মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-০৯

0
3267

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা

নেহাল কাজে মন দিতে পারছে না। একটা অসহনীয় অস্থিরতা ওকে বারবার গ্রাস করছে। কিন্তু কয়েকদিনের ছুটির পরে বাসায় ফেরার উপায় নেই এখন। বিয়ের পর প্রথম অফিসে এসেছে, কলিগরা সকলেই নিমন্ত্রিত ছিল। আজ নানারকম ঠাট্টা মশকরা পর্ব থামছেই না তাদের। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে সেসবের মুখোমুখি হলেও ভেতরে ভেতরে কেমন গুমোট হয়ে আছে।

মনে কালবৈশাখী জমিয়ে রেখে বাইরে ঝলমলে রোদের প্রকাশ ঘটানোর মতো বিড়ম্বনা বোধহয় আর কিছুতে নেই। বিষয়টা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করল নেহাল।

আজ সকালে মায়ের সাথে যেভাবে কথা বলেছে তাতে সে ভীষণভাবে অনুতপ্ত। আজকের আগে নেহাল কোনোদিন এভাবে তার সাথে কথা বলেনি। যার মুখ কখনোই ম্লান হয় না, শুধুমাত্র ওর কথায় আহত হয়ে সেই মুখে বিষাদ জমেছে, এটা যে নেহালের জন্য কতটা পরিতাপের সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। বেরুবার আগে দেখা তার মুখটা নেহালের মননকে আচ্ছন্ন করে রইল সারাটাক্ষণ।

সবই হয়েছে ওই মেয়েটার জন্য, লিলি। যে ওর স্ত্রী। এই বিষয়টা মাথা আসতেই মনটা তেতো হয়ে এলো। বিয়ে করে কোন গ্যাঁড়াকলের মধ্যে ফেঁসে গেছে সেটা যদি সে পুরো দুনিয়াকে দেখাতে পারত, তাহলে যারা আজ ওর বিয়ে নিয়ে খুঁনসুটিতে মেতেছে, তারা নিজেরা হয়তো লজ্জিত হতো নিজেদের কাণ্ড দ্বারা। সুখী দাম্পত্যের সূচনা লগ্নে মানুষ যতটা উচ্ছ্বসিত থাকে, তেমন করেই মিথ্যামিথ্যি সুখ দেখানোর এই চেষ্টায় নিজেকে কপট মনে হচ্ছে। কিন্তু এই কথা নিজের পরিবার, খুব কাছের দুই একজন বন্ধু ছাড়া কাউকে বলাও যায় না।

নেহাল পারছে না সব অস্বীকার করতে, না পারছে জুড়ে থাকতে। এই গ্যাঁড়াকল থেকে সন্তরণের পথ ওর জানা নেই। সে কেবল অপেক্ষা করছে অফিস শেষে কখন মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু স্বস্তির দেখা পাবে।

***
রোমেনা নিজের ঘরে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন। নওরীন আর আশফাক এতক্ষণ এটা-সেটা বললেও তার মুখ থমথমে। নওরীন বেরিয়ে গেল আধাঘণ্টা বাদে।

আশফাক এগিয়ে তার পাশে বসে রোমেনার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “রুমু, তোমাকে আজ অচেনা মনে হচ্ছে। তোমাকে চিনতে পারছি না। এমন করছ কেন? নেহালের কথায়?”

রোমেনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীর গলায় বললেন, “নেহালের কথায় কিছু মনে করিনি। কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোর মধ্যে যদি এ্যাডজাস্টমেন্ট না হয়, কী হবে বলো তো? ভালো চাইতে গিয়ে কি ভুল করে ফেললাম?”

আশফাক স্ত্রীর হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলেন, এরপর বললেন, “সেটা ভাবার সময় তো এখন আর নেই৷ আগে ভাবলে ভালো হতো। এখন কেবল সময়ের হাতে সব ছেড়ে দাও। নেহাল বুদ্ধিমান ছেলে, লিলিকে যতটা দেখলাম, সে-ও অবুঝ নয়। হুট করে তাদের অনিচ্ছায় একসাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। মানিয়ে নিতে তো একটু সময় লাগবেই। এটুকু সময় আমাদের দেয়া উচিত, তাই না?”

“হুম।” এর বেশি কিছু তার মুখ দিয়ে বেরুলো না।

আশফাক আচমকা বললেন, “তুমি রোমেনাই তো? নাকি অন্য কোনো মানুষের আত্মা ভর করেছে বলো তো? অন্ধকারে ঘাড়টার মটকে দিয়ে যাবে না তো?”

রোমেনা ঝট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “আমি অন্য কোনো সুন্দরী রমণীর আত্মা না, শ্যাওড়া গাছের হাড়জিরজিরে পেত্নী। হয়েছে শান্তি?”

“আর শান্তি! একটু পরে আমার ঘাড় মটকানো হবে, আমার কি বিলাপ করে কাঁদা উচিত?”

“বুড়ো হয়েছো, ঢং কমে নাই! ভীমরতি হয়েছে বুড়োর।”

“বয়স তো শরীরের বাড়ে, মনের কি বয়স বাড়ে? আমার তো তেইশের পরে আর বাড়েনি যখন তোমাকে প্রথম দেখি।”

“আহা! এই চাপার জোরেটাই আছে। শোনো, আমার রাগের সুযোগ নিয়ে যে দুইটা মিষ্টি খেয়ে নিলে সেটার কী হবে?”

“তুমি দেখেছ?”

“আমার এই দুই চোখের সাথে অদৃশ্য চোখ আছে তোমার সাথে সেট করা। সুগার লেভেল বাড়তি ছিল তোমার। তাও কেন করলে?”

“যাক, শ্যাওড়া গাছের পেত্নী বিদায় হয়ে স্বরূপে ফিরলে।”

“এসব রসযুক্ত কথা বলে আমাকে ভোলানো যাবে না। যা বললাম উত্তর দাও।”

“আচ্ছা, স্যরি।”

“স্যরি আমাকে না বলে অসুখকে বলা উচিত। সে না মাফ করলে আমার আর কী করার।”

আশফাকের ভীষণ ভালো লাগে স্ত্রীর এই উৎকণ্ঠা। তিনিও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন রোমেনার মনের অবস্থা দেখে। এখন স্বস্তি ফিরেছে। মিষ্টি তিনি একটা খেয়েছেন, নওরীনকে দুটোর কথা বলতে বলেছিল রোমেনাকে রাগিয়ে দিতে। রেগে গেলে নিজের মধ্যে ফিরে আসেন তিনি, এটা আশফাক জানেন। মান ভাঙানোর জন্য এমন ছোট্ট নির্দোষ মিথ্যে বললে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়!

***
লিলি অনেকবার ভেবেছে রোমেনার সাথে গিয়ে দুটো কথা বলে আসবে। কিন্তু কী এক দ্বিধা ওকে বাঁধা দিয়েছে বারবার। এই ভদ্রমহিলাকে সে অল্প সময়েই ভালোবেসে ফেলেছে। তিনি যদি ওকে ভুল বোঝেন! এটা ভাবলেই লিলির মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ওর সাথে নেহালের ঝামেলা চলছিল, ওর সাথেই যুঝে নিত। সবার চোখে ওকে এভাবে দেখানোর কী ছিল। লোকটার জন্য নিজের মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এখানেও সদ্য তৈরি হওয়া ভালো লাগার মানুষগুলোও যদি ওকে বুঝতে ভুল করে ফেলে!

তরী আর মিতুর সাথে কথা বলতেও ভালো লাগছে না আজ। নতুন কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ওদের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য। অন্য সময় সে-ই অগ্রণী ভূমিকায় থাকে, আজ থাকল না থাকার মতোই।

তরী তো বলেই ফেলল, “বিয়ে হতে না হতেই বদলে গেছিস। ক’দিন পর তো তোর দেখাই পাওয়া যাবে না।”

কথাটাও যেন কোথাও গিয়ে লাগল। সে বদলে যাবে না, কারোর জন্য, কিছুর জন্যই সে বদলাবে না। তরীর বলার পরেই সদ্য হওয়া দোদুল্যমান সম্পর্কটা একটা শেকলের মতো ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। নিজের অবচেতনেই কখন যেন মনটা আঁতিপাঁতি খুঁজতে শুরু করল মুক্তির পথ।

***
নেহাল বাসায় ফিরে নিজের ঘরে যাবার আগে মায়ের ঘরে চলে এলো। তখনো রোমেনা আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। নেহাল পা টিপে টিপে উল্টো দিক থেকে বিছানায় উঠে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

রোমেনা মাথা তুলে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সারাদিনে দুজনের মনে যতটা অভিমানের মেঘ জমেছিল, এটুকু স্নেহ মাখা সান্নিধ্যে যেন তা বাষ্পীভূত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ছেলের ভেজা চোখের আভাসে মায়ের মনটাও আর্দ্র হয়ে এলো।

“মন খারাপ?” রোমেনাই প্রথম কথা বললেন।

“ছিল। এখন নেই।”

“তুই আমার উপরে রেগে আছিস বাবু?”

“তোমার উপরে আমার কখনো রাগ হয় না৷ তখন উল্টোপাল্টা যা মুখে এসেছে বলে ফেলেছি। সেসব যদি মনে রাখো, তাহলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।”

“যেটা মনে করে তুই কষ্ট পাবি, তেমন জিনিস মনে রাখতে নেই।”

“তুমি পৃথিবীর সেরা মা।”

“তুই এই বয়সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিস কেন? লোকে কী বলবে?”

“মা, আমি মোটেও ভেউ ভেউ করে কাঁদছি না।” উঠে বসে চোখ মুছতে মুছতে বলল নেহাল।

“কাঁদছিস তো। তোর বউ দেখলে তো বুড়ো খোকা বলবে।”

“কে কী বলল না বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”

“এই তো, আবার বাচ্চাদের মতো নাক ফুলিয়ে রেগে যাচ্ছিস। বড় হওয়ার পাশাপাশি একজনের বর-ও হয়েছিস ভুলিস না।”

মায়ের ঝলমলে হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে সারাদিনের অস্থিরতা নিমিষেই হারিয়ে গেল কোন সুদূরে। এই হাসিটুকু নেহালের কাছে অমূল্য। একরাশ মন ভালো করা বাতাস হু হু করে মনে এসে লাগল। সেই আবেশ নিয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে ওর ঘরের নতুন বাসিন্দার কথা মনে আসতেই সেই আবেশ কোথাও ধাক্কা খেল!
……..
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে