মায়াবী হরিণী পর্ব ৪

0
2202

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
মায়াবী হরিণী পর্ব ৪
লিখাঃ জামিয়া পারভীন তানি

“ কমার্স নিয়ে পড়েছিলাম কেন জানো! আমার বাবা একটা ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড। অনেকে তাকে হেউ করে। সেই তাদেরকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সিকিউরিটি গার্ড এর মেয়ে অফিসার হয়েছে। আর এখনো সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে লড়ছি। কিভাবে বিয়ে করে সে স্বপ্ন মাটি চাপা দিতে পারি! ”
নেহা এক বুক কষ্ট চেপে রেখে আবিরের উদ্দেশ্যে বললো। আবির ম্যাথ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। অনেক জায়গায় চাকরির জন্য এপ্লাই করেছে। হয়তো পেয়েও যাবে শীঘ্রই। নেহা খুব সুন্দরী না হলেও তার সংগ্রামী জীবনের প্রেমে পড়েছিলো আবির সেই প্রথম থেকেই। নেহা কে পারিবারিক ভাবেই চেনে। দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়, তখন থেকেই দেখে আসছে নেহা কতটা পরিশ্রমী। আবিরের ইচ্ছে ছিলো নেহা কে বিয়ে করার। কিন্তু নেহা কিছুতেই রাজি হয়না। যখনই বিয়ের কথা বলে, তখনই বলে বিয়ে করলে চাকরি করতে পারবেনা। চাকরি ওকে করতেই হবে। যত কষ্টই হোক না কেন। আবির বারবার বুঝিয়েছে, বিয়ের পর পড়াবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আজও আবির বলে ব্যর্থ হয়েছে। নেহা জানিয়ে দিলো, বিয়ে করে নিজের স্বপ্ন মাটিচাপা দিবেনা। তবুও আবির বলল,
“ আমরা একসাথে ও তো তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।”
“ কিভাবে জানবো, যদি তোমার ফ্যামিলি বাধা দেয়।”
“ আচ্ছা, একবার ভাবো। তোমার বাবা নিশ্চয়ই তোমার জন্য পাত্র খুঁজছে। যদি জোর করে বিয়ে দেয়, তুমি রাজি হয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত। তখন যদি তোমার পড়াশোনা তে বাধা আসে! তখন কি করবে?”
নেহা একটু ভেবে বললো,
“ বাবা কে চিনি আবির। উনি নিশ্চয়ই আমার ক্ষতি চাইবেন না। আমরা বন্ধুই থাকি প্লিজ…. ”

আবির আর কিছু না শুনেই চলে গেলো। মেয়ে টা কে কিছুতেই বোঝানো যায় না৷ আর কখনো ওর সামনে বিয়ের প্রস্তাব দিবেনা। বারবার অপমানিত হতে কার ভালো লাগে!

দুপুরে ফুয়াদ বাসায় খেতে আসে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলে ছোঁয়া ভাত বেড়ে দেয়। কাঁঠালের তরকারির সাথে ডাল আর ভাত। ছোঁয়া কে দেখে ফুয়াদ বলল,
“ মা কোথায়? তুমি দিচ্ছো যে?”
“ মা গোসল শেষ করে নামাজ পড়ছেন। আমাকে বলে গেছেন আপনি আসলে খাবার বেড়ে দিতে।”
“ আজ এতো দেরি! মা তো টাইম মতো নামাজ পড়েন। কি করছিলেন উনি?”
“ সেলাইয়ের কাজ। ”
“ আর তুমি কি শুয়ে বসে থাকছো নাকি!”

ছোঁয়ার একটু অভিমান হয়, চুপচাপ বসে থাকে। এটা দেখে ফুয়াদ বলল,
“ মা কে সাহায্য করবে বুঝলে। কখনো চুপচাপ বসে শুয়ে সময় নষ্ট করবেনা। ”
“ জ্বি আচ্ছা। ”
ফুয়াদ খেয়ে উঠে পড়ে। ছোঁয়া সব গুছিয়ে রেখে দেয়। সারা দুজন কে একসাথে খেতে বলেছিলো। অথচ ফুয়াদ একবার ও খাবার জন্য সাধলো না। খুব অভিমান নিয়ে না খেয়ে বসে থাকে। যার হাত ধরে এই বাড়িতে আসা, তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ পর ভাবলো, “ না আছে তাদের মধ্যে প্রেম, না টান। কেনই বা বলবে উনি৷ কিসের জন্য অভিমান, যার কোন মূল্যই নেই। ”
এটা ভেবে মন কে শান্তনা দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসে। নামাজ শেষ করে সারা তসবিহ পড়ছিলো। সারা বলল,
“ কিরে ফুয়াদ চলে গেছে। ”
“ জ্বি মা …”
“ মন খারাপ কেন?”
“ মন খারাপ না মা, আপনি এখন খাবেন? ”
“ তুই ওর সাথে খাসনি?”
“ না মা, লজ্জা লাগে। ”
“ ধুর পাগলী, আমায় আপন করে নিতে পারিস আর বরকে আপন করে নিতে পারিস না?”
ছোঁয়া লজ্জায় মাথা নোয়ালো। এখানে তার কিছুই বলার নেই। বিয়েটাই একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে তাকে৷ কিসের অধিকার দাবি করবে সে!
“ আচ্ছা চল খেয়ে নিয়ে কাজ শেষ করি। ” সারা ছোঁয়ার লজ্জা ভাঙাতে বললো।
দুজনে খাওয়ার পর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সারা বলল,
“ ফুয়াদ অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, ভালো কোথাও চান্স পাওয়ার জন্য৷ তাই হয়তো ও তোকে নিয়ে এখন ভাববে না। তাই ওর আশায় বসে নিজের শরীর খারাপ করিস না। নিজের কাজ নিজে চালিয়ে যা। দেখবি একদিন সার্থকতা এসে ধরা দিবে। ”
“ মা উনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করাতে আমার উপর এতো রাগ দেখাচ্ছেন। আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি। ”
“ আহা! দেখো মেয়ের কাণ্ড, একটু কিছু হলেই ফেচফেচ করে কাঁদে। ”
“ সরি মা। ”
“ আচ্ছা, বিয়ের কথা ভুলে যা। মনে কর তুই আমার মেয়ে। এবার খুশি তো!”

ছোঁয়ার হাতের ছোঁয়ায় গলার মালা , কানের দুল, আর টিকলি প্রস্তুত। আর কয়েকটা জিনিস বানাতে হবে, আংটি আর বাহুবন্ধনী বানালেই সেট টা প্রস্তুত হয়ে যাবে। এখন বিয়ের কনের গয়না গুলো পছন্দ হলেই হয়। ছোঁয়া সংকোচ কাটিয়ে বলল,
“ মা, গয়নার ডিজাইন কনে কে দেখিয়ে আসলে কেমন হবে! যদি ওরা কিনে ফেলে আগে আগে। ”
“ হু, বিকেলে যাবো ভেবেই রেখেছি। ব্লাউজের মাপ টা ঠিক হলো কিনা!”

সারা কাজ শেষ করে । ফাহাদ তখন বাসায় আসলে ওকে খাবার দিয়ে দেয়। বলল,
“ তুই খেয়ে নে, আমি নিচ তলায় যাবো। নেহা এখুনি আসবে। দরজা খুলে দিস। ”
সারা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর ফুয়াদ আসে। দুইটা টিউশনি শেষ করে এসেছে। এসেই ঘরে ঢুকে দেখলো ছোঁয়া চুল ছেড়ে চুল শুকাচ্ছে। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেলো। দ্রুত ছোঁয়ার একগোছা চুল মুঠি করে ধরে। ছোঁয়া ভয়ে আঁতকে উঠল । ফুয়াদ ছোঁয়ার থুতনিতে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,
“ বেহায়া মেয়ে, পরপুরুষ কে সৌন্দর্য দেখাতে খুব ভালো লাগছে তাইনা!”
ছোঁয়া কিছুই বুঝলো না। শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ফুয়াদ আরোও শক্ত করে চুল গুলো ধরে বলল,
“ সামনের ফ্লাটের ছেলে টা বারান্দা থেকে অপলক তাকিয়ে আছে, খেয়াল করেছো?”
ছোঁয়া খেয়াল করলো এইবার। অপরাধ বুঝতে পেরে চোখ নামিয়ে বলল,
“ মাফ করবেন। বুঝতে পারিনি। ”

ফুয়াদ ছোঁয়ার চুল ছেড়ে দেয়। রাগ দেখিয়ে বলল,
“ কমনসেন্স নেই তোমার! নাকি সবাই কে মায়াবী চেহেরার মুগ্ধতায় ডুবা ডুবাতে চাও? ”
ছোঁয়া কি বলবে বুঝতে না পেরে ফুয়াদের পা ধরে বসে।
“ সত্যিই বুঝতে পারিনি। আর হবেনা এমন। ”
ফুয়াদ সরে দাঁড়ায়।
“ আহা! এগুলো কি ধরনের ন্যাকামি? ”
ছোঁয়াকে বসে থাকতে দেখে ফুয়াদ ছোঁয়ার পাশে বসে। আস্তে করে বলল,
“ আমি চাই তুমি পর্দা করে চলবে। এমনি কি ফাহাদের থেকেও পর্দা করবে। আশা করি আর বলতে হবেনা। ”
“ জ্বি… ” ছোঁয়ার ছোট্ট জবাব৷
ফুয়াদ কিছু বলছেনা দেখে ছোঁয়া বলল,
“ লেবুর শরবত পান করবেন? ”
ফুয়াদ একবার ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ এতো বিলাসিতা তোমার মানায় না!”
ছোঁয়া না বুঝে তাকিয়ে থাকে। ফুয়াদ বলল,
“ শরবত খাওয়া বড়লোক দের কাজ৷ আমাদের মতো মানুষ দের জন্য না। ”
“ আপনি রোদ থেকে এসেছেন, তাই বলছিলাম। ”
“ লেবু কোথায় পেলে?”
“ মা এনেছেন। ”
“ কখন? “
“ সকালে উনার সাথে বাজারে গেছিলাম। তখন চার টা লেবু নিয়েছেন। ”

এটা বলেই ছোঁয়া গিয়ে লেবু গ্লাসে চেপে নুন দিয়ে শরবত করে নিয়ে আসে। ফুয়াদ কথা না বাড়িয়ে কয়েক ঢোকে শেষ করে ফেলে। ছোঁয়া বলল,
“ আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন৷ শুধু শুধু আপনার পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। ”
“ হঠাৎ? ”
“ নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা। ছোট বেলায় বাপ মা খেয়েছি, আর এখন আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি। ”

ফুয়াদ ছোঁয়ার ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। দুজনের মাঝে অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। একে তাদের সম্পর্ক বৈধ, অন্যদিকে বয়স টাও কম৷ ছোঁয়া খুব কাঁপতে শুরু করে, ফুয়াদ খেয়াল করে হাত টা সরিয়ে নেয়। ফুয়াদ বলল,
“ কখনো নিজেকে দোষারোপ করবেনা। যাই হোক, তোমার মাথা যন্ত্রণা করছে বুঝি!”
“ কিভাবে বুঝলেন? ”
“ কথার মাঝে বিরক্ত প্রকাশ করতে দেখে। ”
“ ও তেমন কিছু না, আমি অভ্যস্ত মাথা ব্যথা নিয়ে। খুব কষ্ট পেলে ব্যথা করে, আবার কিছুক্ষণ পর ভালো হয়ে যায়। ”
“ চুল টেনে ধরে কষ্ট দিলাম। সরি, মাফ করে দিও। ”
“ সেইজন্য নয়৷ আগে থেকেই করছিলো। ”
“ মিথ্যে বলিও না। ”

এটা বলে ফুয়াদ রান্নাঘরে গিয়ে ছয় কাপ চা বসিয়ে দেয়। চা বানিয়ে এককাপ ছোঁয়া কে দেয়, অন্য কাপে নিজে নেয়। বাকিটা ফ্লাক্সে ঢেলে রাখে৷
চা শেষ করার পর ছোঁয়া বলল,
“ যতদিন মামা ছিলেন, খুব আদর করতো আমাকে। মামা বিদেশ যাবার পর থেকেই আমি ওই বাড়ির কাজের মেয়ে হয়ে গেছিলাম। ”
“ তার মানে, ওটা তোমার মামার বাড়ি?”
“ ফ্লাট টা আমারই, কিন্তু…. ”
“ মানে? কি বলছো তুমি? ”
“ ও কিছু না, অন্যদিন বলবো। “ বলে ছোঁয়া উঠে দাঁড়ায়। ফুয়াদের কাপ, নিজের কাপ নিয়ে গিয়ে ধুয়ে ফেলে। ফিরে এসে বলল,
“ আর টিউশনি করাবেন আজ?”
“ একটা কাছে, ওটা রাত ৮ টাই শুরু। ”
“ ওহহহ…”
“ তোমার অতীত সম্পর্কে কি জানার অধিকার নেই আমার? ”

ছোঁয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। বলবে তো অবশ্যই, কিন্তু এখন বলা অসম্ভব৷ তাই বলল,
“ হ্যাঁ জানাবো, কিন্তু সময় হলে৷ ”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে