~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০১
” ইয়ে আম্মা, আমাকে এক কাপ র’টি করে দিতে বলুন তো কাউকে।” খসখসে কণ্ঠে বললেন বাড়ির বড় ছেলে আখতারুজ্জামান। চোখ থেকে চশমা খুলে সেটা পরিস্কার করে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে মুখ তুলে ঘড়ি দেখলেন। তারপর পুরো ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিলেন এক পরত।
দুপুর বারোটা। একটু আগেই দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে। গোরস্থান থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরূমে এসে বসেছেন আখতারুজ্জামান। বাকি ভাইবোনেরাও আছে। সবারই চেহারাতেই একটা কপট দুঃখী ভাব লটকানো। অথচ এই মৃত্যুটার জন্য একেকজনের অপেক্ষার অন্ত ছিল না। সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আখতার। কান্নার শব্দে ঘাড় ফিরালেন।
ইশারা কাঁদছে। তাদের সবার ছোট বোন। বাবার সবচেয়ে আদরের মেয়ে ইশারা। অথচ সেই বেচারিই কিনা আজ বাবাকে মিস করেছে। শেষ দেখাটা দেখতে পারেনি। ওর ট্রেন পুরো চার ঘন্টা লেট ছিল বলে পৌঁছুতে দেরি হয়। ইশারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার সুবাদে সেখানকার হোস্টেলেই থাকতে হয় ওকে। এদিকে দিন পড়েছে গরমের। সারারাতের পর এই তপ্ত দুপুর পর্যন্ত বাবাকে আর ফেলে রাখা যাচ্ছিলো না। যার ফলে ইশারা পৌঁছানোর আগেই গোর দিয়ে ফেলার আদেশ দিতে হয়েছে আখতারকে।
আর এদিকে পৌঁছানোর পর থেকেই কান্না শুরু হয়েছে ইশারার। সেই থেকে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে সে। আখতারুজ্জামানের বিরক্ত লাগছে খুব। একটা মানুষ কত কাঁদতে পারে। এই মেয়ে মেডিকেল কলেজে চান্স পেলো কীভাবে ভেবে পায়না আখতারুজ্জামান। সারাজীবন তেলাপোকা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আর কমিকস পড়ে হি হি করে হাসা যে মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সে কীভাবে মেডিকেলে চান্স পায় আখতারুজ্জামানের মাথায় ঢোকেনা। বিরক্তি নিয়েই আড়চোখে বোনকে দেখলো। এখন ফিঁচ ফিঁচ করে কাঁদছে আর ওড়নাতে চোখ মুছে যাচ্ছে। আশ্চর্য, একটা মানুষ বুড়ো হয়ে ঝুলে ছিল, সে যে মরেছে এটা তো তার জন্যেও ভালো। সারাজীবন বেঁচে থাকবে নাকি।
বিরক্তিতে অকারণেই দুবার কাশলো আকতার। এই কাশি সাধারণ কাশি না। সাংকেতিক কাশি। আলাপ তোলার কাশি। কিন্তু কাশিতে বিশেষ কাজ হলো না। আখতারুজ্জামান দেখলো ভাইবোনেরা সব মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তারমানে এদের ইচ্ছা আলাপটা আখতারুজ্জামানই তুলুক। সব ধান্ধাবাজের দল। রাগ লাগলেও চুপ করে রইলো আখতার। কিছুক্ষণ উসখুস করে বললো,” কই চা দিতে বললাম না ? ”
খাটের এক কোণে চুপ করে বসে ছিলেন ময়না বেগম। বড় ছেলের কথায় সদ্যবিধবা ময়না বেগম দিশেহারা ভঙ্গিতে বাকিদের দিকে তাকালেন। ছেলে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় ওর কথার অর্ধেকই বুঝতে পারেন না ময়না বেগম। র’ টি কী জিনিস জানেন না তিনি। বাকিরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই সেজ মেয়ে গোধূলি ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো ,” আমি দিচ্ছি বড় ভাইয়া।” বলে গোধূলি বেরিয়ে গেল। তার নিজেরও হয়তো মজলিশটাতে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। ওর চলে যাওয়া দেখে তাই মনে হলো ময়নার। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভয়ে ভয়ে ঘরের বাকি সদস্যদের দিকে তাকালেন। সবাই থম ধরে বসে আছে। পরিবেশটা ঝড় ওঠার আগের আবহাওয়ার। ঝড় ওঠার আগে যেমন থেমে যায় চারদিক। তারপর ধূলো উড়িয়ে লঘুচালে এক টুকরো বাতাস এসে কিছু খড়কুটোর ঘূর্ণি তৈরী করে। তারপরেই ধুন্ধুমার কান্ড শুরু হয়ে যায়। লন্ডভন্ড করে রেখে যায় চারিদিক। ময়না বিবির আশঙ্কা বুড়োর ছেলে মেয়েরাও আজ হয়তো তাই করবে। শেষ পর্যন্ত তার পায়ের নিচে স্বামীর একচিলতে ভিটেটুকু থাকবে তো । নইলে কোথায় যাবেন তিনি। এই শেষ বয়সে ?
আখতারুজ্জামানকে ভয় পাবার প্রধান কারণ ওর চন্ডাল রাগ। ময়না বিবির সাথে ওর বাবার বিয়ের দিন এই ছেলেই সবচেয়ে বেশি ঝগড়া করেছিলো। তখন সে সবেমাত্র পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরীতে ঢুকেছে এবং বিয়েও করেছে। বাকিরা তখনও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন আখতারুজ্জামানের দেখাদেখি বাকি ছেলেমেয়েরাও তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছিল বুড়োর সাথে। সে কী ঝগড়া। ব্যতিক্রম ছিল ইশারা। লালমিয়ার সবচে ছোট মেয়ে। লালমিয়া ময়না বিবির দ্বিতীয় স্বামী। বয়সেও ময়নার থেকে বেশ এগিয়ে। ময়না বিবির প্রথম স্বামী তালাক দিয়েছিল ময়না নিঃসন্তান বলে। অথচ তার কয়েক বছর পরেই তার এই নিঃসন্তান হবার কারণেই লালমিয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। মানুষের জীবন কতইনা বিচিত্র। যে দোষে তিনি প্রথম স্বামীর ঘর কতে পারলেন না সেই একই দোষের কারণে দ্বিতীয় স্বামী বেছে নিলেন তাকে। অযোগ্যতাই সেদিন যোগ্যতা হয়ে গিয়েছিলো ময়না বিবির। যেদিন তিনি এ বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলেন সেদিনের কথা এখনও মনে আছে তার। ইশারা তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। তাকে দেখেই ফিক করে হেসে দিয়েছিল ছোট্ট এতিম মেয়েটা। ওকে দেখেই সেদিন বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল ময়নার।
লাল মিয়ার প্রথম স্ত্রী আয়না বিবির মৃত্যুর মাস ছয়েক পরেই নিঃসন্তান ময়নাকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন বুড়ো। ময়নার নিজের বয়সও ততদিনে চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। লালমিয়ার ছেলেমেয়েরা তাদের এই বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি। হয়তো লালমিয়ার প্রয়োজনটা তার ছেলেমেয়ের কাছে ততটা প্রবল বলে মনে হয়নি বলেই। তাদের মতে বাবার তখন তসবীহ জপার বয়স। এখন কিসের বিয়ে ? তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে লোকে কী বলবে। তার নতুন শ্বশুরবাড়িই বা কী বলবে। আখতারুজ্জামানের একথায় বাকি ভাইবোনেরা সমর্থন জোগালেও ইশারা নিরব ছিল। সে বেচারি তখনও নিতান্তই কিশোরী।
তবে বাকি ছেলেমেয়েদের তুমুল বিরোধীতার মুখেও সেদিন অনড় ছিলেন বৃদ্ধ লালমিয়া। ওদের চোখের সামনে দিয়েই তিনি প্রৌঢ়া ময়না বিবিকে নিয়ে সংসার শুরু করেছিলেন। বুড়ো বুড়ির সংসার। তাঁর এককথা, আমার একজন সঙ্গী লাগবে। আমার ব্যক্তিগত দেখাশোনার জন্যই একজন সঙ্গী দরকার। কার পা ধরতে যাবো আমি ? কোন বেটিরে সাথে রেখে গুনাহগার হবো। সব কথা কী তোমাদের বলে বোঝাতে হবে ?”
বাবার এহেন কথায় ছেলেমেয়েরা মহা ক্ষেপে উঠেছিলো সেদিন। তাদের মতে, এতে তাদের মৃত মাকে অপমান করা হচ্ছে । লালমিয়া তবু নির্বিকার। তিনি এক কথার মানুষ। শুধু এতোটুকুই বলেছেন, ” সারাজীবন ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতাম বলে তোমরা আমাকে গোঁড়া বলতে। আজ দেখো গোঁড়া আসলে কে। নিঃসঙ্গ পিতামাতার প্রয়োজনে তাদের হালাল সঙ্গি বেছে নেয়াটা যাদের চোখে অসম্মানের, গোঁড়া মূলত তারাই। যে বিধানে আইনগত, সামাজিক বা ধর্মীয় বাধা নেই সেই বিধানকে লজ্জা ধরে নিয়ে নিছক একটা সংস্কারকে লালন করার নামই হলো গোঁড়ামি। যারা গার্লফ্রেন্ড আর পরকীয়ার মতো হারামকে হালকা চোখে দেখে আর দ্বিতীয় বিয়ে করাকে বলে লুচ্চামি আসল গোঁড়া তো তারাই। প্রয়োজনকে খাটো করে দেখে নিজেদের মনগড়া পছন্দকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলা লোকেরাই আজকের দিনের বড় গোঁড়া। কাজেই গোঁড়া আমি না, গোঁড়া তোমরা। তোমরাই আজ গোঁড়ামি করছো।”
বুড়োর সপাট জবাবের সামনে সব ছেলেমেয়ে কিছুটা মিইয়ে গিয়েছিল। কেবল ইশারাই একা খুশি ছিল এবং বাবার বিয়ের পরেও সে স্বাভাবিক ছিল। নতুন মায়ের আন্তরিক ব্যবহার আর যত্ন আত্তি ওর কচি মন জুড়িয়ে দিয়েছিল প্রথম থেকেই। ফলে লালমিয়ার ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র ইশারাই ময়না বিবিকে মা বলে ডেকেছে। বাকি ছেলেমেয়েদের কেউ ময়না বিবিকে মা বলে ডাকেনি, মন থেকেও মেনে নেয়নি। তবে বুড়োর একথার পর তারা আর কথাও বাড়ায়নি। এর মূল কারণ সত্তোরর্ধো লালমিয়া তখনও যথেষ্ট দাপুটে। একাই বিশাল অঙ্কের টাকা লেনদেন করতেন। লোকজন লাগিয়ে জমিজিরাত দেখাশোনা করতেন। যৌবনে ঢাকায় দশ কাঠা জায়গা কিনে বাড়িঘর তুলে হুলুস্থুল কান্ড করেছেন। শেষ বয়সে এসে ইশারাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে ময়না বিবিকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। ঢাকার বাড়ির ফ্ল্যাটগুলো আগেই ছেলেমেয়েদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। মারা যাবার কয়েক মাস আগে সবাইকে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, গ্রামে যে দুটো পুকুর আছে তার বড়টা ময়নাবিবির নামে থাকবে আর ছোটটার আয় থেকে মাদ্রাসার খরচ বের হবে কারণ ওটাতে মাছের চাষ হয়। বাকি রইলো কিছু জমি আর এই ভিটে বাড়ি। এগুলোও তিনি ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন করে যাবেন। কেউ যেন এগুলো নিয়ে দ্বিমত পোষণ না করে। এটাই ছিল ছেলে মেয়েদের সাথে লালমিয়ার শেষ কথা। এরপর গত কয়েক বছর তিনি বিছানায় একা তড়পেছেন কিন্তু শেষ বয়সের সাথী ময়না বিবি আর ছোট মেয়ে ইশারাকে ছাড়া আর কাউকে পাশে পাননি।
গোধূলি চা এনে দিলে তাতে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো আখতারুজ্জামান। বাকিরা সবাই উসখুস করতে লাগলো। বড় ভাইয়ের আগে কথা বলার ইচ্ছে কারোরই নেই। কারণ ইতোমধ্যেই ফোনে ফোনে তাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছে। কে কী বলবে তার একটা ছোটখাট মহড়াও দেয়া হয়েছে। ময়নাবিবিকে বড়পুকুর দেবার কোন ইচ্ছেই তাদের নেই। সে বড় জোর উত্তরের তিন শতাংশ জমিটা পেতে পারে। কিন্তু এ কথা বললে ময়না বিবির বাপের বাড়ির দিকের লোকেরা ঝামেলা করতে পারে ভেবেই তারা কথা বলার দায়িত্ব আখতারুজ্জামানকে দিয়ে রেখেছে। সে বাড়ির বড় ছেলে। তার কথার ওজনই আলাদা।
একসময় নিরবতা ভাঙলো। লালমিয়ার মেজমেয়ে রুমানা কথা বলে উঠলো। সে বর্তমানে একটা স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে আছে। বোনদের মধ্যে সেই একটু কড়া মেজাজের। রুমানাই এবার বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এভাবে সারারাত বসে থাকলেও কোন সমাধান আসবে না ভাইয়া। একটা কিছু তো করতে হবে। দুদিন বাদে সবাই আমরা যার যার জায়গায় ফিরে যাবো। এখানে জমিজমা তো সবই পড়ে থাকবে । তাছাড়া ছোট আম্মা এখানে একা। জায়গাজমি বারো ভুতে লুটেপুটে খাবে। এতো টাকার লেনদেন। এসব এভাবে ফেলে যাবার কোন মানে হয়না। “বলেই থেমে গেলো রুমানা। যে কোন কথা মুখের ওপর বলে দেবার স্বভাবটা ওর পুরোনো। বিগত দশবছর ধরেই সে স্বামী সন্তান সহ খুলনা আছে। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আজ ভোরেই গ্রামে ছুটে এসেছে সে। তবে ওর স্বামী আসতে পারেনি। সে নাকি ব্যস্ত। তাই স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানকার জায়গাজমির ভাগ বন্টন হয়ে গেলেই রুমানা উড়াল দেবে। আখতারের জোর ধারণা জামাই ব্যাটার শ্বশুড়ের মৃতদেহ দেখার চেয়ে জায়গাজমির টেনশনটাই বেশি ছিল। সেকারণেই একমুহূর্ত দেরি না করে বউছেলেকে ঠেলে পাঠিয়েছে। আখতার পুনরায় কাশলো।
” কিছু একটা করতে হবে তা আমিও জানি। কী করতে হবে তোরাই বল একটু শুনি। ”
” আমরা আর নতুন করে কী বলবো ভাইজান। আমরা থাকতে থাকতেই যদি জায়গা জমি নিয়ে না বসি তাহলে আর বসা হবেনা। এ বাড়িতে আমাদের আর কী আছে যে পিছুটান থাকবে। এক বাবা বেঁচে ছিলেন তবু ফোন টোন দিয়ে কথা বলতাম। এখন তো আর কেউ নেই। যারা আছে সবই বসে আছে সম্পত্তির আশায়। বাপ আমাদের। আর সম্পত্তি বারোভূতের। ” মেজ মেয়ে রুমানার স্বরে ব্যঙ্গ স্পষ্ট। ময়না বিবি ঘোমটায় মুখ ঢাকলেন। তার দিকের লোক বলতে তার এক ভাই আর এক বোন জামাই। তারা এখনও কিছু বলার সুযোগ পায়নি।
ইতোমধ্যে লাল মিয়ার বড় মেয়ে মাসুমা চেঁচিয়ে উঠলো। সে এমনিতে চুপচাপ। কথাও বলে কম। কিন্তু যখন বলে তখন বাকিদের বলার উপায় থাকেনা এতোটাই তীর্যক তার কথা। মাসুমা ধমকের সুরে বললো,” জায়গা জমি করে করে যে একেকজন মাথা খারাপ শুরু করলি। ইশারার কী হবে একবার ভেবেছিস ? আমাদের সবারই ঘর সংসার দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে আব্বা। ইশারাটার তো বিয়েটাও দেখে যেতে পারলো না। ওর কথা একবার ভাববিনা ? ওর দায়িত্ব কে নেবে ? ”
একথায় সবাই যেন একটু নতুন করে নড়েচড়ে বসলো। কেবল ইশারা একাই চট করে উঠে দাঁড়ালো। একমুহূর্ত দেরি না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে ঐ কথাগুলো শুনে। ওর চোখগুলো তখনও বেশ লাল।
আখতারুজ্জামান কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবার আগেই রুমানা বলে উঠলো,” ইশারার বিয়ে নিয়ে ভাবার কী আছে। সে এখন ডাক্তারি পড়ছে। ওর জন্য কী ছেলের অভাব ? আমার দেবরই কতবার আগ্রহ দেখালো। আমি পড়াশোনা শেষ হবার কথা বলে টলে থামিয়ে রেখেছি। তাছাড়া ওর নিজের নামে ফ্ল্যাট আছে। দুদিন পরে নিজেও ভালো রোজগারে নামবে। ওর কথা আলাদা করে ভাবার তো কিছু নেই।”
ময়না বিবি এবার ভয়ে ভয়ে মুখ খুললেন। তিনি এই প্রসঙ্গটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন যেন। ভেজা কণ্ঠে বললেন,” আমার কথায় কিছু মনে কইরোনা তোমরা। আল্লায় দিলে তোমরা সবাই যথেষ্ট বুঝদার। তোমাগো নিজেগোও ছেলেমেয়ে অাছে। এইটা তো বুঝো যে ছেলেমেয়ে যতই শিক্ষিত আর লায়েক হউক না কেন। তার বিয়েটা ময়মুরুব্বিগরেই করানো লাগে। আমি যদিও ইশারার আপন মা না। তারপরেও আমি চাই ওর বিয়েটা সুন্দরভাবে শরীয়ত মাইনা হউক। যুগের লগে তাল মিলাইতে যাইয়া ওরে তোমরা একলা ছাইড়া দিওনা বাবারা। এইটা খালি আমার একলার অনুরোধ না, এইটা তোমাদের বাবারও অনুরোধ।” ময়না বিবি থামলেন। ঘরের সবাই এবার বেশ সরব হয়ে উঠলো।
বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো ইশারা এ পর্যন্ত শুনে আর বাকিটা শোনার জন্য দাঁড়ালো না। আস্তে করে উঠোনে নেমে পড়লো সে। তার ভালো করেই জানা আছে এরপরের কথাগুলো কী হবে। তাই বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেও মনটা পশ্চিমাকাশের মতোই ভার হয়ে আছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে বাবা আর বেঁচে নেই। তিনি আর কোনদিন ফোন দিয়ে বলবেন না, কী রে, মা ? কিছু লাগবে নাকি রে ইশু ? ”
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির বাইরে চলে এলো ইশারা। পাশেই হাকিম মোল্লা চাচার বাড়ি। হাকিম মোল্লা চাচা এখনও বেঁচে আছেন। ইশারা বাড়ি এলেই তাঁর সাথে দেখা করে। সম্পর্কে বাবার দুর সম্পর্কের ভাই হলেও দুই বাড়ির সম্পর্কটা অন্যান্য প্রতিবেশিদের মতোই। বিশেষ বাড়াবাড়ি খাতির নেই। এর বড় কারণ এই বাড়িতে তাদের আসাযাওয়া একেবারেই কম। নেই বললেই চলে। হাকিম মোল্লা চাচার স্ত্রী’র কাছে ইশারা একসময় আরবি পড়তো। পরে লেখাপড়ার জন্য ঢাকা চলে যাবার পর আর পুরোটা শেখা হয়ে ওঠেনি। তবে গ্রামে এলে একবার চাচির সাথে দেখা হতোই ইশারার। বড় মায়াবতী মহিলা।
আজ অনেকদিন পর মোল্লা বাড়িতে এসে পুরোনো ভালো লাগাটা কাজ করছে ইশারার। চাচি সবসময়ই আন্তরিক। ইশারাকে ভীষণ স্নেহ করেন।
চাচিদের উঠোনে পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালো ইশারা। মোল্লা চাচাদের বাড়ির বিরাট উঠানের এককোণে একটা বড় গামলা পেতে রাখা হয়েছে। তাতে সম্ভবত কুসুম গরম পানি নেয়া হয়েছে। কেননা সেই পাত্র থেকেই মগ ভরে ভরে পানি তুলে চাচার গায়ে ঢালার কাজ চলছে। যিনি কাজটা করছেন তাকে দেখতে পাচ্ছেনা ইশারা। তবে তার চওড়া মাংসল পিঠ আর ভারি উরু এখান থেকেই চোখে পড়ছে ইশারার। লুঙ্গিটাকে রীতিমত হাঁটুর উপর তুলে জলচৌকিতে বসে মোল্লা চাচার পায়ে সাবান মাখাচ্ছেন তিনি। আর মোল্লা চাচা মহানন্দে চেয়ারে হেলান দিয়ে সেই দলাই মলাই উপোভোগ করছেন। বোঝাই যাচ্ছে এ ধরণের গোসলে তিনি দারুণভাবে অভ্যস্ত।
ইশারাকে তিনিই প্রথম দেখলেন। চোখে চশমা না থাকায় চোখগুলো কুঁচকে ফেলে বললেন,” কে ওখানে ? ”
ইশারা সালাম দেবার মুহূর্তেই টের পেলো মোটা গর্দানের অধিকারী লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলো ওকে। তাকে চিনতে না পারলেও ইশারা অনুমান করলো এটা মোল্লা চাচার ছেলেদেরই কেউ হবে। যদিও এমন পালোয়ানদেহী কাউকে আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা ইশারার। তবে লোকটার ওকে দেখে ভীষণভাবে গুটিয়ে যাওয়াটা উপোভোগ করলো সে।
মুহূর্তেই গোটানো লুঙ্গি নামিয়ে লোমশ উরু ঢাকলো লোকটা। মোল্লা চাচার চেয়ারের পাশ থেকে তোয়ালেটা টেনে এমন ভাবে নিজের পিঠসহ মাথাটাকে ঢাকলো যেন ইশারা নয় তিনিই কোন লাজুক কুমারী কন্যা। যাকে দেখে ফেললে তার মান চলে যাবে।
ইশারা কয়েক পা এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। মোল্লা চাচাকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো। আর একইসাথে পরম বিস্ময় নিয়ে তোয়ালে ঢাকা পালোয়ানকে আরেকবার দেখে নিলো ইশারা।
[চলবে ইনশাআল্লাহ]