মায়ের মন পর্ব-০৩

0
1999

#মায়ের মন

#Writer_Shukkur_Ali

#পর্ব_৩

– আরে সাফিন ভাইয়া! কেমন আছো?

– হুম,ভালো আছি। তুই কেমন আছিস রে দিপা?

– এই তো,একটু আগেও খারাপ ছিলাম,কিন্তু এখন তোমাকে দেখার পরে আমার মন একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। আরে সঙ্গে এটা কে,ভাবী নাকি?

দিপার শেষের কথায় সাফিন কিছুটা বিব্রত হয়ে নাবিলার দিকে তাকায়। এবং দেখে মেয়েটাও লজ্জা পেয়ে গিয়েছে।

সাফিন বললো – এই! ভাবী বলিস কাকে? উনার তো এখনো বিয়েই হয়নি।

দিপা তখন একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো – বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে? তোমার সঙ্গে যেহেতু আমাদের বাসায় এসেছে,তখন ভাবী হতেই বা কতক্ষণ?

সাফিন এবার অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আর ভাবে – আরে,এই মেয়ে তো দেখছি আমাকে নাবিলার জামাই বানিয়েই ছাড়বে!

সাফিন বিষয়টা পাল্টানো জন্য বললো – তোর বাড়িতে এতদিন পরে এলাম,আমাদেরকে কি ভিতরে ঢুকতে দিবি না?

সাফিনের কথায় দিপা নিজেই এবার লজ্জা পেয়ে যায়। এবং বলে – ও হ্যাঁ,তাই তো! সরি আমি খেয়ালই করিনি তোমরা এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছো। আসো ভিতরে আসো।

দিপা ওদের বসার জন্য ভিতর থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে আসে। সাফিন ওকে বললো – বোন,আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। এখন তোর সাহায্য দরকার।

দিপা বললো – ওকে ভাইয়া বলো,কি সাহায্য লাগবে?

সাফিন তখন নাবিলাকে দেখিয়ে বললো – উনাকে তোর বাসায় কয়েকটা দিনের জন্য একটু রাখতে পারবি?

দিপা বললো – ও আচ্ছা,তাহলে এই ব্যাপার? পারবো মানে! তুমি যদি বলো তাহলে আমি ভাবীকে মাত্র কয়েকটা দিন না,সারাজীবনের জন্য আমার কাছে রেখে দিতে রাজি আছি,এখানে আমার কোনো সমস্যা নেই।

সাফিন তখন বললো – না,না,উনাকে তোর সারাজীবন রাখতে হবে না,মাত্র কয়েকটা দিন রাখলেই হবে। আর তোকে না বললাম উনার এখনো বিয়ে হয়নি? তাহলে বারবার ভাবী বলছিস কেন?

দিপা বললো – ওহ, সরি সরি! আপুর বিয়ে হয়নি,সেটা খালি বারবার মাথা থেকে বের হয়ে যায়!

সাফিন বললো – ঠিক আছে,নিজের খেয়াল রাখিস,আমি তাহলে এখন উঠি।

দিপা তখন অবাক হয়ে বললো – উঠি মানে? খেয়ে যাবে না?

সাফিন বললো – না রে,অন্য আরেকদিন খাবো। আজ যাই। আমার কিছু কাজ রয়েছে সেগুলো সারতে হবে।

সাফিন চলে যায়। নাবিলা দিপার দিকে তাকিয়ে বললো – আপনাদেরকে তো মনে হচ্ছে এখানে এসে বেশ ভালোই ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিলাম।

দিপা বললো – আরে না আপু,কি যে বলে বলেন। এখানে ঝামেলার কি আছে? আপনার জায়গায় যদি আজ আমার বড় বোন থাকতো তাহলে আমি কি তার পাশে দাঁড়াতাম না?

নাবিলা বললো – হুম,কিন্ত তারপরও এখনকার সময়ে একটি অচেনা বিপদগ্রস্ত মানুষকে কয়জনই বা বিশ্বাস করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয় বলেন?

দিপা বললো – এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন,যাক সেসব বাদ দিন। আর শুনুন,আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। কারণ বয়সে আমি আপনার থেকে অনেক ছোট।

নাবিলা তখন হেসে বললো – ঠিক আছে তুমি করেই বলবো,আচ্ছা উনি কি তোমার আপন ভাই হন?

দিপা বললো – না,সাফিন ভাইয়া আমার আপন রক্তের ভাই না। কিন্তু সে এই পযর্ন্ত আমার জন্য যা করেছে,তা নিজের মায়ের পেটের ভাইও করতো কিনা সন্দেহ।

আপনাকে একটা ঘটনা বলি,একবার আমি একটা মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ওই আকস্মিক ঘটনায় আমার শরীর দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়ে যায়। আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেলে ডক্টর আম্মুকে বললেন – ইমিডিয়েট দুই ব্যাগ এবি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত লাগবে। আমাদের কাছে এই গ্রুপের যা রক্ত ছিল তা সব শেষ হয়ে গিয়েছে।

ডক্টরের কথা শুনে আমার আম্মু প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলেন। কারণ এবি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত জোগাড় করা এক ধরনের অসম্ভব ব্যাপার। আর এই রক্ত খুবই বিরল। পৃথিবীর মাত্র ১% মানুষের রক্ত এবি নেগেটিভ। এখন আমার মা এই গ্রুপের রক্ত কোথায় খুঁজবেন? তিনি ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। এদিকে ডক্টর তাকে অনবরত তাড়া দিয়েই যাচ্ছেন – শিগগিরই রক্তের ব্যবস্থা করুন। তা নাহলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না।

আর সেইদিনই কাকতলীয় ভাবে সাফিন ভাইয়া তার আম্মুকে ডক্টর দেখানোর জন্য ওই হসপিটালে একয় তলায় গিয়েছিল। আমার আম্মুকে কান্না করতে দেখে ভাইয়া তখন উনার কাছে গিয়ে জিঙ্গাসা করে – কি হয়েছে আন্টি? আপনি কাঁদছেন কেন?

এর উত্তরে আম্মু বললেন – আমার মেয়ের খুব বাজে ভাবে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বাবা,এখন ওর এবি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু ডক্টর বলছে – তাদের কাছে আপাতত এই গ্রুপের রক্ত নেই। আমাকে রক্ত জোগাড় করতে বলেছে। এখন আমি এবি নেগেটিভ রক্ত কোথায় পাবো? আমি বোধহয় আমার মেয়েটাকে আর বাঁচাতে পারবো না।

সাফিন ভাইয়া তখন আম্মুর হাত ধরে বললো – কে বলেছে বাঁচাতে পারবেন না মা? আপনি অবশ্যই পারবেন। আমি আপনার মেয়েকে রক্ত দেবো। আমার রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ।

সাফিন ভাইয়ার কথা শুনে আমার আম্মু যেন নতুন করে আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন – সত্যি বাবা? তুমি আমার মেয়েকে রক্ত দেবে?

সাফিন ভাইয়া তখন মৃদু হেসে বললো – হ্যাঁ মা সত্যি,আজ যদি আপনার মেয়ের জায়গায় আমার নিজের বোন থাকতো,তাহলে কি আমি তাকে রক্ত দিতাম না?

সাফিন ভাইয়ার কথা শুনে আমার আম্মু তখন খুশি হয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললেন – আল্লাহ্ তোমার ভালো করুক বাবা,তোমার মতো এত ভালো এবং উদার মনের মানুষ যেন সবার ঘরে ঘরে জম্মায়।

সেদিন সাফিন ভাইয়া আমাকে রক্ত দিয়ে না বাঁচালে আমি আজ আপনার সামনে বসে কথা বলতে পারতাম না। আর ভাইয়া শুধু রক্ত দিয়েই থেমে যায়নি। আমি পুরোপুরি সুস্থ না পযর্ন্ত যতটুকু সম্ভব আমাদের পাশে থেকে বিভিন্ন কাজ করে দিয়েছে। আর শেষ পযর্ন্ত তো আম্মু সাফিন ভাইয়াকে বলেই ফেলে – আজ থেকে তুই আমার ছেলে,এতদিন আমি সবাইকে আমার মেয়ের পরিচয় দিয়ে এসেছি, এখন নতুন করে সেই জায়গায় তোকেও স্থান দিলাম। আজ থেকে সবাই জানবে কুসুম আক্তার শুধু এক কন্যার জননী না। সেই সঙ্গে তার আরেকটি ছেলেও রয়েছে যার নাম সাফিন।

আম্মুর কথা শুনে সাফিন ভাইয়া নাকি কেঁদে ফেলেছিলো। আর বলেছিল – আপনি আমাকে এত বড় একটি জায়গায় স্থান দিলেন মা? সত্যিই কি আমি এই স্থান পাওয়ার যোগ্য?

আম্মু বললেন – অবশ্যই তুই যোগ্য,তুই আমাদের জন্য যা করেছিস,তা কেবল একজন প্রকৃত সন্তানই তার মা এবং বোনের করে। হসপিটালে তো সেদিন আরও অনেক লোক ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কি একবারো আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছে আমার কি হয়েছে? আমি কাঁদছি কেন? না চায়নি। শুধুমাত্র তুই জানতে চেয়েছিস। এতেই বোঝা যায় তোর ভিতরে আসল নৈতিক শিক্ষাটা রয়েছে। যেটা বাকি আট দশটা মানুষের মধ্যে নেই।

নাবিলা খুব মনোযোগ দিয়ে দিপার কথা গুলো শুনছিল। সাফিনের করা কর্মকাণ্ডের কথা শোনার পরে সে ওর প্রতি আরও মুগ্ধ হয়ে যায়। এবং ভাবে একটা মানুষ এতটা উদার মনের হয় কিভাবে? সাফিন এমন একটা মানুষ,যে কিনা নিজের চাইতে তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোকে নিয়েই বেশি চিন্তা করে।
**
সাফিন এখন একটি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নাহ,এখন ওকে একটা ছোটখাটো কাজ খুঁজতেই হবে। তা নাহলে সে টিকতে পারবে না। ও হোটেলের ভিতরে ঢুকে। সামনের ক্যাশ কাউন্টারে একজন লোক বসে রয়েছে। খুব সম্ভবত এই হোটেলের ম্যানেজার হবে।

সাফিন তার কাছে গিয়ে সালাম দেয় – আসসালামুয়ালাইকুম।

ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা লোকটা তখন টাকা গুনছিলেন। তিনি তখন টাকা গোনা বন্ধ করে সাফিনের দিকে তাকিয়ে বললেন – ওলাইকুম আসসালাম,কি চাই?

সাফিন বললো – জ্বী,আপনাদের এখানে একটা কাজ চাই,আর যেকোন কাজ দিলেই চলবে। এই যেমন থালা বাসন মাজা। রাঁধুনীর সহকারী হওয়া থেকে শুরু করে যেকোন কাজ।

ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা লোকটার নাম বাহার উদ্দিন। সাফিনের কথা শুনে তিনি তখন ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন। উনি হোটেলে চাকরি করেন আজ আট বছর। এতদিনে কে গরীব আর কে বড়লোক সেটা বাহার উদ্দিন বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন।

উনার সামনে এখন লম্বা,ফর্সা আর রোগা পাতলা করে যেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে ভালো পরিবারের সন্তান। আচ্ছা,ছেলেটার সত্যিই কাজের দরকার? নাকি সে এমনিই তার সঙ্গে মজা করছে?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে