মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-০৫

0
3466

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

“কোথায় যাস এখন?”

লিলির হাত থেকে মোবাইলটা ছিটকে নিচে পড়ে গেল, মা এখনো জেগে থাকবেন এটা কল্পনারও অতীত ছিল ওর জন্য। একেবারে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল, দরজা খুলেই বেরিয়ে যাওয়া বাকি, একবার বেরুতে পারলেই কেল্লাফতে। কিন্তু ওর ভাগ্যে এই বিয়েটাই লেখা আছে হয়তো। এর অন্যথা কোনোভাবেই যেন সম্ভব নয়। তবে এখন সবচাইতে বড় চিন্তা মা’কে মানানো। তিনি এমনিতে শান্ত, ওকে সেভাবে কখনো শাসন করেননি, কিন্তু রেগে গেলে যে ভয়ংকর হয়ে যেতে পারেন সেটা লিলি ছেলেবেলায় একবার দেখেছিল।

লিলি ইতস্ততভাবে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বলল, “কই যাব আবার..” অপ্রস্তুত হেসে আবার বলল, “গরম পড়েছে কত দেখেছ? ছাদে যাচ্ছিলাম।”

“ও, তাই নাকি। ভালো। ছাদে গিয়ে থাকা শুরু করবি নাকি? তল্পিতল্পা নিয়ে যাচ্ছিস। আর এই রাতদুপুরে বাইরের পোশাক পরে ছাদে যেতে হয় জানা ছিল না তো।”

তৌহিদার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে সে ধরা পড়ে অপ্রস্তুতবোধ করছে।

“শুয়ে পড় যা। আর ব্যাগটা আমার কাছে থাকুক।”

লিলির কান্না পাচ্ছিল, মা ওর সাথে এভাবে কড়া গলায় কখনো কথা বলেননি। এমনিতেই বকাঝকা সে অনেক খেয়েছে, কিন্তু সেসবে স্নেহের ছোঁয়া লেগেছিল। আজ যেন বহু দূরের কেউ। পড়ে যাওয়া মোবাইলটা তুলতে গেলে তৌহিদা বললেন,

“আমি আর কয়দিন বাঁচব বল? তোর দাদু বাড়ির মানুষের কাছে শেষ সময়ে এসে আমার মাথা কাটিস না।”

ছলছলে চোখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল লিলি। চোখে সহস্র অনুযোগ, অভিযোগ, অভিমান।

তৌহিদার স্বামী লিয়াকত মারা যাবার পর থেকেই শ্বশুর বাড়ির সাথে বেশ দূরত্ব। দিনে দিনে সেটা কেবল বেড়েই গেছে। লিলিকেও তারা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। অনেক সংগ্রাম তার করতে হয়েছিল মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে। এখনো বিয়ের কথা শুনে তারা নাখোশ হয়েছে। কিন্তু তিনি অটল। এই অবস্থায় মেয়ে যদি এমন কিছু করে ফেলে, তিনি কোথায় মুখ লুকাবেন!

লিলির উপরে তার যত অনাস্থাই থাকুক, তবুও একটা বিশ্বাস কোথাও আছে যে এমন কিছু করবে না যাতে তার মাথা কা”টা যায়। তবে তিনি যা ভয় পান, তা হলো মেয়ে অসম্ভব জেদি। এরজন্য সে যা-কিছু করে ফেলতে পারে৷ ভুল-শুদ্ধের ধার ধারে না। যেমন আজকের কাজটা। তিনি জানেন, হয়তো কোনো বন্ধুর বাসায়ই যেত, কিন্তু যে কথাগুলো রটত তা তিনি কী দিয়ে বন্ধ করতেন!

তাছাড়া, কথায় আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। অস্থির চিত্তের লিলি যদি ভেসে যায়! এখনো তার বুক কাঁপছে, ভাগ্যিস তিনি আজ তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠেছিলেন, নইলে কী হতো, ভাবার সাহসও করতে পারেন না। এত রাতে বাইরে বের হলে কী পরিণতি হতে পারে চিন্তা করেই ভয়ের একটা স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল!

তিনি ওজু করে নামাজে বসলেন।

***
রোমেনা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছেন। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে এতেই তিনি উৎফুল্ল। তার কী কী পছন্দ, অপছন্দ সব তৌহিদার কাছ থেকে এতদিনে শুনে ফেলেছেন। হবু পুত্রবধূর জন্য গহনা আনা হয়েছে। এগুলো তিনি আর নওরীন গিয়ে নিজে পছন্দ করে গলার হার বানাতে দিয়েছিলেন৷ তৌহিদাকে অবশ্য বলেছিলেন লিলির পছন্দটা জেনে নিতে, কিন্তু তিনি বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই, তাদের পছন্দ হলেই হলো। সময় কম বলে তারা আর আপত্তি করেননি৷

সেই হারটা দেখার জন্য ছেলেকে ডেকেছেন রোমেনা। নেহাল বিরস মুখে এসে মায়ের বিছানায় বসেছে। পুরো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শাড়ি, প্রসাধনী থেকে শুরু করে অলংকার, সব।

“তোকে বললাম বিয়ের কেনাকাটায় আমাদের সাথে যেতে৷ তুই গেলি না। কেন? ‘এসব তো আমি পরব না, তাই।’ এটা কোনো উত্তর? শাড়ি, গয়না তুই পরবি না এটা কি আমি জানি না? নাকি এসব পরিয়ে বউ সাজিয়ে তোর বিয়ে দিতে চেয়েছি? গাধা।”

“ছিঃ মা, এসব কী বলছ?”

“যেমন কথা তেমন ঝাটা৷”

হতাশ হলো নেহাল, মা এমনই, তার মুখের কোনো লাগম নেই। তাই আর সে পথে গেল না সে। সসংকোচে বলল,

“মা, আমি ওই মেয়ের সাথে একা কথা বলতে চাই একবার।”

“ওই মেয়ে নামে তো কাউকে চিনি না? তোর লুকায়িত গার্লফ্রেন্ড নাকি!” কপট চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রু নাচিয়ে ছেলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন রোমেনা।

“হ্যাঁ, এখন কী এই বিয়ে ভেঙে দেবে?”

“না, ওর সাথে বিয়ে দেব, মেয়েটার নাম লিলি। তুই জানিস সেটা৷ তবুও লজ্জাবতী লাজুকলতার মতো লাল টুকটুক হয়ে যাচ্ছিস। তুই তো নতুন বউ না, নতুন বর হবি। বরদের এত লজ্জা পেলে চলে না, তখন সত্যি সত্যি এগুলো পরতে হবে কিন্তু।”

“মা, প্লিজ, আমি ভীষণ সিরিয়াস।”

“আমি একদমই সিরিয়াস না৷ সিরিয়াস হতে পারি যদি লিলির সাথে তুই কেন কথা বলতে চাইছিস সেটা আমাকে বলিস।”

“দুদিন পরে যাকে বিয়ে করব, তার সাথে কথা বলা যাবে না?”

“যাবে না কেন? একশ বার যাবে। কিন্তু দুদিন পরে যার সাথে জীবন জুড়তে যাচ্ছে, তার এবং তোর দু’জনের জীবনের অন্যতম বিশেষ দিনে, তার কী পোশাক পরা হবে সেসব যদি দেখিস ধৈর্য ধরে। তাহলে ব্যবস্থা করতে পারি।”

এরপর আর নেহাল কোনো কথা বলতে পারল না। মায়ের সাথে সে কোনোদিন কথায় পারেনি, আজ তার ব্যতিক্রম হবার কোনো প্রশ্নই আসে না। অগত্যা বিয়ের সবগুলো কেনাকাটা ওকে দেখতে হলো বসে বসে। মাঝে দুই তিনবার হাই তুলল। ঘুম পাচ্ছে নেহালের। কিন্তু চলে যাবার উপায় নেই। তখন মা আরেক কথা বলবেন।

বিয়ে উপলক্ষে সকলের এত উৎসাহ, আনন্দ, সে থামিয়ে দিতে পারবে না। লিলিকে দেখে মনে হয়েছে বয়স একটু কম হলেও মানিয়ে হয়তো নিতে পারবে। তবে ওর কতটা আগ্রহ আছে, সেটা জেনে নিতে পারলে খুব ভালো হতো। ভেতরের খচখচানিটা খানিকটা কমে যেত!

***
লিলির সাথে সেদিনের পর থেকে তৌহিদার তেমন কোনো কথা হয়নি। ইচ্ছে করে মাকে এড়িয়ে যাচ্ছে সে। ওর কথা ভাবে না, সে কেন ভাববে!

“দোস্ত, চল একটা পার্টি দেই। ব্যাচেলর পার্টির মতো হবে ধর। রিমির বাসা খালি। সায়েমকে বললে আসল জিনিসের ব্যবস্থা করে দেবে।”

তরীর ইঙ্গিত করা আসল জিনিস যে হরেকরকম পানীয়, সেটা বুঝতে পারল লিলি। কিন্তু এতে ওর মন সায় দিল না। সরাসরি না বলা যায় না। বন্ধুমহলে ওর একটা আলাদা আধিপত্য রয়েছে। এভাবে পিছিয়ে গেলে ওর জায়গাটা থাকবে না।

যদিও একবার মনে হলো, যাবে। তাতে মা-কে একটা শিক্ষা দেয়া যাবে! কিন্তু মন থেকে সায় পেল না। এতটা কঠিন সে কিছুতেই হতে পারবে না। তবুও অভিমান জমা হয়ে আছে একরাশ। ওকে মা’য়ের প্রয়োজন নেই, ওর বিয়েটাই যেহেতু প্রয়োজন, সে বিয়েই করবে। এরপর আর ফিরবে না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল লিলি।

“বাসায় মেহমান এসেছে অনেক। পরশুই তো বিয়ে। এখন রাতে বাইরে গেলে অনেক কথা শুনতে হবে। তোরা করিস নাহয়।” কথাটা বলেই সে ফোন কে”টে দিল।

ফোন রাখতেই দেখল তৌহিদা এসেছেন।

“আমি আজকে তোর সাথে থাকি? আরেকটা রুম খালি করে দিতে হবে।”

“না মা, আমি একা থাকব। তুমি মামি নইলে চাচির সাথে ঘুমিও।”

তৌহিদা ম্লান মুখে ফিরে গেলেন। লিলি আজ কাঁদল খুব করে। এরপর পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে মায়ের ঘরে গেল। যা ভেবেছিল তাই। অন্য দুটো ঘর ভাগাভাগি হয়ে গেছে অতিথিদের মধ্যে। মায়ের সাথে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওর চাচার মেয়ে শায়না। ওর সাথে শোবার জন্যই মা গিয়েছিলেন ওর ঘরে।

“তুই আমার রুমে গিয়ে ঘুমা শায়না।”

“তুই এখানে থাকবি?”

“হ্যাঁ।”

শায়না বেরিয়ে গেল বালিশ নিয়ে। তৌহিদা নীরবে ম্লানমুখে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। লিলি তার সাথে একটাও কথা বলল না, কোলে জড়িয়ে আনা বালিশটা বিছানায় রেখে মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল। তার আগে লাইটটা নিভিয়ে দিল।

তৌহিদা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, লিলি বলল, “আম্মু, গায়ে হাত দিও না প্লিজ। ভালো লাগে না।”

তৌহিদা সরে গেলেন অনেকটা। তার চোখের কোণে পানি জমছে বুঝতে পারছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন মেয়ের রাগটুকু ভালোবাসায় বদলে যাবে৷ তাই এটুকু তিনি সহ্য করে নিলেন।

লিলি এপাশ-ওপাশ করছে, কতক্ষণ সময় গেল সে জানে না। এরপর সহসা মায়ের দিকে ঘুরে তাকে জড়িয়ে ধরল। বহুদিন পরে সে কাঁদছে, খুব কাঁদছে। অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু একটা কী যেন বাঁধা দিতে লাগল! সেটা যে এই কয়েকদিনে তৈরি হওয়া অভিমানের পাহাড় তা কারোরই অবিদিত রইক না!

তৌহিদার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে লিলির চোখের জলে। তিনিও আবার ঘুরে মেয়েকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন, সেই আগের মতো স্নেহে, মমতায়, ভালোবাসায়।

কোনো কথা হলো না, শাব্দিক ভাষার ব্যবহার কেউই করল না! কেবল দু’জনের বিন্দু বিন্দু চোখের জল অব্যক্ত ভাষায় সুগভীর অনুভূতির বিনিময় করল।

তৌহিদা মনে মনে সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করলেন,

“হে আল্লাহ, আজকের পরে আর কোনোদিন যেন আমার মেয়ের চোখে দুঃখের অশ্রু না জমে, এরপর যতবারই কাঁদুক, তা যেন কেবল আনন্দাশ্রু হয়।”
……..
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে