#মায়ের_কথা
পর্বঃ ৬(শেষ পর্ব)
#সাবাব_খান
‘তোমার কি এমন স্বপ্ন আম্মা?’
আম্মা করুন কণ্ঠে বললেন, ‘এইটা আমার অনেক দিনের একটা স্বপ্নের কথা বাপ!’
‘কি কথা আম্মা?’
আম্মা ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি অবাক হলাম। ধ’মকের সুরে বললাম, ‘তুমি কি বলবা কিছু?’
আম্মা কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘শোন বাপ, তোর বাপের মাথা নষ্ট হওয়ার পর আমি অনেক মাইনষেরে অনুরোধ করছি। তোর চাচাগুলারে তোর মামাগুলারেও অনুরোধ করছি। তোর খালু,ফুফা কেউরে বাদ রাখি নাই। একটাই অনুরোধ করছিলাম। কইছিলাম আমার সোনা-গয়না যা আছে সব বেইচ্চা টাকা দিমু। খালি তোর বাপেরে একটু বিদেশে নিয়া চিকিৎসা করাইতে। ইন্ডিয়া নিয়াও যদি চিকিৎসা করাইতে পারতাম আমার মনে হয় কিছুটা ভালো হইতো। কিন্তু সাবাব, কেউ আমার অনুরোধ শোনে নাই। সময় কইরা কেউ তোর বাপেরে চিকিৎসা করতে নিয়া যায় নাই। সবাই নিজেরে নিয়া ব্যস্ত। কে নিয়া যাইবো তোর অসুস্থ বাপেরে চিকিৎসা করতে? তোর বাপের ভাই-বোন কেউই আগায়া আসে নাই আমার অনুরোধে। আমি কেউরে দিয়া ইট্টু মনের মত চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। আমি মহিলা মানুষ। তিনডা বাচ্চা নিয়া নিজেও দৌড়াদৌড়ি করতে পারি নাই। আমার মনের একটাই স্বপ্ন তোর বাপেরে বিদেশ নিয়া যদি ইট্টু চিকিৎসা দিতে পারতাম। স্বপ্নটা কেউ পূরণ করতে আগায়া আসে নাই। আমি স্বামী নিয়া বিপদে পড়ছি। সবাই আমারে অনেক কতা কয়। কিন্তু আমার কামডা কেউ কইরা দেয় না। তুই আমার একমাত্র পোলা। তোর বাপ অসুস্থ। আমি তোরে কোনদিন ঐ দূরের দেশে পাঠাইতাম না। আমি তোরে একটা আশায় পাঠাইছি। আমার আশা তুই তোর বাপেরে এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাবি। কত উন্নত দেশ এমেরিকা! কত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। আমার মনডায় কয় এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইলে তোর বাপে সুস্থ অইতো। শুধু এই কারণেই আমি তোর বউ কইরা আমার ভাইঝিরে আনতে চাইছিলাম। বাইরের মাইয়া আনতে চাই নাই। আমি ভাবছিলাম আমার ভাইঝিডা অনেক ভালো অইবো। তোর বউ হইলেও আমার স্বপ্নে বাধা দিব না। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। অরা অনেক স্বা’র্থপর। অগো চাপ্টার বাদ। তোর কাছে এহন আমার একটাই অনুরোধ ; তুই বিয়া করার আগে তোর বাপেরে ইট্টু এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইস। তোর বাপের সুস্থ হওয়ার স্বপ্নডা পূরণ করিস বাবা। আমার স্বামী থাকতেও আমি অসহায়। যে স্বামীরে নিয়া বিপদে পড়ে সে বোঝে জীবনডা কতো কষ্টের। আপন বলতে তার কেউ থাকে না। আমার তুইই আপন। তুই আমার কথাডা শুনিস বাপ।’
আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। আম্মার কথার মাঝে হাহাকার ছিলো। ছিলো জীবনের প্রতি। আমার প্রতি অনুরোধ আর দায়বদ্ধতা। আমি কি জবাব দেবো? খানিক ভেবে আমি আম্মাকে বললাম, ‘আমি তো মাত্র আসছি এমেরিকায়! এখনই আব্বারে আনতে পারমু কিনা জানিনা! তবে আমি চেষ্টা করমু।’
আমি ফোন রেখে দিলাম। আব্বাকে নিয়ে আম্মার মনের কথা শুনে ভীষণ অবাক লাগলো। এতোটা হাহাকার যে আম্মার মনে, আমি নিজেও জানতাম না। আমি দুদিনের মধ্যেই আসিফ ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। দেশ থেকে সুস্থ মানুষকে এমেরিকায় আনাই অনেক কষ্টকর। সেখানে আব্বার মত একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষকে আনাটা একদম দুসাধ্য,কষ্টসাধ্য।
অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। নিজেরও কষ্ট লাগলো আম্মার কথা শুনতে পারবো না বলে। অবশেষে একজন আইনজীবী আমাকে বিনোদন মিডিয়ার লোকদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। মিডিয়ার লোকেরা খুব সহজেই ইউরোপ-এমেরিকায় আসতে পারে।
আমি অনেক কষ্টে মিডিয়ার কয়েকজন লোকের সাথে পরিচিত হলাম। তারপর এক পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলাম। আব্বাকে অভিনেতা প্রমাণ করার জন্য তিনি আমাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। আমি এফডিসিতে যোগাযোগ করে পরামর্শ অনুযায়ী আব্বার জন্য কিছু কাগজ তৈরি করলাম। আব্বাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত অভিনেতা সাজালাম। তারপরে বিনোদন মিডিয়ার টিমের সাথে নিয়ে এলাম এমেরিকায়। সেদিন আম্মার সাথে কথা বলার ছয় মাসের মধ্যেই আব্বাকে এমেরিকায় নিয়ে আসি। এখানেও টেনশন ছিল। আব্বাকে চিকিৎসার জন্য হসপিটালে রাখতে হবে। দেশে তো আশেপাশে সব একই রকমের লোকজন ছিলো। আর এখানে তো সব সাদা-কালো লোকজন। কেউ কেউ খুব ফর্সা আবার কেউ কেউ খুব কালো। আব্বা এদের মাঝে হাসপাতালে থাকতে গিয়ে আরো ভয় পেয়ে যায় কিনা। এসব চিন্তা ছিল আমার মনে। আমি অনেক ভয় নিয়েই আব্বাকে হাসপাতালে দিলাম ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে। ভিজিটিংয়ের দিন গিয়ে দেখে আসতাম। বুকে পাথরের মত ভয় ছিল। না জানি আব্বার আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যায়! এখানকার পরিবেশে লোকজন আব্বার সম্পূর্ণ অচেনা। একটা অসুস্থ মানুষ অচেনা পরিবেশে আরো অসুস্থ হয়ে যায়। এদের ভাষাও আলাদা। তবে একটা জিনিস সাপোর্ট ছিল। আমার আব্বা তো লেখাপড়া ছিলেন। ইংরেজিতে কথা বললে আব্বা খুব খুশি হয়ে যেতেন। তাকে শিক্ষিত মনে করে কিছু উত্তর দিতে পারতেন। সেটা যেরকমই হোক। আগে থেকেই তো এলোমেলো,অসংলগ্ন কথা বলতেন। এখানেও উত্তরে অসংলগ্ন কথাই বলতেন। তবে ইংরেজিতেই সব বলতেন। মাসখানেক যেতেই আব্বার মাঝে একটু পরিবর্তন আসে। পরিবর্তনটা পজিটিভ ছিল না। ছিলো নেগেটিভ পরিবর্তন। আব্বা বেশি পা’গলামো করতে শুরু করে। থাকতেই চাচ্ছিলো না হাসপাতালে। সেখানকার পরিবেশ,মানুষজন কিছুই পছন্দ হয়নি আব্বার।
আমি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে আসতাম। অসুস্থ মানুষ কি আর এত বোঝে। নতুন এবং অচেনা পরিবেশের কারণেই মূলত সমস্যা হয়েছে। এভাবে একমাস কে’টে যায়। আব্বাও সেট হয়ে যায় হসপিটালে। শুধু সেট হয়ে যায় নি। অন্যান্য অসুস্থ লোকদের সাথে খেলাধুলাও করতেন, আড্ডাও দিতেন। কিছু কথাবার্তাশও ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারতেন। এভাবে কে’টে যায় তিন মাস। এবার আব্বা জামা-কাপড় সব নিজে পড়তে পারতেন। হসপিটাল থেকে এসবই জানিয়েছিল আমায়। আমি নিজেও খেয়াল করেছি আবার চেহারায় এবং সবকিছুতে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছাপ এসেছে। একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। সেই তিন মাস পরেই এক সাক্ষাতে আব্বা আমার কাছে বললেন, ‘আমি কিন্তু সুস্থ হইতাছি বাবু! তোর মা’র কাছে এইডা কইস না। ওর কাছে বলবি আমি পা’গলই আছি। আমরা একসাথে সারপ্রাইজ দিমু তোর মায়রে।’
আমি বুঝতে পারলাম আব্বা আসলেই সুস্থ হচ্ছেন। কারণ আম্মার সাথে দুষ্টুমি করার ব্যাপারটাও আব্বার মাথায় আছে। এভাবে কে’টে যায় পুটো ছয় মাস। আব্বা পুরো সুস্থ এখন। ডাক্তার বলেছিলেন উনি অ্যা’ক্সিডেন্ট করার পরপরই যদি সুচিকিৎসা দেয়া হতো তাহলে এত সময় লাগতো না।
সুস্থ হবার পরে আমি আব্বাকে বাসায় নিয়ে এলাম। আব্বা বাসায় থাকতে চাচ্ছিলেন না। টুকিটাকি কাজ শুরু করেছিলেন। তবে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে আব্বা আম্মার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতেন না। আব্বার গেটআপ পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছিল। আম্মা দেখলেই বুঝতে পারতো যে আব্বা সুস্থ। আব্বা ফোনে কথা বলতেন আম্মার সাথে। কিন্তু পুরোপুরি পা’গল সেজে। আব্বা আমাকেও বলতে দেয়নি আম্মাকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। আমিও আব্বা-আম্মার দুষ্টুমির মাঝখানে বাধা হতে চাইনি।
আরো দু’মাস পরের কথা। আম্মা জানে আব্বা সুস্থ হয়নি। তারপরেও আমি এমেরিকায় এনে চিকিৎসা করেছি। এতেই আম্মা অনেক সন্তুষ্ট। কোনো আফসোস নেই আম্মার। দেশে আমার বিয়ে ঠিক করেছি। আমার সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথেই। আজ আমরা বাপ-ছেলে বাড়ি এসেছি। বাড়ির সামনে এসে আমাদের গারি থামলো। আম্মা কিন্তু জানেনা যে আব্বা সুস্থ। বাড়ি কেউই জানে না। আগেই জানে আমি বাড়ি আসব। ঢাকা থেকে ভাড়াকৃত গাড়ি নিয়ে এসেছি। গাড়ির শব্দ পেয়ে আম্মাসহ আমার বোনেরা দৌড়ে এসেছে। আমি প্রথমে নামলাম গাড়ি থেকে। এরপরে স্যুটবুট পরিহিত কমপ্লিট মডার্ন ভদ্রলোকের ন্যায় আব্বা নামলেন। আম্মার চোখের দৃষ্টি বরফের ন্যায় স্থির হয়ে গেছে। আম্মা ভাবছে এ আমি কাকে দেখছি। আব্বার সেই পা’গলাটে চেহারাটা আর নেই। পরনের কাপড়গুলোও এলোমেলো নয়। হাঁটাচলায়ও কোনো অসংলগ্নতা নেই। কমপ্লিট একজন ভদ্রলোক তার স্বামী। আম্মার চোখের পলক সরছে না। কদমও চলছে না তার। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্বাই এগিয়ে গিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের সবার মাঝেই। আম্মা কান্না শুরু করে দিয়েছেন। আমি জোরগলায় বললাম, ‘ঘরে গিয়ে তোমরা কান্নাকাটি করো তো! বাইরে পাবিলিকলি কিছু কইরো না!’
কয়েকদিন পরের ঘটনা। আজ আমি বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে আছি বাসর ঘরে। নিজের নতুন জীবনের কথা আর কি বলবো! আব্বা-আম্মার নতুন জীবন দেখেই কূল তো পাইনা। একদম নব বিবাহিত দম্পতির ন্যায় আচরণ করছে তারা। আব্বা বারবার রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ নেয় আম্মা হাঁপিয়ে উঠেছে কিনা। আজ সন্ধ্যায় দেখলাম আম্মাকে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়াচ্ছে। ঈদের সুখে আছে তারা দুজন। আমারও সুখ লেগেছে তাদের সুখে। বাসর ঘরে বসে আমার বউকে বললাম, ‘তোমার জন্য আমি রাফারে এক গোল দিয়া সরাইয়া দিছি!’
বউ জবাব দিলো, ‘তুমি নিজেই তো ঠকছো! এক গোল দেয়া লোক আমি চাইনা!’
‘মানে?’
‘আমি চাই আমার জামাই হ্যাট্রিক করুক।
এরকম ব’দমাইশগুলার সবগুলারপ সরায়া দেউক!’
‘আমি কিন্তু হ্যাট্রিকই করেছি। মামার গুষ্ঠী, দাদার গুষ্ঠী দুইটারেই শিক্ষা দিছি। আবার আমার আব্বার চিকিৎসাও করছি। এখন আর আমার কোনো টেনশন নাই। বউ নিয়া সুখের সংসার করমু।’
‘বউরে আগে এমেরিকা নেয়ার ব্যবস্থা করো। নয়তো এমেরিকা বইসা বাংলাদেশে সংসার করা লাগবো।’
‘আরে দুনিয়ার যেই জায়গায়ই যাই বউরে বুকে কইরা নিয়া যাইমু।
‘দেখা যাবে!’
……
দুই বছর পরের কথা। আমার বউকে এমেরিকায় নিয়ে এসেছি। আব্বা-আম্মা দেশে ভালো আছেন। আমার বোন বড়টার বিয়ে হয়েছে ব্যাংকারের সাথে। বোনও চাকরির ট্রাই করছে। নানার গুষ্ঠি, দাদার গুষ্ঠি এখন আর আমাদের সাথে ঝা’মেলা করতে আসে না। আব্বা একাই সবাইকে ফেস করতে পারেন। আম্মাও তার ভাইদেরকে কোন প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। আমার মায়ের গোপন স্বপ্ন ছিলো,গোপন কথা ছিল নিজের স্বামীকে সুস্থ দেখা। আমি #মায়ের_কথা শুনেছি। আম্মা-আব্বা শান্তিতে বসবাস করছেন। একদম নবদম্পতি ন্যায় তাদের সুখের সংসার। মায়ের গোপন কথা শুনে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমিও গর্বিত। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হোক। তাদের গোপন কথা শোনার মত কেউ থাকুক। তাহলে শেষ জীবনে এসেও আমার মায়ের মত হয়তো সবাই সুখের দেখা পাবে।
সমাপ্ত।