#মায়ের মন
#Writer_Shukkur_Ali
#পর্ব_৪
তোমারে দেইখ্যা তো শিক্ষিত পুলা মনে হয়,তা তুমি হোটেলে থালা বাসনের কাম খুঁজতাছো ক্যান?
বাহার উদ্দিনের এই প্রশ্নে সাফিন মাথা নিচু করে বললো – আসলে আমার একটা কাজের খুব দরকার,এখন এই অল্প সময়ের মধ্যে ভালো চাকরি কোথায় পাবো বলেন ? তাই আপাতত হোটেলের কাজ দিয়েই শুরু করতে চাচ্ছি। আর খারাপ কাজ গুলো বাদে পৃথিবীর কোনো কাজই তো ছোট নয় তাই না?
বাহার উদ্দিন বললেন – তা ঠিকই কইছো,কিন্ত আমাদের হোটেলে তো বাসন মাঝা আর বাবুর্চির রান্নার কাজে হাত লাগানোর জন্য অলরেডিই লোক আছে। তোমারে কি কাজ দিমু?
সাফিন বললো – ও আচ্ছা,ঠিক আছে আমাকে তাহলে অন্য কোনো হোটেলে কাজ খুঁজতে হবে। ঠিক আছে,ভালো থাকবেন আসি।
এই বলে সাফিন কিছুটা আশাহীন হয়ে সেই হোটেল থেকে বের হয়ে যায়।
বাহার উদ্দিনের পাশেই হোটেল পরিস্কারের দায়িত্বে থাকা মজনু দাঁড়িয়ে ছিল। সে এতক্ষণ ধরে তাদের দুজনের কথোপকথন শুনছিল। সাফিন চলে যাওয়া মাত্রই সে বাহার উদ্দিনকে বললো – এইডা কি করলেন বস?
ওর প্রশ্নে বাহার উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন – ক্যান আমি কি মিথ্যা কইছি নাকি? ওই ছেলেডারে যা সত্যি তাই তো কইলাম।
মজনু তখন বললো – আরে বস আপনার দেহি আজকাইল কিছুই মনে থাহে না! আপনে কি ভুইল্লা গেলেন,আমাদের পুরান যেই ভাতের হোটেলটা রইছে ওইহানে একজন মেনেজার লাগবো?
বাহার উদ্দিন বললেন – আরে হ তাই তো,আমার তো মাথাতেই ছিল না। ওহন কি করুম? আর তোর কি মনে হয় ওরে রাহন ঠিক হইবো?
মজনু বললো – হইবো মানে! পুরা দৌড়াইবো! আমার ওরে দেইখ্যা মনে হইতাছে হেয় হিসাব নিকাশের কাম ভালো পারে। ওরে আমগো ওই হোটেলে চাকরি দিয়া দেন বস।
বাহার উদ্দিন বললেন – কিন্তু ওই হোটেলে বেতন তো কম,পুলাডায় কি ওত কম বেতনের কাম করবো?
মজনু বললো – আরে বস! আগে বইল্লা তো দ্যাহেন,কাম করুক,বা না করুক,কইতে দোষ কি?
বাহার উদ্দিন তখন বললেন – হ এইডা ঠিক কইছস! যা তাইলে। ওই পোলারে ডাইকা নিয়ায়।
মজনু আচ্ছা বলে সাফিনকে ডাকার জন্য বের হয়। বাইরে বেরিয়ে দেখে ছেলেটা অনেক দূর চলে গিয়েছে। সে তখন দৌড়ে সাফিনের কাছে ছুটে যায় এবং পিছন থেকে ওকে ডাক দেয় – এই যে ভাই শুনো,
সাফিন তখন পিছনে ফিরে বলে – জ্বী? আমাকে বলছেন?
মজনু মিয়া হাপাতে হাপাতে বললো – হ,তোমারেই কইতাছি।
সাফিন বললো – জ্বী বলেন?
মজনু বললো – তুমি একটু আগে কামের লাইগা যেই হোটেলটাই গেছিলা,ওই হোটেলের মেনেজারটা তোমারে আবার ডাকছে,তোমার লগে হেয় আরেকবার কথা কইতে চায়।
মজনুর কথায় সাফিন কিছুটা অবাক হয়। মাত্রই তো ও শুনে আসলো হোটেলে আপাতত কোনো লোক লাগবে না। কারণ কাজের লোক ইতিমধ্যেই রয়েছে। তাহলে ম্যানেজার তাকে ডাকছে কেন? কিছুটা ধোঁয়াশা নিয়ে সে মজনুর সঙ্গে আবার ওই হোটেলে যায়।
সাফিনকে দেখার পরে বাহার উদ্দিন বললেন – হুনো তোমার জন্য একটা কাম আছে,তবে,,।
সাফিন জিঙ্গেস করলো- তবে কি?
বাহার উদ্দিন বললেন – ওইহানে বেতন কম,মাত্র চার হাজার টেকা স্যালারি। তয় তিন বেলা খাওন ফ্রি। আর ঘুমানোর জন্য রুম আছে। এখন তুমি যদি এই কাম করতে চাও তাইলে করতে পারো।
সাফিন তখন উল্লাসিত কন্ঠে বললো – আমি রাজি,বলেন কবে থেকে কাজে লেগে পড়বো?
ওর কথা শুনে বাহার উদ্দিন একটু অবাক হলেন তারপর বললেন – ঠিক আছে,তাইলে আজকে থেইক্কাই কাজে লাইগা পড়ো। ওই মজনু,যা ওরে দিয়ায়।
মজনু সাফিনকে তাদের পুরানো হোটেলে নিয়ে যায়। এরপর ওকে বলে – এইযে তুমি এই হোটেলে বইবা,আর ভালো কথা তোমার নাম কি?
সাফিন বললো – আমার নাম সাফিন,
মজনু বললো – ঠিক আছে,তুমি তাইলে কাম করো। আমি যাই।
মজনু চলে যায়। হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করে সাফিন দেখতে পায় এই হোটেলটা সামনের ওই থেকে বেশ ছোট আর অনেক নোংরা। ও ছোট থেকেই ভালো পরিবেশে বড় হয়েছে। আর এর আগে কখনো সাফিন এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি। যার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই হোটেলের এরকম নোংরা অবস্থা দেখে ওর গা গুলিয়ে আসে। তবে ও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। শত কষ্ট হলেও তাকে এই জায়গার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
***
দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ কেটে যায়। এই তিন সপ্তাহের মধ্যে সাফিন একদিনের জন্যেও তার পালক বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। তবে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবারও তাদের কাছে ফিরে যাবে। কারণ সে যেই জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল সেটার উত্তর শেষ পযর্ন্ত পেয়ে গিয়েছে। ওর জীবনে আসল কমতিটা ছিল দারিদ্রতার।
সাফিনের পালক বাবা শফিক রহমান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। শুধুমাত্র ওনার জন্য ও অভাব কি সেটা কখনো অনুভব করেনি। যার কারণে এই অল্প কয়েকটা দিনে সাফিন অনেক কিছু শিখতে পেরেছে।
**
ঘড়িতে সময় ঠিক রাত নয়টা। সাফিন শফিক রহমানের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলিং বেলে বারবার চাপ দিতে গিয়েও সে থেমে যাচ্ছে। কারণ ওর মনে একটাই ভয়। মায়ের সামনে পড়লে সে উনাকে ঠিক কি উত্তর দেবে?
যাইহোক,বুকে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে শেষ পযর্ন্ত সাফিন কলিং বেল বাজিয়ে দেয়। তবে ওর ভাগ্য ভালো ছিল রাহেলা রহমান জায়গায় উনার মেয়ে নুসরাত দরজা খুলে।
এতদিন পরে সাফিনকে দেখে নুসরাত ওকে চিনতেই পারেনা। কারণ এই তিন সপ্তাহের মধ্যে সাফিনের গায়ের রঙ থেকে শুরু করে পুরো শরীরই চেইঞ্জ হয়ে গিয়েছে।
নুসরাত সাফিনকে জিঙ্গেস করলো – জ্বী,কাকে চাই?
ওর কথা সাফিন অবাক হয়ে বললো – আপু আমাকে চিনতে পারছো না? আমি সাফিন।
নুসরাত ধাক্কা খায়। আর বলে – সাফিন ভাইয়া তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে? আর তোমার এই অবস্থা কেন?
প্রশ্ন গুলো করেই নুসরাত কান্না করতে করতে সাফিনকে জড়িয়ে ধরে। ওর এরকম অদ্ভূত আচরণে সাফিন বেশ ভড়কে যায়। আসলে ঘটনা হচ্ছে – সাফিন আর নুসরাতের পিঠাপিঠি বয়স। তবে ছোটবেলা থেকে সাফিন নুসরাতকে আপু বলে ডাকলেও নুসরাত কিন্তু সাফিনকে কখনোই ভাইয়া বলতো না। সে সব সময় ওর নাম ধরেই ডাকতো। কিন্তু আজ প্রথমবার সাফিনকে ও ভাইয়া বলে ডেকেছে।
নুসরাত কাঁদতে কাঁদতে বললো – আমাকে ক্ষমা দাও ভাইয়া,আমি আর কখনো তোমার অতিত নিয়ে তোমাকে কথা শোনাবো না। আমার এই একটা ভুলের জন্য সবকিছু এলেমেলো হয়ে গিয়েছে, আ আম্মুর,,।
এই পযর্ন্ত বলে থেমে যায় নুসরাত। সাফিন তখন বিচলিত কন্ঠে ওকে জিঙ্গাসা করলো – কি হয়েছে আম্মুর?
নুসরাত বললো – তুমি যেদিন চিঠি লিখে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে,সেদিনই আম্মু স্ট্রোক করেছে।
সাফিন তখন চিৎকার বললো – কি? আম্মু স্ট্রোক করেছে?
নুসরাত বললো – হ্যাঁ ভাইয়া,আম্মু এখন প্যারালাইসিস হয়ে হুইল চেয়ারে বসে গিয়েছে। হাত পা কিছুই নাড়াচাড়া করতে পারে না। এক জায়গায় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। আমাদের কারোর সঙ্গে আম্মু আর কথা বলে না।
সাফিন কখনো ভাবতেই পারেনি তার হুট করে চলে যাওয়ার প্রভাবটা তার পালক মায়ের উপর এমন ভাবে পড়বে।
সাফিন জিঙ্গাসা করলো – এখন আম্মু কোথায় রয়েছে হসপিটালে না বাসায়?
নুসরাত বললো – আম্মু সাত দিনের মতো হসপিটালে এডমিট ছিল,পরে আব্বু উনাকে বাসায় নিয়ে আসে। আচ্ছা এগুলো পরে শুনো। এখন বলো তুমি কোথায় ছিলে? আর তোমার চেহারাটা এরকম কয়লার মতো হয়ে গিয়েছে কি করে?
সাফিন বললো – সব বলবো,আগে আম্মুর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই,পরে তোমাকে সব বলবো।
**
সাফিন মাথা নিচু করে কাঁদছে। ওর সামনে হুইল চেয়ারে রাহেলা রহমান বসে রয়েছেন। এতদিন পরে ছেলেকে কাছেও পেয়েও তিনি ওকে আদর করতে পারছেন না। রাহেলা রহমানের চোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি পড়ছে।
সাফিন সেটা খেয়াল করে। সে তখন রাহেলা রহমানের সামনে গিয়ে তার চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলে – কাঁদছো কেন মা? এই যে তোমার সাফিন চলে এসেছে, এখন তোমার আর কোনো চিন্তা নেই,যার জন্য তোমার এই অবস্থা সেই ছেলেটাই তোমাকে আবার সুস্থ করে তুলবে।
#চলবে