মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৯

0
2

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
এই পর্যন্ত প্রভাত অনেকবার মৃন্ময়ীকে সুন্দর কিছু উপহার দিবে ভেবে-ও দেওয়া হয়নি। সে জানে মৃন্ময়ী নিবে না। একবার অনলাইনে একটা শাড়ি প্রভাতের খুব পছন্দ হয়েছিল। তার ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল মৃন্ময়ীকে যদি এই শাড়িতে দেখতে পারত। মনের ইচ্ছা পূরণের আশায় শাড়ি বিক্রির পেইজ থেকে সে মৃন্ময়ীকে শাড়ি উপহার পাওয়ার বার্তা পাঠিয়েছিল। মৃন্ময়ী তার নাম শুনেই বারণ করে দিয়েছে। এরপর সে নিজে মৃন্ময়ীকে খুব অনুরোধ করেছিল যেন সে শাড়িটা নেয়। কিন্তু মৃন্ময়ী কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখে। অনেকদিন পর এবার আবার তার মনের চাপা ইচ্ছাটা হুট করেই জেগে উঠেছে। তা-ও তার বন্ধুর বউয়ের ফেসবুক পোস্ট দেখে। বন্ধু তার বউকে দারুণ একটা গহনার সেট গিফট করেছে। সেসব নিয়ে তার বউ ভীষণ খুশি হয়ে স্বামীকে ট্যাগ করে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। স্বামীকে নিয়ে খুব আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছে সে। সেই পোস্ট চোখে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রভাতের মন আঁকুপাঁকু করছিল। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার এমন সুন্দর মুহূর্ত কবে আসবে জানে না সে। তবু তার ভীষণ ইচ্ছা এমন কিছু মুহূর্ত তার জীবনে-ও আসুক। মৃন্ময়ী-ও তার ভালোবাসায় মুড়ানো উপহার সানন্দে গ্রহণ করুক। ভীষণ আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ না করুক, অন্তত সে উপহার পেয়ে একটুখানি হাসুক। এর বেশি কিছু প্রভাত আশা করে না। মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে প্রভাত সেই গহনার সেট কিনেছে। আজ সেটা মৃন্ময়ীকে দেওয়ার জন্য নিয়ে-ও এসেছে। অধীর আগ্রহে সে মৃন্ময়ীর কোচিং থেকে বেরোনোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরোতেই সে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মৃন্ময়ী তাকে পাশ কা’টাতে গিয়েও আবার ফিরে তাকাল। সূক্ষ্ম চোখে প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুমি কি অসুস্থ?”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“নাহ্। আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল। মাথাটা একটু ধরেছে।”
“একটু ধরেছে? তোমার চোখ-মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে জ্বর-টর এসে গেছে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি আমার জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছো?”
মৃন্ময়ী হাঁটা দিয়ে বলল,
“কে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে? আমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? অসুস্থ মনে হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করেছি।”
প্রভাত তার পিছু নিয়ে বলল,
“আহা! লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমার জ্বর আসছে মনে হলে তুমি কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমার স্বাস্থ্যের জন্য তুমি ছাড়া আর কে দুশ্চিন্তা করবে বলো?”
মৃন্ময়ী বিড়বিড় করে বলল,
“আমার বয়ে গেছে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে।”
প্রভাত মিটমিট করে হাসছে। আজ অফিস শেষ হওয়ার আগে থেকেই মাথাটা ব্যথা করছে। সে টের পাচ্ছে চোখ দুটো একটু জ্বলছে। জ্বর এলেও আসতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে সে অসুস্থতা নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। এসব ছোটোখাটো অসুস্থতা সয়ে নেওয়ার অভ্যাস তার খুব আছে। প্রভাত বলল,
“আহা! নিজের মানুষকে নিয়ে সবাই-ই একটু-আধটু চিন্তা করে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার। এতে লজ্জার কিছু নেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“চুপ থাকো তো।”
“আচ্ছা, চুপ করলাম। এবার এটা নাও তো,” গহনার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল,
“এটা কী?”
“নিয়ে দেখো।”
“না জেনে কী নিব?”
“যা-ই‌ হোক, তোমার জন্যই আনা। নাও।”
“লাগবে না আমার।”
“না দেখেই বলছো লাগবে না?”
“তো বলছো না কেন?”
“আগে নাও, নিজেই খুলে দেখতে পাবে,” প্যাকেটটা মৃন্ময়ীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“আমি তোমাকে আমার জন্য কিছু আনতে বারণ করেছিলাম না?”
“সে তো আমার সব কাজেই তোমার বারণ। একবার অন্তত বারণ ভাঙতে দাও।”
“না-না, ফেরত নাও এটা। আমার কিছু চাই না।”
“তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে এটা দিতে চাই। কারণ এটা শুধু এবং শুধুমাত্রই তোমার জন্য আনা।”

মৃন্ময়ী কিছুতেই প্রভাতের দেওয়া জিনিস নিবে না। প্রভাত-ও ফেরত নিতে নারাজ। মৃন্ময়ী পড়ে গেল বিপাকে। প্রভাতের জোরাজুরিতে শেষমেশ সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই প্যাকেট খুলল ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। গহনাগুলো এত দারুণ যে মেয়েরা দেখলে তাদের পছন্দ হবেই। অথচ মৃন্ময়ীর মুখের অভিব্যক্তি প্রভাত বুঝতে পারল না। অবশ্য সে জানে তার দেওয়া উপহারে মৃন্ময়ীর আনন্দ দেখার আশা রাখা-ও তার জন্য একপ্রকার বোকামি। এই মেয়ে কখনোই মনের অনুভূতি প্রকাশ করবে না, আনন্দিত হলেও না। তবু প্রভাত ভীষণ উৎসুক হয়ে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী গহনাগুলো হাতে নিয়ে দেখল। এসবের দাম মোটেও কম নয়। অন্তত তার হাতের নাগালের দাম তো নয়-ই। মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আমি তোমার এই উপহার নিতে পারব না প্রভাত। এসব তুমি ফিরিয়ে নাও।”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাতে প্যাকেটটা ফেরত দিতে চাইল। কিন্তু প্রভাত তার দুহাত পেছনে লুকিয়ে ফেলল। শুধাল,
“কেন নিতে পারবে না? আমি দিয়েছি বলে?”
“হ্যাঁ, ধরে নাও তা-ই।”
“মৃন্ময়ী, আমি এটা অনেক শখ করে তোমার জন্য কিনেছি।”
“কেন কিনেছ? আমি তো বলিনি আমার এসব চাই।”
“আমার মনে হয়েছে এটাতে তোমাকে খুব মানাবে, তাই কিনেছি।”
“তুমি ভুল করেছ। দেখো, আমি তোমার এমন কেউ নই যে, কোনো জিনিস দেখলেই তুই চট করে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে, আর আমিও খুশিমনে তা নিয়ে নিব। তুমি বলতে পারো আমি এসব কেন নিব?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এভাবে আপত্তি কোরো না প্লিজ। তুমি বারণ করার পর থেকে আমি যখন-তখন তোমার জন্য কিছু কিনেছি, বলো? কিনিনি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার আপত্তির কথা ভেবে কিছু কিনিনি। কিন্তু এবার আমি তোমাকে এটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না, তাই কিনেছি। এটা গ্রহণ করো প্লিজ। এরপর আর কিছু কিনব না, দেখো। শুধু এটা ফিরিয়ে দিয়ো না। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
মৃন্ময়ী নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল,
“আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে যা উপহার দিয়েছ, আমি নিয়েছি। তোমার খারাপ লাগবে ভেবে ফিরিয়ে দিইনি। তাই বলে তো তোমার অনুরোধ আমি সবসময় রাখতে পারি না প্রভাত। তুমিই বলো আমি তোমার টাকায় কেনা জিনিস কেন নিব? তুমিই বা কেন আমার পেছনে টাকা খরচ করবে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। কত টাকা খরচ করেছি, এটা না দেখে ভালোবাসাটা দেখো।”
“এটা তো আরও বড়ো সমস্যা। আমি যা দেখতে চাই না, তুমি আমাকে তা-ই দেখাতে চাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না। আমাদের সম্পর্কটা-ও একদমই তেমন না।”
“আমি কিছু জানি না। আমি তোমার জন্য এটা এনেছি মানে এটা তোমাকেই নিতে হবে।”
“সবসময় সবকিছুতে জেদ চলে না প্রভাত। এইটুকু বুঝতে শেখো। আমি এসব কোনোভাবেই নিব না। তোমার অনুরোধ-ও আজ আমি রাখব না। প্লিজ তুমি এটা ফিরিয়ে নাও, ধরো।”

প্রভাত কিছুতেই হাত সামনে আনতে চাইল না। মৃন্ময়ী তার একহাত টেনে নিয়ে প্যাকেটটা জোর করে ফেরত দিয়েই ছাড়ল। প্রভাতের কোনো অনুরোধ-ই কাজে আসবে না বুঝতে পেরে সে অন্ধকার মুখে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এটা নিবেই না?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“না।”
“সিরিয়াসলি বলছো?”
“অবশ্যই।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তুমি না নিলে আমি কিন্তু অন্য কাউকে এটা দিবো না। শেষবারের মতো ভেবে দেখো।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই। তুমি আর কখনও আমার জন্য কিছু কিনবে না, এটাই শেষ কথা।”
“আচ্ছা।”
সম্মতি জানিয়েই প্রভাত ডানে-বায়ে না তাকিয়ে, কোনোরকম দ্বিধা না করে প্যাকেটটা ছুঁড়ে মা’রল। প্যাকেটটা সোজা গিয়ে টুপ করে পড়ল রাস্তার ধারের দিঘির জলে। মৃন্ময়ী খনিকের জন্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত এমন কাণ্ড করবে ভাবেনি সে। সচরাচর প্রভাত তার সঙ্গে রাগ দেখায় না। বাইরের মানুষের মুখে শোনা যায় প্রভাত যেমন বেপরোয়া, তেমনি রাগী। কিন্তু মৃন্ময়ী তার আচরণে এখনও তেমন কিছুই দেখেনি। মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলে উঠল,
“এটা কী করলে তুমি?”
“কাজে লাগবে না, তাই ফেলে দিলাম।”
“কেন ফেললে? আমি নিব না বলেই তুমি কেনা জিনিস এভাবে ফেলে দিবে?”
“অনলাইন থেকে কিনেছি। ফেরত নিবে না। ঘরে তো আমার বউ নেই যে ব্যবহার করবে। ফেলে রেখে কী হবে?”
“তো তুমি পানিতে কেন ফেললে? কেউ নেই বলেই তুমি টাকায় কেনা জিনিস ফেলে দিবে? আজব!”
“অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখার জায়গা নেই আমার ঘরে। বাদ দাও। চলো, তোমার দেরী হচ্ছে।”
“আরে! এটা কেমন কথা? এত জেদি হলে এসব কাজ করো কেন? আশ্চর্য!”

রোজ প্রভাত মৃন্ময়ীর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটে। আজ প্রভাত তার আগেই হাঁটা দিয়েছে। মৃন্ময়ী হা-হুতাশ করতে-করতে তার পেছনে হাঁটছে। অথচ প্রভাত এমন ভাব করছে যেন টাকায় কেনা জিনিস হারিয়ে তার একটুও খারাপ লাগছে না। সে কেবল একবার বলল,
“আফসোস বন্ধ করো। আমি তোমার সাথে রাগ করতে চাই না।”
“তোমার খারাপ লাগছে না?”
“না। পাথরের পেছনে ঘুরে-ঘুরে আমিও পাথর হয়ে গেছি। এখন আর কিছুতেই খারাপ লাগে না। আমি জানি অপেক্ষা ছাড়া আমার জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ।”
আজ রাতের জন্য প্রভাতের এই কথাটা মৃন্ময়ীর মনে গেঁথে গেল। বাসায় ফিরেও সে এই কথাটা ভুলতে পারল না। প্রভাতের ভীষণ স্বাভাবিক অথচ অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখটা-ও সে মন থেকে সরাতে পারল না। মৃন্ময়ী ভেবে পায় না এমন বেপরোয়া একটা ছেলে এত ধৈর্য কীভাবে রাখে। এ তো তার চেয়েও বেশি ধৈর্যশীল। মৃন্ময়ী একবার ভাবল জিনিসটা নিলে আর সেটা এভাবে জলে যেত না। আবার ভাবল সে কেন নিবে? সে তো এসব করতে সবসময়ই বারণ করে। প্রভাত নিজেই তার বারণ শোনে না।


এই নিয়ে জাহিদ দশবার মৃদুলাকে কল করেছে। আগামীকাল মৃদুলার ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজি পড়তে-পড়তে তার মাথার খুলি খুলে পড়ার অবস্থা। ইচ্ছা করেই মৃদুলা মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে রেখেছে। জাহিদের বদঅভ্যাস তার জানা আছে। বারণ করলেও এই ছেলে শখানেক ফোন করবে। তারপর আবার নিজেই মেয়েদের মতো অভিমান করবে। গাল ফুলিয়ে বলবে, ‘এই তোমার ভালোবাসা?’ এমনই এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিক ছুটেছে তার কপালে। পড়ার মাঝে মৃদুলা কিছু সময়ের বিরতিতে ফোনটা হাতে নিতেই তার অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিকের বিশটা কল দেখতে পেল। পরপরই আবার কল এলে মৃদুলা রিসিভ করল। জাহিদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
“এতগুলো কল করলাম, পাত্তাই দিলে না।”
মৃদুলা বলল,
“আপনাকে না আমার পড়ার সময় কল করতে বারণ করেছি? তবু করেছেন কেন? আবার বলছেন আমি পাত্তা দিইনি?”
“কী করব বলো? তুমি কল দিতে বারণ করলে তো আমি সেদিন তোমাকে আরও বেশি-বেশি মিস করি। তাই কল না করে থাকতে পারি না। তুমি তো আর আমাকে মিস করো না, তাই তোমার কষ্ট-ও হয় না আমাকে ছাড়া।”
“কাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা। আপনার আজাইরা আলাপ শোনার সময় নেই।”
“দেখেছ, বলেছি না তুমি আমাকে একটুও মিস করো না?”
“আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আপাতত আমি আপনাকে মিস করছি না। কারণ আপনাকে মিস করলে আমার কোনো কাজে আসবে না। আমি মিস করছি আমার ইংলিশ টিচারকে।”
জাহিদ অভিমানী সুরে বলল,
“তুমি আমাকে মিস করো না মেনে নিয়েছি। তাই বলে তুমি অন্য এক পুরুষকে মিস করবে? তুমি না বলো তুমি আমাকে ভালবাসো? এই তোমার ভালোবাসা মৃদুলা?”
“হ্যাঁ, আমার ভালোবাসা একটু অদ্ভুত। কারণ আমার যে একজন পুরুষ আছে, সে তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত। এখন ফোন রাখুন। আমার অনেক পড়া বাকি।”
“শোনো না একটু।”
“বলুন।”
“আই লাভ ইউ।”
“আচ্ছা।”
মৃদুলার সঠিক উত্তর না পেয়ে জাহিদ পুনরায় বলল,
“আই মিস ইউ।”
“আচ্ছা।”
“তুমি আমাকে মিস করছো না?”
“না।”
“ঠিক আছে, তুমি তোমার ইংলিশ টিচারকেই মিস করো। তোমার ইংলিশ টিচারের মাথায় খুব দ্রুতই টাক হবে, দেখো। তখন টাকমাথা লোককে তুমি মিস করো কি না দেখব।”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,
“কিন্তু আমার ইংলিশ টিচার তো অলরেডি টাকমাথা।”
জাহিদ ব্যথিত গলায় বলল,
“তুমি আমাকে এভাবে ছ্যাঁকা দিতে পারো না জান।”
“হয়েছে, এখন আপনার নাটক বন্ধ করুন। আমি পরীক্ষায় ফেল করলে কিন্তু সব দোষ আপনার।”
“তুমি ফেল করলে তো বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে ফেলতাম। কিন্তু তুমি তো ফেল করা পাবলিক-ই না।”
মৃদুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি মনে-মনে চান আমি যেন ফেল করি?”
“আরে নাহ্! আমি তোমার খারাপ চাইতে পারি? পড়া শেষ করে কিন্তু আমাকে অবশ্যই নক করবে।”
“আচ্ছা, এখন রাখছি।”
জাহিদ বলে উঠল,
“আরেকটা কথা শোনো।”
“আবার কী?”
“তোমার আপার সাথে কি প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? কিছু জানো?”
“না তো। কেন, কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে তা তো আমিও ঠিক জানি না। প্রভাত ভাইয়ের খুব মন খারাপ দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, তা-ও কিছু বলল না। আড্ডা দিতে-ও রাজি হলো না, বাড়ি চলে গেল। আমার মনে হলো যে তোমার আপার সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ও, আচ্ছা আমি আপার সাথে কথা বলে দেখব।”
“আরে, তোমার জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমার ধারণা তো ভুল-ও হতে পারে।”
“আমি আপনার মতো গাধা না কি এসব কথা আপাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করব?”
“তাহলে?”
“ওসব আপনি বুঝবেন না। রাখছি, পরে কথা হবে।”

ফোন রেখে পুনরায় পড়তে বসে-ও মৃদুলার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সত্যিই কি আপার সাথে প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? প্রভাত ভাইয়ের মন খারাপ হলে আপার মন কেমন? একবার তো গিয়ে দেখতে হয়। বই-খাতা বন্ধ করে রেখে মৃদুলা চলল আপার কাছে। মৃন্ময়ী বিছানা ঠিক করছিল ঘুমানোর জন্য। মৃদুলা তার ঘরে উঁকি মে’রে মুখোভাব দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সে মৃন্ময়ীর চোখে পড়ে গেল। মৃন্ময়ী জিজ্ঞেস করল,
“কী-রে মৃদুলা? পড়া রেখে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এমনিতেই এসেছি। তুমি কী করছো?”
“ঘুমাব, তোর পড়া শেষ?”
“না, এখনও বাকি আছে। একটানা পড়ে মাথা ধরে গেছে, তাই হাঁটছি।”
“চা খাবি?”
“চা দুবার খেয়ে ফেলেছি। এতবার চা খেতে ভালো লাগে না।”
“ভেতরে আয়।”
“না, চলে যাচ্ছি। তোমার মন খারাপ কেন আপা?”
মৃন্ময়ী যেন চমকে উঠল। মৃদুলা কীভাবে বুঝল তার মন খারাপ? ধরা না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল,
“কে বলল আমার মন খারাপ?”
“তুমি কথা বলার সময় আমার মনে হলো তোমার মনটা একটু খারাপ। কী হয়েছে আপা?”
“আরে না, আমার মন ঠিক আছে।”
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে উত্তম সমাধান দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোর পাকামি করতে হবে না। আমার মন ভালো আছে। তুই পড়তে যা।”
“ঠিক আছে। তুমি বলতে না চাইলে বোলো না। তবে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে মন খারাপ না করে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি চললাম।”

মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ী বড়ো একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মাঝে-মাঝে তার মনে হয় মৃদুলা তার মন পড়তে জানে। এই মেয়েটার সামনে মনোভাব লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। প্রভাতের কথাটা আবারও তার মনে পড়ে গেল। এই ছেলেটা কবে তাকে শান্তি দিবে? কী করবে সে একে নিয়ে? তার দৈনন্দিন জীবনে এমনিতেই সমস্যার শেষ নেই। উঠতে-বসতে তাকে যুদ্ধ করে চলতে হয়। তার সঙ্গে জুটল প্রভাতের জেদ। মৃন্ময়ী না পারে যাকে ফেলতে, না পারে গিলতে। কাঁটার মতো গলায় বিঁধে থেকে আরও যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে। কিসের আশায় অপেক্ষা করছে প্রভাত? এই অপেক্ষার সুফল তাকে কীভাবে দিবে মৃন্ময়ী? সংসার জীবনে পা রাখার সাহস কি মৃন্ময়ীর আদৌ হবে? পৃথিবীটা এত জটিল কেন তার জন্য?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে