#মায়ার_বাঁধন
#পর্ব-০৩+০৪
#আমিনুর রহমান
বাবা মায়ের ইচ্ছেতে কয়েকদিন পর থেকেই মেয়ে দেখা শুরু করলাম। আমি চাই যাকে বিয়ে করবো সে আমার সম্পর্ক সব জানুক। আমি কোনো কিছু লুকাতে চাই না তাঁর কাছে। আমার দুই বছরের একটা মা হারা সন্তান আছে এটা জানার পরেও যে মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। প্রথম দিন যে মেয়েটাকে দেখতে যাবো সেই মেয়েটাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। অনেক বছর আগে মেয়েটাকে দেখেছিলাম। জানি না মেয়েটা আমাকে চিনে কিনা। মেয়ে দেখার পর দুনিয়ার সেই ধরাবাঁধা চিরাচরিত নিয়মে ছেলে মেয়ে আলাদা কথা বলবে এটা যেনো হতেই হবে। আমিও রেহায় পেলাম না অদ্ভুত এই নিয়ম থেকে। অামি অয়নকে নিয়ে যেতে চাইলেও বাবা অয়নকে তাঁর কাছে রেখে দিলেন। আমি মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সময় নীরবতা পালন করলাম,অবশেষে মেয়েটা কথা বলর,তাঁর কথা শুনে আমি জাস্ট হতবাক হয়ে গেলাম। সে খুব লজ্জাবতী কণ্ঠে বলল,
“আমি আপনাকে স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই চিনতাম। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আপনি স্কুলে থেকে পাশ করে চলে যান। তবে আপনার সাথে কখনো কথা হয়নি আমার। আপনি যে আপনার বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই স্কুল মাঠে আসতেন সেটা আমি আজও ভুলিনি। আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগতো কিন্তু কখনো বলার সাহস পাইনি। কারণ তখন আমি বাচ্চা ছিলাম। তাই এমন কথা বলার মতো সাহস আমার ছিলো না। কিন্তু যখন বড় হলাম তখন আপনি আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছেন তাই কথাটা কখনো বলা হয়নি। আজ এতো বছর পর যখন আপনার ছবি দেখলাম তখন আর বিয়ের জন্য না করিনি।”
“আমিও আপনাকে চিনতাম তবে ওইভাবে না,জাস্ট দেখেছিলাম। একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসতো অথচ আমি জানি না এটা সত্যিই সারপ্রাইজড হওয়ার মতো বিষয়। যাইহোক অতীতের কথা বাদ দেই। আমার সম্পর্কে তো সব জানেন,না? আমার একটা দুবছরের ছেলে আছে। ওর কথা চিন্তা করেই আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“আমি জানি,বিয়ের পর ওর দায়িত্বটা আমার ওপর ছেড়ে দিবেন। আমি ওকে নিজের মায়ের মতো আদর করে বড় করে তুলবো। তবে আমার একটা আবদার আছে সেটা আপনাকে রাখতে হবে।”
“কেমন আবদার?”
“যখন আমাদের সন্তান হবে তখন তাকে তাঁর দাদীর কাছে রাখতে হবে। আমি আমার কাছে রাখতে পারবো না। কারণ নিজের সন্তান হলে অন্য কাউকে নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসতে পারবো না আমি। সেক্ষেত্রে আপনারই খারাপ লাগবে। তবে দুই তিন বছর আমি তাকে মায়ের আদর দিবো। তারপর তো সে বড় হয়ে যাবে তখন তো আর কোনো সমস্যা হবে না।”
“আমি এমন কাউকে চাই না আমার বউ হিসেবে। আমার আগে আমার ছেলেকে মেনে নিতে হবে।”
“আপনি একবার বিয়ে করেছিলেন,আপনার একটা বাচ্চাও আছে। এরপরেও আমার মতো একজন মেয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে আর আপনি আমাকে শর্ত দিচ্ছেন? হাও ফানি! শর্ত তো আমার আপনাকে দেওয়া উচিত উল্টা আপনি আমাকে দিচ্ছেন।”
“শর্ত দেইনি আমি শুধু আমার কথা বলেছি। আমার বউ এর থেকে আমার সন্তানের জন্য একজন মা বেশি দরকার।”
বিয়েটা ভেঙে গেলো,ভেবেছিলাম বাবা রাগ করবেন কিন্তু তেমন কিছু মনে হলো না বাবাকে দেখে। এর কিছুদিন পর আবার দ্বিতীয় বারের মতো মেয়ে দেখতে গেলাম। এবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। মেয়েটার বাবা মায়ের আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে,মেয়েটারও আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু যখন মেয়েটাকে আমার সন্তানের দায়িত্বের কথা বললাম ঠিক তখনোই সে সরাসরি না বলে দিলো। সে কেনো অন্য কারো সন্তানের দায়িত্ব নিবে এমন প্রশ্নের জবাবে আমি চুপ করেছিলাম। আমিও দেরি করলাম না,সোজাসুজি বলে দিলাম।
“যে মেয়ে আমার ছেলের দায়িত্ব নিতে পারবে না আমিও তাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
তখন পিছন থেকে মেয়েটা বলল উঠলো।
“আপনি আপনার জন্য হয়তো অনেক বউ পাবেন কিন্তু কোনো মেয়েই আপনার ছেলেকে মায়ের আদর দিতে পারবে না। যার দেওয়ার কথা ছিলো সেই দেয়নি। অন্যরা দিবে এমনটা ভাবা তো বোকামি।”
“বাবা হয়তো আপনাদের বলেনি আমি বউয়ের জন্য আপনাদের কাছে আসিনি। এসেছি একজন মায়ের জন্য। আর আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা মেয়ের মাঝে একজন মা বাস করে। সে চাইলে যে কাউকে মায়ের আদর দিতে পারবে। জন্ম দিলেই শুধু মায়ের আদর দেওয়া যাবে,জন্ম না দিলে মায়ের আদর দেওয়া যাবে না এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। পৃথিবীতে এমন অনেক নজির আছে জন্ম না দিয়েও অনেক মেয়ে একজন আদর্শবান মায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন,আবার জন্ম দিয়েও অনেক মেয়ে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি।”
“আপনি যতোই যুক্তি দেখান না কেনো এই যুগের কোনো মেয়ে আপনার সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখবে না,আদর করবে না। সৎ মায়ের থেকে আপন মায়ের মতো ভালোবাসা আশা করাটা কি অবাস্তব কল্পনা নয়?”
“ভালোবাসার জন্য সৎ মা কিংবা আপন মা হতে হয় না। ভিতরটাতে মা নামক একটা সত্তা থাকতে হয়,নরম একটা হৃদয় থাকতে হয়,না হলে আপন মা হয়েও নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না।”
এই বিয়েটাও হলো না। আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। তাই এটা নিয়ে বেশি ভাবলাম না।
অনেকেই ভাবে ডিভোর্সি মেয়েদের বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজে পাওয়া অনেক কষ্টকর হলেও বিয়ে করা একজন ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হয় না। একজন ডিভোর্সি মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। সমাজের মানুষ একটা ডিভোর্সি মেয়েকে সবসময় খারাপ চোখেই দ্যাখে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা খুব কম হয়। যারা এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তারাই কেবল বিষয়টা বুঝবেন। একজন সংসার ত্যাগ করা ছেলের জন্য চাইলেও ভালো একজন মেয়ে পাওয়া যায় না। যেমনটা মানুষ ভাবে ছেলে হলে মেয়ের অভাব হয় না ব্যাপারটা তেমন না। তবে মেয়েদের থেকে ছেলেদের এই সমস্যাটা কম হয়। তবে একেবারেই হয় না এটা ভুল।
অনেক খুঁজে খুুঁজে বাবা দুইটা মেয়ে দেখেছিলেন আমার জন্য। দুজন রাজীও হয়েছিলো। তবে সমস্যাটা হলো আমার সন্তানকে নিয়ে। তারা কেউ আমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে চায় না। তাই বাবা ঠিক করলেন অয়নকে তাদের কাছেই রাখবে। তাঁর জন্য আমি বিয়ে করছি না এটা বাবা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু বাবার এমন সিদ্ধান্ত আমিও মেনে নিতে পারলাম না। প্রথম প্রথম আমার সন্তানকে আমার কাছে বিরক্ত লাগতো বোঝা মনে হতো। অনিমা যখন চলে যায় তখন একপ্রকার বাঁধ্য হয়েই অয়নকে আমার কাছে রাখতে হয়েছে। অনিমা চলে যাওয়ার পর একটা বছর অয়নকে আমার বড় করতে কতো কষ্ট হয়েছে সেটা একমাত্র আমিই জানি। এতো কষ্টের কারণেই হয়তো অয়নের প্রতি আমার মনে এতো ভালোবাসার জন্ম নিয়েছে। এখন মনে হয় দুনিয়ার কোনো মানুষ আমার পাশে না থাকলেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো কিন্তু অয়নকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা প্রায় আমার পক্ষে অসম্ভব।
তাই আমি বাবার এমন সিদ্ধান্তটাকে মেনে নিতে পারলাম না। আমি যখন বললাম,
“আমি তো বলিনি আমার জন্য সুন্দরী,যুবতি কোনো মেয়ে দেখতে হবে। আমি তো চেয়েছি একজন নারীকে যে আমার অয়নের মা হতে পারবে। মেয়ে অসুন্দর হোক,বয়স্কো হোক,ডিভোর্সি হোক আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অয়নকে নিজের ছেলে হিসেবে মেনে নিতে হবে এমন মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো। আপনিও একজন বাবা। আপনি বুঝেন সন্তানের জন্য একজন পিতার হৃদয়ে কতোটুকু ভালোবাসা জমায়িত থাকে। ওতো ভালো পরিবারের মেয়ে দেখার দরকার নাই। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করাতেই চান তাহলে নরমাল ফ্যামিলিতেই মেয়ে দেখেন। যারা অন্তত একটা মা হারা ছেলের দুঃখ বুঝবে।”
বাবা কিছু বলল না,তবে বুঝতে পারলাম আমার কথাগুলোতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। হবেই বা কি করে? কারণ আমি তাঁর কথাটা রাখতে পারিনি। তাকে কথা দিয়েছিলাম বিয়ে করবো কিন্তু করিনি। ডিভোর্স নামক শব্দটা একজন মানুষের জীবনকে এতোটা বিষাক্ত করে তোলে আমার জানা ছিলো না। কিন্তু আমি এই কয়দিনে মেয়ে দেখতে গিয়ে জিনিসটা বুঝতে পেরেছি। অনেকেই যখন জিগ্যেস করেছে বউ চলে গিয়েছে কি জন্য? নিশ্চিত ছেলের সমস্যা আছে। আজকাল ছেলেদের কাছ থেকে মেয়েরা ওই জিনিসটা পর্যাপ্ত পায় না। এই সমাজ,সমাজের মানুষ অনেক খারাপ। একজন ছেলের যদি নিজের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক না টিকে তাহলে প্রথম যে কথাটা বলবে সেটা হলো ছেলের মাঝে সমস্যা আছে। আবার কেউ কেউ না জেনেই বলে ফেলবে মেয়ের হয়তো অন্য কোনো জায়গায় সম্পর্ক ছিলো তাই চলে গিয়েছে। অনেক সময় অনেক মানুষের কাছ থেকে এরকম কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনেও চুপ করে থাকতে হয়েছে। কারণ বলার মতো কিছু ছিলো না আমার কাছে। অথচ এই সমাজের মানুষ গুলো জানে না ডিভোর্স শুধু শারীরিক সম্পর্কের কারণেই হয় না। একটা বিচ্ছেদের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে যেটা খুব কম মানুষই উপলব্ধি করতে পারে।
রাতে অয়নকে নিয়ে ঘুমানোর সময় একটা প্রবাদ মনে হলো। টাকা হলে এই দুনিয়াতে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। তাহলে আমি কেনো অয়নের জন্য একজন মা পাবো না? এই চিন্তাটা আমার মাথায় আগে কেনো আসেনি এটা মনে হতেই নিজের প্রতি অনেক রাগ হলো। আমি তো চাইলেই অয়নের জন্য বেতন দিয়ে কাউকে রাখতে পারি যে অয়নের দেখাশোনা করবে। অনিমা চলে যাওয়ার পর কাজের মহিলাটা আমাকে অনেক সাহায্য করতো। সে অয়নের অনেক যত্ন নিতো,এর জন্য আমি তাকে কিছু টাকাও দিতাম মাস শেষে। যদিও অয়ন তাঁর কাছ থেকে কখনো মায়ের আদর পায়নি তবুও এই জিনিসটা আগে কেনো আমার মাথায় আসেনি বুঝতে পারলাম না। তাই ভাবলাম যতো টাকা লাগে লাগুক আমি একজন মেয়েকে আমার সন্তানের দেখাশোনার জন্য রাখতে চাই। টাকা হলে নিশ্চয় এমন মেয়ে পেতে কোনো সমস্যা হবে না?
সকালে যখন বাবাকে কথাটা বললাম,
“আমি অয়নের দেখাশোনার জন্য একটা মেয়েকে রাখতে চাই।”
তখন বাবা কিছু বললেন না,বুঝতে পারলাম নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। আমিও আর বেশি কিছু বললাম না। কারণ বাবা যেহেতু না বলেনি তাঁর মানে তিনি এই কাজে বাঁধা দিবেন না। কারণ তাঁর যদি কোনো সিদ্ধান্ত ভালো না লাগে তাহলে সে সরাসরি না বলবে। আর যদি চুপ করে থাকে,কিছু না বলে তাহলে বুঝে নিতে হবে এটাতে তাঁর মত না থাকলেও দ্বিমত নেই। অফিসে গিয়ে কাছের মানুষগুলোকে ফোন করে জানালাম,পেপারে বিজ্ঞাপনও দিলাম। এখন শুধু অপেক্ষা এমন একজনের যে ফোন করে বলবে আমি আপনার চাকরিটা করতে চাই,আপনার ছেলের দেখাশোনা করতে চাই। জানি না এমনটা হবে কিনা তবে আমার বিশ্বাস এমন কেউ না কেউ অবশ্যই আছে যে আমাকে ফোন করবে।
#পর্ব-৪
আমার বিশ্বাসটাই সত্য হলো,কয়েকদিন পরেই একটা মেয়ের ফোন পেলাম আমি। তাঁর সাথে দেখা করার পর অনেক বেশি সকড্ খেলাম। কারণ আমি যেমনটা ভেবছিলাম মেয়েটা তেমন না। আমি কখনো ভাবিনি এতো কম বয়সী একটা মেয়ে এরকম একটা দায়িত্ব নিতে চাইবে। মেয়েটার বয়স কতোই বা হবে? বিশ কিংবা বাইশ। দেখতে শুনতেও অনেক ভালো। তবে আমার জন্য ভালোই হয়েছে তাই আমি কোনো কিছু বিবেচনা না করেই এই মেয়েটাকে আমার ছেলের দেখাশোনার জন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেয়েটাকে যখন বাসায় নিয়ে গেলাম তখন মা যেনো কিভাবে আমার দিকে তাকালো,আমি কিছুটা ভয়ও পেলাম। আসলে এমন একটা মেয়েকে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই নিজের বাড়িতে রাখলে মানুষ কি ভাববে এটা নিয়ে মা অনেক চিন্তিত। তবে আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। কারণ দুবেলা না খেয়ে না থাকলে এই সমাজের মানুষরা আমাকে খাবার দিবে না, আজ যদি বিপদে পড়ি কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই আমি মানুষ কি ভাবলো কিংবা কি ভাববে এটা নিয়ে কখনো ভাবিনি আর ভবিষ্যতেও ভাববো না।
কিছু মানুষের মাঝে অলৌকিক কিছু থাকে। এই মেয়েটার মাঝেও এমন কিছু আছে আমার বিশ্বাস। বাচ্চারা কিছু মানুষকে দেখলে নিজের অজান্তেই কান্না করে দেয় ওই মানুষটার কোলে উঠার জন্য। আবার তাঁর কোলে গেলেও কান্না থেমে যায়। মেয়েটাও ঠিক এরকম। অয়ন তাকে আগে কখনো দেখেনি,আজকেই প্রথম দেখলো অথচ তাকে যখন দেখলো তখন তাঁর কাঁছে যাওয়ার জন্য কান্না করতে লাগলো, যখন তাঁর কাছে গেলো তখন তাঁর কান্নাটাও বিলিন হয়ে গেলো। এটাই তো চেয়েছিলাম আমি। আমার চাওয়াটা সত্যিই হয়েছে। অয়নকে নিয়ে আমার চিন্তা কিছুটা হলেও কমছে এই মেয়েটা আমার অয়নের দায়িত্ব নেওয়াতে।
বাবা কিছু না বললেও মা আমার এরকম কাজকর্মে খুশি হতে পারেনি সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন একজন পুত্রবধূ কিন্তু আমি সেটা তাকে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। মেয়েটাকে তাঁর রুম দেখিয়ে দিলাম,সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। সত্যি বলতে এপর্যন্ত এই মেয়ের নামটাও জানা হয়নি,জিগ্যেস করার সময়ও হয়নি। তাই যখন মেয়েটার নাম জানতে চাইলাম তখন মেয়েটা বলল,তাঁর নাম অর্পিতা। সে দেখতে আহামরি কোনো সুন্দরি না হলেও তাঁর কথাবার্তা অন্য যেকোনো মেয়ের থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমার ইচ্ছে করছিলো মেয়েটার সম্পর্কে জানতে,তাঁর পরিবার সম্পর্কে জানতে,তাঁর সম্পর্কে জানতে। সে কি বিয়ে করেছে? আবার মনে হলো,না এগুলো জানাটা বোধয় কোনো ভদ্রতা হতে পারে না। এগুলো জানার মতো সময় এখনও হয়নি। আর মেয়েটা বিবাহিত হলে হয়তো এমন একটা দায়িত্ব নিতে চাইতো না। মেয়েটাকে জিগ্যেস করলাম আপনাকে কতো টাকা দিতে হবে মাসে?
তখন মেয়ে যেই কথাটা বলল তখন আমার অনেক লজ্জা লাগলো,নিজেকে অনেক ছোট মনে হলো মেয়েটার কাছে। আমার কথার প্রতি উত্তরে অর্পিতা বলল,
“আসলে দেখুন জীবনে সবকিছু টাকা দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। মানুষের জীবনে কিছু কিছু ভালো লাগার অধ্যায় থাকে যেখানে টাকার কোনো স্থান নেই। আমার টাকার অনেক দরকার সেজন্য আমার একটা চাকরি দরকার ছিলো। তবে আমি চাইলে কিন্তু অন্য একটা চাকরিও করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি কারণ অন্য সব চাকরিতে আমি নিজেকে কখনোই ভালো রাখতে পারতাম না। তবে আমার বিশ্বাস এই কাজটাতে আমি নিজেকে সুখী রাখতে পারবো। তাই টাকার কথাটা না হয় নাইবা বলি। দুবেলা দুমুঠা খাবার আর থাকার জন্য একটা জায়গা হলেই আমার হয়ে যাবে এর বেশি কিছু আমার দরকার হবে না। যদি হয় তাহলে আপনাকে বলবো।”
অর্পিতার কথাগুলো কেনো জানি আমার ভিতরের সত্তাটাকে আঘাত করলো। আমার জীবনে কখনো কাউকে এতোটা কষ্ট আর অসহায়ত্ব নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। আমি তাঁর কথাগুলোর জবাবে কিছু বলতে পারলাম না। তবে এতোটুকু বুঝলাম এই মেয়েটাকে টাকা দিয়ে খুশি করা যাবে না। এই মেয়েটা ভালোবাসার পাগল,তাঁর কথা শুনে অন্তত এটা বুঝেছি সে কাউকে খুব করে ভালোবেসেছিলো কিন্তু সেটা সে পায়নি। জীবনে এমন কিছু হারিয়েছে যার জন্য সে এমন হয়ে গিয়েছে। তবে কি হারিয়েছে সেটা আমার অজানা। আগে অয়নের সাথে সবসময় থাকতে হতো,এমনও দিন গিয়েছে যেদিন আমি অয়নকে অফিসে নিয়ে যেতাম। অফিসের সবাই যখন অয়নকে এভাবে দেখতো তখন সবাই অয়নের মায়ের কথা বলতো। একজন মা কিভাবে এতো ছোট্ট একটা শিশুকে রেখে চলে যেতে পারে? আমি তাদের কথার কোনো জবাব দিতে পারতাম না। শুধু বলতাম মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ এই পৃথিবীতে নেই। সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজটাও করতে পারে আবার সবচাইতে জঘন্য নিন্দনীয় কাজটাও করতে পারে। আর অয়ন এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। মানুষ একসময় তাদের প্রিয়জনকে ছেড়ে বাঁচতে শিখে যায়। বাচ্চারাও তেমন বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা মায়ের ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে শিখে যায়। অয়নও হয়তো শিখে যাবে। অয়নকে আমি অর্পিতার কাছেই রাখলাম রাতটুকু। এর আগে রাতে ঘুমানোর আগে অয়ন অনেক কান্না করতো। তবে আজ তাঁর কান্নার শব্দটা আমার কানে বাজলো না।
সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন অয়নকে আমার পাশে না দেখে চমকে গেলাম। কারণ সবসময় অয়নকে সাথে নিয়েই ঘুমিয়েছি আমি। কিন্তু আজ সে আমার সাথে নেই। পরে মনে হলো অয়ন অর্পিতার সাথে ঘুমিয়েছে। আমি অর্পিতার রুমে উকি দিতেই দেখলাম সে অয়নকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। এই দৃৃশ্যটা দেখে আমার আত্মাটা জুড়িয়ে গেলো। মনে হলো অয়ন তাঁর মায়ের বুকেই ঘুমিয়ে আছে। আমি মাঝে মাঝেই অয়নকে দেখার জন্য হঠাৎ করেই অনুমতি না নিয়ে অর্পিতার রুমে ঢুকে যেতাম। তখন দেখতাম অর্পিতার মন খারাপ থাকে কোনো কারণে। কি কারণে খারাপ থাকে সেটা আমি অনেক জানার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। সবসময় সে অন্য মনস্ক থাকে,একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। তাকে দেখলে মনে হয় অতীতে তাঁর সাথে অনেক ভয়ানক কিছু ঘটেছে যেটার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। তাই সবসময় এমন মনমরা হয়ে থাকে সে। দেখতে দেখতে একটা মাস পাড় হয়ে গেলো। এই একটা মাস হয়তো অয়ন তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় কাটিয়েছে। সে পেয়েছে মায়ের আদর। এখন সে আমার থেকে অর্পিতার কাছে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। মাস শেষে অর্পিতাকে কতো টাকা দিবো এটা মিলাতে পারছি না। সে তো আমাকে বলেছে টাকা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা উচিত না। কিন্তু সে যা করেছে আমার ছেলের জন্য আমি তো এর প্রতিদান তাকে দিতে চাই। টাকা ছাড়া আর কি দেওয়ার অাছে আমার?
আমি যখন অর্পিতা মেয়েটার হাতে হাজার বিশেক টাকা দিয়ে বললাম,
“এগুলো কোনো বেতন না এগুলো আমার ছেলের ভালোবাসা। আমি দেখেছি আমার অয়নকে আপনি কতোটা আদর দিয়েছেন, কতোটা মমতায় আগলে রেখেছেন। আমি জানি ভালোবাসা কখনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কিন্তু আপনি আমার ছেলের জন্য যা করেছেন এটার কাছে এই কাগজ গুলো কিছুই না।”
অর্পিতা আমার টাকা নিলো না,আমার হাতে দিয়ে বলল,
“দেখুন আমি কিন্তু আগেই বলেছি আমি টাকার জন্য এই কাজটা করছি না। সত্যি বলতে বেঁচে থাকার জন্য করছি। আমি বুঝি সন্তান কি জিনিস। যে হারিয়েছে সেই কেবল বুঝবে সন্তান হারানোর কি বেদনা। আমার বেঁচে থাকার জন্য কাউকে দরকার ছিলো,আমি আপনার ছেলে অয়নকেই বেছে নিয়েছি। আপনি আমাকে টাকা দিতে চাইলেও আমি নিতে পারবো না। কারণ টাকার বিনিময়ে আমি কাউকে মায়ের আদর দিতে পারবে না। আমি অয়নের মা হওয়ার চেষ্টা করছি,জানি না কতোটা পেরেছি।”
আমি কিছু বললাম না,অর্পিতার দিকে শুধু অবাক চোখে চেয়ে রইলাম। তাকে যতো দেখছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি তাঁর মাঝে এমন কিছু অাছে কিংবা থাকতে পারে যেটা মানুষকে বারবার মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমি না চাইতেও তাঁর প্রতি বারবার মুগ্ধ হচ্ছি,তাঁর কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। তাঁর চিন্তাধারা কতো উঁচুতে,আর আমি এখনো সেই আগের চিন্তাধারা নিয়েই বেঁচে আছি। সবাই তো আর অনিমা হয় না,সব মেয়েই তো আর টাকার পাগল হয় না। কিছু মেয়ে ভালোবাসার পাগলও হয় সেটা অর্পিতাকে দেখলেই বুঝা যায়।
অর্পিতার রুম থেকে এসে শুধু একটা জিনিস ভাবতে লাগলাম,যে মানুষটা আমার জীবনটা এভাবে সুখে শান্তিতে ভরে দিচ্ছে,আমার ছেলেকে মায়ের আদর ভালোবাসা দিচ্ছে আমি তাকে কি দিতে পেরেছি? কিছুই তো দিতে পারলাম না। আমারও তাকে কিছু দিতে হবে,যেটাতে সে হাসবে,খুশি হবে। আমি এমন কিছু তাকে দিতে চাই যেটা পেয়ে সে তাঁর অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবে। কিন্তু কি এমন আছে যা মেয়েটাকে ভালো রাখতে পারে,তাঁর সমস্ত বেদনাময় দিনগুলো ভুলিয়ে দিতে পারে? আমি কি তাঁর অতীতটাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না? অবশ্যই পারি। এর জন্য আমাকে জানতে হবে অতীতে তাঁর সাথে কি হয়েছিলো। যে মানুষ গুলো তাকে ধোঁকা দিয়েছিলো,কষ্ট দিয়েছিলো। যে মানুষ গুলোকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসতো এখনো ভুলতে পারেনি সেই মানুষ গুলোকে আমি আবার তাঁর জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাই। জানি কাজটা অনেক কঠিন তবুও আমি তাঁর জন্য এইটুকু করতে চাই। সে যেমন আমাকে ভালো রেখেছে,আমিও তাকে ভালো রাখতে চাই। কিন্তু ভয় একটাই,সে যদি তাঁর অতীতের মানুষ গুলো ফিরে পেয়ে অয়নকে ভুলে যায় তখন কি হবে? সে কি অয়নকে ছেড়ে যাবে? সেও তো এতো কম সময়ের মধ্যে অয়নকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। সে কি চাইলেই অয়নকে ছেড়ে যেতে পারবে? অর্পিতার অতীতটাকে নাড়া দিতে কেনো জানি ভয় হতে লাগলো আমার। থাকুক না তাঁর অতীত গুলো যেমন আছে তেমনি,নাড়া দেওয়ার কি দরকার? আমি না হয় একটু স্বার্থপর হলামই। নিজেকে ভালো রাখার জন্য তো একটু স্বার্থপর হওয়াই যায়? তাই না?
চলবে……….