মায়ের মন পর্ব-০২

0
2913

#মায়ের মন

#Writer_Shukkur_Ali

#পর্ব_২

সাফিন সারাদিন কিচ্ছু খায়নি। অবশ্য খাবেই বা কি করে? ও তো নিজের সব জিনিসপত্র তার পালক মা বাবার বাড়িতে রেখে এসেছে। যদিও সে এখন ইচ্ছে করলে সেই বাসায় ফিরে গিয়ে এসব জিনিস আবার নিয়ে আসতে পারে। কিন্ত সাফিন ছিল বড্ড জেদি।

ও যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার জীবনে ঠিক কিসের কমতি রয়েছে সেটা জানবে তো জেনেই ছাড়বে। এর জন্য যদি ওকে খালি পেটে রাস্তায়ও থাকতে হয় তাতেও তার কোনো অসুবিধা নেই।

সাফিন পার্কের ভিতর দিয়ে হাটছিলো। হঠাৎ ওর প্রচণ্ড পানির পিপাসা পায়। একে তো মাথার ঊর্ধ্বে কড়া রোদ,তার উপর পেটে মারাত্মক খিদে। সব মিলিয়ে সাফিনের পা দুটো যেন আর চলছিল না। অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে।

তবে সাফিন ঠিক তখনই ওর থেকে কয়েক কদম দূরে একটি পানির ট্যাপ কল দেখতে পায়। যেটা দেখামাত্র সে পাগলের মতো সেখানে ছুটে যায়। এবং ঢকঢক করে ট্যাপ কলের পানি খেতে থাকে। ক্ষুধার জ্বালা নেভানোর জন্য ও বেশ পেট ভরে পানি খায়।

সাফিন একটা খালি বেঞ্চে বসে। আর কিছুক্ষণের জন্য নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে থাকে তার এখন কি করা উচিৎ।

– না আমি আপনাদের সঙ্গে যাবো না,আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।

হঠাৎ সাফিন একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পায়। ও তখন চোখ খুলে পিছনে তাকিয়ে দেখে তিনটা বখাটে ছেলে একজন মেয়েকে জোর করে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।

সাফিন তখন ছেলে গুলোর সামনে গিয়ে বললো – আরে আরে! আপনারা সবাই মিলে মেয়েটাকে এভাবে টানাটানি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

এর উত্তরে তাদের মধ্যে একটা ছেলে ডান হাত দিয়ে সাফিনের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো – ওই ব্যাটা! আমরা ওরে কই নিয়া যাই সেইটা জাইন্না তোর কাম কি? তুই কি ওর জামাই লাগোস?

সাফিন তখন নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বললো – ওর জামাই লাগি কিনা জানিনা,তবে আমি অবশ্যই তোদের দুলাভাই হই।

এ কথা বলেই সে খপ করে ছেলেটার ডান হাতটা ধরে মচকে দেয়। প্রচণ্ড ব্যথায় বেচারা তখন চিৎকার দিয়ে বলে উঠে – ও বাবা গো!

বাকি দুজন এবার মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে ওকে মারতে আসে। তাদের মধ্যে একজনকে সাফিন ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। যার ফলে ওই ছেলের কোমরের বারোটা বেজে যায়। আর অপরজনের মাথায় সাফিন নিজের মাথা দিয়ে বাড়ি মারে। এতে ওর কোনো ক্ষতি না হলেও দ্বিতীয় ছেলেটা মাথায় বাড়ি খেয়ে কয়েক গজ দূরে ছিটকে পড়ে।

সাফিনের মার খেয়ে তিনজনের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এবং তারা ভয়ে সেখান থেকে চম্পট দেয়।

সাফিন মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের পথে হাটা দেয়। তবে কিছু দূর যাওয়ার পরে সে লক্ষ্য করে ওই মেয়েটা তার পিছনে পিছনে আসছে। সাফিন থেমে গেলে মেয়েটাও থেমে যায়।

সাফিন তখন মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় এবং জিঙ্গাসা করেন – একি! আপনি পিছনে পিছনে আসছেন কেন?

ওর প্রশ্নে মেয়েটা কিছুটা ভড়কে যায়। আর আমতা আমতা করে বলে – আ আসলে, আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার মামা মামী আমাকে জোর করে তাদের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমি ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চাই না। কারণ ও মারাত্মক উগ্র এবং বখাটে।

ওই তিনটা ছেলের মধ্যে আপনি যার হাত মচকে দিয়েছেন তার নাম রনি। আর ওর সঙ্গেই মামা মামী আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।

সাফিন বললো – তা এখানে আমি এখন আপনার জন্য কি পারি?

মেয়েটা কিছুটা সংকোচ বোধ করে বললো – না মানে..।বলছিলাম আপনি কি আমাকে কয়েক দিনের জন্য একটু আশ্রয় দিতে পারবেন?

সাফিন তখন মেয়েটাকে জিঙ্গাসা করলো – আপনার নাম কি?

মেয়েটা বললো – নাবিলা,

সাফিন তখন বললো – শোনেন নাবিলা,আমার নিজেরই এখন থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। আপনাকে আশ্রয় দেবো কোথায়?

নাবিলা বললো – ও আচ্ছা, ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি একটা ব্যবস্থা করে নিবোনে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,আসি ভাইয়া।

নাবিলা কথাগুলো হাসি মুখে বললেও সাফিন বুঝতে পারে মেয়েটার আসলেই আর কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা নেই। থাকলে সে তার মতো একটা অপরিচিত ছেলের কাছে আশ্রয় চাইতো না। খুব সম্ভবত মেয়েটার মামা মামী ওর উপরে অনেক অত্যাচার করে। কারণ সে যখন নাবিলার দিকে তাকিয়ে ছিল তখন ওর মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে।

এখন মেয়েটা হয়তো আবার তার সেই অত্যাচারী মামা মামীর কাছে ফিরে যাচ্ছে। বাসায় প্রবেশ করা মাত্রই যারা কিনা নাবিলাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে ওর সম্পূর্ণ জীবনটা এক মিনিটেই শেষ করে দিবে।

সাফিন মেয়েটাকে পিছন থেকে ডাক দেয় – এইযে শুনুন।

নাবিলা আবার সাফিনের কাছে যায় আর মাথা নিচু বলে – জ্বী ভাইয়া,বলেন।

সাফিন বললো – আপনার কি মা বাবা বেঁচে আছেন?

নাবিলা বললো – জ্বী,আছেন। তবে উনারা দুজনই আমার মামা মামীর কাছে পঙ্গু । ওদের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তেই মা বাবা বিরোধীতা করতে পারেন না। আর তাদের প্রতিবাদ করতে না পারার বড় কারণ হচ্ছে – বাবা একবার ব্যবসার জন্য আমার মামার কাছ থেকে দশ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে,সেই ব্যবসায় উনার যে পার্টনার ছিল,সে পুরোপুরি বাবাকে বোকা বানিয়ে মামার দেওয়া সেই দশ লক্ষ টাকা তার কাছ থেকে নিজের পকেটে ভরে নেয়।

ব্যস,সেই থেকে আমার মামা পুরোপুরি বদলে গেল। যে মামা সারাক্ষণ আমাকে আদর করতো। এখন সেই মামা আমাকে আর সহ্য করতে পারে না। কারণ তার ধারণা এইসব কিছু নাকি আমার জন্যই হয়েছে।

তাই এর ক্ষতিপূরণ আমাকেই দিতে হবে। এখন মামার সেই দশ লক্ষ টাকা শোধ করার একমাত্র উপায় বিয়ে। রনির বাবা ফিরোজ খন্দকারের প্রচুর টাকা।

আমার মামা রনির বাবার কাছে বিয়ের কাবিননামা বাবদ বারো লক্ষ টাকা দাবি করেছে। এবং ফিরোজ খন্দকার তার ছেলের জন্য সেই দাবি মেনে নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে।

মামা আমাকে বললেন – কাবিননামার বারো লক্ষ টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই তুই সেই টাকা এনে আমায় দিবি।

আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। তাই মত না থাকার সত্বেও আমি রনিকে বিয়ে করতে রাজি হই।

কিন্তু মা আমাকে সেদিন আড়ালে নিয়ে বললেন – নাবিলা,মা তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করিস না। তোর জীবনটা নষ্ট যাবে।

আমি মাকে বললাম – আমি আর কি করবো মা? মামার কথা না শুনলে তো সে বাবাকে বারো লক্ষ টাকা চুরির দায়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে জেলে পাঠাবে, সেটা কি ভালো হবে বলো?

মা বললেন – আমাদের দুজনকে নিয়ে তোর এত ভাবতে হবে না,তুই নিজের কথা ভাব। এখান থেকে পালা মা।

আমি মাকে বললাম – কি বলছো মা? তোমাদেরকে এখানে বিপদের মধ্যে রেখে আমি পালিয়ে যাবো?

মা বললেন – তুই এসব নিয়ে একদম ভাবিস না,আমি আর তোর বাবা এদিকটা সামলে নিতে পারবো। মায়ের কথাটা শোন মা। পালা পালিয়ে যা এখান থেকে।

মায়ের অনেক জোড়াজুরিতে আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাসা থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু এই কথাটা কিভাবে যেন ওই বখাটে রনির কান পযর্ন্ত পৌঁছে যায়। এবং আমাকে ধরার জন্য সে তার দুজন সহকারীকে নিয়ে আমার পিছু নেয়। তারপরের ঘটনা তো আপনি নিজের চোখেই দেখেছেন।

সাফিন বললো – হুম,আপনি তো দেখছি বেশ ভালোই ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছেন।

নাবিলা বললো – তা তো পড়েছিই,যাক ব্যাপার না। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সাফিন বললো – ঠিক আছে,চলেন তাহলে।

নাবিলা বললো – কোথায় যাবো?

সাফিন বললো – আপনি না কয়েক দিনের জন্য আমার কাছে একটু আশ্রয় চাইলেন? আমি এখন আপনাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি,চলেন।

সাফিনের কথা শুনে নাবিলা তখন অবাক হয়ে বললো – কিন্তু আপনি তো বললেন আপনার নিজের কোনো থাকার জায়গা নেই,তাহলে এখন আবার আমাকে কোথায় আশ্রয় দিতে চাচ্ছেন?

সাফিন বললো – সেটা না হয় গেলেই দেখতে পারবেন।

নাবিলা কয়েক মিনিট কি যেন চিন্তা করে তারপর বললো – ঠিক আছে চলুন,দেখি আপনি আমাকে কোথায় আশ্রয় দেন।

সাফিন তখন একটু ইতস্ততঃ হয়ে বললো – রিক্সায় যেতে হবে,আর ইয়ে..ভাড়াটা কিন্তু আপনিই দিবেন। আমার কাছে এখন একটি টাকাও নেই।

নাবিলা তখন হেসে বললো – আচ্ছা দেবো, সমস্যা নেই।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে