#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
“এটা কার ছবি দিলি দোস্ত, ব্যাটা হ্যান্ডসাম আছে।”
“তোর নতুন ক্রাশ নাকি রে লিলু?”
লিলিদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে ‘বন্ধুতা’ নামেই। সেখানে যাবতীয় কূটচাল থেকে শুরু করে সব রকম আড্ডা চলে এই ত্রয়ীর।
আজ মা নিজের মহান দায়িত্ব পালন করতে তার দৃষ্টিতে এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকের ছবি ওকে দিয়ে গেছেন, লিলি সেটার একটা ছবি তুলে সেই গ্রুপেই পাঠিয়েছে বন্ধুদের দেখার জন্য। তরী আর মিতু দুজনেই যেভাবে কথা বলছে তাতে এখন মনে হচ্ছে না পাঠালেই ভালো হতো।
রেগেমেগে সে উত্তর দিল, “তোদের কি আমাকে ছ্যাবলা মনে হয়?”
“তাইলে এই লাল্টুমার্কা হ্যান্ডসাম ছেলেটার ছবি কেন দিলি?”
“গাধা, এটা সেই লোক, যার গলায় মা আমাকে ঝোলানোর মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে।”
“আমি হলে তো হাসতে হাসতে ঝুলে যেতাম৷ ব্যাটা জোস আছে রে। স্যরি ফর মাই ল্যাঙ্গুয়েজ, তুই বিয়ে করতে চাস না বলেই এভাবে বললাম।” মিতুর মেসেজের উত্তর দিতে দিতেই, তরী লিখেছে,
“তোর আপত্তি কেন?”
“বয়স। আমাদের মিনিমাম বারো বছরের ডিসট্যান্স। জেনারেশন গ্যাপ হলে কত সমস্যা হয় বল! তাছাড়া এখনই আমি বিয়ে করতে চাই না।”
“তাও ঠিক, শুনেছি, বেশি বয়সের ছেলেরা কম বয়সী বউ পছন্দ করে, বুঝলি তো কেন বললাম?”
তরীর কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো লিলির৷ সাথে এই অপরিচিত মানুষটার জন্য মন তিক্ততায় বিষিয়ে এলো। আসলেই কি তাই!
মিতু যদিও ইতিবাচক কথাবার্তা বলছে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তরীর কথাই যেন বারবার মাথায় এসে জট পাকিয়ে দিচ্ছে। অনেকগুলো বিষয় মানুষের সামনে থাকলেও মস্তিষ্ক সবসময় যেন নিজের ভাবনার সাথে যে বিষয় যায় সেই মতকেই দ্রুত গ্রহণ করে ফেলে। লিলির ক্ষেত্রেও তাই হলো। মিতু বলছিল,
“তুই বিয়ে করে ফেল, সমস্যা তো নেই। বয়স একটু বেশি হলেই যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবে না, তা তো নয়। সবার মেন্টালিটিও একরকম নয়।”
লিলি ফোনটা সরিয়ে রাখল, এখন এদের সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে। ওর জীবন কোন খাতে যাবে তা অনিশ্চয়তায় মোড়া, জীবনটা ভালো মতো দেখার আগেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আকাশে সদ্য ডানা মেলে উড়তে শেখা পাখি সে, জীবনের কতটুকুই বা দেখেছে! কিছুই তো দেখা হলো না। এরইমধ্যে ওর ডানা ছেঁটে ফেলার সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি করা শেষ। সারাজীবনের জন্য এক অদৃশ্য শেকলে আটকে পড়ার আশঙ্কা লিলির সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে দিল। কেমন দমবন্ধ করা একটা চাপা যন্ত্রণা হতে লাগল বুকে। সে এটা হতে দিতে পারে না, কিছুতেই না!
***
লিলি অনেক ভেবে চিন্তে মায়ের ঘরে এসেছে। যদি কোনোভাবে তার মন গলানো যায়! তৌহিদা তখন ওষুধ খাচ্ছিলেন। খাওয়ার আধাঘন্টা আগে এটা খেতে হয়।
লিলি আজ মুখাবয়বে একেবারে বিগলিত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে এসেছে।
“কী রে, কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ আম্মু। তুমি শুনতে চাইলে বলতে পারি।”
“আয়, বোস এখানে।” নিজের বিছানায় তার পাশের জায়গাটা ইঙ্গিত করে বললেন তৌহিদা।
“এবার বল, কী বলবি?”
“আম্মু, আমার বিয়ে দিতে চাও, করব। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমার পড়াশোনা কেবল শুরু হলো। সামনে আমার একটা ক্যারিয়ার আছে, বিয়ে করলে তো সব শেষ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব না।”
তৌহিদার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে নিজের ‘ইনোসেন্স’ ধরে রাখার মতো কঠিন কাজ এখন লিলির জন্য আর একটাও নেই। মুখে কাঁদোকাঁদো ভাব আনার চেষ্টা করল প্রাণপণে, কিন্তু কান্নাকাটি ঠিক ওর ধাতে নেই। এভাবে অনুরোধের সুরে কথা বলাও নয়। চিৎকার- চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতে সে সিদ্ধহস্ত। এখন তাই বেগ পেতে হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু সে মরিয়া।
“যাক, শুনে ভালো লাগল যে তুই পড়াশোনা নিয়েও ভাবলি। তা অনার্সে ভর্তির পর কয়দিন পড়তে বসেছিলি একটু হাতের আঙুলে গুণে বলতো শুনি?”
লিলির আজ এক পৃথিবী অনুশোচনা হলো, কেন সে আরেকটু পড়তে বসেনি। পড়াশোনার মতো এত বড় ঢাল হাতছাড়া হয়ে গেল। আফসোস!
“এখন থেকে পড়ব। এক মাস পরেই তো সেমিস্টার ফাইনাল। সিজিপিএ সাড়ে তিনের উপরে এনে দেখাব যদি বিয়ে ভেঙে দাও।”
“তুই এর আগেও বহুবার এসব বলেছিস কোনো প্রয়োজন হলেই। কোনোটাই ভবিষ্যতে করিসনি। আর পড়াশোনা তোর বন্ধ হবে না। রোমেনা ওরকম শাশুড়ি নয়। তোর যত ইচ্ছা পড়াশোনা করতে পারবি। তাছাড়া কাল রোমেনা আসছে, তুই বাকি কথা ওর সাথে বলে নিস। আমার মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছি, তাকে পানিতে ফেলার জন্য নয়, জীবনটা গুছিয়ে দেবার জন্য। এটা মনে রাখিস।”
ব্যর্থ মনোরথে নিজের ঘরে ফিরে এলো লিলি, মায়ের মন আজ চীনের প্রাচীরের চাইতে যেন শক্তিশালী। তাকে টলানো ওর সাধ্য নয়। রোমেনা আন্টির সাথেই বাকি কথা বলবে নাহয়। কী কী বলবে, কীভাবে বলবে তাও ভেবে নিল মনে মনে।
***
নেহালকে নওরীন মারফত মা জানিয়েছিল আজ বাসায় থাকতে। তৌহিদা আন্টির বাসায় মেয়ে দেখতে যেতে হবে। প্রথমে গাইগুই করলেও সে মেনে নিয়ে ছুটির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সকালবেলা রোমেনা ঘোষণা করলেন,
“এখন কোনো সামনা-সামনি দেখাদেখি নেই। বিয়ের কথা পাকা হবার পরেই কেবল তোরা ফেস টু ফেস কথা বলার সুযোগ পাবি। তোর যে মতিগতি! ভীষণ সন্দেহজনক।”
নেহাল সেই থেকে তেতো মুখে বসে আছে। রোমেনা যাবার আগে ছেলের এমন চেহারা দেখে হাসিমুখে টিপ্পনী কেটে বললেন,
“হবু বউ না দেখতে পেলে এত মন খারাপ করতে হয় না খোকা। একটু সবুর কর।”
তিনি বেরিয়ে যাবার পর থেকে নেহাল ওর বাবার পাশে এসে বসল। তিনি অবসর নিয়েছেন বছর চারেক হলো। বই আর পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে ছেলেমেয়েদের সাথে আড্ডা দিয়ে, স্ত্রীর সাথে খুঁনসুটিতে মেতেই তার সময় কেটে যাচ্ছে। এখনো তার হাতে একটা বই, সৈয়দ মুজতবা আলী’র ‘দেশে বিদেশে’। বই থেকে মুখ তুলতেই নেহাল বলল,
“বাবা, মায়ের এমন ডি”ক্টে”ট”র”শি”প কী করে সারাজীবন সহ্য করলে বলো তো? মাঝেমধ্যে তো ঠিকই ঝ” গ*ড়া করো। আমার বিষয়ে টু শব্দ করছ না কেন?”
“আমার ঘাড়ে একটাই মাথা বাপধন। আমি দ”ন্ডি”ত হয়ে গ”র্দা”ন হারাতে চাই না।”
“এমন করে ভেবেও লোকে বিয়ে কেন করে?”
এগাল ওগাল আশফাকের হাসি ছড়িয়ে পড়ল, ছেলের দিকে একটু ঝুঁকে এসে তিনি উৎফুল্ল গলায় বললেন,
“মাঝেমধ্যে হেরে যেতে, মানিয়ে নিতেও ভালো লাগে। এখন বুঝবি না, বিয়ে হোক, আস্তে-ধীরে বুঝবি।”
নেহাল পূর্ণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো, এই হাসির মধ্যে যে সুখ তা যেন স্বর্গীয়! মায়ের সামনে মাঝেমধ্যে যখন হেরে গিয়ে মুখ ভোঁতা করে রাখেন, সেটা কেবলই তাকে দেখাবার জন্য! তাতেও বোধহয় তিনি প্রশান্তি পান। জীবন, জীবনের সাথে জুড়ে থাকা নানারকম সম্পর্কগুলো, তাদের বিষাদ, যন্ত্রণা, আনন্দ, হাসি সব কত বিচিত্র এক সুতোয় গাঁথা! অদৃশ্য সুতোর টান দৃশ্যমান শক্ত লোহার শেকলের চাইতে দৃঢ়।
ভাবনায় ছেদ পড়ল বাবার কথায়, “বিয়েতে রাজি হয়ে যা বাবা। তোর মায়ের সিদ্ধান্তে ভরসা রাখতে পারিস। আমি ওর ন্যায্য সিদ্ধান্তে কোনোদিন অমত করি না।”
নেহাল বিস্মিত হয়ে বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং বোঝাপড়ার স্তরটুকু উপলব্ধি করতে পারল। এভাবে আগে কখনো সে ভেবে দেখেনি। কিন্তু যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে কী এসব সম্পর্কের গূঢ় মানেটুকু বুঝবে! কী জানি!
…….
(ক্রমশ)