মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-০৮

0
3206

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৮)
নুসরাত জাহান লিজা

নেহালের একটা সমস্যা হলো সে প্রয়োজনের সময় প্রায়ই কথা খুঁজে পায় না। এমন হতচকিত মনে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। লিলির চোখে তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি আর কী যেন একটা আছে, সেটা শীতলতা নাকি অন্যকিছু সে জানে না। তবুও মস্তিষ্ক থেকে ম হা যু দ্ধে র পরে একটা কথা বের করে আনতে সক্ষম হলো,

“আমি আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমাকে আপনার পছন্দ নয়, সেটা জানাতে পারেননি?”

“কেন জানাতে যাব? আপনার কাছ থেকে করুণা ভিক্ষা করতে হবে আমাকে? কেঁদেকেটে বলতে হবে, ‘প্লিজ আমাকে বিয়ে করবেন না’?’ এসব আমাকে দিয়ে হবে না।” প্রায় হিসিয়ে উঠে বলল লিলি।

“তাহলে আমি কীভাবে বুঝব? আমার কাছে তো মানুষের মনের কথা বোঝার মেশিন নেই, তাই না?” নেহালের মনে যেটুকু সহানুভূতি ছিল সেটা রাগে বদলে যাচ্ছে।

“এসব ভুজুংভাজুং আমার সাথে দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনার মতো লোকদের আমার চেনা আছে। সব দিকেই তাল দিতে ওস্তাদ।”

“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমার সম্পর্কে কতটা জানেন?”

“আমার জানার দরকারও নেই। তবে আমি কিছু কথা আপনাকে বলতে চাই, সেটা আপনার জানার দরকার। এটা করা যাবে, সেটা করা যাবে না, এসব বিধিনিষেধ একদম জারি করবেন না। বিয়ে করেছেন বলে আমার মাথা কিনে নেননি।”

“আমার কারো মাথা কেনার শখ নেই।”

অস্ফুটস্বরে বললেও কথাটা লিলির কানে গেল। সে বলল, “সেটা বিক্রয়যোগ্য নয়। আরেকটা কথা, মান অপমান বোধ থাকলে এরপর আমার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। যে ধান্দায় বিয়ে করে থাকুন না কেন, সেসব ধান্দা কোনো কাজে আসবে না।”

নেহাল উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লিলি তাড়াহুড়ো করে বলল,

“প্রচুর ঘুম পেয়েছে, এখন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার ইচ্ছে নেই। আমার দিন খারাপ কেটেছে, আপনারও তাই কাটবে। তাই গুড নাইট বলতে পারছি না। অশুভ রাত্রি, দুজনের জন্যই।”

কথা শেষ করে আবার উল্টো দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল লিলি। নেহাল কিছুক্ষণ গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া দিগভ্রান্ত পথিকের মতো বসে রইল। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে না পেরে বিছানার অপরপ্রান্তের পাড় ঘেঁষে গা এলিয়ে দিল। আগের অস্বস্তি বেড়ে গেছে সহস্রগুণ। মর্মপীড়া ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এমন অপমানজনক পরিস্থিতিতে সে জীবনে কোনোদিন পড়েনি, পড়তে হবে তাও কস্মিনকালেও কোনো ঘোরতর দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ভাবতে পারেনি।

মনে মনে নেহাল বন্ধুত্বের পথে হাঁটবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু তা থেকে সরে এলো। তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ইউটার্ন নিল। এই মেয়ের মনের আশেপাশে সে কোনোদিন যাবে না। কিন্তু সে না চাইলেও জীবনের পথ ওদের মিলিয়ে দিয়েছে একই পথের বাঁকে। চাইলেই কী আলাদা পথে যাওয়া যায়!

নেহালের আরেকবার তন্দ্রা ভাব চলে এসেছিল, কিন্তু লিলি উঠে বসতে সেটুকু টুঁটে গেল। মেয়েটা উঠে নিজের ব্যাগের পাশে গেল। ব্যাগের চেইন খুলে কী যেন খুঁজছে। এরপর তা না পেয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

নেহাল কিছু জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও নিজেকে আটকে রাখতে পারল না, “কিছু খুঁজছেন?”

লিলি মাথা উপর নিচ করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।

“কী?”

“বালিশ।”

নেহাল উঠে বসল, ওর মনে হলো এই মেয়ে কেবলমাত্র কমবয়সী তাই নয়, নির্ঘাৎ এই মেয়ের মাথায় গণ্ডগোল আছে, বেশ বড়সড় গণ্ডগোল।

“বিছানায় বালিশ আছে, লাগলে আরেকটার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

“আমি আমার নিজের বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারি না।”

“সামান্য বালিশের জন্য আপনি এমন পাগলামি করছেন?” গলার বিস্ময় কোনোভাবেই চাপা দিতে পারল না নেহাল।

“আপনার কাছে যেটা সামান্য, তুচ্ছ, অন্যের কাছে তাই জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হতে পারে। মা জানে, তাও…”

লিলির মুখে আবারও বিষাদ ঘনিয়ে এলো। মায়ের জন্য মন কেমন করছে। মনে পড়ল, এক দুই দিন ছাড়া সে মাকে ছাড়া থাকেনি। তিনি একা ওকে ছাড়া কীভাবে আছেন, ভাবতেই ভেতরটা টনটনিয়ে উঠল। শুধু কী বালিশ! নিজের প্রিয় চিরচেনা ঘর, অতি প্রিয় আপনজন সবই তো ছেড়ে চলে এলো! কিন্তু এই লোকের সামনে সে কিছুতেই কাঁদবে না।

***
তৌহিদা আজ লিলির ঘরেই শুয়েছেন। পুরো বাড়িতে আজ অনেকেই আছে, তবুও সব যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! একরাশ শূন্যতা ঘর জুড়ে, তার সমস্ত মন জুড়ে।

মেয়ে ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল, তার নিজের শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। প্রেসার ওঠা-নামা করছে, ডায়াবেটিস বাড়তি। তার ভয় হয়, তিনি না থাকলে মেয়েকে কোথায়, কার কাছে রেখে যাবেন! এই চিন্তাও তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।

এই বয়সী মেয়েরা চট করে ভুল করে ফেলে। তিনি তো মা, তিনি ছাড়া তার মেয়ের মাথার উপরে কোনো ছায়া নেই। আরেকটু বড় হলে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে হয়তো এতটা অধীর হতেন না। লিলি প্রচণ্ড অভিমানী, এই অভিমান সহজে গলবে না তিনি জানেন।

নেহালের উপরে মেয়ের জেদের কতটা যেতে পারে সেটাও তার বুঝতে অসুবিধা হয় না। ছেলেটার কথা না ভেবে কেবল স্বার্থপরের মতো নিজের মেয়ের কথা-ই তিনি ভেবেছেন। সেজন্য তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ আছে, সাথে নেহালের উপরে একটা ভরসার জায়গাও তৈরি হয়েছে। এই ছেলে ঠিক তার মেয়েকে ভালোবেসে শুধরে দিতে পারবে। এটা তিনি নিজের চোখে দেখে যেতে চান৷ সেজন্য এটুকু স্বার্থপরতা মা হিসেবে তিনি করতেই পারেন। খুব লোভ হয় আরও কিছুটা বাঁচার, মেয়ের সুখ দেখার জন্য।

এমন ভাবনায় তৌহিদার অপরাধবোধের বোঝা খানিকটা হলেও যেন হালকা হয়ে গেল।

***
বৌভাতের পরে লিলি বাসায় এসেছিল নেহালকে সাথে নিয়ে। মায়ের সাথে মাপা আচরণ করেছে। সৌহার্দপূর্ণ, সহজাত আচরণ না করে পেশাদারী ভঙ্গিতে কথা বলেছে। যা প্রয়োজন সেটুকু বলেছে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায়, কিন্তু এর বাইরে একটা কথাও বলেনি। তৌহিদার ভেজা চোখ লিলিকে গলাতে পারেনি। তৌহিদাও তার মনে জমা শঙ্কা মেয়েকে জানাতে চান না।

সেই রাতের পর থেকে নেহালও আর কথা বলার চেষ্টা করেনি লিলির সাথে। বিয়ের চার দিন পরে আজ রোমেনা সবাইকে নিয়ে সকালের নাস্তা করতে বসেছেন।

লিলিকে পাশে বসিয়ে আমুদে গলায় এটা সেটা বলছিলেন। আনন্দ ঝলমল একটা সুখী পরিবারের ছবি। সম্পর্কের উন্নতি বলতে শাশুড়ি আর নওরীনের সাথে ওর বেশ জমে গেছে বলা যায়।

নেহাল বসতেই রোমেনা স্বভাবসুলভ গলায় ছেলেকে বললেন, “কী রে, তুই না বললি, বিয়ের পরে বউয়ের টিফিন গুছিয়ে দিবি, বিনুনি বেঁধে দিবি, আরও কত কী! এখন তো দেখছি কথাও বলতে পারিস না।”

লিলির হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে আসা নজর এড়ায়নি নেহালের। এই প্রথম মায়ের কথায় বিরক্ত হলো সে। সেটা লুকানোর চেষ্টাও করল না নেহাল। দিগ্বিদিক না ভেবেই বলে ফেলল,

“মা, এভাবে পুশ করছো কেন বারবার? সবকিছু কি এভাবে জোর করে হয়? দু’জনকে একসাথে জুড়ে দিলে, একবারও জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, আমাকে সে বিয়ে করতে চায় কিনা? কেমন ছেলে ওর পছন্দ? প্লিজ সবসময় এমন নিজের মনগড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া বন্ধ করো। একজন বাইরের মানুষ এসেছে, তার এসব খারাপ লাগতে পারে।”

আনন্দময় পরিবেশ নিমিষেই নিস্তব্ধ প্রেতপুরীতে পরিণত হলো যেন। আশফাক, নওরীন আর রিয়াদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রোমেনার দিকে।

রোমেনার সবসময়কার হাসিমুখে একরাশ নিস্তব্ধতা এসে জমা হয়েছে। এত বছরের মধ্যে তার এমন অভিব্যক্তি কেউ দেখেনি। একবার নেহাল অসুস্থ হয়ে যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিল সেইসময়, আরেকবার নওরীনের এক্সিডেন্টের সময় ছাড়া আর কখনো স্ত্রীকে এমন থমথমে মুখে দেখেননি আশফাক। কঠিন পরিস্থিতি সহজ করে নিতে রোমেনা সবসময় সিদ্ধহস্ত।

নেহাল কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেছে না খেয়ে৷ ওর কথাগুলো রোমেনা ছাড়াও আরেকজনের মর্মমূলে এসে আঘাত হেনেছে। লিলি নিজেও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। নেহাল যে এভাবে বলবে, সে ভাবতে পারেনি। ওর মনে হয়েছে সেদিন রাতে আসলেও বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছে, কিন্তু নিজের জেদের কাছে সে হারতে চায়নি বলে দুঃখপ্রকাশ করা হয়নি। সেটা ওর ধাতে নেই।

রোমেনাকে অল্প সময়ে লিলি এতটা ভালোবেসে ফেলেছে আজ বুঝতে পারল। নেহালের উপরে রাগটা বাড়ল। এমন বেয়ারা ছেলেও হয়!
……
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে