কুরবানী ঈদ আমি সাধারণত দেশে করার চেষ্টা করি। দেশে আমার পৈতৃক বাড়ির নীচের দুইতলা জুড়ে একটা এতিমখানা রয়েছে। এতিমখানা করাটা আমার দাদার একটা স্বপ্ন ছিল। তার জীবদ্দশায় করে যেতে পারেননি। বাবা নিজ হাতে এটার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে আমিই এর ভার তুলে নেই। ঈদের দিন দুপুরের খাওয়া শেষে যখন সবগুলো বাচ্চা আমাকে ঘিরে বসে তখন আমি ওদের আমার ছেলেবেলার গল্প বলি, এই এতিমখানা শুরুর গল্প বলি। তবে প্রতি বছরই সব গল্পের সাথে ওদের অনুরোধে একটা গল্প অবশ্যই বলতে হয়। তা হলো আমার মানুষ চেনার গল্প।
আমার বাবা যখন এই এতিমখানা প্রথম শুরু করেন তখন আমার বয়স দশ বছর। সে বছর এটার স্থাপনার পেছনে এতো টাকা খরচ হয়ে যায় যে আমাদের কুরবানীর জন্য গরু কেনা বাবার জন্য সম্ভব হয়না। বাবা দুটো ছোট ছোট ছাগল কিনে আনেন। আমার যে কি ভীষণ মন খারাপ হয় কি বলবো? বন্ধুদের বাবারা সবাই গরু ছাগল দুটোই কুরবানী দিচ্ছে আর আমরা কিনা দুটো বাচ্চা ছাগল? সদ্য একটু একটু বড় হওয়া এই আমার পুরো ইজ্জত যায় যায় অবস্থা আর কি।
ছোট দুটো ছাগল কেটে দিতে খুব বেশী সময় নেয়না যারা মাংস কাটে তারা। মা একা হাতে এতিমখানার দশজন বাচ্চা, তাদের শিক্ষক, আরো যারা আছে তাদের সহ আমাদের সবার জন্য রান্না করতে থাকেন। ওপর থেকে সবার গরু দেখে আমার খুব মন খারাপ দেখে বাবা বলেন, চল তোকে নিয়ে একটা মজার খেলা খেলি। আমার মা বাবা দুজনেই একটু অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। আমাকে কখনোই ছোট বলে কোন কথা বা কোন কিছু চেপে যেতেন না। মা ও বাবার সব ব্যাপারে বেশ প্রশ্রয় দিতেন।বাসার ওয়ারড্রোব থেকে বেছেবুছে দুটো পুরনো গেঞ্জি আর লুঙ্গি নিয়ে আমায় নিয়ে বেরিয়ে পরেন বাবা।
বাবার সাথে থাকলে মজা হবে, এমনকি পাড়ার বন্ধুদের মুখোমুখি হতে হবেনা এই আশাতে আমিও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরি। রিকশা করে অনেকটা পথ যেতে যেতে বাবা জানান, আমরা নাকী মাংস কুড়াতে যাচ্ছি। মানে ঐ গরীব মানুষদের মতো। আমার কাছে খেলাটা খুবই মজার মনে হলো।
– শোন রাতুল, আমরা মোট তিনটে বাসায় যাব মাংস খুঁজতে। যে বাসায় অনেক লম্বা লাইন অর্থাৎ বড় গরু, যে বাসায় মাঝারী লাইন অর্থাৎ ছোট গরু আর যে বাসায় কোন লাইন নেই।
যে বাসায় লাইন নেই ওখানে গিয়ে কি লাভ? ওরা নিশ্চয়ই গরু জবাই দেয়নি। তাই লাইনও নেই।
– আচ্ছা চলতো যাই। দেখি বাপ বেটার ভাগ্যে কি আছে?
প্রথম বাড়িতে লাইনে দাঁড়িয়ে আমি হতাশ হয়ে যাই। এতো লম্বা লাইন পেরিয়ে আদৌ কোনদিন আমি মাংস পাব বলেই আমার মনে হয়না। দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত আমার যখন প্রায় ঘুম চলে এসেছে তখন আমার মাংস পাওয়ার সময় হয়। এক টুকরো মাংস, একটা হাড়, এক টুকরো চর্বি। বাবার ভাগ্যেও তাই জোটে।
দ্বিতীয় বাড়িতে কোন লাইনে দাঁড়াতে হয়নি তবে হুড়োহুড়ি করে মাংস নিতে হয়েছে। অবশ্যই আগের বাসার চেয়ে একটু বেশীই পেয়েছি ভাগে এইবার।
আর তৃতীয় বাড়িতে অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর এক মহিলা দরজা খুলে চাওয়ার আগেই দু টুকরো মাংস বাড়িয়ে দেয় আমাদের দুজনের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ হতে হতে আমি শুনতে পাই পেছনে আমার বয়সী এক ছেলে বলছে, আমাদের নিজেদেরই মাংস নাই ফকিররে মাংস দেন আপনে। জবাবে মহিলাটি বলে, বাবা ভাগ করে খেলে দোষের কিছু নেই। আমাকে তো তাও কেউ এসে ঘরে মাংস দিয়ে গেছে, ওদের মতো করে তো রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মাংস খুঁজতে হয়নি।
বাড়ি ফেরার পথে বাবা জানতে চাইলেন, কেমন লাগলো খেলা?
– জীবন অনেক কঠিন, তাইনা বাবা?
এই যে তিন পদের মানুষ দেখলি, প্রথম যারা তাদেরকে তুই ভাবতে পারিস কৃপণ। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে যদি দেখিস, এতোগুলো মানুষ লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে দিতে হলেতো কম কমই দিতে হবে। তবে চাইলেই কিন্তু তারা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে পারতো। এরা হচ্ছে উচ্চবিত্ত শ্রেনী।
দ্বিতীয় যারা তাদেরকে আমরা বলি মধ্যবিত্ত। কম মাংস দিলে যদি মাংস খুঁজতে আসা মানুষগুলো ফকির বলে তাই একটু বাড়িয়ে দিতে যেয়ে নিজের ভাগেও অনেক সময় তাদের কম পরে যায়। কিন্তু মনের দোটানায় ভোগা এরা কখনোই সেটা সামলে উঠতে পারেনা বলেই ওখানে এতো লোকের হুড়োহুড়ি।
আর যারা তৃতীয় ছিল তারা বিত্তের দিক দিয়ে নিচু হলেও মনের দিক থেকে কিন্তু উঁচু শ্রেনীর। অথচ দেখ তুই কিন্তু ওরকম কোন বাড়িতে যেতেই চাসনি।
এখন আবার ভেবে বসিস না বড়লোক হলেই খারাপ কিংবা গরীব হলেই সবসময় ভালো। এই যে মানুষগুলোকে দেখলি এদের মতোই লোকগুলোকে সাথে নিয়ে তোর রোজদিন কাটবে। কখনো এক দেখাতেই কাউকে বিচার করে ফেলবি না। আমার নেই তাই অন্যকে দেবোনা এরকম যেমন কখনো ভাববি না আবার আমার অনেক আছে শুধু আমিই ভোগ করবো এরকমও কখনো ভাববি না। কুরবানী ঈদ আমাদের আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। এই আত্মত্যাগ মানে কি জানিস? নিজের মনের কলুষতা দূর করে অন্যকে ভালবাসতে শেখা। আমি দোয়া করি সৃষ্টিকর্তা যেন তোর হাতের সামর্থ্য দেয় প্রথম পরিবারটার মত আর মনের সামর্থ্য দেয় শেষের পরিবারটার মতো।
গল্প শেষ করে প্রতিবারই আমি এতিমখানার শিশুগুলোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি আর সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া জানাই আমার বাবার আমার জন্য করা দোয়াটুকু কবুল করে নেয়ার জন্য।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস