#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা
গাড়িতে নেহালের পাশেই বসে আছে লিলি। গাড়ি চলছে লিলির নতুন গন্তব্যের পানে। মেয়েটা অস্বাভাবিক রকম গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে। এই বয়সী একটা মেয়ের জন্য অত্যন্ত বেমানান মনে হচ্ছে। নেহাল প্রথম লিলির যে ছবিটা দেখেছিল, সেখানে অদ্ভুত প্রাণশক্তি মাখা ঝলমলে হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ দেখেছিল। আজ সেটা পুরোপুরি অনুপস্থিত। নেহালের ভেতরের অস্বস্তিবোধ আবার ফিরে আসছিল।
এর আগে একদিন দেখা করার জন্য মায়ের কাছ থেকে লিলির মোবাইল নম্বর নিয়েছিল, কল দেবার পরে যদিও মনে হচ্ছিল মেয়েটা ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা এসব কথাবার্তা চললে নাকি অনেক মেয়েরাই নাকি লজ্জা পায় বলে শুনেছিল, নেহাল তেমনটাই ভেবেছিল সে। লিলি অবশ্য দেখা করতে রাজি হয়নি।
তবে এক দুইবার সকলের উপস্থিতিতে কথা বলার সময় মনে হতো মেয়েটা কী যেন বলতে চায়। একটা অব্যক্ত আর্জি যেন সে দেখেছিল মেয়েটার অভিব্যক্তিতে। সেসবই দ্বিধায় ফেলছিল নেহালকে। লিলির মা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, কোনো সমস্যা নেই। রাজি হয়ে যেতে। এখন কেন যেন মনে হচ্ছে, একবার অন্তত লিলির সাথে খোলাখুলি কথা বলতে পারলে ভালো হতো।
অল্পবয়সী তরুণী মেয়েটার জীবনটা তো এখন ওর সাথে জুড়ে গিয়েছেই। সে নাহয় চেষ্টা করবে বয়সের যেটুকু দূরত্ব তা মন দিয়ে ঘুচিয়ে দেবে। মনে মনে মিশে গেলে বয়সের ওইটুকু দূরত্ব নেহাল নাহয় নিমিষেই পেরিয়ে যাবে।
কতক্ষণ আত্মবিস্মৃত ছিল নেহাল ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারল না। গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনির সাথে আচমকা একটা ফুঁপিয়ে উঠার আওয়াজ কানে আসতে সচকিত হলো সে৷ কখনো কখনো কান্নাই যেন বড্ড স্বাভাবিক বলে মনে হয়, এখন নেহালের মনে হলো লিলি যেন এতক্ষণ পরে এসে খানিকটা সহজ হবার চেষ্টা করছে।
নেহাল একরাশ আড়ষ্টতা নিয়ে লিলির একটা হাতের উপরে নিজের হাতটা রাখল কেবল সান্ত্বনা দেবার জন্যই। কিন্তু লিলি এক মুহূর্তও সময় না দিয়ে হাতটাকে ঝট করে সরিয়ে নিয়ে যেন উদগত কান্নাটাকে গিলে নিল।।
নেহাল ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে হাতটাকে গুটিয়ে নিল। মেয়েটা কি ওকে ভুল বুঝল! খানিকটা সহমর্মিতা প্রকাশ করতে চেয়েছিল, কোনোকিছু না ভেবেই হাত ছুঁয়ে দিয়েছিল। অবশেষে নেহাল কেবল একটা কথাই অস্ফুটস্বরে বলতে পারল,
“স্যরি।”
ওদিকের কোনো সাড়া এলো না। নেহাল আর কোনো কথা বলবার চেষ্টা করল না। নিজেকেই যেন নিজের ভেতরে আরও গুটিয়ে নিল।
***
“যাক, আজ থেকে আমরা পুত্র দায়গ্রস্ত পিতামাতার তকমা কাটালাম। কী বলো?” স্মিত হেসে রোমেনাকে ফোঁড়ন কেটে কথাটা বললেন আশফাক।
“হ্যাঁ, তা তো হলোই। আমার জন্য হয়েছে। এতে তোমার এতে কোনো ক্রেডিট নেই।”
“সবকিছুর ক্রেডিট তো তোমার জন্যই লিখে দিয়েছি। এবার তো আসলেই সবটা তোমার কৃতিত্ব।”
রোমেনা একটু আগে সবরকম আচার অনুষ্ঠান শেষে লিলিকে ঘরে দিয়ে এসেছেন। নেহাল এখনো ছাদে আছে বন্ধুদের সাথে। বাকি দায়িত্ব ওরাই পালন করুক। বেশ কয়েকদিন থেকে ভীষণ ধকল গেল তার। আজ কটা দিন পরে তিনি সুস্থির হয়ে বসতে পারলেন। এরমধ্যেই আশফাক কথাগুলো বললেন।
“কী বলতে চাও? তোমার সব ক্রেডিট আমি নিয়ে নিই? শোনো, আমি তোমার মতো ছ্যাবলা নই বুঝলে? অন্যের ছেড়ে দেয়া কিছু আমি নেই না, সেটা ক্রেডিটই হোক আর যাই হোক।”
“আমি কবে ছ্যাবলামো করলাম?”
“কখন করোনি তাই বলো! তোমার সব হাড্ডি-গুড্ডি আমার চেনা আছে গো।!”
“সর্বনাশ, তুমি কী হাড্ডি স্পেশালিষ্ট নাকি এক্সরে মেশিন? কোনটা?”
“আমি যেটাই হই না কেন, তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। আজকের দিনে একটা শুভকাজ হলো, তাই আজ এসব বন্ধ রাখো৷ দরকার হলে তোমার ওই বিশ্রী সিগারেটেও একটা টান দিতে পারো। আজকের জন্য অনুমতি দেয়া হলো।”
“তুমি বলতে চাও আমি ঝগড়া শুরু করেছি? তুমি আগে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছ আমাকে।”
“না, তুমি আগে বলেছ।”
“আমি সব না করেও সবকিছুর ভাগ চাই, এটা কে বলেছে? আমি?”
আশফাক আর কথা খুঁজে পেলেন না, অকাট্য প্রমাণ, কিন্তু তিনিও চুপচাপ মেনে নিতে চান না। এত অল্পে রণে ভঙ্গ দেয়া যায় না।
“মিথ্যা কথা বলবে না, আমি এসব বলিনি।”
“আমার কাণ আর মেমোরি দুটোই ভীষণ শার্প।”
“হলেই কী, যা বলিনি, সেটা কেন মেনে নেব?”
“কোনো মিথ্যুক লোকের সাথে কথা নেই। আমার বাপের বাড়ি চলে যাব। যাবার সময় লিলিকে সাথে করে নিয়ে যাব। তোমরা বাপ ছেলে আরামে থেকো।” নাটুকে ভঙ্গিতে বললেন রোমেনা।
“কথায় কথায় বাপের বাড়ি যাবার হু*ম’কী দেবার অভ্যাস তোমার আর গেল না।”
“যাবেও না। এটা আমার অব্যর্থ অ” “স্ত্র। জানি এতেই কাজ হবে।”
“সেই, তুমি আমার এখনো অনেক বড় দুর্বলতা আবার তুমিই সবচাইতে বড় শক্তি।”
রোমেনা হাসলেন, তার হাসিতে তৃপ্তির দ্যুতি ছড়ানো। এত বছর পেরিয়ে এসেও সব যেন কেমন নতুন মনে হয় এখনো। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। তার অনেককিছু বলতে হলো না, আশফাক তার অভিব্যক্তিতেই বুঝে নিলেন তার বলা একই কথাগুলো রোমেনারও মনের কথা।
“আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি, এমন কথাই অন্যভাবে বলেছিলাম।”
“আমি সেটাকে সহজ বাংলায় বলেছি।”
আবার শুরু হচ্ছে। একইভাবে কতক্ষণ চলবে কেউই জানে না। তবে আশফাক আর রোমেনা নিজেদের বয়সকে ছাপিয়ে মনের তারুণ্য আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। প্রত্যেকের মধ্যে একটা ছোট্ট শিশু বাস করে, সেটা মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসতে চায় স্থান কাল, পাত্র ভুলে।
***
ঘুমে লিলির চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। সারাদিনের এই অবিশ্রান্ত ক্লান্তিতে সে বিপর্যস্ত প্রায়। আজকের পর না চাইলেও অনাকাঙ্ক্ষিত একটা বদল ওর জীবনে চলে এসেছে। সেটার সাথে সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। নেহাল ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল।
এই লোককে ওর কেন যেন কপট মনে হচ্ছে। ওদিকে বিয়ে করবে বলে নাচছে, অন্যদিকে ওর সাথে কথা বলতে চায়। নিশ্চয়ই ‘বিয়ে যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে, এখন থেকে নাহয় বন্ধুত্ব করি’ এসবই বলত। এসব আলগা দরদ ওর প্রয়োজন নেই বলে সোজা না করে দিয়েছে। নেহালকে দেখলে তো দূর, নাম শুনতেই বিরক্ত লাগছে। মা তো এই ব্যাটার নাম বলতে অজ্ঞান। এই লোক বিয়েতে রাজি না হলেই তো ওর জীবনের এমন দুর্গতি নেমে আসত না। তাই লিলির অবচেতন মনের বড় একটা অংশ নেহাল নামের লোকটাকেই ওর সবচাইতে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নিয়েছে। অথচ লোকটার সাথে ওর জীবন জুড়ে গেছে।
যে ওর এতবড় ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ, তাকে সে হাড়েমজ্জায় বুঝিয়ে দেবে লিলিকে বিয়ে করে কতবড় ভুলটা সে করেছে।
ইতোমধ্যে পোশাক বদলে ফেলেছে, নওরীনের সাহায্য নিয়ে সাজ ধুয়ে মুছে ফেলেছে। এরপর লাইট নিভিয়ে ফুলে সাজানো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মায়ের করুণ মুখটা চোখে ভাসছে। তাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু কোথাও যেন বাঁধছে। তার সাথে আরও কিছুদিন রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো! দূরে যেহেতু মা পাঠিয়েই দিতে চাইছেন, সে দূরেই যাবে, বহুদূরে। কাছে বসেও তার নাগাল পাওয়া যাবে না। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লিলি।
***
নেহাল ঘরে এসে দেখল ঘরজুড়ে অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই নিজের চিরপরিচিত ঘরটাকে অচেনা রূপে আবিষ্কার করল। ঘরের ডেকোরেশনের পাশাপাশি নতুন সদস্যও ঘরে এসেছে। যে মেয়েটা ওর বিছানা অধিকার করে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ওর তো কথা বলার ছিল, অনেককিছু জানার ছিল, জানানোর ছিল।
নেহাল বিছানার অন্যপাশে এসে শুয়ে পড়ল। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। যার সাথে সেভাবে কখনো কথা হয়নি, তার সাথে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে এমন অনুভূতিটা হওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
উল্টো পাশ ফিরে প্রায় জড় পদার্থের মতো নড়াচড়া বিহীনভাবে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। একসময় ঘুম নেমে এলো নেহালের চোখে।
সেই ঘুম ভাঙল কপালে জোর ধাক্কা লেগে৷ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। লিলিকে দেখল নিজের কপাল চেপে গজগজ করতে। কপালের সাথে কপাল কীভাবে ঠোকাঠুকি লেগে গেল, আদৌ সম্ভব কিনা সে বুঝতে পারছে না।
“লাইটটা জ্বালিয়ে দিন তো। এরপর কিছু কথা বলব আপনাকে।”
নেহাল বাধ্যগত মানুষের মতো ওঠে গিয়ে লাইট জ্বালালো। এরপর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার মাথা ব্যথা করছে?”
“কেন? তাহলে কপাল টিপে দেবার ছুতোয় ছুঁয়ে দেয়া যাবে, তাই না?”
এহেন আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না নেহাল, হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখ জুড়ে একরাশ বৈশাখী মেঘ জায়গা করে নিল।
“নিজের বয়সের আশেপাশে কাউকে পাননি বিয়ের জন্য? আমাকেই কেন বিয়ে করলেন?”
উপর্যুপরি আক্রমণে অপমানে মুখ কালো হয়ে গেল নেহালের৷ রাগের পাশাপাশি আরেকটা অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরল, তা হলো অপরাধবোধ। একটা মেয়ের জীবনে সে মেয়েটার সম্মতি ব্যাতিতই সে প্রবেশ করে ফেলেছে। অযাচিত অনুপ্রবেশকারী হবার লজ্জা আর কুণ্ঠা নেহালকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। উত্তর দেবার জন্য কথা খুঁজতে লাগল মনের আঁতিপাঁতি।
……
(ক্রমশ)