#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলির নিজেকে মনে হচ্ছে একগুচ্ছ কাপড়ের বস্তা পরা মমি। বিয়ের ভারি শাড়ি, গহনায় মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাও সেই সকাল সকাল পার্লারে যেতে হয়েছিল। যাবার আগে তরী এসে বলল,
“যা খাওয়ার এখনই খেয়ে নে। ফটোসেশনের আগে তো আর খেতে পারবি না।”
“কেন? কী সমস্যা?”
“আরে, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে তো।”
এটা শোনার পর বেশ ভালো করে খেয়ে নিয়েছে। যদিও ছবি কেমন হবে না হবে সেটা নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ হচ্ছে না৷ তবুও সে ঠিক করেছে আজ যে যা বলে সে লক্ষ্মী মেয়ের মতো তাতেই রাজি হবে।
তৌহিদা নানান ছোটাছুটির মধ্যে থাকলেও মেয়েকে নিজের হাতে তৃপ্তি নিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মেকআপ করা শেষ হতে না হতেই ওর আজ ক্ষুধা লেগে গেল। চার ঘণ্টার উপরে লেগেছে পুরো কণের সাজে তৈরি হতে। তারমধ্যে লিলির খুঁতখুঁতে স্বভাব তো আছেই। এদিকে বেশি লাগছে, ওদিকের রঙ ক্যাটক্যাটে হচ্ছে, ওদিকে আরেকটা মুছতে হবে! নানা কথা।
অন্যান্য সময় দেখা যায় একবার খাবার পরে মা ধরে বেঁধে পরের বেলায় খাওয়ান। যা করতে পারবে না কিংবা খানিকটা অসম্ভবপ্রায় বলে সেই মুহূর্তে মনে হয়, সেটাই করতে চাইবার একটা অদম্য ইচ্ছা থেকেই এটা হচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছে লিলি।
বাসায় ফেরার পরে একবার মনে হলো সাজগোজ চুলোয় যাক, আগে সে কিছু খাবে। কিন্তু তরী আর মিতু হচ্ছে আস্ত ব”দে”র হা”ড্ডি। বিয়ের বিশেষ বিশেষ অংশ দিয়ে নাকি ভ্লগ বানাবে ইউটিউবের জন্য। যদিও লিলির এতে একেবারে সম্মতি নেই। পরে দেখা যাবে ‘বিয়ের দিন কণের রাক্ষুসে খিদে’ শিরোনামে একটা ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে সত্যি সত্যি অনলাইনে আপলোড দিয়ে দেবে। এরপর সেটা রাতারাতি ভাইরাল হবে। লিলি ভাইরাল হতে চায় না এই মুহূর্তে।
বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ওদের দোতলা বাসার ছাদে। এই বাসার নিচতলা এবং দোতলার একটা অংশ ভাড়া দেয়া। ছাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আয়োজন হয়েছে। আরও বড় করে করবে ভাবছিল, কিন্তু রোমেনা হয়তো তৌহিদার উপরে বাড়তি চাপ পড়ুক তা চাননি। তাই কড়া করে না করেছিলেন, কারণ লিলিদের আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সাথে রোমেনাদের কাছের কিছু লোকজন আসবে। তাও সবমিলিয়ে শ’খানেক মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, ভাড়াটিয়াদেরকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে সপরিবারে। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে তার আরও জাঁকজমক করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে এর বেশি প্রস্তুতি তার ছিল না।
ঘণ্টা দুয়েক সঙ সেজে বসে থাকার পরে লিলি শুনল বর এসেছে। ততক্ষণে ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেছে৷ ঘর ভরা মানুষ ওকে দেখতে এসেছে। দর্শনার্থীদের মধ্যে ওর চেনা পরিচিত মানুষই অর্ধেকের বেশি। লিলি এটা বুঝতে পারল না, যারা ওকে এত দেখে অভ্যস্ত, তাদের কৌতূহলটা কোথায়! এদের জন্য সে খাবার কথাই বলতে পারছে না। সকাল থেকে টানা বসে থেকে কোমড়ের হাড় ব্যথা হয়ে গেছে, কিন্তু হাঁটাহাঁটি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ভাগ্যিস মোবাইলটা ওর হাতে ছিল।
অগত্যা সে তরীকে টেক্সট মেসেজ পাঠাল,
“এক মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়। না এলে কী করব জানি না। হয়তো তোদের দুইটার মাথায় হা”তু”ড়ি “মা”র”ব।”
এক মিনিট না হলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে দুজন এসে হাজির হলো এবং ঘরটাও খালি করা হলো ইমার্জেন্সির কথা বলে।
ওরা বরের ছবি তুলে নিয়ে এসেছে। মিতু গদগদ গলায় বলল,
“তোর বরকে একেবারে রাজপুত্রের মতো লাগছে। দেখ?”
লিলির এখন রাজপুত্র দেখার প্রবৃত্তি নেই, সে বলল, “আর আমাকে এখন নিশ্চয়ই মমি মানবী মনে হচ্ছে। ওই ব্যাটার কোনো ছবি আমার সামনে দিলে আমি পেত্নী হয়ে যাব।”
“তুই এমনিতেই পেত্নী। তোর মেজাজের এমন বহর কেন বল তো?” তরী প্রশ্ন করল।
“সকালে খেয়েছি সাতটায়, এখন বাজে প্রায় দুইটা।”
“আর একটু অপেক্ষা কর। এখনই বিয়ের প্রসেসিং শুরু হবে। এরপর বর-কণের একসাথে ছবি তোলা হবে। তারপর…”
“রাখ তোর ছবি! আমার ছবি তোলা তো শেষই। তাছাড়া আমার জীবন নিয়ে টানাটানি। কিছু একটা এখন ব্যবস্থা কর, নইলে ভ্যাম্পায়ার হয়ে সবকয়টার রক্ত শুষে নেব।”
“ছিঃ…”
“ইয়াক..”
দুজনের দিক থেকে এমনই প্রতিক্রিয়া এলো। কিছুক্ষণ পরে মিষ্টি নিয়ে আসা হলো। মিতু কৌশলে সেটা খাইয়ে এক বোতল পানি দিল।
লিলি পানির বোতল থেকে গলা ভেজানোর সময় বেশ খানিকটা পানি শাড়িতে পড়ল। এছাড়া দেখা গেল লিপস্টিকও লেগে গেছে ঠোঁটের আশেপাশে। সেটা ঠিক করতে করতে তরী বলল,
“আজকের দিনে এমন করে থাকিস না। উপভোগ করার চেষ্টা কর। মুহূর্তগুলো কিন্তু আর ফিরে আসবে না।”
উত্তরে কিছু বলার আগেই আরেকবার রুমে মানুষজন আসতে থাকল। লিলির মনে হলো, ওর মতের বাইরে বিয়েটা হচ্ছে বলেই কি সবকিছু এমন অসহনীয় লাগছে? সবসময় কণেকে দেখে এসেছে কেমন দ্যুতিতে উদ্ভাসিত, আনন্দচ্ছটায় জ্বলজ্বলে মুখ। ওর কেন তবে সবকিছু এমন দুর্বিষহ লাগছে!
যখন লিলিকে কবুল বলতে বলা হলো, ওর মনে হলো জীবন থেকে সব উচ্ছ্বাস, আনন্দ যেন প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে কোথাও ভেসে যাচ্ছে। তিতকুটে একটা অনুভূতি হচ্ছিল গলায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কালবিলম্ব না করে ‘কবুল’ বলে দিল। সিগনেচার করার সময়ও সময় ক্ষেপণ করেনি। হাত প্রবলভাবে কাঁপছিল, কিন্তু লিলির যেন ভীষণ তাড়া আজ। কীসের জন্য, সে জানে না!
কণে বিদায়ের আগে তৌহিদা নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদলেন। লিলির চোখে পানির আভাস ছিল, কিন্তু সে জেদ আর অভিমানে সামলে রইল।
লিলি জানে না, অভিমান একবার মনে জন্মালে শেকড় সমেত তা উপড়ে ফেলতে হয়! অভিমান এমন এক আশ্চর্য বাড়ন্ত বৃক্ষ, যেটা একবার জন্ম নিলে বিনা পরিচর্চাতেও ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে ওঠে। না জেনেই সে একটা বুক চাপা অভিমানকে লালন করার চেষ্টা করে গেল।
***
লিলি যেটা জানে না তৌহিদা সেটা বেশ ভালো মতো জানেন। কিন্তু তিনি মেয়েকে আরেকটু সময় দিতে চাইলেন। ‘সময়’ অনেক সময় সব ঠিকঠাক করে দেয়। এই কয়েকদিনে নেহালের সাথে তার কথা হয়েছে অনেকবার। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। তার নির্বাচন ভুল নয়, সেটা লিলি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে বলেই উনার বিশ্বাস।
বয়স নিয়ে নেহালের মধ্যে একটা দ্বিধা ছিল, তৌহিদা বলেছিলেন, “তোমার বয়সের পরেও এখন অনেকে বিয়ে করে না। তুমি এটা নিয়ে এত ভাবছ কেন বাবা?”
নেহাল উত্তরে বলেছিল, “আন্টি, সেটা নিয়ে আমার ভাবনা নেই। কিন্তু লিলি অনেক ছোট। সে বিষয়টা কতটা বুঝতে পারবে বা কীভাবে নেবে, সেটাই ভাবনার।”
“লিলি ছেলেমানুষ, কিন্তু অবুঝ নয়। তুমি একটু সামলে নিও বাবা৷ ওকে বুঝতে পারলেই দেখবে সেও তোমাকে বুঝতে শুরু করবে।”
রোমেনার গাণিতিক হিসেব বাস্তব জীবনে কতটা কার্যকরী হবে তিনি জানেন না! তবে এই দুই মাইনাসের ফলাফল যেন প্লাসই হয় তিনি সর্বান্তকরণে চান।
মেয়েটা যেন এই দুই তিনদিনেই কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, বড্ড বেশিই যেন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা। সেটাই তার বড্ড বুকে লাগত। কিন্তু এখন হিতোপদেশ দিতে গেলে তার ফলাফল ইতিবাচক হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আস্তে-ধীরে মেয়েটা নিজে খানিকটা উপলব্ধি করতে পারলেই কথাগুলো লিলির বোধগম্য হবে। নইলে ফাঁকা উপদেশ ছাড়া অন্যকিছু মনে হবে না। মেয়ে চোখের সামনে বসেই কেমন দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি চেয়েও কিছু করতে পারছেন না, ভেবে তার কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ।
তবে সব কষ্ট ছাপিয়ে গেল আজ, এই খানিক আগে। যখন মেয়েটা তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল। এই ঘরের পাশাপাশি মেয়ের আরেকটা ঘর হলো! তারাও তার মতোই আপনজন হবেন এটাই তার চাওয়া! কিন্তু তিনি যে বড্ড বেশি একা হয়ে গেলেন! এই একাকীত্ব তিনি কী দিয়ে ঘোচাবেন! সারাদিনের ধকল সওয়া লিলির এলোমেলো ঘরটায় এসে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
………
(ক্রমশ)