মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২০

0
7

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২০.
শুক্রবার। মৃদুলার জন্য বিশেষ দিন। বরাবরের মতো সে নিজেকে সাজিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। তারপর থেকে সে টানা আধঘন্টা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। জাহিদের অপেক্ষায়? নাহ্! এখন আর তাকে কারো জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে বিরক্তি আসে না। বারবার রাস্তার দিকে তাকাতে হয় না। সে জানে তার অপেক্ষা থেমে গেছে। তবু কোন ব্যর্থ আশায় তার মন বারবার এভাবে ছুটে আসে, জানে না সে। আধঘন্টা পর কোত্থেকে এক বাইক এসে থামল তার সামনে। মৃদুলা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। হেলমেট খুলে প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“কী? এখনও চিনতে পারনি?”
কপালের ভাঁজ মিলিয়ে নিয়ে মৃদুলা বলল,
“ভাইয়া, আপনি কোত্থেকে এলেন?”
“মহাকাশ থেকে টপকে এলাম। কারণ কোনো এক এলিয়েন আমার কানে-কানে খবর দিলো আমার ছোটোবোন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিরহবিলাস করছে।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“ধুর! আপনি বাইক কিনলেন কবে?”
“কিনলাম গতকাল। তোমার আপাকে নিয়ে মাঝে-মাঝে আকাশে ওড়ার জন্য।”
“বাহ্! আপনার বাইক-ও আকাশপথে চলে?”
“তোমার আপা সাথে থাকলে আমি নিজেই তো আকাশপথে চলি, বাইক কেন নয়?”
“আচ্ছা, বুঝলাম। কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“যাচ্ছিলাম না, তোমার খোঁজেই এলাম।”
“হঠাৎ আমার খোঁজ কেন?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন? আমি কি তোমার খোঁজ নিতে পারি না? বোনদের খোঁজ নেওয়া বারণ?”
“না, এমনিতেই বললাম।”
প্রভাত গাড়িটা পার্ক করে রেখে বলল,
“চলো, কিছু খাই। বেশিক্ষণ বসব না আমি।”
“এখন আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে আমি খাই, তুমি দেখো। এসো।”

প্রভাত মৃদুলাকে নিয়ে পাশের ছোটো রেস্ট্রন্টে বসল। হালকা কিছু খাবার অর্ডার দিলো। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার কী খবর?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আপার খবর জানতে না চেয়ে আমার খবর জানতে চাও। তোমার আপা সবসময়-ই বিন্দাস আছে। চব্বিশ ঘন্টা আমাকে শাসনের মধ্যে রাখছে। বিয়ে করে ঘরে বউ না, অভিভাবক তুলেছি আমি।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন?”
“আরে নাহ্! কী বলছো? আমি ধৈর্য হারাব কেন? ধৈর্য হারানোর কথা তো তোমার আপার, আমার মতো মানুষকে ও সামলাচ্ছে। ও যেখানে ধৈর্য হারাচ্ছে না, আমি হারাব কোন সাহসে? এত কষ্ট করে বিয়ে করেছি কি ধৈর্য হারানোর জন্য?”
“হুম, তা ঠিক। লাস্টবার বাড়ি এসে আপা মায়ের থেকে আপনার পছন্দের পিঠা বানানো শিখে গিয়েছিল। বানিয়ে খাইয়েছে আপনাকে?”
প্রভাত চোখ বড়ো করে বলে উঠল,
“বলো কী! সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
প্রভাত অত্যধিক খুশি হয়ে বলল,
“খাওয়াবে হয়তো সময় পেলে। খবরটা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার আপা যেদিন আমাকে ওই পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে, সেদিন অবশ্যই তাকে আমি বিশেষ পুরষ্কার দিবো।”
“তাহলে তো আমি ভুল করে ফেললাম। আপা হয়তো আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। আমি তার বারোটা বাজিয়ে দিলাম। যাহ্!”
“ব্যাপার নাহ্। তোমার আপাকে আমি বলব না আমি জেনে গেছি।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
একটু চুপ থেকে প্রভাত প্রশ্ন করে বসল,
“তুমি কি সত্যিই মুভ অন করতে পেরেছ মৃদুলা?”
মৃদুলা মৃদু হেসে শুধাল,
“এখনও সন্দেহ আছে?”
“আছে বলেই তো জানতে চাইছি।”
“কেন? আমি কি আপনার সাথে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলছি?”
“কথা ঘুরিয়ো না। সোজাসাপ্টা উত্তর দাও।”
“ধুর! এসব কোনো বিষয় হলো? মুভ অন করতে পারব না কেন? অবশ্যই পেরেছি।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যিই কি পেরেছ?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আজ কার জন্য বেরিয়েছ?”
“টিউশন ছিল।”
“আমি জানি শুক্রবার তোমার টিউশন নেই।”
“সন্ধ্যায় আছে। ছুটির দিন একটু ঘোরাফেরা করার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি।”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“অন্যকে মিথ্যা বুঝানো গেলেও, নিজেকে বুঝানো যায় না মৃদুলা। তুমি জানো জাহিদ আসবে না। তবু কোন আশায় ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকো?”
মৃদুলার মুখটা নিমেষেই কেমন মলিন হয়ে গেল। এদিক-ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সে বলল,
“আমি কারোর আশায় বাঁচি না।”
“এ কথা অন্তত আমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা কোরো না। তোমাদের সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমি জানি তোমার পরিস্থিতি।”
মৃদুলা মিইয়ে পড়া স্বরে বলল,
“জেনে কী হবে ভাইয়া? কিছু তো আর পরিবর্তন হবে না।”
“জানি কিছু পরিবর্তন হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে না পারলেও নিজেকে তো পরিবর্তন করতে হবে। এক জায়গায় আটকে থেকে তুমি কখনোই জীবনযাপন করে শান্তি পাবে না।”
“এটাই তো ও চেয়েছিল, আমার জীবন থেকে যেন সমস্ত শান্তি হারিয়ে যায়।”
“তোমাকেই এটা পরিবর্তন করতে হবে। তোমার বয়সটা নিতান্তই কম। আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখলে গোটা একটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। তোমার জীবনের জন্য তোমাকেই ভাবতে হবে। মনে রাখবে, এটা তোমার জীবন। তোমার মূল্যবান জীবনকে নষ্ট করার অধিকার পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই। তারজন্য আগে নিজের জীবনের মূল্য নিজেকে বুঝতে হবে। নিজের জীবনের মূল্য বুঝার পর দেখবে তুমি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া সৃষ্টিকর্তা কার কপালে কী লিখে রাখেন বলা যায় না। হতেও পারে তোমার জন্য তিনি আরও ভালো কাউকে ঠিক করে রেখেছেন। তাই ভুল মানুষকে আগেভাগেই সরিয়ে দিয়েছেন। আমার মতে ভালোই হয়েছে ভুল মানুষটা তোমার জীবন থেকে দ্রুত সরে গেছে। আরও কয়েক বছর থেকে গেলে তোমার জন্য মুভ অন করা আরও কষ্টকর হয়ে যেত। তাই বলছি ধৈর্য ধরো। ভাগ্য মেনে নাও।”
মৃদুলা বলল,
“আমি সবই বুঝি। আপনি এত চিন্তা করবেন না ভাইয়া। আমাকে আরেকটু একটু সময় দিন। জীবনের প্রতি অবিচার করার মতো মানসিকতা অন্তত আমার নেই।”
“আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবই বোঝো। তবু আমার যতটুকু বলা প্রয়োজন মনে হয় বলি। আমি চাই তুমি যেন এসব কা’টিয়ে উঠতে পারো।”
মৃদুলা মাথা নেড়ে বলল,
“পারব। ধন্যবাদ ভাইয়া।”
“কেন?”
“আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য।”
প্রভাত বলল,
“তুমি আমার জন্য যা করেছ, তার কাছে এসব কিছুই না।”
মৃদুলা হাসল। বলল,
“আমি আপনার জন্য কিছুই করিনি। যা কিছু করেছি আমার আপার জন্য। আমি জানতাম আমার আপা লাকি হবে।”
প্রভাত ভাব নিয়ে বলল,
“ইনডিরেক্টলি আমার-ই প্রশংসা করলে।”

খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে প্রভাত নানান কথায় মৃদুলাকে হাসানোর চেষ্টা করল। মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগে। মৃন্ময়ীর সাথে তার বিয়ের ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ জাহিদ তার কাছে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সবসময়ের মতো তার সাথে চা খেয়েছিল। বাড়ি ফেরার আগমুহূর্তে সে বলে বসেছিল পরদিন সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট। সে ইউরোপ যাচ্ছে। জাহিদের বাবা ইউরোপ থাকেন। গত দুই বছর ধরে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর দেশে আসার আর ইচ্ছা ছিল না তার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জাহিদ আপত্তি জানিয়েছিল। তার আপত্তি ধোপে টিকবে না বুঝে পড়াশোনার অযুহাতে মাকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তার মা-ও অপেক্ষায় ছিলেন কবে তার পড়াশোনা শেষ হবে। জাহিদ তখন বলেছিল পড়াশোনা শেষ করে সে ভেবে দেখবে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে দেশে থেকে যাওয়ার মতো আর কোনো পোক্ত অযুহাত তার কাছে ছিল না। তবু সে বাবা-মাকে বুঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি। কেউই তাকে সমর্থন করেনি। বাধ্য হয়ে সে মায়ের কাছে মৃদুলার কথা জানিয়েছিল। মৃদুলার পরিচয় শুনে বাবা-মা কেউই কোনোরূপ আগ্রহ দেখায়নি। উলটা তার মা দেশ ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। জাহিদ বরাবরই মা ভক্ত ছেলে। মা চলে গেলে তার এদেশে থাকার কোনো উপায় ছিল না। একবার গেলে যে আর সে ফিরবে না। মৃদুলাকে সে মন উজাড় করে ভালোবেসেছিল। তার হৃদয়ের অনেকটা অংশ জুড়ে মৃদুলা ছিল। মেয়েটাকে ঠকানোর কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না। অথচ ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে তাকে বিশ্বাসঘাতক সাজতে হয়েছিল। পরিবারের জন্য নেওয়া মাত্র একটা সিদ্ধান্তের কারণে মৃদুলার সমস্ত বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ছেলেটা সেদিন ছিঁচকাদুনে মেয়েদের মতো কেঁদেছিল। প্রভাতের দুহাত চেপে ধরে অনুরোধ করেছিল মৃদুলাকে যেন তার চলে যাওয়ার আগে খবরটা না দেওয়া হয়। আরও বলেছিল বিশ্বাস ভাঙার জন্য মৃদুলা যেন তাকে ক্ষমা না করে। সে ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। প্রভাতের কেবল শোনা এবং দেখা ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য ছিল না। সে জানত জাহিদ নিরুপায়। তবু সেদিনের পর থেকে সে জাহিদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি। তার অভিযোগ ছিল একটাই। ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে বুঝেও জাহিদ কেন পরিবারের থেকে লুকিয়ে মৃদুলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়েছিল? অনুভূতির জন্য এতটাও অন্ধ হওয়া ঠিক নয়, যা ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াবে। বিয়ের পর প্রভাত যখন মৃন্ময়ীর বাড়ি গিয়েছিল, তখন মৃদুলার মানসিক অবস্থা সে লক্ষ্য করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে সে মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তবু প্রভাত আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি। মৃদুলা নিজেই একদিন তার কাছে এসেছিল জাহিদের খবর জানতে। সেদিন আর সে কিছু লুকায়নি। জাহিদের প্রস্থানের খবরটা শোনার পর শক্তপোক্ত মেয়েটা তার সামনে চোখের পানি না ফেললেও, কতটা আঘাত পেয়েছিল, তা তার মুখ দেখেই প্রভাত বুঝতে পেরেছিল। সেই থেকেই সে মাঝে-মাঝে মৃদুলার খোঁজ-খবর নেয়। কারণ প্রভাত-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে মৃদুলার মানসিক অবস্থার বিষয়ে অবগত। মৃদুলার অনুরোধে সে মৃন্ময়ীকে-ও এসব বিষয় জানায়নি। সে আশা রাখে মৃদুলা ঠিক এই পরিস্থিতি কা’টিয়ে উঠতে পারবে। তবেই সে চিন্তামুক্ত হবে।


মৃন্ময়ী আজকাল রোজ খাবারের টেবিলের চিত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করে। বরাবরের মতো টেবিলে খাবার দিয়ে রাহেলা বেগমকে সরে যেতে দেয় না। নিজে তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসায়। প্রভাতকে-ও সে টেবিল ছাড়তে দেয় না। রোজ তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পালটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। মৃন্ময়ীর মুখে রাহেলা বেগমের জীবনকাহিনি শোনার পর থেকে অবশ্য তার আচরণে ধীরে-ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এখন আর রাহেলা বেগমের প্রতি তার খুব একটা ঘৃণা বোধ হয় না। কিন্তু মৃন্ময়ী যে রাহেলা বেগমকে মা ডাকার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, এটা তার জন্য জটিল। মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে বসানোর কথা সে ভাবতেই পারে না। এ কথা শুনলেই মৃন্ময়ী বলে,
“মায়ের জায়গায় বসাতে হবে কেন? তোমার মা তোমার মনে যে জায়গায় আছে, সে জায়গাতেই থাকবে। সে জায়গা তো আর কেউ দখল করতে পারবে না। তাই বলে যে তুমি আরেকজনকে মা ডাকতে পারবে না, এমন তো কোনো নিয়ম নেই। তুমি তার সন্তান নও, তবু সে তোমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করে। আর সে তোমার মা নয় বলে তুমি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসতে পারবে না? একজন মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না প্রভাত। এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি তো তোমার আছে। তবু কেন আমার এত বুঝাতে হচ্ছে?”
প্রভাত চুপ হয়ে যায়। তারপর আকাশ-পাতাল ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ে। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। প্রভাতকে পালটাতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজ তারা মার্কেটে গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। দরকারি কেনাকাটা করে প্রভাত মৃন্ময়ীর জন্য একটা শাড়ি-ও কিনেছে। শাড়িটা না কি মৃন্ময়ীর উপহার। গতকাল সে প্রভাতের পছন্দের পিঠা বানিয়ে খাইয়েছিল, তাই। সেই সুযোগে মৃন্ময়ী তাকে দিয়ে রাহেলা বেগমের জন্য-ও একটা শাড়ি কিনিয়েছে। বাড়ি ফিরে আবার প্রভাতকেই ঠেলে পাঠিয়েছে রাহেলা বেগমকে শাড়ি দিয়ে আসতে। প্রভাত বারবার বলছিল মৃন্ময়ীকে যেতে। কিন্তু মৃন্ময়ী তাকে দিয়েই শাড়ি দেওয়াবে। এদিকে অস্বস্তিতেই প্রভাতের পা বারবার থেমে যায়। মৃন্ময়ী আবার তাকে পেছন থেকে তাড়া দেয়। রাহেলা বেগম তখন ডাইনিংয়ে বসে লাউশাক কে’টে রাখছিলেন আগামীকালের রান্নার জন্য। প্রভাতকে আসতে দেখে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। প্রভাত তখন ইতস্তত ভঙ্গিতে শাড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। রাহেলা বেগম প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
“কী এটা?”
প্রভাত শুধু বলল,
“নিন।”
রাহেলা বেগম মনে প্রশ্ন নিয়েই প্যাকেটটা নিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী এসে তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ততক্ষণে রাহেলা বেগম প্যাকেট খুলে বুঝেও গেছেন ভেতরে কী আছে। রাহেলা বেগম হঠাৎ চোখেমুখে একপ্রকার উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললেন,
“তুমি এনেছ বাবা?”
প্রভাতের আগে মৃন্ময়ী দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলে উঠল,
“জি আম্মা। আমার জন্য আর আপনার জন্য কিনেছে।”
প্রভাত মিনমিনে গলায় বলল,
“মৃন্ময়ী পছন্দ করেছে।”
রাহেলা বেগম হাসিমুখে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ্ বাবা, সুন্দর শাড়ি।”
রাহেলা বেগম হাসছেন, অথচ তার চোখ ছলছল করছে। প্রভাত সে হাসিমুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দ্রুত প্রস্থান করল। প্রভাত যেতেই মৃন্ময়ী খুশিমনে প্রশ্ন করল,
“আম্মা, আপনি খুশি হয়েছেন?”
রাহেলা বেগম আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“অনেক খুশি হয়েছি মা। আমার ছেলে এই প্রথম আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। আমি খুশি না হয়ে পারি?”
“শাড়িটা পছন্দ করে দিয়েছি কিন্তু আমি। আপনার ছেলের পছন্দ একদম ভালো না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আমি তো বলব আমার ছেলের পছন্দ একশোতে একশো। নয়তো তোমার মতো এমন বউ আনল কী করে?”
মৃন্ময়ী লজ্জা পেয়ে বলল,
“আমি তো শাড়ি পছন্দের কথা বললাম।”

মৃন্ময়ী আনন্দিত মনে ঘরে ফিরতেই প্রভাত টিপ্পনি কে’টে বলে উঠল,
“একজনকে বলতে শুনলাম আমার পছন্দ না কি ভালো না। সে কি নিজের রূপ নিয়ে সন্দিহান?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে ফেলে বলল,
“আরেকজন তাহলে আড়ি পেতে আমার আর আম্মার কথা শুনেছে?”
প্রভাত বলল,
“আড়ি কে পেতেছে? ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছিল।”
“ঘর থেকে মোটেও শোনা যাচ্ছিল না। আড়ি পেতেছিলে, তা-ই বলো।”
“নিজের ঘরে আড়ি কে পাতে? দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই কানে চলে এসেছে।”
“হয়েছে, আর নাটক করতে হবে না।”
প্রভাত দুই হাতে মৃন্ময়ীর গাল টিপে দিয়ে বলল,
“তা আমার নায়িকার রূপ নিয়ে এত সন্দেহ কেন শুনি?”
মৃন্ময়ী তার হাতে মৃদু চড় মে’রে বলল,
“আমি শাড়ির কথা বলছিলাম।”
“ওওও, আর তোমার শাশুড়ি কী বলল?”
“আমার শাশুড়ি কী? তোমার মা বলো।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুই হাত মুঠোবন্দী করে সবগুলো আঙুল তার আঙুলের ভাঁজে বন্দী করে নিল। তারপর বলল,
“এবার বলো তো আমার পছন্দ কেমন?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ছাড়া সব বাজে।”
“তুমি ছাড়া সব বাজে?”
“হুম।”
“সবের মধ্যে তুমি পড় না?”
“না।”
“কে বলেছে?”
“তোমার মা।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ঠোঁটে, কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“এটা-ও আমার পছন্দ।”
মৃন্ময়ী কোনোমতে হাসি আটকে বলল,
“বাজে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“শিওর?”
“উফ্! হাত ছাড়ো তো। তোমার ফাজলামি দেখার সময় নেই। আমার কাজ আছে।”
“এই রাতে বেচারা বরকে ঘরে ফেলে রেখে তোমার আর কাজ কী?”
“খাওয়ার পর যে থালা-বাসন রেখে দিয়েছি, ওগুলো কি জিন-পরী এসে ধুয়ে দিবে?”
“আমি থাকতে তোমার আবার জিন-পরী লাগে? চলো আজ আমি তোমার জিন হয়ে যাই।”
“তোমার কাজের নামে অকাজ বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। তুমি আমার হাত ছাড়ো, তাহলেই হবে।”
মৃন্ময়ী হাত মোচড়াতেই প্রভাত তার আঙুলগুলো মুক্ত করে দিলো। ছাড়া পেয়ে মৃন্ময়ী হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,
“উফ্! আঙুলগুলো একদম ব্যথা বানিয়ে দিয়েছ।”
“সরি বউ।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুহাতের আঙুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তার চুলগুলো ঠিক করে দিতে-দিতে ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ম্যাডাম। অপেক্ষা করিয়ে বুকব্যথা বাড়িয়ো না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে