মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৫

0
86

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৫.
ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃন্ময়ী প্রভাতের দেওয়া গিফট বক্স খুলল। বক্সের ভেতর পেল দুমুঠো কাঁচের চুড়ি আর অনেকগুলো চিরকুট। গুনে দেখল সর্বমোট ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ীর ছাব্বিশ তম জন্মদিন উপলক্ষে ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ী পড়ে দেখল সবকটা চিরকুটে একবার হলেও ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উল্লেখ আছে। এই শব্দ বাদ রেখে প্রভাত একটা চিরকুট-ও লেখেনি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই প্রভাত খুব যত্ন সহকারে লিখেছে। কারণ একটা চিরকুটে-ও কোনো কা’টাছেঁড়া নেই, ভুল বানান নেই, আঁকাবাঁকা অক্ষর নেই। হাতের লেখা-ও গোছানো। সবমিলিয়ে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই সুন্দর। কিন্তু চিরকুটগুলো পড়তে-পড়তে খুশি হওয়ার বদলে মৃন্ময়ীর আরও মন খারাপ হলো। নিজের পালিয়ে চলা মনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। একবার মনে হলো প্রভাতের প্রতি সে একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেছে, আবার মনে হলো এছাড়া তার আর উপায় নেই। চিরকুটে প্রভাত অনেক কথা লিখেছে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার প্রথমদিকের অনুভূতি থেকে শুরু করে বর্তমান অনুভূতি নিয়েও লিখেছে। বুঝাই যাচ্ছে তার অনুভূতির গভীরতা মৃন্ময়ীর ভাবনার বাইরে। একরাশ হতাশা নিয়ে মৃন্ময়ী চুড়ি আর চিরকুটগুলো আলমারিতে তুলে রাখল। ফোনের ডাটা অন করার সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাতের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন এল। প্রভাত জানতে চেয়েছে উপহার পছন্দ হয়েছে কি না। মৃন্ময়ী সেই ম্যাসেজের উত্তর ভেবে পেল না। ফেসবুকে ঢুকতেই প্রভাতের পোস্ট সামনে পড়ল। প্রভাতের দুই লাইনের ইংরেজী স্ট্যাটাস।
‘No one can fix me except you.’

প্রভাতের বন্ধুরা সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে খোঁচা মে’রে অনেক কথা বলেছে, মজা করেছে। একজন তো সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছে, ‘ম্যাডাম তোমাকে চোখে দেখে না মামা। অতিদ্রুত ফুল পাওয়ারের চশমা কিনে দাও, নয়তো আজীবন পেছনে ঘুরেই ম’রতে হবে।’ মৃন্ময়ী কয়েক মিনিট সেই স্ট্যাটাসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবারও এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে ফোন রেখে দিলো। প্রভাতের ম্যাসেজের উত্তরটা-ও দেওয়া হলো না। কীইবা উত্তর দিবে সে? সে জানে ঠিক কোন উত্তরে প্রভাত খুশি হবে। কিন্তু প্রভাতকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর দিতে তার যে অনেক দ্বিধা।

পরদিনই প্রভাত তাকে সর্বপ্রথম যেই প্রশ্নটি করল তা হচ্ছে ‘উপহার পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলে না কেন?’
“ম্যাসেজ দেখিনি,” মিথ্যা বলল মৃন্ময়ী।
“ও। তাহলে এখন বলো পছন্দ হয়েছে কি না।”
মৃন্ময়ী ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তরে বলল,
“সুন্দর চুড়ি।”
“আর চিরকুটগুলো?”
“এত মনোযোগ দিয়ে কোনোদিন পরীক্ষার খাতায় লিখেছিলে?”
“এমনটা বলছো কেন?”
“তোমার চিরকুট দেখে মনে হলো এমন মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখলে ভালো রেজাল্ট পেতে পারতে।”
প্রভাত হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,
“ধ্যাত! আমি যতটা মনোযোগী প্রেমিক, ততটাই অমনোযোগী ছাত্র। অমনোযোগী ছাত্র কী করে পরীক্ষার খাতায় মনোযোগ দিয়ে লিখবে? তোমার প্রেমে পড়েছি বলেই মনোযোগ দিয়ে তোমাকে চিরকুট লিখেছি। তোমার মতো করে পড়াশোনার প্রেমে পড়িনি বলেই মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখা হয়ে ওঠেনি।”
“কাজের বেলায় মনোযোগ থাকে না, মনোযোগ থাকে যত অকাজের বেলায়।”
“তা অবশ্য ভুল বলনি। তবু তোমার প্রতি যখন মনোযোগ আছেই, তখন আশার আলো-ও তো একটু থাকতেই পারে। তাই না? মনোযোগী হলে যেহেতু ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায়। দেখি, আমিও কবে ভালো রেজাল্ট পাই।”
“ভালো রেজাল্ট কাজে আসে, অকাজে না।”
“আমার ভালোবাসাকে তুমি অকাজ বলছো?”
“অযথা সময় নষ্ট করাকে অকাজ বলব না তো কী বলব?”
প্রভাত অভিমানী সুরে বলল,
“ভালোবাসা গ্রহণ যখন করছো না, তখন আমার ভালোবাসাকে একটু সম্মান কিন্তু দেখানো উচিত তোমার। এত ধৈর্য নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি, দিন-দিন তোমাকে এত-এত ভালোবেসে ফেলছি, এসব মোটেও অকাজ হতে পারে না।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি খুবই কাজের কাজ করছো। তোমার সাথে তর্ক করে লাভ নেই আমার।”
প্রভাত প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“মৃত্তিকার ব্যাপারটা নিয়েই এতদিন তুমি খুব চিন্তিত ছিলে, তাই না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মনে তো হচ্ছে খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবু জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“এমনি। দিন-দিন তোমার ওপর চাপ বাড়ছেই। জানি তোমার কষ্ট হয়। তবু আফসোস ছাড়া আমার কিছু করার থাকে না। তুমি আমাকে সেই সুযোগটাই দাও না,” কিছুটা মনমরা হয়ে বলল প্রভাত।
“তোমাকে সুযোগ দিলে আমার কষ্ট কমে যাবে, না তোমার আফসোস কমে যাবে? কোনটা?”
“হয়তো দুটোই। তুমি আমাকে সুযোগ দিলে সর্বপ্রথম আমি তোমার মাথার সমস্ত চাপ ভাগ করে নিব, তোমার মনের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিবো, আমি হব তোমার সমর্থন, তোমার ভরসার জায়গা। যেকোনো মূল্যে আমি তোমাকে সুখী জীবন দিবোই মৃন্ময়ী। তোমার কাছে আমার এসব কথা আবেগ মনে হলেও, আমার কাছে এসব আমার নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা। একবার তুমি আমাকে গ্রহণ করে দেখো, এ সব প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে দেখাব। আমি কাগজে-কলমে লিখে দিতে পারি, আমি প্রভাত তরফদার নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব এবং একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসব।”

“খুব গরম লাগছে। শরবত খাবে?” বলেই মৃন্ময়ী জোরে হাঁটা দিলো।
প্রভাত বুঝল মৃন্ময়ী আবারও এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে-মনে সে হাসল। মৃন্ময়ীর পেছনে ছুটে বলল,
“ম্যাডাম নিজে খাওয়াতে চাইলে আমি কিন্তু দুই গ্লাস খাব। রোদ মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তিন গ্লাস খেয়ো তুমি।”
মৃন্ময়ী কথার কথা বললেও প্রভাত যে সত্যি-সত্যি পরপর তিন গ্লাস শরবত খেয়ে ফেলবে, ভাবেনি সে। প্রভাতের কথা এড়াতে সে শরবত খাওয়ার অযুহাত দেখিয়েছে। একা হলে সে শরবতের দোকানের আশপাশেও ঘেঁষত না। বাড়ি ফিরলেই মা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দেয়। খেলেই ক্লান্ত মনে তৃপ্তি আসে। এক গ্লাস শরবত কিনে টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তবু মৃন্ময়ী আজ এক গ্লাস শরবত খেল। স্বাদ ভালোই। সব মিলিয়ে চার গ্লাস শরবতের বিল তার জলে যাবে, এই ভেবে মনে-মনে নিজেকে বকল। শেষমেশ অবশ্য প্রভাত নিজেই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সে টাকা বের করলেও প্রভাত কিছুতেই তাকে বিল দিতে দেয়নি। নিজেই দিয়ে দিয়েছে। ছেলের বুদ্ধি আছে।


মৃত্তিকার থেকে টাকা নিয়ে দরজির দোকান থেকে আজ জামা নিয়ে এসেছে মৃদুলা। বাড়ি ফিরে সে ভয়ে-ভয়ে মৃন্ময়ীকে ডাকল। মায়ের সামনে ব্যাগ থেকে জামা বের করে মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“জামা নিয়ে এসেছি।”
মৃন্ময়ী জামা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে বলল,
“সুন্দর হয়েছে। এই রংয়ে তোকে মানাবে। সবারটাই এই রংয়ের?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম ঘটনা বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে শুধালেন,
“জামা কার?”
মৃদুলার আগে মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“মৃদুলার।”
সাজেদা বেগম সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলেন কদিন আগে এই জামা কেনার কথাই বলেছিল তার মেয়ে। তিনি ভ্রুকুটি করে পুনরায় মৃদুলাকে বললেন,
“এই জামা তুই শেষমেশ কিনছিসই?”
মৃন্ময়ী বলল,
“থাক না মা। মেয়েরা সবাই একরকম জামা পরবে, ও পরতে না পারলে তো ওর খারাপ লাগবেই। তাছাড়া পরীক্ষার পর কে কোথায় ভর্তি হয় তার তো ঠিক নেই। একসঙ্গে একটু ভালো সময় কা’টাক ওরা।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“কত টাকা লেগেছে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“জামা বারোশো টাকা, বানাতে লেগেছে দুইশো টাকা।”
সাজেদা বেগম চোখ বড়ো করে বললেন,
“চৌদ্দশো টাকা খরচ করে ফেলেছিস এই জামার পেছনে! আর তুই যে গায়েই মাখছিস না। তুই কি তোর বোনদের জন্য টাকার গাছ লাগিয়েছিস?”
মায়ের কথা শুনে মৃন্ময়ী বলল,
“জামা বানাতে আমি টাকা দিইনি। ও আমার কাছে টাকা চায়নি।”
“তাহলে টাকা কোথায় পেল?”
“মৃত্তিকা দিয়েছে।”
মৃত্তিকার কথা শুনেই সাজেদা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“মৃত্তিকা টাকা পেল কোথায়?”
“ওর কাছে ছিল, সেখান থেকেই দিয়েছিল।”
“ওর জামাইয়ের টাকা?”
“হবে হয়তো। ও আর টাকা কোথায় পাবে?”
এক মুহুর্তে সাজেদা বেগমের মুখোভাব পালটে গেল। রাগত মুখে তিনি মৃদুলাকে বললেন,
“তুই আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওর থেকে টাকা চেয়েছিস কোন সাহসে?”
মৃদুলা নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি চাইনি, আপু নিজেই দিয়েছে।”
সাজেদা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আপু চাইলেই তুই নিয়ে নিবি? তোর আপুর দুই টাকা রোজগার আছে? আজীবন আরেকজনের কলিজা ঠুকরে খাওয়া ওর স্বভাব। এই পর্যন্ত ওর ওই ছ্যাঁচড়া জামাইয়ের এক পয়সা আমরা খেয়েছি? তুই দেখিসনি, ওর জামাইয়ের টাকায় একটা ফল নিয়ে এলেও আমি তা ফেরত পাঠিয়েছি? দেখেছিস কি না? তুই কোন সাহসে ওর জামাইয়ের টাকায় জামা কিনলি? মৃন্ময়ী তোকে কোন জিনিসটা না দেয়? তুই মুখ ফুটে কিছু চাইলে কষ্ট হলেও ও কিনে এনে দেয়। কী-রে? দেয় না? একবার চাইতে বারণ করেছি বলেই তুই গিয়ে ওর কাছে হাত পাতলি? এই, তোর লাজ-শরম নেই? তোকে আমি এসবই শিখিয়েছি?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মা, তুমি ওকে বকছো কেন? মৃত্তিকা যেচে দিয়েছে বলেই তো ও নিয়েছে। নইলে কি ও নিজে চাইতে যাওয়ার মতো মেয়ে? আমি জানলে তো আমি নিজেই ব্যবস্থা করে দিতাম।”
“ওকে যেচে দিলেই ও নিবে কেন? ওই ছ্যাঁচড়া ছেলের টাকা ও খরচ করল কোন সাহসে? আমার মান-সম্মান সব খেয়েছে, ওই ছেলের টাকা তো আমাকে হাতে ধরিয়ে দিলেও আমি নিতাম না। এই জামার জন্য ও আমার অবাধ্য হয়েছে না? মৃন্ময়ী তোকে আমি বলে দিচ্ছি, এখন থেকে ওর জামাকাপড়ের পেছনে তুই একটা টাকাও খরচ করতে পারবি না। আমিও দেখব ও কদিন ওর দুলাভাইয়ের টাকায় চলতে পারে। আমার সাথে চালাকি? ওকে আমি বুদ্ধিমতী ভাবতাম। আরেক গাধা ফিরে এসে ওর মাথার মধ্যেও গোবর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারে শান্তি আর দিবে না এরা।”
মায়ের চেঁচামেচি শুনে মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের এসব কথা শুনে আর সামনে এগোয়নি। মৃদুলাকে দেখল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নতুন জামাটা মা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মৃন্ময়ী সেটা তুলে মৃদুলার হাতে দিলো। মৃত্তিকা এগিয়ে এসে বলল,
“মৃদুলাকে কিছু বোলো না মা। ওর কোনো দোষ নেই। আমি নিজেই ওকে জোর করে টাকা দিয়েছি। তুমি শুনলে রাগ করবে বলেই ও তখন নিতে চায়নি। তোমার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো, ওকে ছাড়ো। দুদিন পর ওদের অনুষ্ঠান। এখন আবার জামা নিয়ে বকলে ওর মন ভেঙে যাবে।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তোমাকে আর আমি কী বলব মা? তোমার সঙ্গে আর কলাগাছের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তো কোনো তফাৎ নেই। তুমি এই সংসারে উপকারী কাজ না করতে জানলেও, বেছে-বেছে অপকারী কাজগুলো খুব ভালো করেই করতে জানো।”
“টাকাটা মৃদুলার দরকার ছিল, তাই দিয়েছিলাম।”
“টাকার দরকার ছিল, তোর জামাইয়ের টাকার তো দরকার ছিল না। যেদিন নিজের উপার্জন করার যোগ্যতা হবে, সেদিন এই সংসারে টাকা খরচ করিস।”
“সরি,” মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই মৃত্তিকা মাথানিচু করে চলে গেল।
তবু যখন সাজেদা বেগমের রাগ কমছিল না, তখন মৃন্ময়ী জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে গেল। একা বসে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করল। মৃদুলা জামা হাতে ঘরে গিয়ে দেখল মৃত্তিকা নিঃশব্দে কাঁদছে। মৃদুলাকে দেখে সে চোখের পানি মুছে ভেজা গলায় বলল,
“খারাপ মানুষদের করা ভালো কাজ-ও খারাপ হয়ে যায়, তাই না রে?”
মৃদুলা উত্তর দিলো না। চুপচাপ গিয়ে নতুন জামাটা আলমারিতে তুলে রাখল।

সেদিন রাতে মৃন্ময়ী ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃত্তিকা তার ঘরে এল। মৃন্ময়ী তাকে ডেকে বিছানায় বসাল। মৃত্তিকা নিজেই আগে কথা তুলল,
“এখনই ঘুমাবি?”
“হ্যাঁ। তুই কিছু বলবি?”
“তাহলে কাল বলব নে। তুই ঘুমা।”
“সমস্যা নেই, বল। তোর কি মন খারাপ?” মৃত্তিকার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না। হঠাৎ করে মনে হলো তোকে একটা কথা বলে দেখি।”
“বল না।”
মৃত্তিকা একটু আমতা-আমতা করে বলল,
“আপা, তুই কি আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারবি?”
মৃন্ময়ীর মুখ দেখে মনে হলো সে অবাক হয়েছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফের শুধাল,
“কাজ? তুই কাজ করবি?”
“করতে তো চাইছি। কিন্তু আমি তো অনার্স শেষ করিনি। এইচএসসির সার্টিফিকেটে কোনো কাজ পেলে করব।”
“তুই কি সিরিয়াস?”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম। কতকাল আর তোকে জ্বালাব? বিয়ের আগেও জ্বালিয়েছি, বিয়ের পর এসে-ও জ্বালাচ্ছি। আমার ওপর মায়ের রাগটা অস্বাভাবিক না, বুঝি আমি।”
“তুই কি মায়ের কথায় অভিমান করেছিস?”
“না রে। ওসব কথা আমার প্রাপ্য। অভিমান করব কোন সাহসে? ভাবলাম এখন তো বাড়িতেই বসে আছি, তারচেয়ে কোনো কাজ-টাজ করতে পারলে তো ভালো হয়। সময়-ও কে’টে যাবে, হাতখরচটা-ও পাওয়া যাবে।”
“কী কাজ করতে চাস তুই?”
“আমি তো এ বিষয়ে জানি না। সম্ভব হলে তুই একটু দেখ না কোথাও কোনো কাজ যদি পাস। তুই যা ঠিক করে দিবি তা-ই করব। আমার তো কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তুই কি পারবি খোঁজ নিতে? ভেবেছিলাম আমার বন্ধুদের বলব, পরে আবার ভাবলাম যাকে বলব সে-ই তো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবে।”
মৃন্ময়ী একটু ভেবে বলল,
“থাক, কাউকে বলার দরকার নেই। তুই যখন নিজে থেকে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিস, আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচিত যারা আছে, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো পাওয়া যাবে।”
“আচ্ছা, না পেলে-ও জানাস আমাকে।”
“পাওয়া যাবে, চিন্তা করিস না,” আশ্বস্ত করে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। মনে যে শত বাঁধা তার। মৃন্ময়ী তার মুখ দেখে প্রশ্ন করল,
“আর কিছু বলবি?”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“না। আমি চলে যাচ্ছি, তুই ঘুমিয়ে পড়।”
“আচ্ছা যা। আমি দেখব ব্যাপারটা।”

মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মৃন্ময়ী দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল। আজ আবার প্রভাত ম্যাসেজ করেছে,
“আপনাদের কোচিংয়ে ভর্তি হতে খরচ কত ম্যাডাম? আমার মতো ছাত্র কি গ্রহণযোগ্য?”
উত্তরে মৃন্ময়ী লিখল,
“কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না জানি না। তবে তোমার মতো গোরু মার্কা ঢেউটিন ছাত্র আমার ক্লাসে গ্রহণযোগ্য নয়।”
সঙ্গে-সঙ্গে তার ম্যাসেজে প্রভাত স্যাড রিয়্যাক্ট দিয়ে লিখল,
“মুখের ওপর অপমান করে দিলে? ঠিক আছে, আমি তোমাদের কোচিংয়ে-ই ভর্তি হব। তারপর দেখব তুমি কীভাবে আমাকে ক্লাসে না নাও।”
মৃন্ময়ী আর উত্তর দিবে না ভেবেও আবার কী মনে করে প্রশ্ন করল,
“তুমি না মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়েছিলে?”
“একবার দিয়েছিলাম, তা-ও কলেজ থেকে স্যার ফোন করে খবর দিয়েছিল বলে। পরীক্ষায় বসে দেখি কোনো প্রশ্নই আমার পরিচিত না।”
“তুমি কি পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলে?”
“আরে নাহ্! পড়ব কখন? পরীক্ষা দিতে ডেকেছিল, তাই গিয়েছিলাম।”
“না পড়ে পরীক্ষা দিতে গেলে প্রশ্ন পরিচিত লাগবে কীভাবে? তারপর আর কোনো পরীক্ষা দাওনি?”
“নাহ্।”
“সেকি! তাহলে ভর্তি হয়েছিলে কেন?”
“আমার বাপের ঠেলাঠেলিতে আর আমার আবেগে ভর্তি হয়েছিলাম। একবার পরীক্ষায় বসার পর যখন বুঝলাম আমার পড়ার বয়স শেষ হয়ে গেছে, তখন থেকে ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।”
“কী আশ্চর্য! তোমার পড়ার বয়স শেষ হয়েছে কে বলল তোমাকে?”
“এটা আবার কারো বলা লাগে? আমিই বুঝে গেছি। এখন হচ্ছে আমার বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করার বয়স, বউ-বাচ্চা নিয়ে জীবন সাজানোর বয়স। বউয়ের মন পড়ার বয়সে কিসের বই পড়ে পরীক্ষায় বসব? আমি শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষায় আছি। তুমি সম্মতি জানালেই আমি বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষায় বসে পড়ব।”
এই ম্যাসেজ পড়ে মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। পরমুহূর্তে খেয়াল হতেই আবার মুখে গাম্ভীর্যতা টেনে লিখল,
“তোমার মতো এমন আজাইরা চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বসে থাকি না আমি।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আহা! আমি জানি তো তুমি ভালো মেয়ে। আমি তো আর তোমার মতো ভালো ছেলে নই। আমি হচ্ছি ভালো প্রেমিক। তাই তুমি পড়ার পেছনে ছুটছো, আর আমি তোমার পেছনে। আচ্ছা, এভাবে ছুটতে-ছুটতে একদিন তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে যদি আমিও আমার লক্ষ্য পৌঁছে যাই, ব্যাপারটা দারুণ হবে না? আই উইশ খুব শীঘ্রই এমন দিন আসুক। তুমি তোমার স্বপ্ন জয় করো, আর আমি তোমাকে।”

মৃন্ময়ী আজও এই ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রত্যুত্তর না করেই ফোন রেখে দিলো। স্বপ্ন জয়? সে তো অনেক কঠিন। মৃন্ময়ী নিজেও জানে না সে স্বপ্ন জয় করতে পারবে কি না। শেষমেশ তার এত চেষ্টা, এত কষ্ট সার্থক হবে কি না। তবু সে ছুটছে। প্রভাতের ধারণা তার মতো সে-ও স্বপ্ন জয় করতে ছুটছে। অবশ্য তার স্বপ্ন কেবলই মৃন্ময়ী। তুলনা করলে মৃন্ময়ীর লক্ষ্যে পৌঁছানো যেমন অনিশ্চিত, প্রভাতের-ও তাই। অথচ সে চাইলেই পেতে পারে সুনিশ্চিত সুখী জীবন। ছেলেটা সত্যি বেপরোয়া। তার ভাবনার চেয়েও বেশি বেপরোয়া।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে