মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৩

0
2

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
নতুন পার্স পেয়ে খুব খুশি হলেও মৃদুলা বেজার মুখে বলল,
“পার্স আমি নিজেই কিনতাম আপু। তুমি কেন কিনতে গেলে?”
“কেন, তোর পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দ হয়েছে। তোমাকে না বলেছি আমার পেছনে অযথা খরচ না করতে?”
“দাম বেশি না তো। মাত্র আড়াইশো টাকা।”
“হোক, আড়াইশো টাকা তোমারই উপকারে আসত।”
মৃন্ময়ী হেসে মাকে ডেকে বলল,
“মা দেখো, তোমার মেয়ে খুব বড়ো হয়ে গেছে। এমনভাবে বলছে যেন তার জন্য খরচ করা আমার দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“আমার মেয়ে ঠিকই বলে। যেটা কেনার সামর্থ ওর আছে, সেটা ও নিজেই কিনে নিবে। তোর এত বাড়তি খরচের কী দরকার? ওর যখন হাতে টাকা না থাকে, কিছু দরকার হলে তো ও নিজেই তোকে জানায়। দুজনেই কষ্ট করে টাকা রোজগার করিস। খরচ তেমনই ভেবেচিন্তে করা উচিত।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভেবেচিন্তে, মেপে-মেপে তো সবসময়ই খরচ করি মা। তবু কখনও-কখনও ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে তোমাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছা করে। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের। তোমাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবকিছু। তারজন্য মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভাঙতে আমার কোনো আফসোস নেই।”
মৃদুলা মন খারাপী সুরে বলল,
“আমাদের ভালো রাখার তাগিদে তো তুমি নিজের জীবনটাকেই ব’লিদান দিয়ে দিচ্ছ আপু। আমরা তোমাকে ভুলিয়েই দিয়েছি তোমার-ও একটা জীবন আছে। তোমার-ও আমাদের মতো সবরকম চাহিদা আছে, হাসিখুশি থাকার ইচ্ছা আছে, একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা আছে। অথচ দায়িত্বের নামে আমরা তোমাকে টেনেহিঁচড়ে তোমার জীবন থেকে কতটা দূরে সরিয়ে এনেছি! আমরা খুবই স্বার্থপর, তাই না আপু?”

সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মৃদুলার কথায় যে মেয়েটার ক্লান্ত মনটায় মন খারাপের ছায়া পড়েছে, তা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন। তাই তিনি মৃদুলাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তুই ওর কানের কাছে ভনভন না করে সর তো। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দে। কী গরম পড়েছে দেখেছিস? মেয়েটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে না?”
“চলে যাচ্ছি, আমার পড়তে বসতে হবে,” বলে মৃদুলা উঠে পড়তেই মৃন্ময়ী তাকে পিছু ডাকল,
“শোন।”
“বলো আপু।”
মৃন্ময়ী তার ব্যাগ থেকে নতুন কেনা কানের দুলগুলো বের করে দিয়ে বলল,
“নে, কানের দুলের ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছিল, তাই নিয়ে এসেছি।”
মৃদুলা হাতে নিয়ে দুই জোড়া দুল দেখে জিজ্ঞেস করল,
“একরকম দুই জোড়া দুল দিয়ে আমি কী করব?”
“মৃত্তিকাকে এক জোড়া দিয়ে আয়।”
মৃদুলা একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“তুমি পারো-ও আপু!”

মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে ছিল। মৃদুলা এসে তার হাতে এক জোড়া কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার।”
মৃত্তিকা কানের দুলটা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“সুন্দর তো! তুই কিনেছিস?”
“উঁহু, বড়ো আপু আমার জন্য পার্স কিনতে গিয়েছিল। তখন এই দুলের ডিজাইন পছন্দ হয়েছে বলে তোমার আর আমার জন্য নিয়ে এসেছে।”
“ও, আসলেই সুন্দর।”
“আপু এখনও তোমাকে নিয়ে কত ভাবে! সত্যি, অবাক না হয়ে পারি না। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো তোমার ছায়া-ও মাড়াতাম না। আপু একটা অদ্ভুত মানুষ!” কথাগুলো বলতে-বলতে মৃদুলা চলে গেল।

মৃত্তিকা প্রতিবাদ করল না। ইদানীং মা-বোনের কড়া কথার বিপরীতে তার আর প্রতিবাদ আসে না। তর্ক করার ইচ্ছা জাগে না। কথা-ও যেন সে খুব মেপে-মেপে বলছে। কী দরকার কথা বাড়িয়ে তর্কে জড়ানোর? তর্ক করার মতো কথাই তো আজ আর তার ঝুলিতে নেই। সম্পূর্ণ শূন্য ঝুলি নিয়ে সে এই সংসারে ফিরে এসেছে। এই সংসারে আগে তার ভিন্ন একটা জায়গা ছিল, অন্যরকম মনের জোর ছিল। সেই জায়গাটা-ও সে নিজের দোষে হারিয়েছে। তবু যখন তার শেষ আশ্রয়স্থল এই সংসারটাই, শেষ ভরসা বড়ো আপা-ই, তখন আর নিজেকে আগের জায়গায় কল্পনা করার অর্থ কী? আগের মৃত্তিকা আর আজকের মৃত্তিকার জীবনের মাঝে যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আগের মৃত্তিকার জীবনে যে পরিবারের চেয়েও মূল্যবান একটা মানুষ ছিল, সে-ও আর তার নেই। মৃত্তিকা তার ফোনটার দিকে তাকাল। স্ক্রিনে তার আর তার স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভাসছে। ছবিটা তাদের বিয়ের দিনে তোলা। কী খুশি ছিল তারা সেদিন! পরমুহূর্তেই সে হাতের কানের দুলের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তার চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে এল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস।


গরমে অতিষ্ঠ প্রভাত শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে হাঁটছে। একটু পরপরই সে শার্ট ঝাঁকিয়ে শরীরে হাওয়া দিচ্ছে আর আফসোসের সুরে বলছে,
“আহ্! সিঙ্গেল মানুষের এমন গরম লাগার মানে কী! বেয়াদব গরম কি জানে না সিঙ্গেল মানুষকে বাতাস করার কেউ নেই? মনে হচ্ছে এই গরমের থেকে বাঁচতে অতি শীঘ্র বিয়ে করতে হবে। বউ-ই এই বাড়াবাড়ি রকমের গরমের একমাত্র সমাধান।”
মৃন্ময়ীকে শুনিয়ে সে এত কথা বললেও মৃন্ময়ী যেন শুনেও শুনছে না। সে তার মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। প্রভাত মাথা কাত করে উঁকি দিয়ে তার মুখোভাব লক্ষ্য করে বলল,
“ও ম্যাডাম, একটু দয়া তো করতে পারো। না কি? বেচারা ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে? এই মাথাফাটা গরমে তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে যদি মাথা ফেটে ম’রেটরে যাই, তখন তো আর কেঁদে-ও লাভ হবে না। এখন মানুষ আছি বলে তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে পেছনে ঘুরছি, ভূ’ত হলে তো তুমি আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালাবে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভূত হলে পছন্দমতো একটা পেতনি খুঁজে নিয়ো‌।”
“পেতনিটা তুমি হলে আমি এক কথায় রাজি আছি।”
“আমার ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে ম’রার।”
প্রভাত অবাক কন্ঠে বলল,
“তারমানে তুমি চাও আমি একাই ম’রে যাই? আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, আর তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছো? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় মৃন্ময়ী।”
“আমি কিছুই চাইছি না। তুমি নিজেই মুখের কথায় ম’রে যাচ্ছ, আবার মুখের কথায় ভূ’ত হয়ে যাচ্ছ।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“কী করব? তুমি তো আমার দুঃখ বোঝো না। আমার সব দুঃখ বারবার পিষে ফেলে রেখে চলে যাও।”
“বললাম তো আমি কিছুই করি না। যা করার তুমি নিজেই করো। দুঃখের কথা বললে সেটাও তুমি নিজের ইচ্ছায় জুটিয়ে নাও।”
প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তা অবশ্য মিথ্যা বলনি। দোষ তো আমারই। আমি নিজেই তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে চারটা বছর ধরে পেছনে পড়ে আছি। তুমি আমায় বিন্দুমাত্র আশা দাওনি। তবু আমি মৃন্ময়ী নামক আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে চলেছি। আমি জানি না এই সব অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আমি কবে তোমার হৃদয়ে পৌঁছাতে পারব। তবু আমি ধোঁয়াশার মতো আশা ছাড়ব না। আমি তোমাকে জয় করবই। হয় আমি তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব, নয় আজীবনের মতো ঘরের আশা ত্যাগ করব।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কারণে তুমি ঘরের আশা ছাড়তে পারো না। যেহেতু আমি তোমাকে কোনোরকম আশা দিইনি, সেহেতু তুমি আমাকে আজন্মের দোষী-ও বানাতে পারো না।”
“নাহ্। আমি তো বলছি তুমি দোষী নও, দোষী আমি নিজেই। এটুকু দোষ না করলে কি আর অসম্ভব রকমের ভালোবাসা জয় করা যায়? দোষ যখন করেই ফেলেছি, চালিয়ে যাই না। জয়ী তো আমি একদিন হবই। আর দুর্ভাগ্যবশত হেরে গেলে, ঘর-টরের স্বপ্ন ওখানেই শেষ। তবে ভয় নেই, আমি কোনোদিনও তোমার দিকে আঙুল তুলব না। আমি জানি তুমি কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছো, কেন দিনের পর দিন প্রেম-ভালোবাসা এড়িয়ে চলছো। যেখানে আমি নিজেকে তোমার জায়গায় কল্পনা করতে-ও ভয় পাই, সেখানে তোমাকে দোষ দেওয়া তো অসম্ভব কাজ।”

মৃন্ময়ী কিছুক্ষণ নীরব রইল, প্রভাত-ও। তারপর মৃন্ময়ী নরম গলায় বলল,
“প্রভাত, জেনেবুঝে আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে কী মজা পাচ্ছ? বয়স বাড়ছে, আর এমন বেপরোয়া হয়ো না।”
প্রভাত নিঃশব্দে হাসল। বলল,
“বেপরোয়া বলেই আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটছি। নয়তো বহু আগেই থেমে যেতাম।”
“এবার তো থামো। তুমি কি ক্লান্ত হও না?”
“থামার জন্য তো এতটা পথ হাঁটিনি। আর তোমার বেলায় আমার কোনো ক্লান্তি-ও নেই। যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেদিন থেকেই আমি আমার মনের সমস্ত ক্লান্তিদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। মৃন্ময়ী ম্যাডামকে জয় করার অভিযানে নেমেছি যে। এটুকু প্রস্তুতি তো নিতেই হত।”
“লাভ নেই প্রভাত। আমি তোমাকে বারবার বলেছি আমার পরিবারের বাইরে আমি এখন কিচ্ছু ভাবতে পারব না। আমার জীবন আমাকে সেই সুযোগ দিবে না।”
“আর যদি কোনোদিন সেই সুযোগ আসে, সেদিন কি তুমি আমাকে ভালবাসবে?”
“আসবে না।”
“যদি আসে?”
“অসম্ভব।”
“আচ্ছা, না আসুক। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যি কথাটা জানতে চাই। সুযোগ এলে কি তুমি আমায় ভালবাসবে?”
“আমার জন্য ওসব কল্পনা ছাড়া কিছুই না।”
“বলো না। আমি একবার তোমার মনের কথা শুনতে চাই, শুধু একবার। মনে করো এটা কল্পনাই। তোমার সামনে সুযোগ এসেছে কাউকে ভালোবাসার। তুমি কী করবে? সেদিনও আমাকে এভাবেই ফিরিয়ে দিবে? না আমাকে গ্রহণ করে নিবে? না কি আমাকে অযোগ্য ভেবে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে বসবে? বলো না প্লিজ।”

অবাক চোখে মৃন্ময়ী প্রভাতের ব্যাকুলতা দেখছে। যতই সে এই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুক, মাঝেমাঝে এমন কিছু মুহূর্তে ছেলেটার এসব ব্যাকুলতা দেখলে তার খারাপ লাগে। কোন সুখে এই ছেলে তাকে ভালোবাসল? কেন তার মনে মৃন্ময়ীর জন্যই এত পাগলামির সৃষ্টি হলো? সে তো অন্য কাউকে এমন পাগলের মতো ভালোবেসে একটা সুখী জীবন নিশ্চিত করতে পারত। তবে আর তাকে মৃন্ময়ীর অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হত না। মৃন্ময়ী নিচু স্বরে বলল,
“আমি তোমাকে মিছে আশা দিতে পারব না।”
“তোমাকে আশা দিতে হবে না। তুমি মুখ দিয়ে শুধু এইটুকু বলো যে, কোনোদিন সুযোগ এলে তুমি আমাকেই ভালোবাসবে। ব্যস এটুকুই, আর কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে। বাকিটা আমি নিজেই বুঝে নিব। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
“তোমার নিজস্ব একটা জীবন আছে প্রভাত। আমি চাই না আমার জন্য তুমি তোমার জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।”
“আর তুমি? তুমি কী করছো? তোমার কি নিজস্ব জীবন নেই? তা নিয়ে তো তোমার বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। এটা কি নিজস্ব জীবন থেকে সরে যাওয়া নয়?”
“আমার আর তোমার জীবন এক নয়। তুমি তো জানো তোমার থেকে আমি সম্পূর্ণ আলাদা।”
“হোক আলাদা। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও, আলাদাকেই আমি এক করে নিব।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমার জন্য বিয়ে করা মানেই পরিবার ছাড়া। এই পরিবার ছাড়ার কথা আমি ভাবতেও পারব না।”
“আমি তো তোমাকে পরিবার ছাড়তে বলছি না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি কোনোদিনও তোমাকে তোমার পরিবার ছাড়তে বলব না। আমি শুধু চাইছি তুমি তোমার জীবনটা নিয়ে একটু ভাবো। তারপর তোমার-আমার জীবনে শুধু একটু পরিবর্তন আসবে। তোমার বাকি সব একইরকম থাকবে, আমি তোমাকে কিচ্ছু পরিবর্তন করতে বলব না। বিয়ে করলেই পরিবারের সাথে তোমার দূরত্ব তৈরি হবে, এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো প্লিজ। আমি তো জানি তোমার পরিবারের তোমাকে কতটা দরকার। আমি তাতে কোনোদিনও আপত্তি করার সাহস দেখাব না। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী বুঝাতে চাইছি?”
“পারছি।”
“তাহলে কিছু তো বলো।”
“প্রভাত, মুখে অনেককিছুই বলা সম্ভব। চামড়ার মুখ তো, বলতে বাঁধে না। আর যদি হয় আবেগের কথা, তাহলে তো আরও আগে বাঁধে না। বাঁধে গিয়ে কোথায় জানো? যখন কথা রাখার সময় হয়। বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ তখনই হয়।”
“আমি ম’রে গেলেও আমার কথা ভাঙব না। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিতে বললে আমি তা-ও করতে পারব।”
“মৃত্তিকার বর-ও হয়তো তাকে এমনভাবেই কথা দিয়েছিল। সে কি করেছে জানো? এত-এত ভালোবাসাসহ মৃত্তিকাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওর নিজের হাতে সাজানো সংসারটা থেকে বের করে দিয়ে এখন নতুন বউ নিয়ে আনন্দ করছে।”
কথাটা শুনে প্রভাত ভীষণ অবাক হলো। মৃত্তিকার সাথে এমনটা হয়েছে, এই খবর তার জানা ছিল না। খবর নিতে হবে। আপাতত প্রভাত সে কথায় মাথা না ঘামিয়ে বলল,
“সব মানুষ তো এক হয় না। আমি খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে আমি খারাপ নই। তুমি একটা চিটারের সাথে আমার তুলনা করতে পারো না। আমি আর যা-ই করি, তোমার সঙ্গে চিট করব না।”
“আমি তুলনা করছি না, তোমাকে খারাপ-ও বলছি না। আমি শুধু বাস্তবতার বিষয়ে কথা বলছি। তুমি আমাকে যা বুঝাতে চাইছো, আমিও তারই প্রেক্ষাপট ধরে কথা বলছি।”
প্রভাত চরম হতাশ হয়ে বলল,
“তুমি আমাকে বুঝতে পারো না, না কি বুঝতে চাও না, তা-ই আমার বুঝে আসে না। এত ভালোবাসা চোখে দেখার পরও, এত সুযোগ সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা মানুষ নিজের জীবন নিয়ে কীভাবে এতটা উদাসীন হয় মৃন্ময়ী?”
মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উত্তর দিলো,
“মানুষটা আমি বলেই হয়তো।”


মৃদুলা আজ মৃত্তিকাকে ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বের করেছে। মৃত্তিকা প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘর থেকে বেরোয় না। সে যে এই বাড়িতে আছে, তা-ই আজকাল বুঝা যায় না। অথচ আগে এ বাড়িতে তার কন্ঠস্বরই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। মৃদুলা আজ টিউশন থেকে ফেরার সময় ঝালমুড়ি কিনে এনেছে। বাড়ি ফিরে সে মা আর বোনকে ডেকে ঝালমুড়ি খেতে বসেছে। খেতে-খেতে মৃদুলা মাকে প্রশ্ন করল,
“মা, আপুর কাছে এখন টাকা চাইলে কি দিতে পারবে?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কেন? তোর টাকা লাগবে না কি?”
“ওই কিছু টাকা লাগত।”
“কিসের জন্য?”
“কলেজে।”
“কদিন আগে না টাকা দিলো?”
“ওই টাকা না।”
“তাহলে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে। তারজন্য বান্ধবীরা সবাই একরকম জামা কিনবে।”
“তোর কাছে টাকা নেই?”
“যা আছে, তাতে হবে না।”
“তাহলে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে জামা না কিনলে কী হয়? ঘরে কি তোর নতুন জামা নেই?”
মৃদুলা মুখে একরাশ অন্ধকার নামিয়ে বলল,
“সবাই একরকম জামা পরবে, তারমধ্যে আমি একা অন্যরকম জামা পরে যাব কীভাবে?”

সাজেদা বেগমের হঠাৎ কী হলো কে জানে? তিনি ধুম করে রেগে গেলেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
“না যেতে পারলে আমাকে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে আন। আর কী করবি? আমার তো আর দুই টাকা রোজগার নেই যে বললেই দিয়ে দিবো। একজন দিন-রাত খেটে ম’রছে আর আমাদের টানছে। টানতে-টানতে তার দম ফুরানোর জোগাড় হচ্ছে, তা তোরা বুঝবি কী করে? তোরা তো তার কাছে হাত পাতলেই সব পেয়ে যাস। তারপর তার নিমক খেয়ে তার সাথেই নিমকহারামি করে পার পেয়ে যাস। আমার এই মেয়ে কি তোদের জন্য খাটতে-খাটতে ম’রে যেতে জন্মেছে রে? তোদের কাছে ওর কী এমন ঠেকা যে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে তোদের সুখে রাখছে? তারপরও তোরা আমার মেয়েটার র’ক্ত পানি করা জীবনটার ওপর থুথু কেন ছিটাস? বলতে পারিস? কী পাপ করেছিল ও? কেন করিস তোরা এমন?”

কথা শেষ করার আগেই সাজেদা বেগম কেঁদে ফেলেছেন। মৃদুলা ব্যথাতুর মুখে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। সাজেদা বেগম উঠে সরে যেতেই মৃত্তিকা-ও উঠে পড়ল। সে উঠতেই মৃদুলা শক্ত মুখে বলে উঠল,
“শান্তি হয়েছ তুমি? তোমার কারণে মায়ের এসব কথা আমাকেও শুনতে হয়? আমি কী করেছি? আজব! তোমার দোষে আমিও কেন এসব কথা শুনব? আপু কি তোমার জন্য কম করেছে? আমার তো মনে হয় আপু আমার চেয়েও বেশি করেছে তোমার জন্য। তবু তুমি তাকে এত কষ্ট কী করে দাও? আল্লাহ্ কি তোমাকে মন বলতে কিছু দেয়নি আপা?”
মৃত্তিকা জবাব দিতে পারল না। মাথা নিচু করে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখের রং বদলে গেল। বিছানার কাছে গিয়ে সে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার কান্নার শব্দ দরজার ওপাশে বসা মৃদুলার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হৃদয়টা দেখল না কেউ। আবদ্ধ রুমের দেয়ালে-দেয়ালে কান্নার শব্দ ধাক্কা খেয়ে তার নিজের কানেই ফিরে এল। মৃত্তিকার যেন নিজের কান্নার শব্দটা-ও সহ্য হলো না। সে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরল। সে আজীবন সন্ধি করে এল আনন্দের সাথে। হাসতে-হাসতে একটা জীবন কা’টিয়ে দিতে চাইল। অথচ কান্নারা হঠাৎ কেন তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে