মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১২+১৩

0
2

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
প্রভাতকে জানানোর পর থেকে মৃত্তিকাকে বিরক্ত করা তো দূর, শফিক আর তার সামনে-ও আসছে না। মৃন্ময়ী প্রভাতকে জিজ্ঞেস করেছিল সে শফিককে কীভাবে আটকাল। প্রভাত হাসতে-হাসতে শুধু উত্তর দিয়েছে, “ওইটুকু পুঁচকে ছেলেকে শায়েস্তা করা কী এমন আহামরি কাজ? বেচারা ভয় পেয়েছে, আর বিরক্ত করবে না। এর বেশি জেনে তোমার কাজ নেই।” কিছুতেই প্রভাতের পেট থেকে সত্য কথাটা বের করা যায়নি। উলটো সে মৃন্ময়ীর কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
“আমি তো তোমার সমস্যার সমাধান করে দিলাম, এবার তুমি আমার সমস্যার সমাধান করে দাও।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোমার আবার কী সমস্যা?”
“আমার বউ নেই, এটাই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। কবে আমার বউয়ের অভাব পূরণ করছো বলো।”
“যেদিন পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হবে, সেদিন।”
প্রভাত হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝেছি, এবার আমাকেই শক্ত একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। মিষ্টি কথা খরচ করে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,
“কী ব্যবস্থা নিবে, শুনি?”
“তা কি আমি তোমায় বলব? তুমি শুধু বউ সাজার প্রস্তুতি নাও, বাকিটা সময় বলে দিবে।”
মৃন্ময়ী মৃদু হাসল। প্রভাত সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
“হাসছো যে? তুমি কি বউ সাজার কথা শুনে খুশি হলে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, তোমার কনফিডেন্স দেখে।”
“কনফিডেন্স আমার সবসময়ই আছে। এবার শুধু কনফিডেন্সকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পালা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা, শুভকামনা রইল তোমার জন্য।”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“লাভ ইউ।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকাল। তবে প্রভাতের হাসি-হাসি মুখে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। প্রভাতের ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেখা মুছল না। আজকাল মৃন্ময়ী তার সাথে অনেকটাই সহজ হয়েছে। আগের মতো হুটহাট রাগ দেখায় না। ব্যাপারটা প্রভাত ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে মন খারাপ হলেও মৃন্ময়ী এখন তা প্রভাতের কাছে বলতে দ্বিধা করে না। প্রভাত এতেই ভীষণ খুশি। মৃন্ময়ীর এই সহজ রূপটাই তো সে সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে সে কিছুটা হলেও সফল হলো। বাকি সাফল্যটুকু-ও সে যেকোনো মূল্যে জয় করে নিবে।

সবেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে মৃন্ময়ী। ডানহাতে একটা নীল পলিথিন। মৃত্তিকার জন্য কিছু জলপাই কিনে নিয়ে এসেছে সে। এই সময় মৃত্তিকা আর মা নিশ্চয়ই কাঁথা সেলাই করছে। আজকাল রোজ বাড়ি ফিরেই সে দেখে মা আর মৃত্তিকা বাচ্চার জন্য ছোটো-ছোটো কাঁথা সেলাই করছে। দৃশ্যটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে মৃন্ময়ীর। মৃত্তিকার সাথে মায়ের বেশ ভাব হয়েছে। এটা খুব দরকার ছিল। ভাবতে-ভাবতে মৃন্ময়ী ঘরে ঢুকতেই খানিক থমকাল। বসার ঘরে মায়ের সঙ্গে চার-পাঁচটা অপরিচিত মহিলা বসে গল্প করছে। মৃন্ময়ী তাদের কাউকেই চেনে না। অকস্মাৎ সে সালাম জানাতে-ও ভুলে গেল। সাজেদা বেগম তাকে দেখেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এই তো আমার মেয়ে চলে এসেছে।”
তারপর মৃন্ময়ীকে বললেন,
“সালাম দে, ওনারা তোর জন্যই এসেছে।”
অগত্যা মায়ের কথামতো মৃন্ময়ী সালাম জানাল। সাজেদা বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে এসে তাকে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে আয়। ওনারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।”
মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে ঘরে ঢুকতে যেতেই আবার রান্নাঘরে শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল। মৃদুলাকে দেখল কড়াইতে কিছু ভাজছে। সে বলে উঠল,
“মৃদুলা, তুই আজ টিউশনে যাসনি?”
মৃদুলা উত্তর দিলো,
“মা যেতে দেয়নি।”
“কেন?”
মৃদুলা হেসে উঠে বলল,
“বাড়িতে এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটবে, আমি অনুপস্থিত থাকলে কী করে হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“কিসের মারাত্মক ব্যাপার? আর ওই মহিলারা কারা?”
মৃদুলা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“তাদের আমি চিনব কী করে? এখনও তো আত্মীয়তা-ই হলো না। তুমি ঘরে যাও তো আপা। ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে আমার দেওয়া শাড়িটা নামিয়ে পরো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমার কাজে ডিস্টার্ব হচ্ছে। এই দেখো, তোমার সাথে কথা বলতে-বলতে কয়েকটা পিঠা বেশি ভেজে ফেলেছি। যাও, যাও।”
“আশ্চর্য!”

মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে দেখল তার ঘরে বসে মৃত্তিকা কাঁথা সেলাই করছে। তাকে দেখেই সে বলল,
“এতক্ষণে এলি তুই? সেই কখন থেকে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। কী এনেছিস রে?”
মৃন্ময়ী জলপাইয়ের প্যাকেটটা মৃত্তিকার কোলের ওপর রাখল। মৃত্তিকার হাসি-হাসি মুখ দেখে মনে হলো জলপাই পেয়ে সে খুশি হয়েছে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে মৃন্ময়ী বলল,
“বাসায় কী হচ্ছে একটু বলবি আমাকে? ওই মহিলারা কোত্থেকে এসেছে?”
“কোত্থেকে এসেছে তা একমাত্র মা জানে। আমি শুধু এটুকু জানি যে তারা তোকে দেখতে এসেছে।”
“তা তো মায়ের তাড়া দেখেই আমি বুঝে গেছি। কিন্তু এদের আমাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলো কে?”
মৃত্তিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“জানি না। মা নিজেই সকালে আমাকে বলল। তারপর নিজেই সারাদিন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল। তোকে জানিয়ে দিই কি না, সেই ভয়ে তেমন কিছুই বলেনি আমাকে।”
“কী মুশকিল! মা কি বাচ্চা, বল? এতদিন তো এমন করেনি। হুট করে আবার তার মাথায় এসব বাচ্চামি জাগল কীভাবে?”
“মা-ই জানে। তুই দাঁড়িয়ে না থেকে জামাকাপড় পালটা, নয়তো মা এক্ষুনি এসে আবার তাড়া দিবে। আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছে তোকে যেন সুন্দর করে সাজিয়ে দিই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুই-ও কি মায়ের মতো পাগল হলি? জানিস না আমি এসব পছন্দ করি না?”
“আমি কী করব বল? মাকে এই কথা বল তুই, দেখ কেমন তেতে ওঠে। আমি একবার বলাতে আমাকে একশো ধমক দিয়েছে।”
মৃন্ময়ী বিরক্তিতে মুখে চ-সূচক শব্দ করে বলল,
“মা যে কী করে!”

বলতে-বলতেই সাজেদা বেগম দরজায় উপস্থিত হলেন। তাড়া দেখিয়ে মৃন্ময়ীকে বললেন,
“তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? জামা-কাপড় পাল্টাচ্ছিস না কেন?”
মৃন্ময়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
“এসবের মানে কী মা? তুমি আবার আমাকে না বলে এসব কাণ্ড শুরু করেছ? আমি বলেছি না এভাবে হুটহাট কাউকে বাড়ি আসতে বলবে না?”
“হুটহাট কোথায়? আমার সাথে কথা বলেই তো এসেছে।”
“তো তুমি আমাকে জানিয়েছ? আমাকে না জানিয়ে তুমি যাকে-তাকে আসতে বলো কেন? আমি তো তোমাকে বারবার বারণ করেছিলাম।”
সাজেদা বেগম তার কথা কানেই তুললেন না। উলটো বললেন,
“তাড়াতাড়ি কর, আমার যেন আর ডাকতে আসা না লাগে। এই মৃত্তিকা, ওকে রেডি করে দে।”

মৃত্তিকা কিছু বলতেও পারল না। সাজেদা বেগম তাড়া দিয়ে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃত্তিকা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কী করব? আগে জানলে তো জানাতাম তোকে। এখন আর রাগ করিস না প্লিজ। মা কেমন তা তো জানিসই। মহিলারা যখন এসে বসে আছে, তাদের তো তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সামনে যা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি বিয়ে-ই যখন করব না, তখন সামনে যাব কেন? আশ্চর্য!”
“সামনে গেলেই তো তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে না। ওনারা চলে যাওয়ার পর না হয় তুই মায়ের সাথে কথা বলিস। এখন তো বাইরের মানুষের সামনে কিছু বলতে পারবি না।”

মহাবিরক্তি নিয়েই শেষে মৃন্ময়ী ভালো জামা পরল। কিন্তু তাকে সাজানো গেল না। মৃদুলা সাজতে বলে উলটো বকা খেয়ে গেল। মহিলাদের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী ভদ্র আচরণ করলেও তার মনের মধ্যে বিরক্তি টগবগ করছিল। কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছা করছিল না। তবু ভদ্রতার খাতিরে দিতে হলো। মায়ের প্রতি তার রীতিমতো রাগ উঠে গেল। মা তাকে নিয়ে মহিলাদের কাছে এমন মিষ্টি-মিষ্টি বুলি আওড়াচ্ছিলেন, যেন আজই তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। মৃন্ময়ী শুধু অপেক্ষায় ছিল কখন মহিলারা বিদায় হবেন। বিদায়ের সময় মহিলারা আবার বলেও গেলেন বাড়ি ফিরে তারা তাদের ছেলেকে পাঠানোর দিন বলে দিবেন। তাদের বিদায় জানিয়েই মৃন্ময়ী মাকে চেপে ধরল। জানতে চাইল এদের সে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। সাজেদা বেগম বললেন,
“আমি তুলে আনতে যাব কেন? তারাই আমাকে ধরেছিল, আপনার মেয়েকে দেখতে যাব। তাদের ছেলের খোঁজ-খবর নিয়ে শুনলাম ভালো ছেলে, তাই আসতে বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“তুমি আবার ছেলের খোঁজ-খবরও নিয়েছ? মানে তুমি এতদূর এগিয়ে গেছ, অথচ আমাকেই জানানোর প্রয়োজন মনে করনি?”
“তোকে কী জানাব? জানালে তুই ‘না-না’ ছাড়া কিছু বলতি? আমার দায়িত্ব আমার মেয়েকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেওয়া, আমি তা-ই করছি।”
“তোমাকে এত দায়িত্ব পালন করতে হবে না মা। আমি হাজারবার তোমাকে বলেছি তুমি আর যা-ই করো, অন্তত আমার বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমার কথা তুমি কেন শোনো না?”
সাজেদা বেগম রাগত মুখে বললেন,
“বিয়ে নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না তো কে ঘামাবে? তুই যে কোন চিন্তা-ভাবনা করে বসে আছিস, তা কি আমি জানি না? আজীবন কি তুই এই বাড়ির খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি? নিজের দিকে তাকানো লাগবে না?”
“আমার চিন্তা আমি করি মা, তোমাকে করতে হবে না। আমি যেমন আছি ভালো আছি, এরচেয়ে আর ভালোর চিন্তা করার দরকার নেই।”
“কী ভালো আছিস তুই? এই তোর ভালোর নমুনা?”
“তোমরা আমাকে ছেড়ে দয়া করে নিজেদের ভালোর দিকে তাকাও।”
“আমাদের ভালো তোকে সারাজীবন অবিবাহিত থেকে দেখতে হবে না। এত বছর যথেষ্ট দেখেছিস। এখন নিজের কথা ভাব। এই মহিলারা তাদের ছেলে পাঠাবে। পছন্দ হলে আর সব ঠিকঠাক থাকলে এবার তোকে বিয়ে করতেই হবে। এবার আর আমি তোর কোনো কথাই শুনব না।”
সাজেদা বেগম একটু উঁচু গলায় কথাগুলো বলে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী এত কথা বলল, তার কিছুই তিনি শোনার প্রয়োজনবোধ করলেন না। মৃত্তিকা আর মৃদুলা অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। মৃত্তিকা মিনমিনে গলায় বলল,
“বিয়েটা এবার কর আপা। এমন করিস না। বয়স পেরিয়ে গেলে আর কবে নিজের সংসার সাজাবি?”
মৃদুলা-ও বলল,
“হ্যাঁ আপা, আর না-না কোরো না। এবার বিয়েটা করেই নাও। তোমার একটা সংসার হলেই মা অনেকটা চিন্তামুক্ত হতে পারবে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোরা-ও দেখছি মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এক সুরে কথা বলছিস। কর, সবাই মিলে আমার চিন্তা কর। নিজেদের চিন্তা আর করা লাগবে না। আমিও দেখব তোদের চিন্তা কে করে। আছি বলে তো মূল্য বুঝতে পারছিস না। বিদায় করে দেখ একবার, তখন বুঝবি বাস্তবতা কী।”
আপনমনে বকতে-বকতে মৃন্ময়ী ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা আর মৃদুলা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মৃত্তিকা হতাশ গলায় বলল,
“একে বুঝানো আমার কাজ নয় বোন।”
মৃদুলা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার নিজের আত্মবিশ্বাসী সত্তা জাগিয়ে তুলে দৃঢ় গলায় বলল,
“নাহ্! হাল ছাড়লে চলবে না। এবার আপাকে রাজি করাতেই হবে। আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।”
মৃত্তিকা জোরপূর্বক হেসে বলল,
“অল দ্যা বেস্ট।”


মৃন্ময়ী আজ ভীষণ চুপচাপ। প্রভাত বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও সে কেবল হুঁ-হা উত্তরে সাড়া দিয়েছে। প্রভাত কিছু পথ হাঁটার পর নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী এবার মুখ খুলল। তবে বেশ চড়া গলায় বলে উঠল,
“তোমার কেন মনে হয় সবসময় আমার বাসাতেই শুধু সমস্যা হয়? দুনিয়ার আর কোথাও কি কোনো সমস্যা নেই? না কি দুনিয়ার যত সমস্যা সব আমার বাসাতেই বাস করে?”
প্রভাত বলল,
“আমি জানি তো বাসায় সমস্যা হলে তোমার সবসময় মন খারাপ থাকে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তা যদি না হয় তবে দুনিয়ার অন্য কোথাও তোমার সমস্যা হলে তা-ই বলো, শুনি।”
মৃন্ময়ী আবারও চুপ হয়ে গেল। প্রভাত বারবার তার রাগে খোঁচা মে’রে বলল,
“কী হলো? বললে না? বলো।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাতের খোঁচাখুঁচিতে বিরক্ত হয়ে পুনরায় বলে উঠল,
“আহ্ প্রভাত! জ্বালিয়ো না তো।”
“আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি?”
“তো কী করছো?”
“প্রশ্ন করছি।”
“প্রশ্ন করবে না।”
“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। তুমি কি খুব রেগে আছো?”
“আবারও প্রশ্ন করছো?”
“রাগের কারণটুকু শুধু জানতে চেয়েছি।”
মৃন্ময়ী আবারও কপালে ভাঁজ ফেলে গাল ফুলিয়ে রইল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তোমার রাগত চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বুড়ো বয়সে চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে! চোখের ডাক্তার দেখাও।”
“আমার ডাক্তার তো তুমিই।”
মৃন্ময়ী চুপ। প্রভাত বলল,
“একটু দাঁড়াও, আমি ঝালমুড়ি নিয়ে আসি। ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।”
“তো খাও গিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে কী করব?”
“দাঁড়াও না প্লিজ। যেয়ো না কিন্তু, হ্যাঁ? অপেক্ষা করো আমার জন্য।”

প্রভাত রাস্তার ওপারের ঝালমুড়ির দোকানে চলে গেল। যেতে-যেতে সে বারবার করে ফিরে তাকিয়ে দেখল মৃন্ময়ী চলে যাচ্ছে কি না। মৃন্ময়ী একবার ভেবেছিল চলে যাবে। প্রভাতের অমন বারবার ফিরে তাকানো দেখে আবার কী ভেবে দাঁড়িয়ে রইল, তবে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রভাত বেশ খুশি হয়েছে। দুই হাতে দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে মৃন্ময়ীর কাছে ফিরে এসে একহাতের ঝালমুড়ি বাড়িয়ে ধরে বলল,
“নাও।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি খাব না। তোমার খেতে ইচ্ছা করেছে, তুমিই খাও।”
“আমি তো তোমার জন্য-ও এনেছি, নাও।”
“আমি তো খাব বলিনি। আনলে কেন?”
“খাবে না, তা-ও তো বলনি।”
“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করনি।”
“আচ্ছা, আমারই ভুল। এখন খেয়ে নাও তো। আমি একা খেতে পারব না, নষ্ট হবে।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে খেতে গিয়ে ঝালমুড়িতে মরিচের পরিমাণ দেখে চোখ বড়ো করে বলল,
“এত ঝাল!”
প্রভাত হেসে বলল,
“ঝালমুড়ি কি মিষ্টি হয়?”
“না, কিন্তু এত বেশি মরিচ দিয়ে আনলে কেন?”
“খেতে পারবে না?”
“পারব, কিন্তু পরে অনেক পানি খেতে হবে।”
“পানি এনে দিবো, সমস্যা নেই। খাও, খাও। এটুকু ঝাল তোমার রাগের কাছে কিচ্ছু না। ঝালমুড়ির ঝালের সাথে যদি তোমার মনের ভেতরের রাগের ঝাল বেরিয়ে আসে, তাহলে তো তোমারই উপকার। তাই না?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই প্রভাত দাঁত বের করে হেসে বলল,
“মজা করেছি, স্যরি।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি খেতে-খেতে বেশ কয়েকবার প্রভাতের মুখের দিকে তাকাল। আজকাল প্রভাতের সাথে কোনো কথা শেয়ার করতে না পারলে তার ভালো লাগে না। মনখুলে যেকোনো কথা বলার এই একটাই তো জায়গা তার। আগে প্রভাত নিজেই তাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পেট থেকে কথা বের করত। আর এখন সে নিজেই কথা বলার জন্য ভেতর-ভেতর ছটফট করে। প্রভাত বুঝতে পারল তার মনোভাব। তারপর নিজেই বলল,
“কিছু বলতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলে ফেলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী একটু অস্বস্তিতে ভুগছে। অন্যান্য সমস্যার মতো তো এই কথাটা না যে ঠাস করে বলে ফেলবে। প্রভাত চোখ ছোটো করে বলল,
“এখনও তুমি কথা বলতে দ্বিধাবোধ করো? এতদিনেও একটু সাহস হয়নি?”
“তা না। কথাটা একটু অন্যরকম।”
“কী রকম?”
মৃন্ময়ী এবার সাহস করে বলে ফেলল,
“বিকেলে আমাদের বাড়িতে কয়েকজন মহিলা এসেছিল।”
“কোন মহিলা?”
“আমি চিনি না, মা চেনে।”
প্রভাত যেন এক মুহুর্তেই ব্যাপারটা ধরে ফেলল। চোখ বড়ো করে সে বলে উঠল,
“বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল?”
মৃন্ময়ী মৃদু ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। প্রভাতের মুখটা হঠাৎ করেই খুব সিরিয়াস দেখাল। সে মৃন্ময়ীকে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল,
“তোমার মা তাদের কোথায় পেল?”
“কী জানি! আগেও তো মা অনেকবার এমন করেছিল। আমি রাগ দেখানোর পর কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু করেছে।”
“তোমাকে আগে থেকে কিছু জানায়নি?”
“না, স্কুল থেকে ফিরে দেখি মহিলারা বসে আছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? মায়ের সাথে অযথা রাগ দেখিয়ে শেষে সামনে যেতে হয়েছে।”
“তুমি কি শাড়ি পরেছিলেন?”
“উঁহু।”
“সেজেছিলে?”
“নাহ্!”
“তারা কি তোমাকে পছন্দ করেছে বলে গেছে?”
মৃন্ময়ী হতাশ মুখে বলল,
“হুম।”
“আর কী বলে গেছে?”
“পাত্রকে পাঠাবে বলে গেছে।”
“তোমার মা রাজি?”
“মায়ের কথা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?”
প্রভাত এবার কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“তার মানে তারা তোমাকে আবার দেখতে আসবে?”
“তা-ই তো মনে হচ্ছে।”
“তুমি কিছু বলনি?”
“মায়ের সাথে রেগে ছিলাম, তাই কিছু বলিনি তখন।”
প্রভাত হঠাৎ রেগে গেল। সে রাগত মুখে বলে উঠল,
“ছেলের ঠিকানা জেনে আমাকে জানিয়ো। তারপর ওর বিয়ে করার সাধ আমি মিটাচ্ছি।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি বলেছি কিছু করতে?”
“তাহলে কি তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করবে?”
“আমি কখন বললাম ওই ছেলেকে আমি বিয়ে করব?”
“তাহলে?”
“প্রতিবারের মতোই না বলে দিবো। এভাবে মায়ের বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করার হলে তো কবেই করে ফেলতাম। আমার কি সেই সুযোগ আছে?”
“সুযোগ অবশ্যই আছে। তবে সেটা শুধুই আমার বেলায়। তুমি বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করলে করবে শুধুমাত্র আমাকে। আমি ছাড়া অন্য কেউ এই জায়গায় দাঁড়াতে চাইলে আমি তার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দিবো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ইশ্! কেমন গুণ্ডাদের মতো কথা বলছো।”
“অন্য কেউ আমার জায়গা নিতে চাইলে আমি গুণ্ডা-ই হব।”
মৃন্ময়ী মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এমনভাবে বলছো, আমি যেন তোমাকে জায়গা দিয়ে বসে আছি।”
প্রভাত বলল,
“সে জায়গা তো আমার জন্যই বরাদ্দ আছে। খুব শীঘ্রই আমি আমার জায়গা দখল করে নেব। তুমিও বাঁধা দিতে পারবে না।”
“আমি বাঁধা দিতে পারব না? এমন বিশ্বাস তুমি কোথায় পেলে?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তোমার পরিবর্তন থেকে।”
“কী পরিবর্তন?”
“তুমি কি নিজের পরিবর্তন বুঝতে পারো না? তা-ও আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? একমাস আগেও কি তুমি নিজে থেকে আমাকে কোনো কথা বলতে? এখন কিন্তু বলছো। এটা কি বিরাট ধরনের পরিবর্তন নয়? আমি জানি তুমি মুখে স্বীকার করবে না। না করলে কোরো না, সমস্যা নেই। আমি তোমার মন বুঝতে পারি।”
মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় বলল,
“খুব বোঝো তুমি।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই বুঝি। আর এভাবে মন বুঝতে-বুঝতেই একদিন দেখবে আমি তোমার গোটা মনটাকেই দখল করে নিয়েছি। তখন মন জুড়ে শুধু প্রভাত ছাড়া কিছুই খুঁজে পাবে না। তোমার মনে রাগ তো দূর, মন খারাপকে-ও তখন আর আমি জায়গা দিবো না। আমি ছাড়া বাকি সবার ওপর, সবকিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
পাত্রপক্ষ থেকে খবর এসেছে পাত্রসহ তার বোন আর দুলাভাই মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। তাদের পছন্দ হলে বিয়ের বিষয়ে কথা এগোবে। খবর শুনে মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে তার মাকে বলেছে তাদের আসতে নিষেধ করতে। কিন্তু সাজেদা বেগম তাতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন। মৃন্ময়ীর কথা কানে না তুলে সে তাদের আসতে বলে দিয়েছেন। সেই নিয়ে মা-মেয়ের মাঝে শুরু হয়েছে কথা কাটাকাটি। মৃন্ময়ী কিছুতেই আর পাত্রপক্ষের সামনে যেতে রাজি না। সাজেদা বেগম-ও নাছোড়বান্দা। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই এবার সাজেদা বেগমকে বুঝাতে পারছে না। মৃত্তিকা আর মৃদুলাকে-ও বারবার করে বলেছিল তারা যেন মাকে বুঝায়। অথচ তারা বুঝাতে গেলেই সাজেদা বেগম রেগেমেগে সবাইকে চোখ রাঙানি দিয়ে বিদায় করে দেন। মায়ের রাগের সামনে তারা কোনো বোনই টিকতে পারে না। মৃদুলা তবু বকা খাওয়ার পর-ও মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। সাজেদা বেগম উলটো তাকে বলে দিয়েছেন মৃন্ময়ীকে বুঝাতে। বোনকে তারা আর কত বছর এভাবে রাখবে? বোনের ভালোর জন্যই তো বিয়ের তাড়া দেওয়া। মৃদুলা মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“তোমাদের দুই বিরোধী দলের গ্যাঞ্জামের মাঝে আমাকে আর ঢুকিয়ো না প্লিজ।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“মা কী বলেছে?”
“কী আবার বলবে? সারাদিন ধরে যা বলে এসেছে তা-ই। মায়ের একটাই কথা, তোমাকে এবার সে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তার কথায় কোনো নড়চড় হবে না।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল ,
“আমি বিয়ে না করলে সে আমাকে কীভাবে বিয়ে দিবে? আশ্চর্য! আমি কি বাচ্চা মেয়ে আছি যে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
মৃদুলা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, কথা অবশ্য ঠিক। মা তোমাকে কী করে বিয়ে দিবে তা আমার জানা নেই। তবে তোমার দিক থেকে কীভাবে আটকানো যায়, তা জানা আছে।”
মৃন্ময়ী কৌতুহলী হয়ে উঠে বলল,
“সত্যি? কীভাবে রে?”
মৃদুলা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বলল,
“বলব না।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“না বললে আটকাব কীভাবে?”
“তা-ও বলব না।”
“আজব! তাহলে বললি কেন তুই জানিস?”
“তোমার আগ্রহ দেখলাম।”
“অসময়ে ফাজলামি করিস না মৃদুলা।”
“করছি না। মাথা খাটিয়ে একটু চিন্তা করো। তোমার মাথায় দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই। সমাধান চোখের সামনে থাকলেও তুমি সমস্যা বয়ে বেড়াও।”
“চোখের সামনে কী সমাধান দেখিস তুই?”
“চোখে কালো চশমা পড়ে থাকলে দেখবে কীভাবে?”
“হেঁয়ালি না করে বললেই পারিস।”
“নিজে থেকে চিন্তা করো। আমার মাথা দিয়ে চিন্তা করলে তোমার মাথা আছে কোন কাজে?”
বলেই মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ীর বিরক্ত লাগল। মৃদুলাটা সবসময় এমন বুদ্ধিমতী সাজে। বুদ্ধি উপকারে না এলে তার এত বুদ্ধিমত্তা দেখে কী করবে সে?

সাজেদা বেগম কাঁথা সেলাই করবেন। কিন্তু রাতের বেলায় তিনি সুচের ক্ষুদ্র ফাঁকফোকর দিয়ে সুতা ঢুকাতে পারেন না। তাই মৃদুলাকে বারবার করে ডাকেন সুতা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। আজ-ও মৃদুলা তার সুচে সুতা ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পাশে বসে রইল। তারপর বলল,
“মা শোনো, বড়ো আপা এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তুমি শুধু-শুধু তাদের ডেকে এনে খরচ কোরো না।”
সাজেদা বেগম বিরক্ত চোখ তুলে বললেন,
“আবার তুই আমার কানের কাছে ভনভন করতে এসেছিস?”
“আমাকে তো তুমিই ডেকে আনলে।”
“আমি কাজে ডেকেছি, অকাজে না। তুই তোর কাজে যা, আবার ডাকলে আসিস।”
মৃদুলা এক চুল-ও নড়ল না। শক্ত হয়ে বসে বলল,
“মা, আমি ভালো কথাই বলছি। তুমি আমাদের কথা না শুনে রাগ দেখিয়ে লোকজনের পেছনে টাকা খরচ করবে, কিন্তু আপা তো ওই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তাহলে লাভ কী এসব করে?”
“তোর আপা কোন ছেলেকে বিয়েটা করবে, বুঝা আমাকে। এই ছেলে আর ওই ছেলে আছে? ওই মেয়ে তো চিরকুমারী থাকার তালে আছে। তোরা বুঝবি কীভাবে?”
“আরে করবে-করবে। এখন কোনো ছেলেকে বিয়ে না করলেও, একদিন একজনকে ঠিকই বিয়ে করবে। তোমাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
“তা চিন্তা যে করব না, সেই একদিনটা ঠিক কবে আসবে মা? আমি ম’রলে? আর সেই একজনটাই বা কোন রাজপুত্র যার অপেক্ষায় বসে থেকে তোমার আপা বয়স বাড়াচ্ছে?”
মৃদুলা বলল,
“হতেও তো পারে আপার নিজের কোনো পছন্দ আছে, তাই এখন তোমার পছন্দে বিয়ে করতে চাইছে না।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“তোর আপা করবে ছেলে পছন্দ? তাহলে কি আর এত বছর ধরে বসে আছে?”
“এভাবে বলছো কেন? এখন তো কাউকে পছন্দ করতে-ও পারে।”
সাজেদা বেগম কেমন সন্দিহান দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বললেন,
“তুই কি কোনো কথা লুকাচ্ছিস আমার থেকে?”
“আমি কী লুকাব?”
“তোর আপা কাকে পছন্দ করে?”
“তা আমি কী করে জানব? আমি তো শুধু সন্দেহ প্রকাশ করলাম। তুমি আমার কথা শোনো মা, আমি ভালো কথাই বলছি। ওই লোকদের আসতে বারণ করে দাও। আপা কোন ছেলেকে পছন্দ করে তার খোঁজ নিয়ে আমি তোমাকে জানাব। তারপর বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো, কাজে লাগবে। যা কোনো কাজে আসবে না, তার পেছনে টাকা খুইয়ে কোনো লাভ নেই।”
সাজেদা বেগম রাগত স্বরে বললেন,
“ঘুরেফিরে এই কথা বলতেই আসিস? এই, তুই তোর রুমে যা। আমাকে আর কিছু বুঝাতে আসবি না। সেদিনের সেই বাচ্চা, তারা আসে আমাকে বুঝাতে। খুব বুঝদার হয়ে গেছে একেকজন।”
আরও একবার সাজেদা বেগমের বকা শুনতে হলো মৃদুলাকে। ঘরে গিমে মৃদুলা বিরক্ত মুখে বলল,
“মায়ের মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই।”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর মাথায় তো বুদ্ধির পাহাড়। তুই কেন কিছু করতে পারছিস না?”
“তোমার বড়ো আপা নিজেই এখন চুপ করে বসে আছে, দেখছো না?”
“কী আর করবে? মায়ের সাথে তো সারাদিন কম তর্ক করল না। এই রাত-বিরাতেও তর্ক করবে?”
“সে-ই, সে বিয়েও করবে না, মায়ের সাথেও পারবে না।”
“আরে ধুর! এসব আর নতুন কী? শেষমেশ গিয়ে তো আপার অসম্মতিতেই বিয়ে আটকে যাবে। তাকে কি মা জোর করে বিয়ে দিতে পারবে?”
“মা এবার কী ত্যাড়ামি করছে দেখছো না? শেষমেশ গিয়ে আবার কী না কী গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে, তা কে জানে?”
“কী জানি! এদের ঝামেলা আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুদ্ধিমতী হয়ে-ও বিপদে আছি।”


সকাল-সকাল সাজেদা বেগমের মেজাজ বিগড়ে আছে। আজ বিকালে পাত্রপক্ষের আসার কথা ছিল। অথচ সকালবেলাই খবর এল তারা আসবে না। মৃন্ময়ীকে তারা তাদের ছেলের বউ বানাতে চান না। কারণ হিসেবে জানালেন মৃন্ময়ীর না কি কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। তারা বিয়ে করার চিন্তা-ভাবনাও করেছে। খুব শীঘ্রই পরিবারকে জানিয়ে তারা বিয়ে করবে। এ কথা না কি মৃন্ময়ীর প্রেমিক নিজে তাদের কল করে জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর জন্য তাদের অযথা সময় নষ্ট করতে নিষেধ করেছে। খবর শুনে সাজেদা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মৃন্ময়ীকে এ কথা জিজ্ঞেস করতেই সে অস্বীকার করল। সাজেদা বেগম নিজেও বিশ্বাস করেন মৃন্ময়ীর কোনো ছেলের সাথেই সম্পর্ক নেই। তাহলে এমন কথা বলল কে? অপরিচিত ছেলেটাকে না চিনলেও সে রাগে, দুঃখে সকাল থেকে ছেলেটাকে বকেই চলেছেন। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে মৃন্ময়ী নিজেও ভীষণ অবাক হয়েছে। যদিও পাত্রপক্ষের আগমনে বাঁধা পড়ায় মনে-মনে সে খুব স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু মনের ভেতর প্রশ্ন রয়ে গেল কে এমনটা করল। যদিও এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে জটিল নয়। পৃথিবীতে একজন মানুষই আছে যে তার জন্য এমন অদ্ভুত কাণ্ড-ও ঘটাতে পারে। তখনই সে ফোন বের করে প্রভাতকে ম্যাসেজ করল,
“আজ বিকেলে যে পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিল, তারা আসবে না জানিয়েছে।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতের উত্তর এল,
“গুড নিউজ।”
“কেন আসবে না জানতে চাইবে না?”
“তা জেনে আমার কী হবে? আপদ বিদায় হয়েছে, এতেই আমি খুশি।”
তবু মৃন্ময়ী লিখল,
“আমার কোন প্রেমিক না কি তাদের কল করে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বলেছে তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। কদিন পর আমরা বিয়ে-ও করব।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“তোমার তো বিরাট উপকার হলো। তুমি খুশি হওনি।”
“হয়েছি, এসব আটকাতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে আমার এই আগন্তুক প্রেমিক দেখা দিলো, তা-ই তো বুঝতে পারছি না।”
“না বুঝলে নেই। এত বুঝে কী করবে? সমস্যার সমাধান হয়েছে, ব্যস, এবার খুশি থাকো।”
“তুমি আমার আগন্তুক প্রেমিকের কথা শুনে অবাক হলে না যে?”
“অবাক হওয়ার কী আছে?”
“এমনভাবে বলছো মনে হচ্ছে সে তোমার অতি পরিচিত কেউ।”
“কী যে বলো! কে না কে মজা করেছে। আমি চিনব কীভাবে?”
“তুমি চেনো না?”
“না।”
“তুমি নিজেকেই নিজে চেনো না? কী আশ্চর্য!”
“আমি তো তোমার আগন্তুক প্রেমিক নই, প্রকাশ্য প্রেমিক। তোমার হবু জামাই।”
“চালাকি কম করো। আমি খুব ভালোভাবেই জানি এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ করেনি।”
“বাহ্! কী ভালো চিনো তুমি আমাকে! এরপরও বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
“কথা ঘুরাবে না।”
“ঘুরাচ্ছি না, বলো কী জানতে চাও।”
“তোমাকে তো আমি তাদের পরিচয় দেইনি। তাহলে তুমি তাদের খুঁজে বের করলে কীভাবে? ফোন নাম্বার পেলে কোথায়?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“এসব কোনো বিশাল ব্যাপার নয়। তোমার জন্য আমি তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর পরিচয়-ও খুঁজে বের করতে পারতাম।”
“চৌদ্দ গোষ্ঠীর কথা আমি জানতে চাইনি। যা জানতে চেয়েছি, তা বলো। নাম্বার পেয়েছ কার থেকে?”
“স্বপ্নে পেয়েছি। তোমার ওসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ নেই। তুমি আমার বউ সাজার চিন্তা-ভাবনা করো।”

প্রভাতের হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তায় মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত সত্যি কথা বলবে না। পাত্রপক্ষ আসার কথা তাদের ঘরের বাইরের মানুষ প্রভাত ছাড়া আর কেউই জানত না। তাহলে কি ঘরের কেউ প্রভাতকে সাহায্য করেছে? কে? মৃত্তিকা? হতেই পারে। মৃত্তিকা ওর প্রাক্তন স্বামীর সমস্যা-ও সমাধান করেছিল প্রভাতকে দিয়েই। তাহলে কি মৃন্ময়ীর অগোচরে এবার-ও সে সমাধান হিসেবে প্রভাতকেই বেছে নিয়েছে? জিজ্ঞেস করতে হবে। সে ছুটে গেল মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করতে। অথচ জিজ্ঞেস করার পর মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“আমি প্রভাত ভাইকে কোথায় পাব? তার সাথে তো আমার কোনো যোগাযোগ-ই নেই। আমি আরও মনে-মনে আফসোস করছিলাম তার সাথে যোগাযোগ নেই বলে।”
“সত্যিই তুই জানাসনি?”
“আরে না। তোর সঙ্গে মিথ্যা বলব কেন?”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাহলে কে?”
“তুই এসব নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন? তোর তো খুশি হওয়ার কথা। যে প্রভাত ভাইকে নাম্বার দিয়েছে, সে তোর কত বড়ো উপকার করেছে। আমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তো আমি নিজেই তাকে জানিয়ে দিতাম।”

পরক্ষণেই মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“এই আপা, মৃদুলা প্রভাত ভাইয়ের ব্যাপারে কতটুকু জানে?”
“ওকে তো আমি কখনও এসব নিয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু ও যা চালাক! মাঝে-মাঝে কথাবার্তা শুনে মনে হয় ও সবই জানে। কীভাবে জানে তা আমি নিজেও জানি না। জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে, সত্যি কথা বলে না।”
মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওওও, তাহলে তুই ঘরে বিড়াল রেখে বাইরে খোঁজ করছিস কী করতে? তোর ঘরের বিড়াল-ই ইঁদুর খেয়ে ঘাপটি মে’রে বসে আছে, দেখ গিয়ে।”
“তুই কি মৃদুলাকে সন্দেহ করছিস?”
“তা নয়তো কী? ওই মেয়ের পেটে-পেটে যে কত বুদ্ধি, তা তুই ধরতে পারিসনি। গতকাল তোর থেকেও ওর বেশি তাড়া ছিল, কীভাবে পাত্রপক্ষের আসা আটকাবে তা নিয়ে। মাকে বুঝাতে গিয়ে কয়েকবার বকা-ও খেয়ে এসেছিল। তারপর হয়তো কাউকে না জানিয়ে প্রভাত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।”
এতক্ষণে মৃন্ময়ীর মাথা থেকে চিন্তার প্যাঁচ খুলল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, তোর ধারণাই সঠিক। তাহলে মৃদুলা-ই একাজ করেছে।”
মৃত্তিকা হেসে উঠে মজা করে বলল,
“এক কেজি মিষ্টি কিনে এনে ওকে জিজ্ঞেস করতে যা। তোর এত বড়ো উপকার করল।”

ওদিকে মৃদুলাকে চেপে ধরেছেন সাজেদা বেগম। গত রাতেই মৃদুলা মৃন্ময়ীর পছন্দের ছেলের কথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করল, আর আজই মৃন্ময়ীর কোন অপরিচিত প্রেমিকের আবির্ভাব হলো। এসবের মানে কী? মৃদুলা নিশ্চয়ই কিছু জানে, কিন্তু তাকে বলছে না। আজ তিনি ওর পেট থেকে সত্যি কথা বের করেই ছাড়বেন। মায়ের চাপে পড়ে মৃদুলা বলল,
“মা, আমি কি তোমাকে আমার মনের সন্দেহ জানিয়ে-ও ভুল করলাম? আমি কীভাবে জানব আপা সত্যিই কাউকে পছন্দ করে কি না? তুমি আপাকেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর আপা তো অস্বীকার-ই করছে‌।”
“আপা অস্বীকার করলে তুমি আমাকে ধরলে কী মনে করে?”
“তুই গত রাতেই বললি আর সকাল হতেই কোন ছেলে বিয়েতে বাঁধা দিলো, বুঝা আমাকে? এটা কি সন্দেহের বিষয় না? আমার তো মনে হচ্ছে ওই ছেলেকে তুই চিনিস।”
“আমি কী করে চিনব? আজব! আপা কি ওর ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলে?”
সাজেদা বেগম নিজের কথায় অটল থেকে বললেন,
“আমি নিশ্চিত তুই ওই ছেলেকে চিনিস। আমি তোকে ভালোয়-ভালোয় জিজ্ঞেস করছি মৃদুলা, সত্যি কথা বল। এটা তোর আপার জন্যই ভালো। নইলে বাইরের মানুষ বদনাম ছড়াতে এক সেকেন্ড-ও ভাববে না।”
“আমি তো বলেছি আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে জানাব। বলেছি যখন, অবশ্যই জানাব। আজই আমি খোঁজ লাগাব। আপাতত আমি কিছুই জানি না মা। আমি নিজে না জানলে তোমাকে কার কথা বলব? তুমি অযথা আমার সাথে এখন চেঁচামেচি কোরো না।”
তবু সাজেদা বেগম মুখ বন্ধ করতে পারলেন না। একা-একা বকেই চললেন,
“তোরা সবাই আমার সাথে চালাকি করছিস তো? কর, কর। এখন তো বুঝতে চাইছিস না। আমি ম’রে গেলে বুঝবি আমি তোদের ভালো চেয়েছি, না খারাপ চেয়েছি। যার যা ইচ্ছা কর। আমি আর কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাব না।”

মৃন্ময়ী আর মৃত্তিকা নিশ্চিত যে প্রভাতকে পাত্রপক্ষের ফোন নাম্বার মৃদুলা-ই দিয়েছে। অথচ তারা যখন মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করল, মৃদুলা তখন ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ার ভান ধরে বলে উঠল,
“তোমরা আমাকে সন্দেহ করছো? সিরিয়াসলি? ওই অপরিচিত ছেলে যে প্রভাত ভাই, তা-ই তো আমি মাত্র তোমাদের থেকে জানলাম। আচ্ছা আপা, প্রভাত ভাই জানল কী করে আজ তোমাকে দেখতে আসবে? এ খবর তো আমরা ছাড়া কেউ জানত না।”
মৃত্তিকা বলল,
“কথা ঘুরাবি না। সত্যি কথা স্বীকার করে নে। আমরা জানি তুই ছাড়া কেউ একাজ করেনি।”
মৃদুলা বলল,
“কী যে বলো আপু! আমার জীবনে তিনটা স্বপ্ন আছে। তৃতীয়টা হলো জামাইয়ের কাঁধে চড়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরতে যাওয়া, দ্বিতীয়টা হলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে ভালো একটা চাকরি করা, আর প্রথমটা হলো আপার বিয়ে খাওয়া। ভাবতে পারছো? আপার বিয়ে খাওয়া আমার প্রথম স্বপ্ন। আর সেই আমি কি না আপার বিয়ে ভাঙার কাজে সাহায্য করব? আমি কি পাগল? আমি আরও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে আমি আপার বিয়ে খাব, আর কবে আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন পূরণ হবে।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাদ দে আপা। বোমা মে’রেও তুই এই নাটকবাজের পেট থেকে সত্যি কথা বের করতে পারবি না। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ওকে বরং পুরস্কৃত করিস।”
মৃন্ময়ী মৃদুলাকে শুধাল,
“সেরা অভিনেত্রী পুরষ্কার হিসেবে কী চায়?”
মৃদুলা মন খারাপের ভান ধরে বলল,
“তোমরা এভাবে আমাকে অপমান করছো আপা? আমার একটা কথা-ও তোমরা বিশ্বাস করছো না। এই তোমাদের ছোটো বোনের প্রতি ভালোবাসা?”
মৃত্তিকা বলল,
“আমরা সত্যবাদীকে বিশ্বাস করি, মিথ্যাবাদীকে না।”
“ঠিক আছে। আমাকে অবিশ্বাস করছো তো? করো। একদিন বুঝবে আমি কেমন বিশ্বাসী মানুষ। সেদিন বিশ্বাস করতে চাইলেও আমি তোমাদের কথা শুনব না।”
“কেন আপা? ততদিনে কি আপনার কান অকেজো হয়ে যাবে? ওওও, বুঝতে পেরেছি। সেইদিন আসতে-আসতে আপনি নিশ্চয়ই বুড়ি হয়ে যাবেন?”
মৃত্তিকার সাথে মৃন্ময়ী-ও হেসে ফেলল। মৃদুলা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“তোমাদের সাথে আমি আর কোনো কথাই বলব না। কেউ একদম আমাকে ডাকবে না আর। এখন থেকে আমি তোমাদের সাথে রেগে আছি।”
মৃত্তিকা আবারও মজা করে মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, আমাদের বড়ো আপা তো রেগে আছেন। তার রাগ ভাঙানোর জন্য এক কেজি মিষ্টি ঘুষ নিয়ে আসিস কাল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে