মায়ের কথা পর্ব-০২

0
117

#মায়ের_কথা
পর্বঃ ২
#সাবাব_খান

একদা আমার মাকে চো’র সাব্যস্ত করেছিলেন বড় মামী। তার জীবনে ঘটেছে বিচিত্র ঘটনা। আমার মামাতো ভাই অনার্সে পড়ে স্থানীয় একটি কলেজে। রকি নাম ভাইয়ের। কোনো ভার্সিটিতে চান্স পায় নি। কিছু খা’রাপ স্বভাবের কারণে ভাইটাকে কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতেও ভর্তি করায় নি। দূরে গিয়ে কখন কি করে বসে ঠিক আছে? খা’রাপ স্বভাব বলতে ইন্টারমিডিয়েট থেকেই নেশা করে ; ম’দ গাঁ’জা খায় আর কি! লাস্ট শীতের এক রাতে নে’শা করে পথ হারিয়ে ফেলে রকি ভাই। ভুলক্রমে ঢুকে পড়ে রাস্তার পাশের এক বাড়িতে। সেই বাড়ির পেছনে মাতাল অবস্থায় বসে ছিলো কিছুক্ষণ। একা একাই আবোল-তাবোল বকছিলো। পাশেই ছিল ঐ বাড়ির ছাগলের খোপ। তাদের শখের দুটো খা’সী ছিলো খোপে। রকি ভাইয়ের কথা শুনে খা’সী দুটোও ব্যা ব্যা,ম্যা ম্যা করে ডাকছিল। মা’তাল ভাইটা ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েন খা’সী দুটোর বিরতিহীন ডাকে। রাগে জোরে জোরে লা’থি দিতে শুরু করেন ওদের খোপে। লা’থির শব্দে খা’সির ব্যা ব্যা,ম্যা ম্যা আরও বেড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। চেহারা না দেখেই চোর ভেবে বাঁশ দিয়ে জোরে বারি মা’রে রকি ভাইয়ের মাথায়। সেখানেই জ্ঞান হারান ভাই। চেহারা দেখে বাড়ির লোকদেরও হুশ হয় এটা বড় মার্কেটের মালিকের ছেলে রকি। তবে মা’তাল ছেলে, নে’শাখোর ছেলে। নে’শার ঘোরে খা’সী চুরি করতে আসতেই পারে। তারা পুরোপুরি ধরেই নিয়েছে রকি ভাই খা’সি চুরি করতেই গেছে। রকি ভাইও এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে কিছু বলতে পারে নি। প্রথমত মা’তাল ছিল। দ্বিতীয়ত সেই রাতে মা’তাল অবস্থায় মাথায় আ’ঘাত পেয়ে ব্রেনে সমস্যা হয়েছে। এখনো মা’তালের মতোই আবোল-তাবোল বকে। অনেক চিকিৎসা হচ্ছে রকি ভাইয়ের। হয়তো ঠিক হবে কোনো একদিন। আমি চাই ঠিক হোক। কিন্তু এখন আমার আব্বার মতই কথা-বার্তায় এলোমেলো,অগোছালো।

বড় মামার ছেলে রকি ভাইয়ের জন্য আমার খা’রাপ লাগে। ভাইটা চোর ছিল না। চুরি করতেও যায় নি। অথচ খা’সী চুরি করতে যাবার দায় কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেমনটা ওর মা আমার মাকে চুরির দায় দিয়েছিল। খা’সির মাংস চুরির দায়। এই কয়েক মাসে রকি ভাইয়ের পিছনে অনেক খরচ হয়েছে। টাকা পয়সার কমতি নেই এখনও। রকি ভাইয়েরা দুই ভাই-বোন শুধু। বোন রাফা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। একমাত্র ছেলের পেছনে টাকা খরচ করতে কি দোষ! তবে আমার কেন যেন মনে হয় এই খা’সি চুরি করতে যাবার অপবাদ আল্লাহর বিচার। আমার আম্মাকে অনেক মানুষের মধ্যে খা’সির মাংস চোর সাব্যস্ত করেছিলো বড় মামী। আরেক কো’রবানির ঈদ আসার আগেই হয়তো আল্লাহ বিচার করেছে। জানি না, আমার ধারণা সত্যি কিনা! আল্লাহই ভালো জানেন।

আপনারা কি ভাবছেন? আমার দাদা বাড়ির লোকজন আমাদেরকে খুব ভালোবাসে? দাদা বাড়ির হিসেবটাও একটু বলি। আমার বাপ-চাচারা চার ভাই। আব্বা সবার বড়। আমাদের বাড়িটা পৌরসভার মধ্যেই তবে এক প্রান্তে। থানা শহরে পায়ে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। সিএনজি কিংবা বাইকে আরও অনেক কম সময় লাগে। দুটো কারখানাও আছে বাড়ির অদূরে। এখানে কয়েক বছর ধরেই বাড়ি ভাড়া দেয়া যাচ্ছে। রাস্তার পাশে দোকান ভাড়াও দেয়া যাচ্ছে। আমার তিন চাচা ঘর করার জন্য জমি নিয়েছে বাড়ির সামনের দিকে,রাস্তার পাশের উঁচু অংশে। আমার আব্বাকে ঘর করার জমি দিয়েছে বাড়ির পেছনের দিকের বাগান এবং নালার ভেতরে, নিচু অংশে। আমরা ঘর করতে গেলেও বালি অথবা মাটি কিনে এনে বাগানের সেই নিচু জমি প্রথমে ভরাট করতে হবে। তারপরে ঘর নির্মাণ করতে হবে। তারা উচু জমিতে ঘর করে অলরেডি ভাড়াও দিচ্ছে। আমাদের কি সাধ্য আছে নিচু জমি ভরাট করে ঘর নির্মাণ করার? যেখানে পেট চালাতেই দায় সেখানে জমি ভরাট করে ঘর করবো কিভাবে? চাচারা রাস্তার পাশে জমি নেয়ায় ওনারা দোকানঘর উঠিয়ে ভাড়া দিচ্ছে। আমাদের জমি তো বাগানে। দোকান তৈরি করারও সুযোগ নেই। দাদার অনেকগুলো পুকুর ছিল। আমাদের ভা’গে পুরো একটা পুকুর পড়েছে। বাড়িতে অনেক বড় ফলের বাগান। সবকিছু এখনো চাচাদেরই হাতে। আব্বার এক্সিডেন্ট হবার আগে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলো। মেজো চাচা দেখতেন বাড়ির জমি-জমা। ঘর তৈরির জমি দেখিয়ে দিলেও আমাদের জমি-জমা এখনো মেজো চাচাই দ্যাখেন। সব সময় একটা কথাই বলে, ‘তোগো এখনো সবকিছু বুইঝা খাওয়ার বয়স হয়নাই।’

আর সবকিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আসে আমার আব্বার কাছে। আব্বা তো অসুস্থ। মানসিক ভারসাম্যহীন। সে তো ভালো-মন্দ কিছু বোঝেনা। আমার দাদী আর মেজো চাচা যা বুঝায় আব্বাকে; সেটা বুঝেই দায়িত্ব মেজো চাচাকেই দিয়ে দেয়। আব্বা অসুস্থ হবার পরে আমরা যৌথ পরিবার থেকে বের হয়ে যাই। আব্বার ইনকাম ছিলো না বলে তিন চাচী তখন আম্মাকে কাজের লোকের মতো খাটাতো। আব্বার যত্ন করারও সময় পেতেন না আম্মা। তারপর আমরা হাড়ি আলাদা করি। চেয়ারম্যান,মেম্বার আর আমার নানা বাড়ির লোকদের ডেকে আনেন আম্মা। চাচাদেরকে অনুরোধ করেন আব্বার ভা’গের জমিটুকু বুঝিয়ে দেবার জন্য যেন আমরা নিজেদের মতো করে চলতে পারি। তখন মেজো চাচা ব’দনাম ছড়িয়ে দেন আম্মার চরিত্রের নামে। আম্মার নাকি চরিত্র খা’রাপ। জমি ভা’গ করে দিলেই আব্বাকে বোকা বানিয়ে সব নিয়ে চলে যাবে। মামারা এই আম্মার নামে দেয়া এই অপবাদের প্রতিবাদ করেছিলেন প্রথমে। কিন্তু বড় মামা হুট করেই মেজো চাচার কথা বিশ্বাস করেন। আসলে আমার বড় মামী বুদ্ধি দিয়েছিলেন। বড় মামী আর মেজো চাচী আপন দুই বোন। বউ, শা’লী আর ভায়রার বুদ্ধিতে বড় মামাও আম্মার বিরুদ্ধে চলে যান। আমার দাদীও ওদের কথাই বিশ্বাস করেন। তখন আর আব্বার ভা’গের জমি বুঝিয়ে দেয়া হয় নি। একজন নারী যখন বিপদে পড়ে তখন তাকে শোষণ করার জন্য প্রথমেই চরিত্রের ব’দনাম দেয়া হয়। আমার মায়ের বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। তাছাড়া আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন বাপের বাড়ি,শ্বশুর বাড়ি দুটোই একরকম থাকবে। পারলে দুই গ্রুপ এক হয়ে যাবে আপনাকে শাসানোর জন্য। এখনো আমাদের সম্পত্তি মেজো চাচার হাতে। উনি যা হাতে দেন তাই মাথা পেতে নিতে হয়।

আমি ভাবছি আমার আম্মার কথা। একটা মহিলার স্বামী যখন অসুস্থ থাকে তখন তার পাশে কেউ থাকেনা। আপনার মনে হবে বাপের বাড়ির মানুষগুলো এত অপমান করে, তারপরেও আম্মা কেন তাদের কাছে ছুটে যায়? আসলে কি আমার দাদা বাড়ি থেকে আমাদেরকে পুরোপুরি বের করে দিতো। তাই আম্মা অনেক অ’পমান,লা’ঞ্চনার পরেও ভাইদের সাথে একটু সম্পর্ক রাখে। হয়তো মেজো চাচা আব্বার সম্পত্তি নিজ দায়িত্বে রেখেছেন কিন্তু আমরা তো দাদাবাড়িতেই আছি। নানা বাড়ির সাপোর্ট না থাকলে আমাদেরকে দাদাবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হতো। আমার মামাদের কথা কি বলবো? জানিনা কতদূর ভালবাসে আম্মাকে? নানা বাড়িতে যখন কোনো প্রোগ্রাম হয় তখন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। দায় এড়াতে আমাদেরকেও দাওয়াত দেয়। আমরা যাই না প্রথমে। আম্মা দৌড়ে দৌড়ে যান। সকল কাজ করেন। অনুষ্ঠান শেষের দিকে অথবা খাওয়ার আগে বিশাল একটা ত্রুটি বের হয় অনুষ্ঠানের। সব দায় এসে পড়ে আমার আম্মার মাথায়। বহুবার ঘটেছে এমন। সারাদিন নানা বাড়িতে বসে খেটে-খুটে বাপের বাড়ির প্রোগ্রাম তুলে দেন আম্মা। সে আম্মারই দোষ হয় সব। কেন যেন মনে হয় যেসব মহিলাদের শ্বশুরবাড়ি আর বাপেরবড়ি পাশাপাশি তাদের দোষ একটু বেশি। দোষ না করলেও দোষ। মাঝে মাঝে মনে হয় আম্মার লজ্জা কম। কিন্তু পরে আবার মনে হয় আপনজনের মুখ দেখে আম্মা সব ভুলে যান। আসতে-যেতে দেখা হয় তো বাপের ফ্যামিলির লোকের সাথে! র’ক্তের লোকদের চেহারা দেখে হয়তো সব ভুলে যান আম্মা। আমার মা,খালাদের মধ্যে আম্মাই বড়। বড় মামা সবার বড়, ভাই-বোন সবার মধ্যে। তারপরেই এই আম্মা। ছোট ভাই-বোনদের প্রতি আম্মার কি টান! একটু ঊনিশ-বিশ হলেই দৌড়ে যান। কখনো কখনো এমনও মনে হয় ; আম্মা মাফ করে দেন ছোট ভাই-বোনকে। আমার নানা,নানী জীবিত নেই। নানাবাড়িতে আম্মাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালায় বড় মামি। আম্মার বড় ভাইয়ের বউ। আর অন্যরা তার সাথে সায় দেয়, তালি বাজায়। অনেক অনুরোধ করেও আম্মাকে ফেরাতে পারি না নানা বাড়ির দিক থেকে।

আমার পরিচয়টাই তো দেয়া হয়নি। আমার নাম সাবাব খান। গত কো’রবানির ঈদের সময় বলেছিলাম না ভার্সিটি কোচিং করছি! আমি একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি অলরেডি। ভালো কোন ভার্সিটি নয়। দেশের অনেক জেলাতেই ভার্সিটি হয়েছে। আমাদের জেলায়ও একটা ভার্সিটি আছে। ওখানেই চান্স পেয়েছি। তবে সাবজেক্টটা ভালো, ইংরেজি। টিউশনি করেই নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করি। আমার ছোট দুই বোন; সারা আর স্নিগ্ধা। আমরা তিন ভাই-বোন আর বাবা-মা নিয়ে আমাদের পরিবার। চাচাদের কয়েকটি বিল্ডিংয়ের পেছনে একটি কাঠের ঘরে আমাদের বসবাস।
…………

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। আমার অনার্সও শেষ। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। আমি মেজো চাচার কাছ থেকে আমাদের ভা’গের জমি আদায় করে নিয়েছি। বলেছি আমাদের জমি আমাদেরকে বুঝিয়ে না দিলে মা’মলা দেবো। অতঃপর মা’মলার ভয়ে ভা’গের জমি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। অনার্সের প্রথম বছর টিউশনি করে পড়েছিলাম। বুঝলাম এভাবে জীবনযু’দ্ধ করার কোন মানে হয় না। তখনই মেজো চাচার উপর চড়াও হয়েছি। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সব জমি বুঝে নিয়েছি। ইদানিং তিন চাচা নিত্য এসে ঝ’গড়া করেন। এদিক দিয়ে কম হয়ে গেছে, ঐদিক দিয়ে বেশি হয়ে গেছে। আমি বাড়ি থেকেই ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করেছি। বছর দু্য়েক আগে আমি আর মা বুদ্ধি করে আমাদের ভা’গের পুকুরটায় মাছ চাষ শুরু করি। রাত-দিন কাজ করি আমরা। ছোট বোন দুইটাও আমাদের সাথে খেটেছে ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদে। মায়ের সোনার চেইন বিক্রি করে সেই টাকায় মাছের খাবার যোগাড় করেছিলাম। আস্তে আস্তে মাছগুলো বড় হয়। এবার আসে বিক্রির পালা। মাছের আড়তদারদের সাথে কথা হয়, সকালে মাছ বিক্রি করব। আগের রাতে জেলে খবর দিয়ে রাখি পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকালে উঠে দেখি পুকুরের সব মাছ ম’রে ভেসে উঠেছে। আসলে রাতের আঁধারে কেউ বি’ষ দিয়েছে আমাদের পুকুরে। এসব কে করেছে বোঝেন? আমার মেজো চাচার পরিবার। এতদিন ভো’গ করেছে তো পুকুরটা! যখন আমরা আমাদের হাতে নিয়ে এলাম তখন তাদের দুঃখ লেগেছে! ক্ষতি করে দিল আমাদের। অথচ রাত-দিন কষ্ট করেছি আমরা। কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল! সব এক নিমিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

আমি কারো ক্ষতি করলাম না। কারণ আমার বোন দুইটাও বড় হয়েছে। কে আবার ওদের ক্ষতি করে দেয়! আমি এক নতুন সিদ্ধান্ত নিলাম! সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলেই ভিতর থেকে নতুন কাজ করব। শুরু হলো আমার নতুন চিন্তা। এখন তো অনার্সও পাশ করেছি।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে