#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২১)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলির ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, পর্দা ঠিকঠাক টেনে দেয়া হয়নি। ভারি পর্দার ফাঁক গলে প্রথম প্রহরের সূর্যালোক ঘরে ঢুকে লুটোপুটি খাচ্ছিল মেঝেতে। পাশেই নেহাল আধোশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাত জাগার ক্লান্তি ছুঁয়ে আছে ছেলেটার মুখে। এমন চমৎকার একটা ভোর বহুদিন পরে লিলি চাক্ষুষ করল।
পায়ের ব্যাথাটা না ভোগালে সে নিশ্চিত এখন নেহালকে ডেকে তুলে বাইরে বের হতো হাঁটতে। খোলা আকাশের নিচে নেহালের কাঁধে মাথা রেখে একটা ভোর দেখার তৃষ্ণা জাগল ওর মনে।
পা ফেলে নামতে কষ্ট হলেও সে নেহালকে ডাকল না, সারারাত ওর জন্য কষ্ট করেছে ছেলেটা। এখন একটু ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক নাহয়। কী চমৎকার করেই না ঘুমাচ্ছে ছেলেটা৷ লিলির বড্ড মায়া হলো।
সে সুস্থ পায়ে ভর রেখে উঠে এলো। কয়েক পা ফেলার পরেই ক্লান্ত লাগছিল।
“আমাকে ডাকোনি কেন লিলি?”
লিলি মাথা না ঘুরিয়ে সদ্য জেগে উঠা নেহালকে বলল, “ডাকলে কী কোলে করে নিয়ে যেতেন?”
নেহালের উত্তর না পেয়ে মৃদু হেসে নেহালের দিকে ঘুরে তাকিয়ে লিলি আবার বলল, “আপনি ফান বুঝতে পারেন না? হায় আল্লাহ! এমন নিরামিষ কেন আপনি? খাবারে তো বাছবিচার তেমন দেখি না।”
“খাবারের সাথে এটার সম্পর্ক কী? তোমার ধারণা শুধু নিরামিষ খাবার খেলে তোমাকে কোলে নিতে পারতাম?”
লিলি বিস্ফারিত চোখে নেহালের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন উত্তর নেহাল দিতে পারে সে ভাবতেও পারেনি। লিলি যতক্ষণে ওর কথা গলধঃকরণ করল, ততক্ষণে সে উঠে এসে লিলির পাশে দাঁড়িয়েছে।
নেহালের চোখে একটা নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি থাকলেও সেখানে যেন একইসাথে খানিকটা তৃপ্তিও বিদ্যমান।
“সেটা তো জানি না। তবে আরেকটু সাহস আর বুদ্ধি যে বাড়ত সেটুকু বাজি ধরে বলতে পারি।” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল লিলি।
নেহাল আজ অপ্রতিভ হলো না, নির্মল হাসল কেবল। প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করল,
“কখন যাব আমরা?”
“শ্বশুরবাড়ি যাবার এত তাড়া কেন আপনার?”
“কারণ শাশুড়ির পাগল মেয়ে সেখানে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে, সাথে আমাকেও পাগল বানানোর পায়তারা করছে।”
“আমি পাগল?”
“কিঞ্চিৎ পাগল আর অনেকটা ছেলেমানুষ।”
“আমি মোটেই আণ্ডাবাচ্চা নই।”
“তার থেকে কমও নও।”
লোকে জেনে-বুঝে বিষপান করে আর নেহাল অজ্ঞাতেই যেন দঁড়ির ফাঁসে গলা ঢুলিয়ে দিল নাকি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুঝতেই পারল না। কারণ ওর কথা শেষ হবার পরেই লিলি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,
“বাচ্চা মেয়েরা কী কী করে সব যদি না দেখাই তাহলে আমার নাম বদলে রাখব। সার্টিফিকেট আর এনআইডি চেঞ্জ করা, আরেকবার আকিকা দেবার ঝক্কির জন্য হলেও আমাকে প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে হবে।”
***
রোমেনা এসে লিলিকে খাইয়ে দিয়ে গেলেন।
“কী রে, জ্বর তো এখন আর নেই। ব্যথা বেশি নাকি? মুড অফ মনে হচ্ছে।”
“ব্যথা আছে। তবে আমার আসলেও মুড অফ।”
“কেন?”
“তোমার কোহিনূর হীরা ছেলের জন্য।”
“কী করেছে আমার সুবোধ ছেলে?”
“আমাকে পাগল বলেছে। আবার বলেছে আমি নাকি বাচ্চা মেয়ে।”
রোমেনা মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, “শোন, এগুলো একদম পাত্তা দিবি না বুঝলি। এভাবে রাগ করে বসে না থেকে ওই হাঁদারামকে বুঝিয়ে দে তুই কতটা পুঁচকে। তাহলেই তো হয়।”
লিলির কিছুটা সময় লাগল বুঝে উঠতে। এরপর খিলখিলিয়ে হেসে রোমেনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি এত ভালো কেন মা? তোমার মতো এমন সুপার ডুপার শাশুড়ি পেলে তো সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে বিয়ে করতে।”
“আমি এক পিসই বুঝলি। সেটা তো বুকড। ছেলেকে তো আবার বিয়ে করাব না। তুই পারমিশন দিবি নাকি?”
“এ্যাহ্! ঘুণাক্ষরেও না। তোমার ছেলে এমন চিন্তা করলে সোজা মামলা ঠুকে দেব, বুঝলে?”
“তাই নাকি! পছন্দ হয়েছে বুঝি আমার ছেলেকে?”
লিলি এবার অপ্রতিভ হলো, সহসা কথা খুঁজে পেল না৷ এমন খোলাখুলি এসব কথা বলা যায় নাকি! ওরও তো লজ্জা টজ্জা বলে কিছু আছে।
রোমেনা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে লিলির চিবুক নিজের একটা হাত দিয়ে তুলে বললেন,
“কী রে? বলবি না?”
লিলি সলজ্জ মুখে মৃদু স্বরে কথা ঘোরানোর সাথে সাথে কিছুটা স্বীকারোক্তির স্বরে বলল, “তোমার ছেলেকে কিছুটা মনে ধরেছে ঠিকই, তবে তোমাকে বেশি পছন্দ হয়েছে।”
“এই কিঞ্চিৎ কবে অসীম হবে তুই বুঝতেও পারবি না। এভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মনের সাথে মন মিলে যায়।”
রোমেনা আজ ভারি স্বস্তি বোধ করলেন৷ জীবনে এই প্রথমবার নিজের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল হলো কিনা এমন ভাবনাও তার আত্মবিশ্বাসী মনে উঁকি দিয়েছিল। এবার বুক থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেল তার।
একবার যখন দুটো বরফের টুকরো গলতে শুরু করেছে, তখন অতিসত্বর যে তা তরলে রূপান্তরিত হয়ে মিলেমিশে একাকার হবে, এটা তিনি দিব্য দৃষ্টিতে যেন দেখতে পেলেন।
***
লিলিকে সাথে নিয়ে নেহাল এসেছে। কিন্তু বাসায় তালা ঝুলানো। লিলি উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“এত সকালে আম্মু কোথায় গেছে?”
“কল দিয়ে দেখো।”
নেহাল বলার আগেই লিলি নিজের ফোনটা বের করে ফেলেছে। ওপাশে রিং হয়ে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো।
“আম্মু, কই তুমি? আমি বাসায় আসলাম, তুমি কি বাজারে?”
“না রে। আমি বাসে। তোর দাদু বাড়িতে যাচ্ছি।”
“হঠাৎ?”
“একটা কাজ পড়ে গেছে। সবাই একসাথে বসবে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। জরুরি তলব।”
লিলির উড়তে থাকা মন মুহূর্তেই মাটিতে আঁছড়ে পড়ল। ভেতরের অপরাধবোধ বেড়ে গেল যেন৷
“গতকাল তোকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরিস্থিতি এমন হলো…” এটুকু বলে তৌহিদা থেমে গেলেন৷
“তুমি কাল ফিরবে?”
“কাল মনে হয় ফিরতে পারব না। তিন চারদিন বা সপ্তাহখানেক লাগতে পারে। তোর কিছু লাগবে বাসায়?”
“তোমাকে লাগবে আম্মু। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
“কী বলবি? বল না!” মা’য়ের গলায় উৎকন্ঠা। তিনি লিলির কথা শুনতে চাইছিলেন উদগ্রীব হয়ে।
“সামনা-সামনি বলতে হবে। আমি ফিরে যাচ্ছি।”
“তোর শরীর এখন কেমন?”
“ভালো। তুমি বেশি দেরি করবে না কিন্তু। ওখানে এসবের মধ্যে না গেলেই কি হতো না?”
“ওরা এত করে আসতে বলল। হাজার হোক, তুই ওদেরও রক্ত।”
“হুম।” এসবে লিলি একেবারেই আগ্রহবোধ করে না। মন পুড়তে থাকে। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে, অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গ্রাস করল।
“তোর কাছে তো চাবি আছে। বাসায় যা।”
“আজ আর ইচ্ছে করছে না।”
রিকশায় বসেও মন খারাপের রেশ রয়ে গেল। মান অভিমানের অবসান, নিজের প্রথম ভালোবাসার গল্প এসব ফোনে বলা যায় নাকি।
“বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।” নেহালের কথায় লিলি খানিকটা ধাতস্থ হলো। এমন আনমনা লিলিকে দেখতে ওর ভালো লাগছিল না একেবারে।
“তাহলে আজ হুড ফেলে ভিজব।”
“তোমার এখনো জ্বর আছে লিলি।”
“এটা বাচ্চা মেয়ের অবুঝ আবদার। সকালে ছেলেমানুষ বলেছিলেন না?”
“তুমি আগে সুস্থ হও, এরপর ভিজবে।”
বলতে বলতে বৃষ্টি শুরু হলো। লিলি রিকশার হুড ফেলে দিল। নেহালের সমস্ত আপত্তি মাঠে মারা গেল। এই মেয়ে এত জেদি কেন ভেবে কপাল চাপড়াল।
“আজ শাড়ি পরে হাত ভর্তি চুড়ি পরলে জম্পেশ হতো। এ্যাই, আরেকদিন ভিজব ওইভাবে ঠিক আছে?”
নেহাল মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল। ওর কানে যেন বৃষ্টির রিমঝিম ছাপিয়ে কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ এসে ঢুকল। লিলির ‘এ্যাই’ বলাটাও ভীষণ উপভোগ্য মনে হলো।
বৃষ্টি স্নাত লিলির দিকে তাকিয়ে নেহালের অকস্মাৎ মনে হলো, এমন সৌন্দর্য সে কখনও দেখেনি। এমন সহজাত ভঙ্গিতে কলকলে হাসিতে বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়া কোনো তরুণীকে সে আগে খেয়াল করেনি। কালো মেঘের ঢেউয়ের ভাঁজে এক চিলতে বিদ্যুৎ চমকের মতো আলোকিত মেয়েটা নেহালের শূন্য হৃদয়ে যেন পূর্ণতার পসরা সাজিয়ে হাজির হলো।
খুব কাছ ঘেঁষে বসে থাকা উৎফুল্ল, প্রাণবন্ত মেয়েটাকে অনন্য মনে হচ্ছে ওর কাছে। যার মনে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ আর রোদ্দুর এসে আনাগোনা করে যায়। নেহাল একটা শব্দ মনে মনে উচ্চারণ করল,
“আনপ্রেডিক্টেবল লেডি।”
“আজকে কিন্তু আমার আবদার শেষ হয়নি।”
“এখন কি আইসক্রিম খেতে চাইবে?”
“উহু। এত সহজ হলে তো হতোই। আমি ভীষণ ভীষণ দুরন্ত বাচ্চা ছিলাম। একদিন ছেলেবেলাটা ফিরিয়ে আনি নাহয়। আপনার জানা প্রয়োজন।”
“তাহলে বলে ফেলো।”
“আচ্ছা, যান। এত কঠিনও না। আরেকটু সহজ করি। এখন আমরা চিড়িয়াখানায় যাব, এরপর শিশুপার্ক। বাচ্চাকাচ্চা বলে কথা, তার উপর পাগল। কী কী পাগলামি করা যায় ভাবছি।”
“আমি মাফ চাইছি। আর কখনো বলব না। এবার কি মাফ করা যায়?”
গভীর চিন্তায় ডুবে যাবার মতো ভঙ্গি করে এরপর মুখ খুলল লিলি, “আচ্ছা, যান৷ এবারের মতো মাফ করলাম। এরকম ভিজে টিজে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবে না। আমি বয়সে ছোট হতে পারি, কিন্তু বাচ্চা নই।”
“সেটা আমি হাড়েমজ্জায় জানি।”
“আপনি আবার আমাকে খোঁচা দিলেন বলে মনে হলো।”
নেহাল সন্ত্রস্ত গলায় দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল, “একদম না। আমার আর নতুন ঝামেলা… না, না, নতুন ইয়ে মাথায় নেবার মতো…”
“হয়েছে হয়েছে। ঢং করতে হবে না। পুরোপুরি মাফ করেই দিয়েছিলাম। কিন্তু নতুন করে খোঁচা দেবার জন্য সেই রায় বাতিল করব কিনা ভাবছি।”
“এই, না না, একদম না।”
“তাহলে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে।”
“এটার জন্য কোনো বিনিময়ের প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেই রাজি।”
লিলি ওর ভেজা হাত নেহালে দিকে বাড়িয়ে দিল, নেহালও সেই হাতটা নিজের মুঠোবন্দি করল। ওদের বন্ধুত্ব হবার মুহূর্তের স্বাক্ষী হলো অজস্র বৃষ্টি ফোঁটা, সুদূরের ওই বিশাল আকাশ আর ওই মেঘ।
***
পরেরদিনও লিলি ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারল না। বিকেলে তরী আর মিতু এসে হাজির হলো বাসায়। সাথে অবশ্য ইলা এসেছে। এই মেয়েটাকে ওরা কেউই তেমন পছন্দ করে না। বড্ড গায়ে পড়া। নিজে থেকেই যেচে পড়ে ওদের সাথে চলে এসেছে।
“তোর বর কই? অসুখে কেমন কেয়ার করল?” তরী জানতে চাইল।
“যথেষ্টই করল।”
“শোন, বয়স অনেক বেশি তো। একটু বাজিয়ে নিস। হুট করে গলে যাস না। বেশি বয়সে অল্প বয়স্ক বউ পেলে প্রথম প্রথম সবাই একটু লেগে থাকে, কয়দিন পরে দেখবি সব হাওয়া।” ইলা বলে উঠল।
লিলির ভীষণ রাগ হলো, তবে সে বলার আগে মিতুই বলল, “তোর এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?”
“এক্সপেরিয়েন্স লাগে নাকি! আশেপাশে কত দেখি!”
“যাকে নিয়ে বলতে চাইছিস সেই মানুষটা কেমন, সেটা দেখে তারপর এমন জাজমেন্ট করিস। একজনকে দেখে দশ জনকে বিচার করা বন্ধ কর।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল লিলি, সে রাগ, আনন্দ কোনোকিছুতেই রাখঢাক করতে পারে না।
মিতু আর তরী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল ইলাকে নিয়ে। ওদেরও ভীষণ রাগ হয়েছে কেন একে সাথে আনতে গেল।
***
নেহালকে আজ কেমন যেন অবসন্ন লাগছিল। ওর বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বললেও কেমন যেন মেকি বলে মনে হচ্ছিল। ওর সাথেও কথা বলছে না। যখন কোনো বাক্যবিনিময় না করেই ঘুমোনোর আয়োজন করল ছেলেটা তখন লিলি চিন্তিত হলো।
“কী হয়েছে আপনার?”
“আমার জন্য তোমার অনেক সমস্যা হয়ে গেল।”
“মানে কী?”
“তোমার আমার মধ্যে বয়সের একটা সুস্পষ্ট ব্যবধান আছে। এটা…”
“আপনি ইলার কথা শুনেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমার উত্তর শোনেননি?”
“শুনেছি। তবুও তুমি হয়তো মানিয়ে নিতে চাইছ, কিন্তু ওরা অনেক কথা বলছে।”
“ওদের মতামত আপনাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি আমি কী ভাবছি সেটা?”
“আমার কাছে তোমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা। তবুও…”
“তাহলে এখন তবুও, কিন্তু এসবের আর স্থান দিয়েন না৷”
লিলি একটু থেমে প্রস্তাব দিল, “চলুন না একটু বারান্দায় বসি। খুব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে।”
লিলি এখন একটু খুঁড়িয়ে চললেও ভালো মতোই হাঁটতে পারছে। তবুও সে বলল, “হাতটা ধরুন তো। আমার পায়ে ব্যথা ভুলে গেলেন?”
নেহালের স্বভাবসুলভ হাসি তবুও অনুপস্থিত। তবে সে লিলির হাত ধরে বারান্দায় এলো।
সত্যি সত্যি আজ আকাশে জোৎস্নার বান ডেকেছে। অপূর্ব আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। ফুলের সুবাস কেমন অপার্থিব করে তুলেছে পরিবেশটা।
“এখনো মন খারাপ তোমার নেহাল?”
নেহাল চমকে উঠে লিলির দিকে মোহাবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটা যে শুধু সান্ত্বনা দেবার জন্য বলার জন্য বলেনি তা এখন পরিষ্কার। লিলির মুখে নিজের নাম অন্যরকম একটা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে নিল ওকে।
“চাঁদের দিকে একবার তাকাও প্লিজ! আমি কিছু বলতে চাই।”
লিলির কথায় নেহাল ওর মোহাবিষ্ট দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে নিয়ে গেল। লিলি আচমকা ঠোঁট দুটো নেহালের গালে আলতো করে ছুঁইয়ে দিল।
কী ঘটেছে বুঝতে এবং ঘটনার সাথে ধাতস্থ হতে হতে নেহাল লিলিকে সেই ত্রিসীমানার মধ্যে দেখতে পেল না। ওর একটা হাত অবচেতনেই নিজের গালে চলে গেল, মুখে চওড়া একটা হাসি ফুটল।
***
লিলি নেহালের মন ভালো করার একটা তাগিদ যেন ভেতরে ভেতরে প্রচন্ডভাবে অনুভব করছিল, একইসাথে নিখাঁদ ভালোবাসার বিশ্বস্ততায় আশ্বস্ত করতে চাইছিল৷
আগেপিছে কিছু না ভেবেই তাই ওমন একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে। এখন পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা এসে ওর উপরে ভর করেছে যেন। এমনভাবে কোনোদিন লজ্জা পাবে তা কবেই বা ভাবতে পেরেছিল লিলি!
উঁকি দিয়ে একবার নেহালকে মিষ্টি করে হাসতে দেখল। রাঙা হেসে লিলি নিজের হাত দুটোর পাতা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল সলাজে।
…….
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২২)
নুসরাত জাহান লিজা
পুষ্পিতাকে তৈরি করে দিল নওরীন। অনেকদিন স্কুলে যাওয়া হয়নি। এখন আবার মূলস্রোতে ফিরতে হবে মেয়েটাকে।
“স্কুলকে মিস করছিলি?”
“আমার কোনো বন্ধু নেই।”
“আমি তোর বন্ধু নই বুঝি?”
“হ্যাঁ তো।”
“এখন তোর ক্লাসের বাকি সবার সাথে বন্ধুত্ব করবি। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা।”
“কই তোমাদের মা মেয়ের হলো?” রিয়াদ ওদের আজকে স্কুলে দিয়ে এরপর অফিসে যাবে।
“আর দুই মিনিট। মেয়েকে নিয়ে বেরোও, আমি আসছি।”
“এই দুই মিনিট আর শেষ হলো না তোমার।”
“তোমারও তাড়া দেয়ার অভ্যাস আর গেল না।”
“চল, মা, আমরা যাই। তোর মা অলওয়েজ লেট।”
রিয়াদ হেসে কথাটা বলে বেরিয়ে গেল পুষ্পিতার হাত ধরে।
নওরীন চোখ রাঙিয়ে বলল, “রিয়াদ…”
বাকিটা আর বলল না, তৃপ্ত হাসি ফুটল মুখাবয়বে। এতদিন স্বপ্নে দেখে আসা সুখী পরিবারের ছবিটা এত দ্রুত পার্থিব জগতে ধরা দেবে নওরীন ভাবতে পারেনি।
***
নেহাল অফিসে এসেছে। কিন্তু ওর মন জুড়ে গতকাল রাতের আবেশ ছড়িয়ে আছে। ডাকাবুকো লিলি এমন কাণ্ড ঘটাবে এটায় তেমন বিস্মিত হয়নি, কিন্তু এরপর থেকে মেয়েটা কেমন লাজুক লতার মতো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। এই নতুন রূপেও মেয়েটা অনন্য।
লিলি ভয়ংকর, লিলি অকপট আবার অন্য আরেকটা লাজুক সত্তাও ওর মধ্যে বিদ্যমান। ওদিক থেকে গ্রিন সিগনাল যখন এসে গেছে নেহালও এবার আর কোনো দ্বিধা রাখতে চায়নি।
সে লিলিকে একটা প্রশ্ন করেছিল রাতে, “তোমার মনে কোনো দ্বিধা, সংশয় নেই তো।”
উত্তরে লিলি আরেকবার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলেছিল, “আমি অনেক ভেবেই এগিয়ে এসেছি। আর একবার যখন পা বাড়িয়েছি, তখন দ্বিধা, সংশয় সব চুকিয়ে বুকিয়ে বিদায় করেছি।”
নেহাল লিলির হাত দুটোকে নিজের হাতের মধ্যে ধরে গভীর আবেগে বলেছিল, “আমিও সকল সংকোচকে ছুটি দিয়ে দিলাম। আজ থেকে আমরা একাত্ম হলাম।”
দুটো ঋণাত্মক মানসিকতার মানুষ সেই মুহূর্তে একটা মোহনায় এসে মিশে গেল। কাগজে কলমে পরিণয় সূত্রে তারা আগেই আবদ্ধ হয়েছিল, গতকালের জোৎস্নাশোভিত রাতটা যেন এসেছিল অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে। দুটো মানুষের সমস্তটা একাকার হয়ে গেল ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। আলোকবর্ষ দূরত্বও ভালোবাসার এই প্রবল স্রোতের কাছে যেন নস্যি।
তা না হলে ক’দিন আগেই যে এতটা দূরের মানুষ ছিল, সামান্য সময়ের ব্যবধানে লিলির হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে নেহালের বিস্তার কী করে হতো!
ভলিউম একেবারে কমিয়ে দিয়েই সে ইউটিউবে চলে এলো লিলির ভিডিও দেখতে। নতুন ভিডিও বাদে সবগুলো বেশ কয়েকবার করে দেখা হয়ে গেছে ওর।
***
লিলির পরীক্ষা দু’দিন পরেই, কিন্তু গতকাল কিচ্ছু পড়া হয়নি। তাই আজ অন্য ভাবনায় মন দিতে পারেনি। যদিও বারবার উড়ুক্কু মনটা উড়ে উড়ে ছুটতে চাইছে, কিন্তু বেরসিক পরীক্ষার তো কোনো সময় জ্ঞান নেই। তাই মনকে কষে পড়ার টেবিলে বাঁধতে চাইছে।
ফোনটা বাজছে অনবরত, সোহানটাকে এবার আচ্ছা মতো সিধে করতে হবে। এত নম্বর ব্লক করেছে, তবুও ব্যাটা ছ্যাঁচোড় কল দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে।
“ফোনটা ধরছো না কেন? অনেকক্ষণ থেকে বাজছে।”
“বাজুক, সব ফোন ধরতে নেই।”
নেহাল কখন এসেছে লিলি খেয়ালই করেনি। এখন কথা বলায় ঘুরে তাকিয়ে উত্তর দিল।
“কে?”
লিলির মাথায় একটা ছোট্ট পোকা আছে, সেটা আরেকবার ঘ্যানঘ্যান করে ওকে মন্ত্রণা দিতে লাগল।
“তোমাকে বলেছিলাম না, আমার এক্স…”
বাকিটুকু বলার আগেই নেহাল গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “কেন কল দিচ্ছে?”
“সেটা আমি কী করে জানব। তোমার জানতে ইচ্ছে হলে কলটা রিসিভ করে ওকে জিজ্ঞেস করো।”
নেহাল সত্যি সত্যি ফোনটা হাতে নিল, কল কেটে গেছে ততক্ষণে।
“আমি এর ব্যবস্থা করছি, তুমি চিন্তা করো না।”
“তোমার বুদ্ধি আমি জানি। আমি ছ্যাচড়াদের নিয়ে চিন্তা করি না। আমি নিজেই হ্যান্ডেল করতে পারব।”
“আমার বুদ্ধি জানো মানে?”
“তুমি গুগলে হয়তো এবার সার্চ করে বসবে, ‘বউয়ের এক্স বয়ফ্রেন্ডকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়?’ আমি শিওর।” বলেই হেসে ফেলল লিলি।
নেহাল আরেকবার অপ্রস্তুত হলো। এটা নিয়ে কতবার কতভাবে বিচ্ছু মেয়েটা কথা শোনাবে কে জানে!
“মোটেও না।”
“মোটেও হ্যাঁ।”
“ভুলভাল বাক্য।”
“কেন? তুমি কি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ আর সুনীতিকুমারের কাছ থেকে বাংলার কোর্স করেছ নাকি যে তোমার সাথে কথা বলতে হলে অভিধান মেনে ব্যাকরণ গুলে খেয়ে কথা বলতে হবে?”
“হয়েছে। যা ইচ্ছে তাই বলো।”
“আমি কি বাচাল নাকি, যা ইচ্ছে তাই বলব।”
“আগে ওইটার ব্যবস্থা করো।”
“কোনটার?” নেহালের হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনে লিলি বুঝতে পারল না প্রথমে।
“তোমার ফোন যে বারবার বাজাচ্ছে।”
“তুমি কি জানো, তুমি অন্নেক কিউট একটা পোলা। কথাবার্তায় আরকি।”
নেহালকে জ্বালাতন করতে, কিঞ্চিৎ নাজেহাল করতে লিলি এখনো মজা পায়। উপভোগ করে ছেলেটার অপ্রস্তুত ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখটা। একগাল হেসে লিলি আবার বলল,
“দেখতেও। ছেলেদের এত সুন্দর হতে নেই।”
“সৌন্দর্যে বুঝি কেবল মেয়েদের অধিকার?”
“সকলের অধিকার।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”
“পড়তে বসেছি। পরে কথা বলব তোমার সাথে। তোমার প্রসংশা করলাম, আমাকে মিথ্যা করে হলেও কিছু স্তুতিবাক্য বলতে পারতে। কিচ্ছু পারো না তুমি।”
নেহাল এবার লিলির কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “মিথ্যে করে বলছি না, সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি করে বলছি, আমার চোখে তোমার মতো করে কেউ কখনো পড়েনি। একটা সুতীব্র কৌতূহল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে তোমার দিকে। কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারিনি। আমার জন্য তোমার চাইতে সুন্দর আর কেউই নেই।”
লিলি মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কেন জানে না, এর উত্তর দিতে পারল না। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া স্তুতিবাক্যে সে বুঁদ হয়ে রইল মুহূর্তকাল। জানে না সে সত্যিই সুন্দরী কিনা। কিন্তু যে ভালোবাসে তার চোখে মুগ্ধতা দেখতে ভালো লাগে।
***
সকালে লিলি মাকে কয়েকবার কল করল। একবার কথা হয়েছে। আজ ফিরবেন দুপুরের আগেই।
ওর মাথায় কেবল এটাই ঘুরছে মা কতটা খুশি হবেন। লিলির চিন্তায় মা’য়ের বিষন্ন মুখটা বারবার ভেসে উঠছে মানসপটে। আজ নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হবেন।
মা’য়ের আনন্দের প্রকাশ কেমন হবে! লিলি যেই কথাটা প্রথম বলবে তা হলো,
“আম্মু, তোমার পছন্দ আমার জন্য খারাপ হতেই পারে না। তুমি যাকে আমার জন্য বাছাই করেছ, আমার জন্য এর থেকে ভালো কেউ হতেই পারত না। তোমাকে অনেক ভালোবাসি আম্মু।”
মাকে কখনো কোনো কথা বলতে সংকোচ হয়নি ওর। তবে আজ বেশ কয়েকবার মনে মনে আওড়ে নিয়েছে, তবুও বুকে ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে।
গতকালের পরীক্ষা ভালোই হয়েছে প্রস্তুতি অনুযায়ী। পরের পরীক্ষা তিনদিন পরে। আজ বাসাতেই ছিল। টেবিল এলোমেলো লাগছিল বলে সেটা গোছাচ্ছিল।
হঠাৎ খেয়াল করল হন্তদন্ত হয়ে রোমেনা ঢুকলেন, তার এলোমেলো অভিব্যক্তি দেখে লিলির ভেতর থেকে যেন অশুভ ইঙ্গিত এলো।
“কী হয়েছে মা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
ভাঙা গলায় রোমেনা কেবল বলতে পারলেন, “চল, আমাদের এক্ষুণি বেরুতে হবে।”
“কোথায়?” কোনোমতে উচ্চারণ করল লিলি।
“তৌহিদা হাসপাতালে।”
লিলির হাত থেকে বই পড়ে গেল, হাঁটুতে জোর পাচ্ছে না৷ রোমেনা এগিয়ে এসে ওকে আগলে নিলেন।
……
(ক্রমশ)