজলামো করি।তোমায় জ্বালাতে,বিরক্ত করতে আমার ভাল্লাগে।”
আহ্লাদী কন্ঠে বলে শালিক।শালিকের কথা শুনে আহানের ভালো লাগে কিন্তু প্রকাশ করে না।থাক না কিছু অনুভুতি অপ্রকাশিত।
______💗
রাতে পড়তে বসে আহান আনানকে ফোন দেয়।অনেকদিন হলো কথা হয় না।অনলাইনে থাকলেও মেসেজ সীন করে না।রিপ্লাই তো দূরেই থাক।দু তিনবার কল দেওয়ার পর চার বারের বেলায় আনান ফোন রিসিভ করে।
” কি রে?হঠাৎ ফোন দিলি যে!”
” হু,তোমার ভাই তো সব হঠাৎ হঠাৎ ইই করে।জুঁই আপুর সাথে এতটাই ব্যস্ত থাকো যে আমার মেসেজ সীন করার পর্যন্ত সময় হয় না?”
আহানের মুখে জুঁইয়ের কথা শোনা মাত্রই আনানের চোখ মুখ আরও মলিন হয়ে যায়।মলিন হয়ে যায় কন্ঠস্বর।ভেতরের চাপা কষ্টকে কোনো রকমে নিয়ন্ত্রণ করে বলে,,,
” না রে আহি।ওর ইন্টার পরীক্ষা চলে কথা হয় না।”
আহান বুঝতে পারে আনানের কন্ঠস্বর ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে।কেমন একটা চাপা কান্নার উপস্থিতি পাচ্ছে আহান আনানের কন্ঠে,,,
” ভাইয়া?কিছু হয়েছে?এরকম লাগছে কেন গলা?”
” না রে কি হবে?ঠান্ডা লেগেছে হয়তো তাই অস্বাভাবিক লাগছে।”
” ঠান্ডার ধাঁচ আমার আছে তোমার না।আটলান্টিক মহাসাগরে চু বি য়ে রাখলেও তোমার কিচ্ছু হবে না।আপুর সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
” জুঁই ঝগড়া করার মতো মেয়ে ইই না আমার কাছে।”
” তাহলে?”
আনান বলতে গিয়েও বলতে পারে না।ভেতরের কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসে কাঁটার মতো বিদ্ধ হচ্ছে।
” আহি আমি রাখছি।ঘুমাবো।তোকে অন্য কোনোদিন সময় করে বলবো নি।”
ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দেয় আনান।ফোনের ওপাশ থেকে আহান হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিছু একটা তো হয়েছেই আনানের।না হলে সে এমন করবে কেন?বুঝ হওয়ার পর থেকে আহান আনানকে চিনে আসছে।ছেলেটা সবার থেকে আলাদা।দাদির থেকে আহান শুনেছে।আনান দুঃখে সর্বশেষ কেঁদেছিলো বাবার লা শ দেখে।রক্তাক্ত নিথর আরিফ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড কেঁদেছিলো সে।তারপর কাঁদে মায়ের বিয়ের সময়।আশরাফ সাহেবকে বাবা ডাকতে বলায় সে তার কি রাগ!রাগে কান্নাকাটি করে জিনিস ভাঙচুর করেছিলো।এতে মিসেস লাকীও প্রচন্ড রাগ করেছিলেন।মে রে ও ছিলেন ছেলেকে।তারপর থেকে আনান না তার মা কে মা ডাকে আর না আশরাফ সাহেবকে বাবা।আজ প্রায় একুশ বছর পর আনানের কন্ঠস্বরকে কান্নার ছোঁয়া পেয়েছে।আর আহান এই প্রথম আনানের এই রূপ দেখলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহান বলে,,,,
” ভাইয়াকে যতটা কঠিন ভেবেছিলাম ভাইয়া অতটা কঠিন না।ভাইয়ারও মন আছে দুঃখ কষ্ট আছে।কথায় বলে না, অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর।ভাইয়া পাথর হয়ে গিয়েছিলো।ভাইয়া কাঁদতে পারলে কাঁদুক।খুব কাঁদুক।একটা মানুষ কত ইই আর চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতো!”
চলবে