#মায়ের মন
#Writer_Shukkur_Ali
#শেষ_পর্ব
সাফিন ফিরে আসার পরে রাহেলা রহমান আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। তিনি এখন একটু একটু কথা বলতে পারছেন। তবে উনার মুখে জড়তা থাকার কারণে সেই কথা কেউ সেভাবে বুঝতে পারে না। তবে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে রাহেলা রহমানের অপরিস্ফুট কথা কেউ বুঝতে না পারলেও সাফিন কিন্তু সেগুলো খুব সহজেই বুঝতে পারে।
যাইহোক,এভাবে এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরে রাহেলা রহমান পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যান। উনার মুখের জড়তা কেটে যায়।
রাহেলা রহমান ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি সুস্থ হয়ে সাফিনকে অনেক বকবেন। কিন্তু একজন মা তার সন্তানের উপর বাইরে থেকে যতই রাগ কিংবা অভিমান করে থাকুক না কেন। ভিতরে ভিতরে কিন্তু তার মন ঠিকই কাঁদে।
রাহেলা রহমানের অবস্থাও হয়েছে এমন। তিনি সাফিনকে বকা দিতে গিয়ে উল্টো নিজেই কেঁদে ফেলেন। এবং ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন – তোকে যে আমি নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসি,সেটা তুই কেন এতদিনেও বুঝতে পারলি না বাবা?
সাফিন কাঁদতে কাঁদতে বললো – কারণ আমি কখনো তোমার ভালোবাসা বোঝার চেষ্টাই করিনি আম্মু,তাই যখন জানতে পারলাম তুমি আর আব্বু আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছো,তখনই আমি কোনো কিছু না বলে স্বার্থপরের মতো বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছি, একবারো তোমার কথা ভাবিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু।
রাহেলা রহমান বললেন – বেশ,যা তোকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। তবে আবারও যদি এরকম ভুল করিস,তাহলে কিন্তু আমি তোকে আর কখনোই ক্ষমা করবো না।
সাফিন বললো – আচ্ছা আম্মু,আর কখনো একরকম ভুল করবো না।
**
– সাফিন,তুমি তো একবার চলেই গিয়েছিলে। তাহলে এখন আবার এই বাড়িতে ফিরে এলে কেন?
সাফিন হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখে শফিক রহমান দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উনার হাতে খাবারের প্লেট।
শফিক রহমান খাবারের প্লেটটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে সাফিনকে আবারও প্রশ্ন করলেন – কি হলো,উত্তর দিচ্ছো না কেন? তুমি যখন আমাদের কাউকে কিছু না বলে চলেই গিয়েছিলে,তখন ফিরে এলে কেন?
সাফিন বললো – আব্বু,আমি কিন্তু যাওয়ার আগে চিঠি লিখে গিয়েছিলাম। আমার জীবনে একটা কমতি রয়েছে। সেটা কি তা না জানা পযর্ন্ত আমি বাড়িতে ফিরবো না। আমার সেই কমতিটা পূরণ হয়ে গিয়েছে,তাই আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি। তবে তুমি যদি আমাকে এখন চলে যেতে বলো তাহলে আমি চলে যাবো সমস্যা নেই।
শফিক রহমান সাফিনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – সাফিন,আমার জীবনে সবচেয়ে বড় আক্ষেপটা কোথায় জানো?
আমার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ছোট থেকে এই পযর্ন্ত আমার কাছে তাদের শত শত আবদার করেছে,কিন্ত তুমি আজ অবধি নিজের একটা আবদারের কথা আমাকে বলোনি। তোমার এসব আচরণেই আমার কাছে এটা ক্লিয়ার যে তুমি এখনো এই রহমান পরিবারটাকে নিজের পরিবার ভাবতে পারোনি।
বাবার কথা শুনে তখন সাফিনের হঠাৎ মনে হয় আজ পযর্ন্ত সে তো তার বাবার কাছে কোনো আবদার করেনি। যেটা নিয়ে উনার মনে প্রচুর আক্ষেপ। তাই আজ ও শফিক রহমানের কাছে একটা আবদার করবে। দেখা যাক,তিনি সাফিনের সেই আবদারটা রাখেন কিনা।
সাফিন তখন হালকা কেশে গলাটা পরিস্কার করে বললো – আব্বু,আজ আমি তোমার কাছে একটা আবদার করতে চাই। দেখি তুমি আমার সেই বাসনা পূরণ করো কিনা।
সাফিনের কথা শুনে শফিক রহমানের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। তিনি তখন আনন্দিত গলায় জানতে চাইলেন – বলো,কি আবদার? আমি তোমার সেই আবদারটা অবশ্যই পূরণ করবো।
সাফিন বললো – বেশ,আমার দশ লক্ষ টাকা লাগবে। এবং সেটা অত্যাবশ্যক।
শফিক রহমান তখন ভ্রু কুঁচকে বললেন – ওহ্ এই ব্যাপার? ঠিক আছে,আমি এক্ষুণি তোমাকে দশ লক্ষ টাকার একটি চেক লিখে দিচ্ছি। তুমি ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলে নিও।
শফিক রহমান ব্যাংকের চেকে সই করে সাফিনের হাতে দিয়ে বললেন – এই নাও,
সাফিন চেকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। কারণ শফিক রহমান ওকে দশ লক্ষ টাকার জায়গায় বিশ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছেন।
সাফিন বললো – আব্বু এখানে তো বিশ লক্ষ টাকার চেক,বাকি দশ লক্ষ কি করবো?
শফিক রহমান বললেন – ওটাও তোমার কাছে রেখে দাও,সামনে কাজে লাগবে।
সাফিন চেকটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো – আমি এতগুলো টাকা দিয়ে কি করবো তা জানতে চাইলে না?
শফিক রহমান উনার স্ত্রী রাহেলা রহমানকে ভাত খাইয়ে দিতে দিতে বললেন – না চাইলাম না,কারণ আমি জানি টাকাটা তুমি কারোর না কারোর উপকার করার জন্যই নিয়েছো।
**
সাফিন দিপাদের বাসায় এসেছে। ওর হাতে বিফকেস।
সাফিন বললো – আসসালামুয়ালাইকুম,মা কেমন আছো?
দিপার মা বললেন – ওলাইকুম আসসলাম, ভালো আছি বাবা। তুই কেমন আছিস?
সাফিন বললো – এইতো মা আমিও ভালো আছি,ইয়ে মা..সেদিন তোমার অনুমতি ছাড়া একটা মেয়েকে এখানে কয়েক দিনের জন্য রেখে গিয়েছিলাম,তুমি আমার উপরে রাগ করোনি তো?
দিপার মা বললেন – আরে না বাবা,রাগ করবো কেন? আমি তো ভালো করেই জানি তুই পরোপকারী মানুষ। মেয়েটা বিপদে পড়েছে বলেই তো তুই ওকে আমার বাড়িতে এনে রেখেছিস তাই না?
সাফিন বললো – হ্যাঁ মা,আসলে তুমি ছাড়া অন্য কাউকে ভরসা করার সাহস পাচ্ছিলাম না।
দিপার মা বললেন – ঠিক আছে,আচ্ছা তোর হাতে ওই বিফকেসের ভিতরে কি?
সাফিন বললো – এতে দশ লক্ষ টাকা রয়েছে মা।
দিপার মা বললো – ও আচ্ছা,আয় ভিতরে আয়।
সাফিন বাড়ির প্রবেশ করে। নাবিলা তখন দিপার সঙ্গে বসে টিভি দেখছিল। সাফিনকে দেখে ওরা দুজনেই দাঁড়িয়ে যায়।
দিপা হাসিমুখে সাফিনকে বলে – সাফিন ভাইয়া,তুমি নাবিলা আপুর সঙ্গে বসে গল্প করো। আমি তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসছি।
দিপা চলে যাওয়ার পরে নাবিলা সাফিনকে জিঙ্গেস করলো – কি অবস্থা? কেমন আছেন?
সাফিন বললো – জ্বী,ভালো। নিন। বিফকেসটা ধরুন।
নাবিলা টাকার বিফকেসটা হাতে নিয়ে বললো – এটা তো বেশ ভারী,কি আছে এতে?
সাফিন বললো – এখানে দশ লক্ষ টাকা রয়েছে,আর এই টাকাটা আমি আপনার জন্য এনেছি। আমি চাই এই টাকা আপনার মামার হাতে তুলে দিয়ে আপনি এবং আপনার বাবা মা উনার থেকে মুক্ত হয়ে যান।
নাবিলা বললো – আপনি এতগুলো টাকা কোথায় পেলেন? আর আমি কি আপনার কাছে টাকা চেয়েছি?
সাফিন বললো – না,তা অবশ্য চাননি। কিন্তু আমার মনে হলো টাকাটা দিয়ে আপনাকে যদি কিছুটা উপকার করা যায় তাহলে ক্ষতি কি?
নাবিলা বললো – আপনি আমার জন্য যা করেছেন ওটাই যথেষ্ট,এই টাকা আমি নিতে পারবো না দুঃখিত।
সাফিন কিছুটা মন খারাপ কন্ঠে বললো – আপনি হয়তো ভাবছেন আপনাকে করুণা করে টাকাগুলো দিচ্ছি,কিন্ত বিশ্বাস করেন, আমি মোটেও সেরকম কিছু ভেবে আপনাকে টাকাগুলো দিতে আসিনি। আমি এসেছিলাম আপনার একজন শুভাকাঙ্খী হয়ে।
আচ্ছা,আপনি এটা এখন আপাতত ধার হিসেবে নিন। পরে নাহয় আস্তে আস্তে আমাকে শোধ করে দিবেন। প্লিজ না করবেন না। আপনি টাকা গুলো না নিলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।
নাবিলা তখন একটু ভেবে বললো – আচ্ছা ঠিক আছে,আপনি যখন এত করে বলছেন তখন আমি টাকাটা নেবো। তবে আমার একটা শর্ত রয়েছে।
সাফিন তখন উৎফুল্ল কন্ঠে জিঙ্গেস করলো – বলুন কি শর্ত? আপনার যেকোন শর্তে আমি রাজি আছি।
নাবিলা বললো – আমাকে সারাজীবনের জন্য আপনার সেবা করার সুযোগ দিতে হবে,যদি আমার এই শর্তে রাজি থাকেন,তবেই আমি আপনার কাছ থেকে এই বিফকেস ভর্তি টাকা গ্রহণ করবো।
সাফিন নাবিলার শর্ত শুনে একটু থতমত খায়। তবে পর মূহুর্তেই ও চিন্তা করে দেখে এতে যদি মেয়েটা খুশি হয়,তাহলে ও নাহয় সেটাই করবে।
সাফিন তখন বললো – বেশ তাই হবে,চলুন তাহলে।
নাবিলা বললো – কোথায়?
সাফিন বললো – আমার বাড়িতে,আজ আপনার সঙ্গে একজনকে পরিচয় করাবো।
নাবিলা তখন কথা না বাড়িয়ে বললো – ঠিক আছে,চলুন।
সাফিন দিপার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো – আচ্ছা,আজ তাহলে আসি মা?
দিপার মা বললেন – ঠিক আছে,যা বাবা। আর হ্যাঁ সাবধানে যাস কিন্তু।
সাফিন বললো – আচ্ছা,মা।
**
সাফিন নাবিলাকে রাহেলা রহমানের কাছে নিয়ে যায়। এবং বলে – ইয়ে মা..এই মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি,এখন তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমরা..।
রাহেলা রহমান সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে ইশারা করে সাফিনকে থামিয়ে দিয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে জিঙ্গেস করলেন – তোমার নাম কি?
নাবিলা তখন মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বললো – জ্বী নাবিলা।
রাহেলা রহমান তখন বললেন – আমার এই পাগল ছেলেটার সঙ্গে সারাজীবন এক ছাদের নিচে সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়ে থাকতে পারবে তো?
নাবিলা এবার কিছুটা লজ্জামাখা কন্ঠে উত্তর দিলো – জ্বী পারবো।
রাহেলা রহমান তাকে আবারও বললেন – ভালো করে ভেবে দ্যাখো,আমার এই ছেলে কিন্তু অনেক জেদি। ওর সঙ্গে সংসার করতে হলে তোমাকে অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে। পারবে তো এত ধৈর্য নিয়ে ওর সংসার করতে?
নাবিলা বললো – জ্বী মা,আমি পারবো।
রাহেলা রহমান তখন সাফিনকে বললেন – সাফিন,মেয়েটাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি ওর পরিবারের সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে আলাপ করতে চাই। তুই উনাদেরকে এ বাড়িতে আনার ব্যবস্থা কর।
সাফিন তখন হাটু গেড়ে রাহেলা রহমানের সামনে বসে বললো – সত্যি বলছো মা? তুমি নাবিলার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলবে?
রাহেলা রহমান বললেন – হ্যাঁ বলবো বাবা,তুই সব আয়োজন কর। আমি তোর আর নাবিলার বিয়ে দেবো।
সাফিন উনাকে জড়িয়ে ধরে। এর ঠিক এক মাস পরে সাফিন আর নাবিলার মহা ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়।
আজ রাহেলা রহমান প্রচণ্ড খুশি। কারণ শেষ পযর্ন্ত উনি সাফিনের মায়ের স্থানে বসতে পেরেছেন।
রাহেলা রহমান সাফিনকে পেটে ধরেননি ঠিকই,কিন্তু একজন মা হিসেবে উনার যা যা কর্তব্য পালন করা দরকার,তিনি তার সবকিছুই ওর জন্য করেছেন।
#সমাপ্ত