মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
5

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২১.
মৃত্তিকাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন সাজেদা বেগম আর মৃদুলা। প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে তার‌। মৃন্ময়ীকে কল করে খবর দিয়েছেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ী তাদের কল পাওয়ামাত্র রেডি হয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছে। বেচারি মৃত্তিকার অবস্থা শোচনীয়। গতকাল পর্যন্ত-ও সে নরমাল ডেলিভারির আশায় ছিল। ডক্টর-ও তাকে তেমন আশ্বাস-ই দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তার অবস্থা থেকে ডক্টর-ই বললেন আজকের মধ্যে সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে হবে। নয়তো বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এ কথা শুনে মৃত্তিকার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ডেলিভারির জন্য সে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তা সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য যথেষ্ট নয়। সাজেদা বেগম এবং মৃত্তিকার জন্য তো এত টাকা দেওয়া অসম্ভব। একমাত্র ভরসা তাদের মৃন্ময়ীর মুখেই। মা যখন ভরসার চোখ দুটো তার দিকে তুলে ধরল, মৃন্ময়ী অন্ধকার মুখে বলল,
“আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তা দিলেও তো হবে না মা।”
সাজেদা বেগম দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে বললেন,
“এত করেও শেষমেশ এসে বাচ্চাটাকে আমরা হারাব?”
মৃদুলা বলল,
“এসব বোলো না মা। আপু, কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করা যায় না?”
মৃন্ময়ী ভাবুক মুখে বলল,
“তা তো করতেই হবে।”
“আমাদের কাছে যা টাকা আছে, তা একসঙ্গে করে রাখি। বাকি টাকাটা কারো কাছ থেকে ধার নেওয়া গেলে ভালো হয়। পরে না হয় আমরা সবাই মিলে শোধ করে দিবো।”
“আমি দেখছি কী করা যায়। তোরা চিন্তা করিস না।”

মৃন্ময়ী কেবিনের বাইরে সরে গিয়ে দ্রুত ভাবতে শুরু করল কার-কার কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায়। আগে বিপদে পড়লে অনেকের কাছেই টাকা চাওয়া যেত। এখন তা সবাই সহজভাবে দেখবে না। বরং তার স্বামী থাকতে অন্যদের কাছে টাকা ধার চাওয়ার বিষয়টা নির্ঘাত সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মৃন্ময়ী বেছে-বেছে বিশ্বাসযোগ্য দু-এক জন মানুষকে কল করার সিদ্ধান্ত নিতেই তার সামনে প্রভাত উপস্থিত হলো। প্রভাত তার চিন্তাগ্রস্থ মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি এখানে কী করছো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার একটা কল করতে হবে। তুমি ভেতরে যাও, আমি আসছি।”
“আমি ভেতর থেকেই এসেছি। ডক্টরের সাথে কথা বললাম। সিজারিয়ান ডেলিভারি ছাড়া উপায় নেই। আমি বলেছি যেটা ভালো হয়, সেটাই করতে। মৃত্তিকা আর বাচ্চা সুস্থ থাকলেই হয়। আমরা সিদ্ধান্ত জানালেই ওনারা ডেলিভারির টাইম জানিয়ে দিবেন। টাকা-পয়সার কথা-ও আমি জেনে এসেছি। তাড়াতাড়ি চলো।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”
“কেন? কাকে কল করবে তুমি?”
“করব একজনকে।”
“কোনো সমস্যা?”
“না।”
প্রভাত চলে যেতে গিয়েও আবার থেমে গেল। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি টাকা নিয়ে চিন্তিত?”
মৃন্ময়ী বলল,
“হ্যাঁ, একটু চিন্তা তো হচ্ছেই।”
“কেন?”
“আমার আর মৃদুলার কাছে দিয়ে দিয়েছি। আরও কিছু টাকা লাগবে।”
“আচ্ছা, বাকি টাকা কার কাছে চাইলে?”
“চাইনি এখনও। জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি ওদের কাছে যাও।”
প্রভাত কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। মৃন্ময়ী শুধাল,
“কী? তাকিয়ে আছো কেন?”
“তুমি কি আদৌ আমাকে নিজের পরিবার ভাবতে পেরেছ মৃন্ময়ী?”
“এ আবার কেমন কথা?”
“আমাকে সামনে রেখে তুমি অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়া ধরেছে, এটা কেমন কথা?”
“ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি-”
তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রভাত বলল,
“যেমন ব্যাপার-ই হোক। কারোর কাছ থেকে টাকা ধার চাইবে না। চলো।”
“আরে আমার কথা তো শোনো।”
“কথা বাড়ি ফিরে শুনব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তাকে কেবিনের সামনে পৌঁছে দিয়ে সে শুধু বলল,
“মৃদুলাকে নিয়ে গিয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলো। আমি টাকা তুলে নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই সে প্রস্থান করল। মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মৃদুলা এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া কি রাগ করেছে?”
“অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়ার কথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়েছে।”
“এখন কোথায় গেল?”
“টাকা তুলতে।”
“ভাইয়াকে না বলে আগেই টাকা ধার চাওয়া উচিত হয়নি। কথাটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল আমার।”
“টাকা চাইনি। ও যেমনটা ভাবছে, আমি তো তা ভেবে টাকা ধার করার কথা ভাবিনি। ও তো কম করে না আমার পরিবার নিয়ে। তবু বারবার আমি ওর টাকা নিই কী করে বল? কিছু টাকা ধার করলে কি আমি পরে শোধ করে দিতে পারতাম না? ওর জন্যই তো এখন আমার আগের মতো টানাপোড়েন নেই। ওকে তা কে বুঝাতে?”
মৃদুলা বলল,
“বুঝাতে হবে না। তোমার থেকে ভাইয়া ভালোই বোঝে। তুমি তাকে অসন্তুষ্ট কোরো না আর।”

মৃত্তিকার ডেলিভারির পুরো টাকাটাই শেষে প্রভাত দিয়েছে। রাত দুইটায় মৃত্তিকা একজন কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তারা দুজনেই সুস্থ আছে। প্রভাত আর মৃন্ময়ী রাতে হসপিটালেই থেকে গেছে। রাতের খাবার রাহেলা বেগম রান্না করে প্রভাতের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সকালে মৃত্তিকাকে অপারেশন রুম থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সকালের খাবারটা-ও প্রভাত বাইরে থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। প্রভাত যখন মৃত্তিকাকে দেখতে গেল, সে তখন দুচোখে টলমল জল নিয়ে প্রভাতের দিকে তাকাল। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা মেখে বলল,
“আপনার কাছে আমি ঋণী থাকব ভাইয়া। আপনি না থাকলে এই বিপদের দিনে আমার বোনদের না জানি কত ভোগান্তি পোহাতে হত। আমি সুস্থ হয়ে চাকরি কনটিনিউ করার পর আমি আপনার পাওনা শোধ করে দিবো। আপনার এই উপকার আমি আজীবন মনে রাখব।”
প্রভাত বলল,
“এসব বলে আমাকে পর করে দিয়ো না মৃত্তিকা। আমি বলেছি না তোমরা যেমন মৃন্ময়ীর পরিবার, তেমনি আমার-ও পরিবার? ওর পরিবারের গুরুত্ব আমার কাছে কোনো অংশে কম নয়। আমাকে পরিবারের একজন ভাবলে ঋণ শব্দটা আর কখনও মুখে আনবে না। আপনজনদের কাছে আবার ঋণ কিসের? তোমার বাচ্চা-ও এখন থেকে আমাদের পরিবার। তুমি নিজেই যদি আমাকে পরিবার না ভাবো, তোমার বাচ্চা ভাববে কীভাবে?”
মৃত্তিকা বলল,
“না-না ভাইয়া। আমরা কখনোই আপনাকে পর ভাবি না। আপনি সবসময় আমাদের পরিবার হয়ে পাশে থেকেছেন। আমার বাচ্চার তো ভাগ্য ভালো যে ও আপনার মতো পরিবার পেয়েছে।”
পাশ থেকে মৃদুলা বলল,
“আমাকে খালামনি হিসেবে পাওয়া-ও তোমার বাচ্চার সৌভাগ্য, হুহ্!”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তা দেখব খালামনি কেমন যত্ন করে।”
“দেখো, দেখো। বাড়ি চলো, তারপর তোমাকেই আমি শেখাব কীভাবে বাচ্চার যত্ন নিতে হয়।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যাক, তাহলে তো বাচ্চা নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।”

মৃন্ময়ীর স্কুলে যেতে হবে বলে, প্রভাতের সঙ্গেই তাকে ফিরে যেতে হলো। তার অবশ্য চিন্তা হচ্ছিল মা-বোনদের নিয়ে। মৃদুলা আর মা বলল তাদের সমস্যা হবে না। মৃন্ময়ী যেন ক্লাস শেষ করে আসে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই অফিসে চলে যাবে। বাইকে বসে প্রভাতকে চুপচাপ দেখে মৃন্ময়ী নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“এই, তুমি কি আমার সাথে রেগে আছো?”
প্রভাত ছোটো করে জবাব দিলো,
“উঁহু।”
“মিথ্যা বলছো।”
“মিথ্যা বলব কেন?”
“তুমি টাকার বিষয়টা নিয়ে আমার সাথে রেগে আছো। তাই না?”
“তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার সাথে রাগ করি না।”
“তাহলে কি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছ?”
“বাদ দাও, যা গেছে তো গেছে।”
মৃন্ময়ী বাদ দিলো না। প্রভাতের পেটের কাছের শার্টটা আরও একটু চেপে ধরে বলল,
“সরি গো। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এত অসন্তুষ্ট হবে। আসলে আমি ব্যাপারটা তেমনভাবে ভাবিনি।”
“তাহলে কেমনভাবে ভেবেছিলে?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি তো এইমাসে অলরেডি অনেক খরচ করে ফেলেছ। এটা যদি আমি সামলাতে পারি।”
“সব খরচ আর এক না। তুমি নিজে ব্যাপারটা সামলাতে চেয়েছ, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি তা করতেই পারো। কিন্তু অন্য কারো থেকে টাকা ধার নিয়ে কেন? ধার মানুষ কখন নেয়? যখন নিজেদের হাতে কোনো উপায় না থাকে। তোমার তো আমি ছিলাম। আমি তোমার নিজের মানুষ না। তুমি নিজের মানুষ রেখে অন্যদের কাছে কেন সাহায্য চাইবে?”
মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে সে সত্যিই ভুল করে ফেলেছে। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ভবিষ্যতে আর এমনটা কোরো না মৃন্ময়ী। তোমার যখন সবচেয়ে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, তখন আমি অধিকারের অভাবে যখন-তখন তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। এখনও যদি তুমি আমাকে সুযোগ না দাও, আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাব। তোমাকে সাহায্য করতে না পারার মতো বড়ো ব্যর্থতা আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আর করব না, প্রমিস। প্লিজ তুমি আমার সাথে রাগ কোরো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“রাগ করিনি। তুমি চা খাবে?”
“না, এখন চা খেলে দুজনেরই দেরী হয়ে যাবে।”


টিউশন থেকে ফিরেই মৃদুলা ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা চেঁচিয়ে ডেকে বলছে,
“হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। তোর জন্য আমিও না খেয়ে বসে আছি। বাবু জেগে গেলে খেতে পারব না।”
মৃদুলা দুর্বল কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে আপু। একটু জিরিয়ে নিই। তোমার বেশি ক্ষুধা পেলে খেয়ে নাও।”
“তাহলে আমি এতক্ষণ তোর জন্য বসে ছিলাম কেন? তোর বিশ্রাম শেষ হলে ডাকিস আমাকে।”
“আচ্ছা।”
ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুলা ফেসবুকে ঢুকল। মৃত্তিকার মেয়ের সঙ্গে আজ সে দারুণ কিছু ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। এখন নিউজফিডে ঢুকেই দেখল অনেক রিয়্যাক্ট, কমেন্ট পড়েছে। নোটিফিকেশন চেক করতেই মৃদুলা চমকে উঠে বসে পড়ল। তার পোস্টে জাহিদের রিয়্যাক্ট! কী করে? চলে যাওয়ার পর জাহিদ তো আর এই আইডিতে অ্যাক্টিভ হয়নি। পরক্ষণেই সে খেয়াল করল জাহিদ তাকে ম্যাসেজ-ও দিয়েছে। অবিশ্বাস্য লাগল মৃদুলার। কাঁপা হাতে সে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখল অনেক বড়ো ম্যাসেজ। জাহিদ লিখেছে,
“কেমন আছো মৃদুলা? আমি খুব আশা করি তুমি ভালো থাকো। জানি আমি তোমাকে কেমন আঘাত করেছি। তবু আমি আশা রাখি তুমি ভালো থাকো। এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করার সাধ্য যে আমার নেই। এখানে আসার পর তোমার একটু খোঁজ নেওয়ার জন্য আমি প্রভাত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাই বোধহয় আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে কিছু সময়ের জন্য এই আইডি অ্যাক্টিভ করলাম। তুমি হয়তো ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে চিট করেছি। সে তুমি ভাবতেই পারো। সত্যিই তো, আমি তোমার বিশ্বাস রাখতে পারিনি, তোয়ায় ঠকিয়েছি। কিন্তু জানো, আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম মাকে মানানোর। জীবনে প্রথমবার আমি তোমার জন্য মায়ের হাত-পা ধরে অনুরোধ করেছিলাম। তবু আমি ব্যর্থ হয়েছি। মৃদুলা, তোমাকে ভালোবাসার দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। আর তোমাকে হারানো আমার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা। অমি জানি না এই তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে আমার ঠিক কত যুগ লাগবে। তবু বলব, তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। আমি তোমার স্মৃতিতে বাঁচার যোগ্যতা রাখি না। আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আমাকে ঘৃণা করে হলেও তুমি আবার প্রেমে পড়ো। জীবনে একজন সঠিক মানুষকে বেছে নিয়ো যে কোনোদিন তোমার বিশ্বাস ভাঙবে না। মাঝপথে তোমার হাত ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে না। তার সঙ্গে তুমি খুশি থেকো। তোমার ওই চাঁদমুখে দুঃখ শোভা পায় না। তোমার প্রাপ্য একটি সুন্দর, সুখী জীবন। আমার হয়তো আর কোনোদিন দেশে ফেরা হবে না। ফিরলেও হয়তো আর তোমার মুখোমুখি হব না। তাই আর তোমাকে মিছে সান্ত্বনা দিতে চাই না। তোমাকে এই ম্যাসেজের উত্তর দিতে হবে না। আমি এই আইডি নষ্ট না করলেও আজকের পর আর এটা আমার কাজে আসবে না। যদি কোনোদিন সম্ভব হয়, এই অপরাধীকে ক্ষমা কোরো। সবসময় ভালো থেকো মৃদুলা।”

আশপাশে কেউ না থাকলে এই মুহূর্তে হয়তো মৃদুলা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদত। কিন্তু তার ম্যাসেজ পড়া শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা আবারও তাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। মৃদুলার আর কাঁদা হলো না। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো উগড়ে ফেলা হলো না। একবার ভাবল খেতে যাবে না। মৃত্তিকা এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেছে ভেবে আবার না-ও করতে পারল না। গলাভর্তি কান্না গিলে নিয়ে সে ভাত খেতে গেল। পেট পুরে ভাত খাওয়ার পর না হয় সে কাঁদবে। সারারাত কাঁদবে। এতগুলো দিন যত কান্না সে জমিয়ে রেখেছে, আজ সমস্ত কান্নাকে সে একেবারে মুক্তি দিয়ে দিবে। আজকের পর যে তাকে নতুনভাবে বাঁচতে হবে। নতুন মানুষের জন্য হৃদয়ে নতুন জায়গা তৈরি করতে হবে। এমনটাই তো হওয়ার ছিল।


বারান্দায় কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছে মৃন্ময়ী। গাছগুলো অবশ্য প্রভাত এনে দিয়েছে। হঠাৎ করে তার খুব ফুলগাছের শখ হয়েছিল। প্রভাতকে বলার পরদিনই সে কিছু চারাগাছ নিয়ে হাজির হয়েছে। সেগুলো টবে লাগাতে-ও মৃন্ময়ীকে সাহায্য করেছে। মৃন্ময়ী রোজ দুবেলা করে গাছের যত্ন নেয়। সকালে নামাজ আদায় করার পর একবার, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার। রাতেও সে বারান্দায় বসে ফুলগাছ দেখে আর তাদের বড়ো হওয়ার অপেক্ষা করে। সে মনে-মনে কল্পনা করে গাছগুলো বড়ো হয়ে ফুল দেওয়ার পর তার বারান্দাটা কেমন দেখাবে। বারান্দা জুড়ে নানান রঙের ফুলে অবশ্যই সুন্দর দেখাবে। আচ্ছা, মৃত্তিকার মতো তার কোল জুড়ে-ও যদি ফুলের মতো একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসে, সে-ও নিশ্চয়ই তার ঘর সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিবে? ইদানীং প্রভাত খুব বাচ্চাদের গল্প করছে। মৃত্তিকার বাচ্চাকে যতবার দেখে আসছে, ততবারই বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ীকে বলছে তার ঘরে আরও একজন সদস্য দরকার। মৃন্ময়ী নিজেও এখন বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। এখন তার চাকরি-বাকরির ঝামেলা মিটে গেছে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে সে। চাকরিটা পাওয়ার পর আগের স্কুল, কোচিং দুটোই ছেড়ে দিয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়েও তার দুশ্চিন্তা নেই। প্রভাত তার বেতন নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের ইচ্ছামতো সে খরচ করে। মায়ের ঔষধের খরচ প্রভাত যেচে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। এখন তার পরিবারে প্রয়োজনীয় খরচ দেওয়ার পরও তার হাতে টাকা অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকার খরচ সে নিজেই চালাতে পারে। আর তার বাচ্চা তো বড়ো হচ্ছে সবার দায়িত্ব। প্রথমদিকে মৃত্তিকা নিজেও ভাবতে পারেনি তার বাচ্চা এতগুলো মানুষের পরিবার হয়ে উঠবে। তারা তাকে পরিবারের অভাব টেরই পেতে দেয় না। মৃন্ময়ীর চিন্তা এখন শুধু মৃদুলার জন্য। মেয়েটা পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত তার দিকটা মৃন্ময়ীকেই দেখতে হবে।

“কী আকাশ-কুসুম ভাবছেন ম্যাডাম?”
প্রভাতের ডাকে মৃন্ময়ীর ভাবনায় ছেদ পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“কিছু না।”
“অবশ্যই কিছু ভাবছিলে। নয়তো আমার উপস্থিতি টের পেলে না কেন?”
“কতকিছুই ভাবছিলাম।”
“তা ম্যাডামের ভাবনায় কি এই অধমের ঠাঁই হয়েছিল?” মৃন্ময়ীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে শুধাল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুমমম।”
“কী ভাবা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে?”
“ভাবছিলাম কোন ভালো কাজের উপহারস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা আমার পোড়া কপালে একজনকে লিখে দিয়েছিলেন।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“পোড়া কপালে?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে দুহাতে প্রভাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একজন মলম লাগিয়ে সারিয়ে নিয়েছে।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“কেউ কি আমার প্রশংসা করছে।”
“তোমার প্রশংসা কে করছে? আমি তো আমার বরের কথা বলছি।”
“ওওও…আপনার বর আপনাকে এত ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
“বাহ্! ভীষণ গর্বিত দেখছি। তা আপনি আপনার বরকে কতটুকু ভালোবাসেন?”
“তার মতো করে হয়তো ভালোবাসতে পারি না। তবে অনেক ভালোবাসি।”
“অনেক?”
“হ্যাঁ, অনেক।”
“তাহলে তো আপনার বরকে ভাগ্যবান বলা যায়।”
“উঁহু, ভাগ্যবতী তো আমি। তাকে জীবনে না পেলে হয়তো আমি একজন প্রকৃত প্রেমিককে হারাতাম। ভেতর থেকে কোনোদিন অনুভব করতে পারতাম না পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছে যার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার দুঃখে সে দুঃখ পায়, আমার আনন্দে সে আনন্দিত হয়। সে আমার জীবনের জাদুকর। সে নিজেও জানে না আমার টানাহেঁচড়ার জীবনটাকে সে কতটা বদলে দিয়েছে। আমাকে সে আগাগোড়া সুখী মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই সুখ তোমার পাওনা ছিল ম্যাডাম। আর তোমাকে বিয়ে না করলে আমার ভাগ্য বদলাত কী করে? এদিক থেকে আমি নিজেই তো ভাগ্যবান। তুমি আমায় সংসারের মায়ায় না বাঁধলে হয়তো আজীবনই আমি ভবঘুরে, বেপরোয়া প্রভাত তরফদার থেকে যেতাম। নয়তো কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিল আমার মতো মানুষ একদিন বাধ্য স্বামীতে পরিণত হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি বাধ্য স্বামী?”
“অবশ্যই। তোমার তাতে কোনো সন্দেহ আছে?”
“না-না, তুমি তো খুব বাধ্য স্বামী। আমার কথায় ওঠো, বসো, খাও, ঘুমাও, সব করো। একদম বউভক্ত স্বামী।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি যে খাস বউভক্ত, তাতে অন্তত তোমার সন্দেহ থাকা উচিত নয়। নয়তো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না কেন?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের বাহুতে চিমটি কে’টে বলল,
“তুমি তো এক নির্লজ্জ, একটাদিন-ও তোমার জন্য শান্তিতে বাবার বাড়ি থাকতে পারি না। ঢেংঢেং করে পেছন-পেছন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হাজির হও।”
“আমি আজীবন এমন নির্লজ্জ-ই থাকতে চাই। আমার বউকে আমি ছাড়ব কেন? এমনিতেই জীবনের কতগুলো সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আমায় পাত্তা না দিয়ে আরও সময় নষ্ট করেছ। আমার অবশ্যই উচিত জীবনের বাকি সময়ের পুরোটা তোমার সঙ্গে কা’টানো। এতেও কি তোমার আপত্তি আছে?”
“আমার আপত্তি থাকলে কি তুমি আমার কথা শুনবে?”
“অবশ্যই না। এমন আপত্তি আমি মোটেও অ্যালাউ করব না। তুমি আমার বউ, সবসময় আমার কাছাকাছি থাকবে। এতে আমাদের ভালোবাসা আরও-আরও-আরও বাড়বে। এতে তোমার আপত্তি থাকা কি উচিত?”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“একদমই না।”
প্রভাত তার নাক টিপে দিয়ে বলল,
“এইতো আমার লক্ষ্মী বউ বুঝতে পেরেছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফাজিল একটা। সরো, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
প্রভাত তাকে আটকে রেখে আদুরে গলায় বলল,
“শোনো না।”
“শুনছিই তো, বলো।”
“মৃত্তিকার বাবুটা আজ কী করেছে জানো? আমি গিয়ে কোলে নেওয়ার পর একহাতে আমার শার্ট মুঠোয় শক্ত করে যে ধরেছিল, মৃত্তিকা-ও ছাড়াতে পারছিল না। আমার যে কী ভালো লাগছিল তখন!”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আদর পেয়ে-পেয়ে ও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে।”
“হুম। এই, আমাদের-ও ওর মতো একটা বাবু থাকলে অমন কিউট-কিউট আচরণ করবে, তাই না?”
“সব বাচ্চারাই অমন কিউট আচরণ করে।”
“সব বাচ্চাদেরটা তো আমরা সবসময় দেখতে পারি না। ঘরে থাকলে তো চব্বিশ ঘন্টা দেখতে পারব, আদর করতে পারব।”
“সে-ই, কথার মাঝে একশোটা প্যাঁচ না দিয়ে সোজাসুজি বললেই হয়।”
“আমি তো সবসময় বলি, তুমিই তো এখনও পরিষ্কারভাবে কিছু বলছো না।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, তোমার ছেলে চাই, না মেয়ে চাই?”
“আল্লাহ্ যা দিবে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহর পরিকল্পনার চেয়ে তো আমার চাওয়া বড়ো না।”
“ভেরি গুড। তাহলে তোমার ছেলে-মেয়ের নাম খোঁজা শুরু করো।”
প্রভাত চোখ দুটো গোলাকার করে বলে উঠল,
“সত্যি?”
“হুম।”
“তুমি সিরিয়াস?”
“অবশ্যই।”
খুশিতে প্রভাত মৃন্ময়ীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,,
“থ্যাংক ইউ বউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমি প্রচণ্ড খুশি।”
“খুশিতে আমাকেই মে’রে ফেলো না।”
প্রভাত হাতের বাঁধন আলগা করে বলল,
“সরি, বেশি এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“কিন্তু আমি চিন্তায় আছি আল্লাহ্ আমাদের সন্তান দিলে ওকে সময় দিবো কীভাবে? আমি তো সারাদিন থাকি স্কুলে।”
প্রভাত বলল,
“তাতে কী? তোমার সাথে যারা চাকরি করে, তাদের বুঝি বাচ্চা নেই? আমি আছি তো।”
“তোমার-ও তো কাজের ব্যস্ততা।”
“বাড়িতে মা আছে না? সে দেখবে। একটু বড়ো হলে তখন তুমি-আমি দুজনেই সঙ্গে রাখতে পারব। ওসব নিয়ে ভেবো না তো। সবাই মিলে ঠিক সামলে নেওয়া যাবে।”
“আর যদি হয় তোমার মতো বেপরোয়া?”
“হলেই সমস্যা কোথায়? তুমি সামলে নিতে পারবে।”
“কীভাবে?”
“আমাকে সামলাতে পারলে বাচ্চাকে পারবে না কেন?”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বলল,
“দারুণ উদাহরণ।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“একটা পরিপূর্ণ পরিবার পাওয়ার পর আমার জীবনে আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকবে না ম্যাডাম। ওপরওয়ালার কাছে আমি সবসময় তোমাকে চেয়েছি, তিনি আমার জীবনে তোমাকেই জুড়ে দিয়েছেন। এরপর তোমার ছোট্ট একটা অংশ যেদিন আমাকে বাবা বলে ডাকবে, ব্যস, এ পৃথিবীতে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে। এক জীবনে সুখী হতে এরচেয়ে বেশি কিছু আর আমার চাই না।”

~সমাপ্ত~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে