‘তিতির, আজ কি এনেছিস লাঞ্চে?’
রায়হান, তুই এতো ছোঁচা কেন? রোজ এসে তিতিরের লাঞ্চ খুঁজে খুঁজে খাস। আন্টিকে বলতে পারিস না বানিয়ে দিতে? কাল রাতেও তো দেখলাম স্ট্যাটাস দিয়েছিস, হ্যাভিং বিরিয়ানী উইথ মম।
‘আহা নিলয় থাম তো। রায়হান খায় দেখেই আমার রক্ষা। আম্মার রোজদিন রান্নার এক্সপেরিমেন্টে আমি টায়ার্ড।’(তিতির)
‘ কি রে ছোঁচা আজকেও তিতিরের লাঞ্চ খতম? এই শোন কাল আমার বাসায় রাতে তোদের দাওয়াত। এই ছোঁচা রায়হান তোর দাওয়াত দুপুর থেকে। তুই দুপুরে চলে আসিস।’ (শুভ)
আমার বন্ধুরা রোজ আমাকে খাবার নিয়ে খোঁচা দিলেও আমি কিছু মনে করিনা। ওরা এমনই। এর মানে এই না যে ওরা আমাকে ভালবাসেনা। কিন্তু কি করবো তিতিরের আম্মুর রান্না যে এতো মজা, একদম আমার মায়ের রান্নার মতো। কতবার ওদের বলতে চেয়েছি আমি যতোটা আগ্রহ নিয়ে খাবারটা খাই তার পুরোটাই খাবারে মেখে থাকা মা মা গন্ধটা বুক ভরে পাবার জন্য।
……………
আমার বাবা মা দুজনেই ছিলেন নার্স। ছিলেন বলছি কারণ আমার জীবনে মায়ের অস্তিত্ব এখনো থাকলেও বাবা আমাদের জীবন ছেড়ে চলে গেছেন বহুদিন আগে। একই সাথে পড়াশোনা আর কাজের সুবাদে বাবা মায়ের সখ্যতা হয় নার্সিং পড়ার সময় থেকেই। প্রেমের সম্পর্ক দু পরিবারেই মেনে নেয়ার ব্যাপারে বাঁধা ছিল বিধায় দুজনেই বিদেশে চলে যাবেন বলে মনে মনে ঠিক করে রাখেন। সেসময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের নার্সদের বেশ চাহিদা ছিল। দুজনের এক সাথে চাকুরী হয়ে যাওয়াতে দুই পরিবার বিয়েতে আর অমত করেনি। এসবই মায়ের কাছে শোনা।
দুজনে একসাথে বিদেশে যাবার সুযোগ পেলেও একই শহরে কাজ হয়নি। খুব একটা সমস্যা হয়নি তাতে। সারা সপ্তাহ কাজ শেষে দুজনে একসাথে ছুটি কাটাতেন। ভালোই নাকি দিন যাচ্ছিল। বিপত্তি বাঁধে আমার জন্মের পরপর। আমাকে রেখে কাজে যাওয়া, সংসার সামলানো মায়ের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ততদিনে অভিজ্ঞতার জেরে মায়ের চাকুরী হয়ে যায় বাবার হাসপাতালে। কিন্তু বাবা কেন যেন চাইতেন না মা ঐ হাসপাতালে কাজ করুক। দিনে দিনে মা জানতে পারেন কারণ। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভীনদেশী আরেক নার্সের হাত ধরে বাবা পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যেরই দূরের আরেক হাসপাতালে।
সদ্য নিজের ভেঙে যাওয়া সংসার, ছোট্ট আমি, নিজের একাকী জীবন, চাকুরী সব মিলিয়ে মা যেন কোনভাবেই আর পেরে উঠছিলেন না। বাধ্য হয়েই আমাকে রেখে যান নানুর কাছে। দেশে কাজ করতে চাননি আমাকে বড় করতে স্বচ্ছলতার অভাব হবে বলে। ক্লাস ফোরে যখন আমাকে প্রথমবার রেখে যান আমার সে কি কান্না। আমি শুধু বলছিলাম, মা আমি একা বাসায় থাকতে পারবো তবু আমায় রেখে যেওনা। কতোটা কষ্ট মা বুকে নিয়ে আমাকে রেখে গেছেন আমি জানিনা তবে আমার শিশু মন সেদিন দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল মায়ের সান্নিধ্য হারিয়ে। মনে মনে শুধু অভিশাপ দিয়েছি বাবা নামক জঘন্য প্রাণীটিকে।
মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা নাকি অসীম। আর সেই ক্ষমতাবলেই একদিন দুদিন তিনদিন করে মাকে ছাড়া আমিও থাকতে শিখে যাই। শুধু যখন বন্ধুরা তাদের মায়ের আদরের গল্প করে আমার খুব ইচ্ছে করে আমিও একটু আমার মায়ের গল্প করি। কিন্তু কি গল্প করবো? সপ্তাহে একদিন ফোনে কেমন আছিস, পড়াশোনা করিস, নানুর কথা শুনিস এটুকু ছাড়া যে মায়ের সাথে আমার আর কোন আত্মিক যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি কখনো। শুধু যখন মা দুবছরে একবার আসে দুমাসের জন্য আমি প্রাণ ভরে মায়ের গন্ধটুকু বুকে ধরে রাখি আবারো দুটো বছরের জন্য।
আগে মায়ের কথা মনে হলেই একা একা কাঁদতাম, এখন আর কাঁদিনা। একা একাই মায়ের সাথে কথা বলি বন্ধুর মতো। নিজে ভালো কিছু খেলে মাকে সহ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই। আমার বন্ধুরা আমায় ওদের বাড়ি দাওয়াত দেয় আমি দিতে পারিনা। কিভাবে দেবো আমার মা তো আমার কাছেই থাকেনা। অনেকবার ভেবেছি ওদের বলি আমার মায়ের গল্প। তারপর যখনই মনে হয় সাথে বাবার গল্প চলে আসবে আর তার পিছু পিছু আমার কষ্টের অতীত তখন নিজেকে সামলে নেই। কি দরকার শুধু শুধু কষ্টের বোঝা বাড়িয়ে?
মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা ক’মাস যাবত। আমি বলেছি এবার যেন একেবারে চলে আসে। আর কোন কষ্ট করতে দেবোনা তাকে। শুধু আমার দিকে চেয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিল বিদেশ বিভূয়ে এতোটা পরিশ্রম করে। মা হয়তো সান্ত্বনা খোঁজে ছেলের জন্য ভবিষ্যত গুছিয়ে দিয়েছেন এই ভেবে। কিন্তু মায়ের ঐ নিত্যদিনের সান্নিধ্যটুকু ছাড়া যে আমার বুকের ভেতর একটা খা খা শূন্যতা নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা তা কি মা কোনদিন বুঝতে পেরেছে?
…………….
এই তিতির, নিলয়, শুভ কাল আমার বাসায় তোদের দাওয়াত। সারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সব খাবারের খোঁটার উসুল দেব। দেখি কত খেতে পারিস।
– ভুতের মুখে রাম নাম? ঘটনা কি রায়হান? (নিলয়)
তোরা আমায় খাবার নিয়ে গত কয়েক বছর এতো খোঁটা দিয়েছিস শুনে আমার মা আজ তোদের রেঁধে খাওয়াবে বলেছে।
………………
রায়হানের দেয়া ঠিকানায় তিন বন্ধু পরদিন এসে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে যায়। বাসাভর্তি অনেক মানুষ। রায়হানের বন্ধু শুনে তাদের একজন নিয়ে যায় রায়হানের ঘরে।
– রায়হান কি হয়েছে? এতো মানুষ কেন বাসায়? সামনে কার খাটিয়া রাখা? কে মারা গেছে?(শুভ)
আমি তোদের কথা রাখতে পারিনি রে দোস্ত। মা কথা দিয়েছিল তোদের আজ রেঁধে খাওয়াবে। মা কথা রাখেনি। সেই কোন শৈশব থেকে অপেক্ষায় ছিলাম আমার বুকের ভেতরের শূন্যতাটুকু মাকে রোজ সকালে জড়িয়ে ধরে ঘুচিয়ে নেব। সে সুযোগই পেলাম না। মা শুধু আমায় দিয়েই গেলো, কিছুই পেলোনা আমার থেকে। আমার মা, আমি আমরা দুজনেই বড় অভাগারে বন্ধু, বড়ই অভাগা।
…………..
রায়হানের মতো কিছু মানুষ একটা জীবনে কখনো নিজের মতো করে মায়ের ভালবাসাটুকু পায়না। আর কিছু মানুষ রোজদিন সে ভালবাসার খোঁজ পেয়েও তার মূল্য দেয়না। জীবন আসলেই বড় অদ্ভুত আচরণ করে কারো কারো সাথে। কোন এক অদৃশ্য সৃষ্টির সুতোর টানে ছুটে চলা কতিপয় মানুষ আসলেই দূর্ভাগা যারা মায়ের গন্ধ মেখে বড় হওয়ার সুযোগ পায়না।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস