#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৪.
মৃদুলা প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মুখোভাবে স্পষ্ট যে জামা কিনতে না পারার বিষয়টি নিয়ে তার এখনও মন খারাপ। অনেকক্ষণ ধরে মৃত্তিকা তাকে কিছু বলার জন্য কাঁচুমাচু করছে। কিন্তু বলা-ই হচ্ছে না। মৃদুলা যখন হিজাব পরছিল, তখন মৃত্তিকা তাকে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আপাকে টাকার কথা বলেছিলি?”
মৃদুলা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,
“বলব না।”
“জিজ্ঞেস করে দেখতে পারতি না?”
“এই মাসে আপা অনেক খরচ করে ফেলেছে। এখন আমি টাকা নিলে তার নিজের হাত খরচের টাকা-ও হয়তো থাকবে না। তোমার মতো আপার গলায় ছু’রি ধরে টাকা আদায় করার স্বভাব আমার নেই। লাগবে না আমার জামা।”
মৃত্তিকা মন খারাপ করল না। পুনরায় শুধাল,
“তাহলে কী করবি? অন্য জামা পরেই যাবি?”
“তা-ও জানি না।”
“জামা কি তোরা পছন্দ করে রেখেছিস?”
“হুম।”
“দাম কত?”
“বারোশো টাকা।”
“কিনে আবার বানাতে দিতে হবে না?”
“কিনবই না, আবার বানাতে দিবো।”
মৃত্তিকা আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে তার ব্যাগ থেকে বারোশো টাকা বের করে নিয়ে এল। মৃদুলার হিজাব পরা শেষ হতেই সে হঠাৎ বোনের হাতটা ধরে মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দিলো। প্রথমে মৃদুলা চমকে উঠল। তারপর মুঠো খুলে টাকা দেখে সে অবাক চোখে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই মৃত্তিকা বলল,
“টাকাটা নে বোন। জামা নিয়ে আসিস।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“তুমি টাকা পেলে কোথায়?”
“আমার জমানো টাকা ছিল। এখন তো আমার লাগছে না, তুই নিয়ে কাজে লাগা।”
“তোমার জামাইয়ের টাকা না? আমি এই টাকা নিতে পারব না। পরে মা আমাকে যা-তা বলবে।”
মৃদুলা অসহায় মুখে বলল,
“এমন করিস না রে মৃদুলা। আমি জানি এখন তোর কেমন লাগছে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে আমিও আপার থেকে টাকা নিয়েছিলাম। আপার কাছে টাকা আছে, না কি নেই, তা-ও আমি ভাবতাম না। আর তুই তো আমার চেয়ে কত বুদ্ধিমতী। তোর মতো সুন্দর মন আমার নেই। কিন্তু এটুকু বুঝার ক্ষমতা আছে যে, তোর সুন্দর মনটা হাসিমুখে কষ্ট গিলে নেয়। আমি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনি। তোর প্রয়োজন নিয়েও মাথা ঘামাইনি। আজকাল তোকে দেখলে আমার নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, জানিস? তুই এই টাকাটা নিলে আমি খুব খুশি হব। প্লিজ নে।”
মৃদুলা তবু আপত্তি জানিয়ে বলল,
“না-না আপা। এই টাকার জন্য না পরে আমাকে মায়ের কত বকা শুনতে হয়। তুমি বলেছ, এতেই আমি খুশি হয়েছি। তোমার টাকা তুমিই রেখে দাও, দরকার পড়লে খরচ করতে পারবে।”
“নে না রে। তুই তো আমার কাছে টাকা চাসনি। আমি নিজেই তোকে দিচ্ছি। মা কিছু বললে বলিস তুই নিতে চাসনি, আমিই তোকে জোর করে দিয়েছি। দরকার পড়লে আমিও মাকে বুঝিয়ে বলব। জামা কিনে ফেললে তো আর মা সেটা ফেরত দিতে পারবে না। তুই নিয়ে যা, আমার টাকা লাগবে না।”
মৃত্তিকা তারপরও একটু দোনামনা করল। মনে-মনে তার ভয় লাগছে। মা যদি বকাঝকা করে? আবার মৃত্তিকা এত করে বলার পর আর সে তাকে টাকা ফিরিয়ে-ও দিতে পারল না। শেষমেশ তাকে টাকা নিতেই হলো। ভাবল জামা কিনে আগেভাগেই মাকে জানাবে না। আগে বড়ো আপাকে জানিয়ে তারপর মাকে জানাবে। মৃত্তিকা আবার তাকে এ-ও বলে দিয়েছে যে, জামা এনে বাড়িতে না এনে যেন দরজির কাছে দিয়ে আসে। জামা বানানোর মজুরিটা-ও মৃত্তিকা দিয়ে দিবে। মৃদুলার বিস্ময় যেন কমতেই চাইছে না। এই কি তার ছোটো আপা, আজীবন যার নিজের স্বার্থ ছাড়া পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না? যে আজীবন শুধু নিতেই জানত, সে দিতে শিখল কবে?
•
একহাতে কেক বক্স, আরেকহাতে গিফট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাত। মৃন্ময়ীর আজ দেরী হচ্ছে কেন? তার হাত দুটো তো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হিসেবে আবার মশার কামড়-ও সহ্য করতে হচ্ছে। কামড়ে-কামড়ে পা দুটো শেষ করে দিলো। ইচ্ছে করছে মশার গলা চেপে ধরে কানের নিচে কয়েকটা চটকানা লাগিয়ে দিতে। অবশেষে যখন মৃন্ময়ীর দেখা মিলল, তখন প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে বলল,
“আজ তুমি এত দেরী করলে যে? এদিকে তোমার অনুপস্থিতিতে মশারা আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মশারা তোমার মতোই ঘাড়ত্যাড়া।”
“কী যে বলো! মশারা কেন আমার হতে যাবে? তুমি ছাড়া কেউ আমার না।”
“তোমার হাতে এসব কী?”
“ওহ্! এসব তোমার জন্য। শুভ জন্মদিন মৃন্ময়ী।”
প্রভাত হাসিমুখে কেক বক্সটা বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী চরম অবাক হলো। আজ যে তার জন্মদিন তা হয়তো সে ছাড়া অন্য কারোরই মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। আগে ফেসবুকে জন্মদিনের নোটিফিকেশন পেলে অনেকে পোস্টের মাধ্যমে তাকে শুভেচ্ছা জানাত। দুবছর ধরে মৃন্ময়ী জন্মতারিখ অনলি মি করে রেখেছে। কেন জানি তার এসব খুব একটা ভালো লাগে না। মায়ের তো কোনোকালেই কারোর জন্মতারিখ মনে থাকে না। মৃত্তিকা ফেসবুকে নোটিফিকেশন বন্ধ হওয়ার পর আর শুভেচ্ছা জানায়নি। মৃদুলার যেবার মনে থাকে, সেবার সে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। আর যেবার মনে না থাকে, পরবর্তীতে মনে পড়লে খুব আফসোস করে। প্রভাত-ই একমাত্র মানুষ যে দুবার ধরেই তার জন্মদিনে কেক, গিফটসহ শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়। গত বছর সে প্রভাতের আনা উপহার গ্রহণ করেনি, কেক-ও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তখন সে প্রভাতের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল। এবার আবার প্রভাত একই কাজ করল। মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার এসব আনা উচিত হয়নি। গতবার তোমায় বারণ করেছিলাম তো, ভুলে গেছো?”
“তোমার ওসব বারণ প্রভাত তরফদার ভদ্র ছেলের মতো মেনে নিবে, এটা ভাবা-ও তোমার উচিত হয়নি। বেপরোয়া ছেলেরা এত বাধ্য হয় না। কিন্তু তুমি দয়া করে এবারেও অবাধ্যতা কোরো না। গতবার কেক নিয়ে বন্ধুদের দান করে দিয়েছিলাম, এবারে কিন্তু তা-ও করব না। আমি অত ভদ্র না।”
মৃন্ময়ী ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পেল না। চ-সূচক আওয়াজ করে বলল,
“কী মুশকিল! বুড়ো বয়সে তুমি এমন বাচ্চামি কেন করো?”
“কী মুশকিল! কারণটা বলতে-বলতে তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার মনেই থাকছে না। এটা-ও কি আমার দোষ?”
“তুমি সত্যিই একটা অসম্ভব মানুষ। তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই আমার উচিত হয়নি।”
“করেই যখন ফেলেছ, এখন আরেকটু ভালো ব্যবহার করে কেকটা গ্রহণ করে আমায় ধন্য করো ম্যাডাম।”
“আমার এখন কেক খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে ফেলো।”
“তা বললে তো হবে না ম্যাডাম। এক চিমটি হলেও খেতে হবে। নয়তো আজ আমি এই কেক নিয়ে তোমার বাসায় গিয়ে উঠব।”
মৃন্ময়ী হতাশ চোখে চাইল। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস নেই? সত্যি-সত্যি বাসায় গিয়ে উঠতে-ও এর কোনো দ্বিধা হবে না। দিশা না পেয়ে সে মনকে সান্ত্বনা দিলো, ‘কেকই তো! একটু খেলেই তো আর প্রেম হয়ে যাবে না।’ তারপর বলল,
“ঠিক আছে, দাও। কিন্তু আমি এক কামড়ের বেশি খেতে পারব না।”
প্রভাত দারুণ খুশিতে চমৎকার হাসিতে বলল,
“তোমার এক কামড়েই আমার কেক স্বার্থক। চলো কোথাও বসি।”
তারা একটা বন্ধ দোকানের সামনের টুলে বসল। প্রভাত বক্স খুলে প্লাস্টিকের ছু’রিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“কাটো।”
নিজের সামনে প্রভাতকে এত খুশি মৃন্ময়ী এই প্রথম দেখল। কী উৎসুক চোখে সে মৃন্ময়ীর কেক কা’টার অপেক্ষা করছে! মৃন্ময়ী কেক কা’টল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত কেকের কা’টা টুকরোটা হাতে তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর মুখের কাছে ধরল। মৃন্ময়ী ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বুঝতে পেরে প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“খাও না, আমি খুব খুশি হব। জাস্ট ওয়ান বাইট, প্লিজ।”
অস্বস্তি পেরিয়ে মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত থেকে এক কামড় কেক খেল। বাকি কেকটুকু প্রভাত নিসঙ্কোচে নিজের মুখে পুরে নিল। বিষয়টা মৃন্ময়ী ঠিকঠাক খেয়াল না করার ভান করল। খেয়াল করলেই যত অস্বস্তি। প্রভাত আরেক টুকরো কেক বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আরেকটু খাও না। কেকটা খুব মজা। এমনিতেও তো কে’টে ফেলেছো।”
মৃন্ময়ী ওই কেকটুকু-ও খেল। তারপর বলল,
“আমি এখন উঠছি।”
“আরেকটু খাও না।”
“আর পারব না।”
“তাহলে আরেকটু সময় বসো।”
প্রভাত পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বের করে মৃন্ময়ীকে একটা টিস্যু দিলো। তারপর নিজের হাত মুছে নিয়ে পাশ থেকে গিফট বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী এবার দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“কেক পর্যন্ত ঠিক আছে প্রভাত। আমি তোমাকে একেবারেই ফিরিয়ে দিইনি। কিন্তু উপহার আমি গ্রহণ করতে পারব না, সরি।”
“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। ঠিক এই কারণেই আমি খুব মূল্যবান কিছু কিনিনি, বিশ্বাস করো। আমি পারতাম তোমার জন্য মূল্যবান উপহার কিনতে, তবু কিনিনি শুধুমাত্র তুমি গ্রহণ করবে না বলে। তুমি এই প্যাকেট খুলে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমি একদমই মিথ্যা বলছি না। এর ভেতরে খুবই সামান্য উপহার আছে। তুমি এটা গ্রহণ করলে এই সামান্য উপহারটাই আমার কাছে অসামান্য মনে হবে।”
“প্রভাত, আমাকে জোর কোরো না প্লিজ।”
“জোর করছি না। তোমাকে কোনো কিছুতে জোর করার সাহস আমার নেই। আমি চাই আমার এই সামান্য উপহারটা তুমি গ্রহণ করো। প্রেমিক হিসেবে না হোক, অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো। তুমি ফিরিয়ে দিলে এই উপহার অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না, ফিরিয়ে দেওয়া-ও সম্ভব না। প্লিজ মৃন্ময়ী, সামান্য উপহারই তো। খোলার পর যদি তোমার মনে হয় আমি বিশাল কিছু কিনে ফেলেছি, তাহলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো। আমি কিছুই মনে করব না।”
মৃন্ময়ী আবারও হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ কী যে হচ্ছে তার সাথে! আগের মতো প্রভাতের ওপর প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত-ও সে হতে পারছে না। ছেলেটা এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করে যে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তবু তো সে শক্ত থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করে। শেষমেশ উপহারটা-ও মৃন্ময়ীকে গ্রহণ করতে হলো। প্রভাতের খুশি যেন আর ধরে না। খুশিতে সে বাকি কেকটুকু এক বসাতে একাই খেয়ে ফেলল। তারপর মৃন্ময়ীকে বাড়ি অবধি-ও পৌঁছে দিয়ে এল। বাড়িতে ঢোকার আগে যখন মৃন্ময়ী ছোটো করে তাকে ধন্যবাদ জানাল, ঠিক তখন প্রভাতের মনে হলো আজকের দিনটা আসলেই একটু বেশিই বিশেষ। এমন দিন সে তার জীবনে বারবার ফিরে পেতে চায়।
উপহারসহ বাড়িতে ঢুকতেই মৃন্ময়ী মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়ল। সাজেদা বেগম বক্সটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কী রে?”
“উপহার।”
“কে দিলো?”
“এক বন্ধু,” উত্তরটা মিথ্যা হয়েও সত্য মনে হলো মৃন্ময়ীর।
সাজেদা বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কোন বন্ধু?”
“তুমি চিনবে না। আমার সহপাঠী ছিল।”
“তা হঠাৎ তোকে উপহার দিলো যে?”
“দিতে ইচ্ছা করেছে তাই দিয়েছে।”
“তোর অনেক ভালো বন্ধু বুঝি?”
“ওই ভালোই।”
“ওওও। এটার ভেতরে কী আছে?”
“জানি না, খুললে বলতে পারব।”
“তাহলে খুলে দেখ।”
“খুলব নে মা। একটু জিরিয়ে নিই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ঠান্ডা শরবত খাবি? বানিয়ে দিবো?”
“বানাবে? বানাও তাহলে। গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।”
সাজেদা বেগম তখনই শরবত বানাতে চললেন। মৃন্ময়ী নিজের ঘরে ঢুকতেই তার পেছন-পেছন মৃদুলা-ও এল। ভেতরে ঢুকেই সে মৃন্ময়ীকে দুহাতে জাপটে ধরে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে আপু।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ বোন।”
মৃদুলা মৃন্ময়ীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“গিফটটা তোমায় প্রভাত ভাইয়া দিয়েছে, তাই না?”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“তুই জানলি কীভাবে?”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“গণনা করে জেনেছি। দাঁড়াও, তোমার জন্য আমার তরফ থেকেও একটা ছোট্ট উপহার আছে।”
“কী উপহার?”
মৃদুলা এক ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। তাকে আলমারির ভেতরের জামাকাপড়ের নিচ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করতে দেখে মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“কী-রে? ওটা কী লুকিয়ে রেখেছিলি?”
মৃদুলা বলল,
“বড়ো আপুর বার্থডে গিফট।”
মৃত্তিকা একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
“আজ আপার বার্থডে?”
“কেন? তুমি জানতে না?”
“মনে ছিল না।”
মৃদুলা উপহার নিয়ে ছুটল বড়ো বোনের কাছে। মৃত্তিকার হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। নিজেকে প্রচণ্ডরকম স্বার্থপর মনে হলো। মা ঠিকই বলে, আপাকে সে কোনোকালেই বোঝেনি। বুঝতে চায়নি আর-কী। আচ্ছা, সে এখন খালি হাতে গিয়ে জন্মদিনের শুকনো একটা শুভেচ্ছা জানালে কি আপা খুশি হবে? না থাক, মৃদুলার মতো তো সে আপাকে ভালোবাসতেই পারে না। আজ হঠাৎ মিছে আবেগ দেখিয়ে কী হবে? তারচেয়ে বরং মৃদুলার সুন্দর শুভেচ্ছায় আপা খুশি থাকুক।
মৃদুলার উপহার খুলে মৃন্ময়ী অবাক হলো। এই মেয়ে তার জন্য দারুণ একটা শাড়ি কিনেছে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আবার চুড়ি আর কানের দুল-ও কিনেছে। মৃন্ময়ী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এ তুই কী করেছিস মৃদুলা!”
মৃদুলা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তোমার ভাষায় অকাজ করে ফেলেছি, জানি। কিন্তু তুমি আমায় বকতে পারবে না। তুমিই সেদিন আমার জন্য পার্স কিনে এনে মাকে বলেছিলে মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভেঙে পরিবারকে খুশি করতে ভালো লাগে। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি।”
“তাই বলে তুই এত টাকা খরচ করবি? অল্প টাকায় কি উপহার দেওয়া যায় না?”
“আমার তোমাকে শাড়ি দেওয়ার শখ জেগেছিল, তাই শাড়িই কিনেছি। অন্যকিছু কিনলে মনে শান্তি পেতাম না।”
“এ মাসে নিশ্চয়ই হাত খরচে টানাটানি পড়ে গেছে?”
মৃদুলা হাসিমুখেই বলল,
“তা একটু পড়েছে। সমস্যা নেই, আগামী সপ্তাহেই আরেকটা টিউশনের টাকা পাব। এখন আমার গিফট তোমার পছন্দ হয়েছে কি না তা-ই বলো।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“খুব পছন্দ হয়েছে। তোর পছন্দ কখনও খারাপ হয় না। কিন্তু এবারের মতো কিছু বললাম না, আর কখনও যেন এমন অকাজ করতে না দেখি।”
মৃদুলা বলল,
“তুমি খুশি হলে আমি এমন অকাজ বারবার করতে চাই। তারপর বকা শুনতে-ও আমার আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বাড়িতে এই মেয়েটা আছে বলেই মাঝে-মাঝে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সে হাসতে পারে। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি এতটুকু দয়া করেছিলেন!
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।