মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০১

0
3

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১.
“তোর জামাই না কি তুই বলতে পাগল? তাহলে এক বছরের মাথায় তালাক দেওয়ার জন্য কপাল ঠুকে ম’রে কীভাবে? খুব তো বড়ো গলা করে বলেছিলি ওই ছেলে তোকে আমাদের চেয়েও বেশি সুখে রাখবে। সুখ এমন বাড়া-ই বেড়েছিল যে চার-পাঁচটা ব্যাগ ভরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো?”

মায়ের মুখে এমন কটুক্তি শুনে-ও ঠোঁটকাটা মৃত্তিকা তর্কে জড়াতে পারছে না। সময়টা এক বছর আগে হলে তার মুখ কোনোমতেই বন্ধ থাকত না। ঠিকই মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিত। কিন্তু আজ সে জবাব দেওয়ার মতো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরেনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে একেবারে বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ব্যাগের আকার আর সংখ্যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে শশুরবাড়িতে ফেরার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাগপত্রের যা অবস্থা, ভুল করে কোনোকিছু ফেলে রেখে এসেছে বলেও মনে হচ্ছে না। মা সাজেদা বেগম আহাজারি শুরু করেছেন মেয়ে এসে হতে। মৃত্তিকা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা, এখানেও কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না আমায়? নাওয়া, খাওয়া, ঘুম কবে ঠিকমতো করেছি, তা আমি নিজেই ভুলে গেছি। তোমার আমাকে যা বলার পরে বোলো। দয়া করে এখন আপাতত মুখটা বন্ধ রাখো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যা মা, শান্তি কর এখন তুই। আমাকে তো তুই কম শান্তি দিসনি। যা, যা। বড়ো বোনের রোজগার আছে, ছোটো বোনের রোজগার আছে, তুই কি আর অশান্তিতে থাকবি?”

মৃত্তিকা মায়ের কথায় কান না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। সাজেদা বেগম কপালে এক হাত ঠেকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তার দুচোখ জলে ভরে উঠেছে। টেবিলের ওপর থেকে ছোটো বাটন ফোনটা নিয়ে কল করলেন বড়ো মেয়ে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী স্কুলের বাচ্চাদের শেষ ক্লাস করিয়ে মাত্রই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েছে। মায়ের ফোন পেয়ে ভাবল বাড়িতে কিছু লাগবে। রিসিভ করার পর সাজেদা বেগম ধরা গলায় আহাজারি করে বলে উঠলেন,
“তোর বোনের সংসারের স্বাদ মিটে গেছে রে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দেখ ব্যাগপত্র গুছিয়ে শশুরবাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছে।”

মৃন্ময়ী একটু হোঁচট খেলেও খুব বেশি অবাক হলো না। এমন কিছু যে হবে, তা সে পূর্বেই আঁচ করেছিল। সে শান্ত গলায় জানতে চাইল,
“ও নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছে, না কি ওনারা পাঠিয়ে দিয়েছে?”
“এবার ও নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে। আগেরবার যাওয়ার সময় বলেছিলাম না, ওই সংসারের ভাত ওর কপালে নেই? দেখলি? মাস না পেরোতে নিজেই আবার চলে এল। এই সংসারে ওকে বসিয়ে কে খাওয়াতে পারবে বুঝা আমাকে।”
“মা, আমি বাড়ি ফিরে কথা বলছি তোমার সাথে। এখন রাখো।”
“আচ্ছা, আয় তাড়াতাড়ি। এসে ওর সাথে কথা বল ভালোভাবে। আমার সাথে তো জীবনেও খোলাখুলি কোনো কথা বলে না।”
“আচ্ছা, আমি আসছি। তুমি আগেই ওর সাথে রাগারাগী কোরো না।”


বোনকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে পথ চলছে মৃন্ময়ী। সে দ্রুত পা চালাতে চাইলেও তার পা চলতে চাইছে না। দুশ্চিন্তায় শরীরের শক্তি নিভু-নিভু করছে। তার বোনটা বিয়ের আগে থেকে এই পর্যন্ত তাদের কম দুশ্চিন্তা দেয়নি। তাদের বাবা নেই আজ চারটা বছর। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে গোটা একটা সংসারের ভার তার মাথায় এসে পড়েছে। সংসারের রোজকার খাবারের জোগান, চারজনের পোশাকের জোগান, দুই বোনের পড়াশোনার খরচ জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ছোটো বোন মৃদুলা বরাবরই তার কষ্ট বোঝে। তাই তো বোনের কাঁধ থেকে একটুখানি ভার কমানোর প্রচেষ্টায় সে ক্লাস টেন থেকেই টিউশন শুরু করেছিল। এখন তার কলেজ জীবন-ও শেষের পথে। তবে আগের থেকে এখন তার ছাত্র-ছাত্রী বাড়ার সাথে উপার্জন-ও বেড়েছে। টিউশন থেকে প্রাপ্ত মাসিক বেতন সে কোনোভাবেই অপ্রয়োজনে ব্যয় করে না। নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর চেষ্টা করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে বড়ো বোনের কাছ থেকে টাকাও চায় না। তবে মৃন্ময়ী বোঝে টিউশনের টাকায় কলেজের বেতন পরিশোধ করে, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর মেয়েটার সারা মাসের হাত খরচে টানাটানি পড়ে। তাই সে প্রতি মাসেই মৃদুলাকে কিছু হাত খরচ দেয়। এই বোনটার প্রতি মৃন্ময়ী খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করে। কিন্তু মৃত্তিকা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার পড়াশোনার খরচ মৃন্ময়ীকেই বহন করতে হয়েছে। তার ওপর সামর্থের তুলনায় মেয়েটার চাহিদা বেশি ছিল। সাজগোজের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিল। নতুন পোশাকের সাথে একেক সময় একেক সাজের সামগ্রী কেনার জন্য মৃন্ময়ীকে সে পাগল করে ফেলত। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী এলাকার এক ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছেলেটাকে তার পরিবারের সবাই চিনত। এটাও জানত ছেলেটা কোনো দিক থেকেই সুপাত্র না। তাদের সম্পর্কের খবর জানার পর ওই সবাই তাকে অনেক বারণ করেছিল যেন ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক না রাখে। কিন্তু বারবার সাবধান করার পরও সে কারোর কথা কানে না তুলে দিনদিন ওই ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এই নিয়ে সাজেদা বেগম অধৈর্য হয়ে শেষমেশ মেয়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিলেন। জেদি মৃত্তিকা তাতে নিজের ভুল বুঝার বদলে উলটো আরও বড়ো ভুলের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে সেই ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল সে। তবু যদি বিবাহিত জীবনে কিঞ্চিত সুখ মিলত! শশুরবাড়ির লোকজন তাদের একমাত্র আদরের ছেলের জন্য মৃত্তিকাকে ঘরে তোলে ঠিকই, কিন্তু কোনোদিনই পুত্রবধূর জায়গা দেয়নি। প্রতিটি মানুষের থেকে সে শুধু অবহেলা আর মুখ ঝামটা পেয়েছে। তার জন্য অবশ্য তার নিজের ব্যক্তিত্বের একাংশ-ও দায়ী ছিল। টেনেটুনে সংসার জীবনের এক বছর গড়াতেই স্বামীর চোখেও সে বি’ষে পরিণত হয়। স্বামী তার পড়াশোনা চালাতেও অস্বীকার করে বসে। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের নিত্যদিনের ঝামেলা। কদিন পরপরই সে শশুরবাড়ি থেকে ঝগড়াবিবাদ করে বাবার বাড়ি এসে আশ্রয় নেয়। এভাবে চলতে-চলতেই আজ তার শশুরবাড়ি থেকে একেবারে ফিরে আসা। মৃন্ময়ী জানে না এরপর কী হবে। সামনের দিনগুলো সে কীভাবে সামাল দিবে। ছোটো বোনটার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। সামনে সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পণ করবে। মেয়েটার খুব ইচ্ছা ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। যদিও সে মৃন্ময়ীকে কখনও সেভাবে বলেনি খরচের ভয়ে। তবে মৃন্ময়ীর-ও ইচ্ছা ছোটো বোনটাকে মোটামুটি একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর। মেয়েটা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। সে চায় মেয়েটার এত মেধা, এত প্রচেষ্টা একদিন সফলতার মুখ দেখুক। নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে তার খরচ আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে আবার মৃত্তিকার খরচ সে কীভাবে জোগান দিবে?

বোনের ভাবনায় মগ্ন মৃন্ময়ী ভুলেই গিয়েছিল তার নিত্যদিনের উটকো ঝামেলার কথা। হুট করে চোখের সামনে প্রভাতের রোজকার হাসিমুখটা ধরা দিতেই ক্ষণিকের জন্য সে হকচকিয়ে গেল, কিন্তু পা থামাল না। অতিদ্রুত নিজেকে সামলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। পাশ কে’টে সে চলে যাওয়ার আগেই প্রভাত পিছু নিল। সে-ও মৃন্ময়ীর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে আর জিজ্ঞেস করছে,
“ম্যাডামের আজ এত তাড়া কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর তো করলই না, বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রভাতকে খেয়ালই করছে না। প্রভাতের মনে সন্দেহ জাগল মৃন্ময়ী নিশ্চয়ই কোনো সমস্যায় পড়েছে। নয়তো গত দেড় বছরে-ও প্রভাত তাকে রাস্তায় এত দ্রুত গতিতে হাঁটতে দেখেনি। সে সবসময়ই খুব ভদ্রভাবে চলাফেরা করে। স্বভাবে কোনো চঞ্চলতা চোখে পড়ে না। প্রভাত পুনরায় প্রশ্ন করল,
“এত তাড়া কেন? ম্যাডাম কি কোনো সমস্যায় পড়েছো?”
এ পর্যায়ে মৃন্ময়ী থমকে দাঁড়াল। বরাবরের মতোই শান্ত দৃষ্টি মেলে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যায় পড়লেও তোমাকে বললে আমার সমস্যার সমাধান হবে না। তাই অযথা প্রশ্ন কোরো না। আর আজ আমার তাড়া আছে দেখছো তো। আজ অন্তত পিছু ছাড়ো, প্লিজ।”
প্রভাত বলল,
“ঠিক আছে, আর কোনো প্রশ্ন করছি না। মুখ বন্ধ করে হাঁটছি শুধু।”
মৃন্ময়ী চরম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,
“একটা দিন কি তুমি আমায় একা চলতে দিবে না প্রভাত?”
“আজ কোনো কথা বলব না। চুপচাপ শুধু হাঁটব।”
“প্রভাত প্লিজ। দেখছো তো আমি তাড়াহুড়া করে হাঁটছি। তোমাকে এভাবে আমার পেছনে ছুটতে দেখলে এলাকার লোকজন কী বলবে?”
প্রভাত বরাবরের মতোই বেপরোয়াভাবে বলল,
“লোকজনের কথার তোয়াক্কা প্রভাত করে না ম্যাডাম।”
“তুমি না করলেও আমি করি। কারণ আমি একটা মেয়ে। লোকজন বাজে মন্তব্যটা আগে আমার দিকেই ছুঁড়ে দিবে। তুমি তাদের চোখে পড়বে না। আর কতবার বললে বুঝবে তুমি?”

প্রভাতের মুখ দেখে মনে হলো সে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছে। মুখ ভার করে সে বলল,
“দেড় বছর ধরে তোমার এই এক কথা শুনতে-শুনতেই পেছনে ঘুরছি। এলাকার লোকজন তোমাকে খুব ভালো করেই চেনে। এ-ও খুব ভালোভাবেই জানে যে, প্রভাত তরফদার নিজেই মৃন্ময়ী ম্যাডামের পেছনে পাগলা কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ম্যাডাম তাকে পাত্তা দেয় না। তারা খারাপ বললেও আমাকেই বলে, তোমাকে না। জেনেবুঝে বারবার এলাকার লোকজনের দোহাই কেন দাও ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী ততক্ষণে তাকে পেছনে ফেলে দূরে চলে গেছে। একে তো মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তার পাহাড়, তারমধ্যে প্রভাত নামক উটকো ঝামেলাটা তার বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।


বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে দেখতে পেল না। মৃদুলা এ সময় পড়াতে যায়। মা সাজেদা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হয়তো তার-ই অপেক্ষায়। সে ঘরে ঢুকতেই শক্ত মুখে বলে উঠলেন,
“এসেছিস? যা দেখে আয় তোদের রাজরানি এসেছে। এসে হতে দরজা আটকে বসে আছে। ডেকে দেখ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে কি না। জিজ্ঞেস কর রাজমহল ছেড়ে এখানে এসেছে কেন।”

মৃন্ময়ী কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ক্লান্ত মুখে বলল,
“মাথা গরম কোরো না মা। এসেছে যখন, তখন তো সারাদিনই দরজা আটকে বসে থাকবে না। বেরোলে আমি কথা বলব। তুমি শান্ত হয়ে বসো।”
সাজেদা বেগম ভারী নিঃশ্বাস ফেলে শুধালেন,
“তুই নিজে কি শান্ত আছিস?”
“আমি তো শান্তই আছি মা। তোমার কল পেয়ে ছুটির পর কত তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরেছি জানো? তবু তো আমি তোমার মতো এত উত্তেজিত হইনি।”
“তুই পারিস, আমি পারি না মা।”
অত দ্রুত হেঁটে এসে মৃন্ময়ীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে ঢকঢক করে পরপর দুই গ্লাস পানি পান করল। তা দেখে সাজেদা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“আজও হেঁটে এসেছিস?”
মৃন্ময়ী মুখে হাসি টেনে বলল,
“কী করব বলো? আমি রাস্তায় বেরোলেই সব রিকশা হাওয়া হয়ে যায়। রিকশার জন্য যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ততক্ষণে আমি হেঁটে-ই বাড়ি চলে আসতে পারি।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তুই রিকশা পাস না, না কি রিকশা তোকে পায় না, তা কি আমি বুঝি না ভাবিস? রিকশা খুঁজলে তো তুই পাবি। মোটে বিশটা টাকা ভাড়া। দশ টাকা বাঁচিয়ে কি তুই সংসার উদ্ধার করে ফেলবি?”

মৃন্ময়ী কেবল হাসল। বিশ টাকায় সংসার উদ্ধার? হ্যাঁ, তাই তো করছে সে। এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারে খাবারের জোগান দিতে রোজকার যাতায়াত ভাড়া থেকে বাঁচিয়ে আনা ওই বিশটা টাকাই তার কাছে অনেক মূল্যবান। স্কুল, কোচিং দুই জায়গা থেকেই মাস শেষে বেতন আসে। সেই বেতন দিয়ে পুরো একটা মাস তাদের খুব হিসাব করে চলতে হয়। আজকাল আবার খরচ কিছু বেড়েছে। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডায়বেটিস আগের চেয়ে বেড়েছে। তার জন্য প্রতি মাসে ঔষধ কেনা লাগছে। মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই আবার উঠে বসল। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাড়াহুড়া করে হেঁটে আসায় তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পরনের কাপড় থেকে ঘামের দুর্গন্ধ আসছে। গোসল করা দরকার। সকালবেলায় একবার সে গোসল করে স্কুলে গিয়েছিল। তবু এই মুহূর্তে আরেকবার গোসল না করে থাকা যাচ্ছে না। মৃন্ময়ী বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ঠান্ডা পানিতে গোসল করল। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল মৃদুলা চলে এসেছে। চেয়ারে বসে সে মৃত্তিকার বাড়ি ফেরা নিয়ে মায়ের আহাজারি শুনছে। তাকে দেখেই মৃদুলা হাসিমুখে বলল,
“আপু, এদিকে এসো। এই দেখো কী এনেছি।”
“কী এনেছিস?”

কৌতূহল নিয়ে মৃন্ময়ী এগিয়ে গিয়ে দেখল টেবিলের ওপর নীল রংয়ের পলিথিন ব্যাগ। মৃদুলা ব্যাগের মুখ খুলে লিচু দেখতে পেল। লিচু কিনে এনেছে মেয়েটা। মৃন্ময়ীর বুঝতে বাকি রইল না তার বোন লিচু কেন এনেছে। দুদিন আগে কথায়-কথায় সে বলে ফেলেছিল এবারের সিজনে তাদের একদিন-ও লিচু খাওয়া হয়নি। এ মাসে বেতন পেলে সে কিনে আনবে। তার আগেই মৃদুলা নিয়ে হাজির। মৃন্ময়ী বলল,
“তুই আবার লিচু কিনতে গেলি কেন? আমি বলেছিলাম না বেতন পাওয়ার পর কিনে আনব?”
মৃদুলা বলল,
“তাতে কী? আজ আমি একটা টিউশনের বেতন পেয়েছি, তাই নিয়ে এলাম। আমি তো আর তোমার মতো বাজার-টাজার করে দিতে পারি না। টুকটাক কিছু কিনি, তাতে-ও এত আপত্তি করো কেন?”
“আমি তো সেজন্য বলি না বোন। তোর টাকা তো তোর নিজেরই কাজে লাগে। এভাবে খরচ করলে তোরই ক্ষতি।”
“এটুকু খরচে আমার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে না আপু। আগে খাও তো। বসো এখানে। দাও, আমি কাপড় মেলে দিয়ে আসছি।”

মৃন্ময়ীর হাত থেকে মৃদুলা ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে চলে গেল। মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। মেয়েটা এমনই। টিউশনের বেতন পেলেই টুকটাক কিছু না কিনে সে বাড়ি ফিরতে পারে না। মাঝে-মাঝে আবার দুই-এক রকম খুচরা বাজার নিয়েও হাজির হয়। মৃন্ময়ী বারণ করলেও সে কানে তোলে না। মৃন্ময়ী ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে লিচুর খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে মাকে শুধাল,
“মৃত্তিকা একবারও বেরোয়নি?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“একবার বেরিয়েছিল পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে ঘুমাবে বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছে। তোর সামনে বেরোনোর মুখ না থাকলে বেরোবে কীভাবে? ডেকে দেখ।”
“না থাক। এখন হয়তো মন-মেজাজ ভালো নেই। রাতে কোচিং থেকে ফিরে কথা বলব।”
“তখন আবার দেখবি ঘুমের ভং ধরে পড়ে আছে।”
“আহা মা! সবে তো এলো। প্রতিদিনই কি ও ঘুমিয়ে কা’টাবে? সকালে হলেও তো আমার সাথে দেখা হবে। আজ কিছু বোলো না। কিছু সময়ের জন্য ওকে একা ছেড়ে দাও। মৃদুলাকে আজ আমার ঘরে ঘুমাতে বোলো। ও একটু শান্ত হোক, তারপর কথা বলা যাবে।”


কোচিং থেকে বেরিয়ে মৃন্ময়ী আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। নাহ্, প্রভাতকে দেখা যাচ্ছে না। যদিও সে নিশ্চিত মাঝপথে হলেও ওই ছেলে তার সুদর্শন চেহারা দেখাতে হাজির হবেই। তবু আপাতত সে আপনমনে হাঁটা ধরল। ছেলেটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। কিছুতেই কথা শুনানো যায় না। রেগে কথা বললেও এক কানে তুলে অপর কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেয়। সেই মাধ্যমিক থেকে প্রভাতকে সে শুধুমাত্রই সহপাঠী হিসেবে চিনত। তখন থেকেই প্রভাত খুব ডানপিটে স্বভাবের। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্র ছিল সে। স্কুলের শিক্ষকরা-ও তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ট ছিলেন। সপ্তাহের আগায়-মাথায় স্কুলে তার বাবার ডাক পড়ত। এলাকার লোকজনের অভিযোগ তো ছিল নিত্যদিনের। তবু প্রভাতের দুষ্টুমি এক ফোঁটাও কমত না। প্রভাত যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন হঠাৎ তার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মা’রা যান। মৃন্ময়ীর স্পষ্ট মনে আছে, মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য তারা এক অন্য প্রভাতকে দেখতে পেয়েছিল। দুষ্টুমি বন্ধ, দৌড়ঝাঁপ বন্ধ, অকারণ অট্টহাসি বন্ধ। শোনা গিয়েছিল দুষ্টু প্রভাত মাকে খুব ভালোবাসত। মা ছিল তার একমাত্র ছায়া। বাবার শাসন খুব একটা পায়নি সে। তাই মায়ের শোক কা’টিয়ে ওঠার পরেই প্রভাতের দুষ্টুমি দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। একবার তো দুষ্টুমির সূত্রে এক দূর্ঘটনা ঘটিয়ে বাবার হাতে বেদম মা’র খেয়েছিল। তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। দুষ্টু প্রভাতকে আজ পর্যন্ত সেই মহিলা ভালো চোখে দেখতে পারেননি। ফলস্বরূপ প্রভাত নিজেও মহিলাকে মায়ের জায়গা দেয়নি। সবাই ভেবেই নিয়েছিল এই দুষ্টু প্রভাতের পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটবে কলেজের ত্রিসীমানায় পা রাখতেই। যদিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে পড়াশোনার চেয়ে বেশি দুষ্টুমি করে-করেই প্রভাত কোনোমতে এইচএসসি পাস করে আবার অনার্সে-ও ভর্তি হয়েছিল। বন্ধুরা যখন একে-একে কাজকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, তখন হয়তো তার-ও কিছু শুভ বোধদয় হয়েছিল। কম্পিউটারের কাজের বিষয়ে তার বেশ জানাশোনা ছিল। অন্য কোনো কাজে আগ্রহ জন্মায়নি বলে সে কম্পিউটারকেই বেছে নিয়েছিল। কম্পিউটারের দোকানে পার্ট টাইম কাজ করতে-করতে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল সে। অনার্স শেষ করে এখন সে মোটামুটি ভালো একটা কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। বয়স বাড়ার সাথে আগের মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি কিছুটা কমলেও এখনও সে সবার কাছে দুষ্টু প্রভাত-ই রয়ে গেছে। কারণ সুযোগ পেলে বাঁদরামি সে এখনও করে। এলাকার লোকজন তো তাকে কোনোদিন ভদ্রবেশে দেখার আশাই ছেড়ে দিয়েছে। আগাগোড়াই যে ছেলে লাগাম ছাড়া, সে ভালো হবে কীভাবে? বরং তাদের ভাবনায় প্রভাতের সঙ্গ যে ছেলে পাবে, সে-ই বেপরোয়া হবে।

মৃন্ময়ীর ধারণা একশো ভাগ সত্য প্রমাণ করে দিয়ে প্রভাত রাস্তার মোড়েই দেখা দিলো। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে উজ্জ্বল হাসিতে মনের প্রশান্তি প্রকাশ করল। বরাবরের মতোই মৃন্ময়ী তাকে দেখেও থামল না। প্রভাত নিজেই তার পিছু নিল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাডামের কি সমস্যার সমাধান হয়েছে?”
মৃন্ময়ী তাকেই পালটা প্রশ্ন করল,
“কিসের সমস্যা?”
“বিকালে যে খুব তাড়া দেখিয়ে বাড়ি ফিরলে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম তা তো আর বললে না।”
“আপাতত তোমার চেয়ে বড়ো সমস্যা আমার জীবনে আর একটাও নেই।”
“সত্যিই কি?”
“সন্দেহের কোনো কারণ নেই নিশ্চয়ই?”
“অবশ্যই আছে। ভেবে দেখো, আমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলে তুমি আমাকে উপড়ে ফেলার জন্য চাকরিবাকরি ছেড়ে দিতে পারো, যেন আমি আর তোমার পেছনে ঘুরতে না পারি। কিন্তু তুমি সেটা করবে না। কেন করবে না? কারণ এরচেয়েও বড়ো সমস্যা তোমার জীবনে আছে। যা সামলাতে হলে তোমার এই চাকরিবাকরি-ও প্রয়োজন। আর তোমার চাকরিবাকরি প্রয়োজন মানেই আমাকে তুমি উপড়ে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে আমিও তোমার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াব, বিশেষ প্রয়োজন।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“আমি কি বলেছি তোমাকে আমার প্রয়োজন? আমি যে সবসময় তোমাকে বলি আমার পেছন ছাড়ো, শোনো না কেন তুমি?”
“তোমায় ভালোবাসি যে, বোঝো না কেন তুমি?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
আমি তো বারবার তোমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে আমি তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই না।”
“চাইবে, চাইবে। আমি যেহেতু চাই, তুমিও একদিন চাইবে।”
“তোমার এত শখ থাকলে এখন থেকে গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো। ওখানে মেয়ের অভাব নেই। পছন্দমতো কারো পেছনে এভাবে ঘুরঘুর করে শখ মিটিয়ে নাও। তবু আমাকে ছাড়ো। তোমার শখ মিটানোর শখ আমার নেই।”
তবু প্রভাত দৃঢ় গলায় বলল,
“ওসব গার্লস আমার চাই না। আমার শুধু মৃন্ময়ী ম্যাডাম হলেই চলবে।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দুটো একসঙ্গে জড়ো করে বলল,
“মাফ দাও, রোজ-রোজ এক কথা আর ভালো লাগে না।”
“চলো বিয়ে করে ফেলি, ভালো লাগবে।”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি বোঝো না আমি তোমার সাথে রাগ করি? তোমার কি মানসম্মানে-ও লাগে না?”
প্রভাত শব্দ তুলে হেসে বলল,
“আমার আবার মানসম্মান আছে কবে থেকে? তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে এমনিতেই সবার চোখে বেহায়া হয়ে গেছি। আরেকটু ধৈর্য্য ধরে তোমাকে পেয়ে গেলেই মানসম্মান রক্ষা করা শিখে নিব।”
“বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো। ছাব্বিশে দাঁড়িয়েও আঠারো বছরের যুবকের মতো আচরণ করো কীভাবে তুমি? লজ্জা লাগে না?”
“অত লজ্জা কোলে নিয়ে বসে থাকলে কি তোমায় ঘরে তুলতে পারব? এজন্যই তো বলি, দুজনেই বুড়িয়ে যাচ্ছি, চলো বিয়ে করে ফেলি। তারপর আমার আচরণ তুমি নিজেই পালটে দিতে পারবে। ভেবে দেখো, বিরাট চান্স কিন্তু। মিস করে গেলে তোমারই ক্ষতি। পৃথিবী জুড়ে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তুমি আর এমন প্রেমিক পুরুষ পাবে না।”
“দরকার-ও নেই আমার। বকবক বন্ধ করে নিজের পথে হাঁটো।”
“তোমার সঙ্গে হেঁটে-হেঁটেও যে পথ ফুরাতে চায় না, সে পথে আমি একা হাঁটতে চাই না ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে, তবে আমি নিজেই সে পথ ধরছি।”

বলেই মৃন্ময়ী বিকালের মতো আবারও দ্রুত গতিতে পা চালাল। প্রভাত তার পেছনে ছুটল না, স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে চলল। সে মৃন্ময়ীকে চেনে। তার জ্বালাতনে অতিষ্ট মৃন্ময়ী সবসময়ই তার সঙ্গে একটু-আধটু রাগ দেখায়, বকাঝকা করে। কিন্তু সে যখন পারিবারিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়, তখনই তার মেজাজ একটু অন্যরকম থাকে। রাগের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রভাত নিশ্চিত তার মনে আজ-ও কিছু চলছে। মেয়েটা এত চাপা স্বভাবের! দেড় বছর ধরে পেছনে ঘুরেও সে এই মেয়েটার মনের কথা বুঝতে পারে না। তবু তার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক না। একদিন হয়তো মেয়েটা-ও তাকে বুঝবে। মেয়েটা তাকে বুঝে গেলেই মেয়েটাকে বুঝা-ও তার জন্য সহজ হবে। চেষ্টা সে চালিয়ে যাবেই। চেষ্টা করতে তো আর টাকা-পয়সা লাগে না? লাগে শুধু একটু ধৈর্য। মৃন্ময়ীর মনের গহীনে পৌঁছাতে যতটুকু পথ তাকে হাঁটতে হয়, সে হাঁটবে। এটুকু ধৈর্য তার আছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে