মায়ের মন পর্ব-০১

0
3317

#মায়ের মন

#Writer_Shukkur_Ali

#পর্ব_০১

আম্মু,তুমি আর আব্বু বলে ছোটবেলায় আমাকে রাস্তা কুড়িয়ে এনেছো, এটা কি সত্যি?

রাহেলা রহমান রান্নাঘরে খাবার তৈরি করছিলেন। হঠাৎ সাফিনের এই প্রশ্নে তিনি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। উনি এবং উনার স্বামী ওকে যে রাস্তা তুলে এনেছেন সেটা তো সাফিনের জানার কথা নয়। কথাটা তো এত বছর তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই গোপন ছিল। তাহলে সেটা সাফিন জানলো কিভাবে? তবে কি শফিক ওকে সবটা বলে দিয়েছে?

রাহেলা রহমানকে নীরব থাকতে দেখে সাফিন আবারও তাকে প্রশ্ন করে – ও মা, চুপ করে রয়েছো কেন? আমি যেটা জিঙ্গাসা করছি সেটার উত্তর দাও। তোমরা দুজনে কি সত্যিই আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছো?

রাহেলা রহমান এবার হালকা গলায় ওকে জিঙ্গাসা করলেন – তোকে এসব কে বলেছে?

সাফিন বললো – নুসরাত আপু,

রাহেলা রহমান চমকে গেলেন। নুসরাত আবার এগুলো শুনলো কার কাছ থেকে?

সাফিন শুকনো হাসি দিয়ে বললো – বুঝতে পেরেছি ,তার মানে নুসরাত আপুর কথাই ঠিক। আজ থেকে ২৩ বছর আগে তোমরা আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে নিজেদের জীবনধারায় বড় করে তুলেছো।

সাফিন কথাগুলো শান্ত ভঙ্গিতে বললেও রাহেলা রহমানের ওর বলা প্রতিটা বাক্য বিষাক্ত ছুরির মতো মনের ভিতরে গেঁথে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ রান্নাবান্না সব থামিয়ে দিয়ে নুসরাতের কাছে গেলেন।

নুসরাত তখন মেঝে থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরো উঠাচ্ছিলো। রাহেলা রহমান মেয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কোনো প্রকার সাড়া শব্দ ছাড়া আচমকা মাকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু ভয় পেয়ে যায়।

নুসরাত তখন উনাকে জিঙ্গাসা করলো – আরে আম্মু? তুমি আমার পিছনে এসে দাঁড়ালে কখন?

রাহেলা রহমান মেয়ের প্রশ্নকে পাত্তা দিলেন না। তিনি নুসরাতকে জিঙ্গাসা করলেন – তুই সাফিনকে কি বলেছিস?

নুসরাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে থেকে বললো – যা সত্যি তাই বলেছি, ও তো একটা রাস্তার ছেলে। শুধু তোমার আর বাবার দয়ায় সে এখনো আমাদের বাসায় রাজার হালে থাকতে পারছে। ভালো ভালো খাবার গিলতে পারছে।

রাহেলা রহমান নুসরাতের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। এবং রাগী গলায় বললেন – বেয়াদব মেয়ে! তোকে আমি এই ব্যবহার শিখিয়েছি?

মায়ের হাতে চড় খেয়ে নুসরাত পুরো হতবাক হয়ে যায়। ও গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো – আম্মু, একটা রাস্তার ছেলের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত উঠালে?

রাহেলা রহমান মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন – একদম চুপ! সাফিনকে আরেকবার রাস্তার ছেলে বললে আমার থেকে খারাপ কিন্তু আর কেউ হবে না।

নুসরাত ভয়ে চুপ হয়ে যায়। রাহেলা রহমান ওকে বললেন – সাফিনকে যে আমি আর তোর বাবা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছি সেটা তুই জানলি কিভাবে?

নুসরাত এবার আর কিছু বলতে পারে না। ও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে থাকে।

আসলে ঘটনা হচ্ছে – একদিন রাতে পানি খাওয়ার জন্য ও ডাইনিং টেবিলের দিকে যাচ্ছিল। বাবা মায়ের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নুসরাত ভিতর থেকে উনাদের কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পায়। বাবা মা ঠিক কি নিয়ে আলোচনা করছেন সেটা জানার জন্য তার মনে বেশ আগ্রহ জাগে। নুসরাত দরজায় কান লাগিয়ে বাবা মায়ের কথা শোনার চেষ্টা করে।

ঘরের ভিতরে বাবা মাকে বলছেন – আচ্ছা রাহেলা,তোমার কি মনে হয় না,এবার সাফিনকে আমাদের সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ?

এর উত্তরে মা তখন বাবাকে কড়া গলায় বললেন – না!একদমই না,সাফিন সত্যিটা জানলে মোটেও সহ্য করতে পারবে না। কারণ ওর যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে তখন থেকে সে আমাদেরকেই নিজের মা বাবা বলে জেনে এসেছে। এখন যদি আমি আর তুমি ওকে বলি – সাফিন, তুই আমাদের নিজের ছেলে না। তোকে আমরা রাস্তা থেকে তুলে এনে নিজেদের পরিচয়ে বড় করেছি। এটা জানার পরে ওর মনের অবস্থা কি হবে তা একবার ভেবে দেখেছো?

বাবা বললেন – কিন্তু রাহেলা,তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা ছেলেটাকে সত্যিটা না জানিয়ে অন্যায় করছি?

মা বললেন – তা তো মনে হচ্ছে,কিন্তু কি করবো বলো? সাফিনকে আমি কখনোই বাইরের ছেলে হিসেবে দেখিনি। দেখলে আমি সেদিন তোমার হাজার বারণ করার সত্বেও ওকে ময়লার স্তুপ থেকে উঠিয়ে নিজের সঙ্গে আনতাম না।

নুসরাত বাবা মায়ের মুখে এসব কিছু শুনে একদম হতভম্ব হয়ে যায়। সাফিন তাহলে তার নিজের ভাই না। এজন্যই তো ও সব সময় ভাবতো বাবা মায়ের স্বভাব কিংবা চেহারার সঙ্গে ওর কোনো মিল নেই কেন।

যাইহোক, নুসরাত বাবা মায়ের ঘরের সামনে থেকে সরে যায়। তবে সে এই কথা তার বাকি দুই ভাইবোনকে জানায় না।
**
রাহেলা রহমান বললেন – কি হলো,আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন? বল তুই এসব কিভাবে জানলি?

নুসরাতের গলা শুকিয়ে এসেছে। সে বেশ ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো – আ আসলে, তুমি আর বাবা সাফিনকে নিয়ে সেদিন রাতে যখন কথা বলছিলে তখন আমি তোমাদের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ওইদিন সাফিনকে নিয়ে বলা তোমাদের সব কথা আমি শুনে ফেলি।

নুসরাতের কথা শুনে রাহেলা রহমান ওর ডান গালে আরেকটা চড় দিলেন। এবং ক্ষিপ্ত গলায় বললেন – ফাজিল মেয়ে! তুই তাহলে সারাদিন ঘরের মধ্যে এসব করে বেড়াস? আচ্ছা শুনেছিস ভালো কথা, তা সেটা আবার সাফিনকে বলার কি দরকার ছিল হা?

মায়ের হাতে পরপর দুটো চড় খেয়ে নুসরাত এবার কেঁদে ফেলে। আর হেঁচকি দিতে দিতে বলে – আম্মু,বিশ্বাস করো আমি সাফিনকে কথাটা বলতে চাইনি। এই দেখো,আব্বু গত বছর আমাকে জম্মদিনে যেই কাঁচের জারটা উপহার দিয়েছিল সেটা ও আজ ইচ্ছে করেই ভেঙে ফেলেছে।

আব্বুর দেওয়া উপহারটা সাফিন ভেঙে ফেলায় আমার মাথা অনেক গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই রাগের মাথায় আমি মুখ ফসকে ওকে সত্যিটা বলে দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু।

রাহেলা রহমান বিরক্ত হয়ে নুসরাতের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই ছোটবেলা থেকে তিনি দেখে আসছেন উনার তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে কেউই সাফিনকে দেখতে পারে না।

রাহেলা রহমান সাফিনের ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন ও ঘরে নেই। হঠাৎ উনার চোখ সাফিনের পড়ার টেবিলে যায়। তিনি সেখানে কলম দিয়ে চাপা রাখা একটি কাগজ দেখতে পেলেন।

রাহেলা রহমান কলমটা সরিয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখেন এটা সাফিনের হাতে লেখা চিঠি। উনি তখন সেটা পড়তে শুরু করেন।

** প্রিয় স্যার এবং ম্যাডাম**

আমার মতো একটি গরীব অসহায় রাস্তার ছেলেকে কুড়িয়ে এনে এতগুলো বছর নিজেদের পরিচয়ে বড় করেছেন তার জন্য আমি আপনাদের দুজনের কাছেই অনেক কৃতজ্ঞ। শুধুমাত্র আপনাদের কারণে আমি ভালো পরিবেশে থাকতে পেরেছি। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে সুন্দর একটা পরিবার পেয়েছি।

কিন্তু তারপরও আমার এখন মনে হচ্ছে আমার জীবনে কিছু একটার কমতি রয়ে গিয়েছে। আমি আমার সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে বের হলাম। যেদিন আমার কমতির জায়গাটা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হবে সেদিনই আমি আবার আপনাদের কাছে ফিরে আসবো

** ইতি আপনাদের পালক সন্তান সাফিন**

চিঠির শেষের লাইনটা পড়ে রাহেলা রহমানের মনের ভিতরটা তছনছ হয়ে যায়।

রাহেলা রহমান ছেলেকে ফোন করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন সাফিন ওর ব্যবহৃত ফোন,মানিব্যাগ চশমা, ঘড়ি,এসব কিছু ঘরে রেখে গিয়েছে। তার মানে এখন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোনো উপায় নেই।

মাথায় অতিরিক্ত মানুষিক চাপ পড়ার কারণে রাহেলা রহমান সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে