#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলি বাসায় ফিরে মাকে নিষ্প্রভ দেখে খানিকটা বিভ্রান্ত হলো। যদিও নতুন কিছু নয়, তবুও আজ যেন মাত্রাটা একটু বেশি। সে ভেতরে এসে ব্যাগটা রেখে মায়ের পাশে এসে বসল।
“আম্মু, কী হয়েছে?”
“তুই বুঝবি না।”
“কেন? বলো তো। টেনশন হচ্ছে এবার।”
“আমাকে নিয়ে টেনশন করার প্রয়োজন নেই। যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়, খেয়ে নে। পরে কথা বলব তোর সাথে।”
এবার লিলি পুরোপুরি নিশ্চিত, কিছু একটা গড়বড় তো আছেই। তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না, মায়ের তাড়া খেয়ে উঠল। মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে ভাবার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা আসলে কী। ওকে কী বলতে চান মা, যার জন্য তিনি এমন দ্বিধায় ভুগছেন! বাথরুম থেকে বেরিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিল। সোহানের তেতাল্লিশটা মিসড কল, হোয়াটসঅ্যাপেও অনেকগুলো মেসেজ জমে আছে৷ কিন্তু এসব দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করল না সে৷
ওদের তিনজনের মিলিত একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, চ্যানেলের নাম ‘বন্ধুতা’। তাতে আপলোড করা নতুন ভিডিওতে কেমন ভিউ হচ্ছে সেটাতেও আগ্রহী হলো না।
“কী রে, আয়?” মা হাঁক ছেড়ে ডাকতেই সে গিয়ে বসল খাবার টেবিলে।
“শোন, যখন বলতে হবে তখন এখনই বলি, রোমেনাকে তো চিনিসই!”
“রোমেনা আন্টির কী হয়েছে?”
“ওর কিছু হয়নি। ও ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে, তোকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে। আমি রাজি থাকলে কথা পাকাপাকি হবে। আমি এখন ওকে ফোন করে আমার অনাপত্তির কথা জানাতে চাই।”
লিলি মাত্রই পানি মুখে দিয়েছিল, সেটা গলধঃকরণ করার আগেই মায়ের এহেন বক্তব্যে সমস্ত পানিটুকু ছিটকে বেরিয়ে এলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল টেবিলের চারপাশে। সে এমন ছ্যাঁকা এতটুকু জীবনে কোনোদিন খায়নি। সমস্তটা একটা স্বপ্ন বই অন্য কিছু মনে হচ্ছে না। লিলি কথাটাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করতে না করতেই তৌহিদা আবারও বললেন,
“সাবধানে পানি খাবি তো৷”
“আম্মু, এসব কী বলছ তুমি? তোমার মাথা ঠিক আছে?”
“খুব ভালো আছি আমি। শোন রোমেনার ছেলের ছবি আমি তোকে দেব। তুই দেখিস।”
“এখনই আমার বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়েছ কেন? এটাই তো বুঝলাম না!”
“তুই আমার একটা কথাও শুনিস? যা ইচ্ছা তাই করছিস। সারাদিন বন্ধুবান্ধবের সাথে হৈ হৈ। সবাই কী ভালো? হুটহাট এখানে ওখানে চলে যাস, সারাদিন ফোন গুতিয়ে যাস। রাত জেগেও তোদের এসব চলতে থাকে। রাস্তায় একবার মা*রা*মা*রি পর্যন্ত করে এলি। তোর আসেপাশে যেগুলো ঘোরাঘুরি করে, এদের সাথে যদি তুই জড়িয়ে যাস জীবনটা কী হবে বুঝিস?”
“তুমি যার গলায় ঝুলাতে চাচ্ছ, তার কী যোগ্যতা বলো তো! সে কী এমন সুপুত্র শুনি একটু?”
“সে অনেক ধীরস্থির স্বভাবের। তোর মতো উড়নচণ্ডী না। এটাই তার সবচাইতে বড় যোগ্যতা। বয়স একটু বেশি, তাই তোর চাইতে বেশি পরিণত।”
“বয়স কত বেশি?”
“দশ-বারো বছর তেমন বড় পার্থক্য না।”
অবিশ্বাসের চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকালো লিলি। সব একটা দুঃস্বপ্ন হলে কী যে ভালো হতো। এই তো কয়েকদিন আগে ওদের ব্যাচের একটা মেয়ে এরকম একজন বয়সের মানুষকে বিয়ে করেছে শুনে নিজেদের মধ্যে কত সমালোচনা করল। এই পাপের ফল যে এভাবে চুকাতে হবে সে কস্মিনকালেও কোনোদিন ভাবেনি।
“এটাই তার যোগ্যতা?”
“আরও অনেক যোগ্যতা আছে, সেসব পরে জানবি।”
বড় করে একটা শ্বাস টেনে লিলি জেদি গলায় বলল”আমি রাজি না। এখন কোনোভাবেই বিয়ে করব না, করব না, করব না।”
তৌহিদাও আজ অভিব্যক্তিতে এবং গলায় কাঠিন্য ফুটিয়ে বলল, “এক কথা তিনবার বললেই যদি বেশি জোরালো হয় বলে মনে করিস তাহলে সেটা আমিও বলতে পারি। এই বিয়েটাই আমি দেব,দেব, দেবই।”
তৌহিদা উঠে চলে গেলেন। লিলির আর খাওয়া হলো না। ভাতের মধ্যে হাত নাড়াচাড়া করে গ্লাসের পানি পুরোটা প্লেটের মধ্যে ঢেলে সেও উঠে নিজের ঘরে চলে এলো। ওর মাথায় এই মুহূর্তে ভিসুভিয়াস ভর করেছে।
***
নওরীন স্কুলে ছিল, মা একটু আগে কল করে বললেন নেহালের সাথে একটু কথা বলতে। তার দেড় বছরের ছোট ভাই সে। কিন্তু একেবারে পিঠাপিঠি হবার সুবাদে খুব ভালো বন্ধুত্ব ভাইবোনের মধ্যে, সেটা খুঁনসুটির যেমন, তেমন বোঝাপড়ারও। পরস্পরের নাম ধরে তুই বলেই সম্বোধন চলে ওদের মধ্যে। নওরীন অবশ্য মাঝেমধ্যে নিজের বড় হবার সুবিধা চেয়ে মায়ের কাছে অভিযোগ করত। তিনি দুইজনের এমন দুষ্টু মিষ্টি খুঁনসুটিতে কখনোই আসতেন না, তার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ থেকে একটা উত্তরই পাওয়া যেত সবসময়,
“তোরা হাত পা অক্ষত রেখে যা খুশি কর, আমার কাছে এসে কমপ্লেইন করবি না কোনোদিন।”
ওপাশে রিং হতে হতে প্রথমবার কেটে যাবার পর দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো।
“তুই? কী ব্যাপার এত সকাল সকাল?”
“ব্যাপার তো একটা আছে। তুই কি অফিসে?”
“হ্যাঁ। শুনি কী ব্যাপার?”
“তোহিদা আন্টি সম্মতি দিয়েছেন। তোদের বিয়ের ডেট যত দ্রুত সম্ভব করা হবে। তুই সামনে কবে একসাথে ছুটি ম্যানেজ করতে পারবি জানা!”
“মানে কী?”
“মানে বুঝতে হলে এতদিনে তোর একটা বিয়ে হয়ে ছোট্ট একটা-দুইটা বাচ্চাও থাকত।”
“মাঝেমাঝে মায়ের মতো কথা বলিস কেন তুই?”
“মায়ের মেয়ে, তাই। শোন, আমারও মেয়ে পছন্দ হয়েছে। ওকে অবশ্য আমি আগে কয়েকবার দেখেছিলাম। তবে তখন ও ছোট ছিল অনেক।”
“তুই এটাতে কীভাবে সাপোর্ট করছিস? একটা বাচ্চা মেয়ে।”
“মানুষ সারাজীবন বাচ্চা থাকে না গা*ধা। বয়স সবসময় ম্যাচুরিটি আনে না।”
“হইসে জ্ঞান মা, তোর জ্ঞান বিতান বন্ধ কর।”
“তুই বিয়ে এত ভয় পাস কেন?”
“ঘরে বাইরে দেখি তো। নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। আঁচল ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো আমার একেবারেই পছন্দ না।”
“তো আঁচল ধরে ঘুরিস না, হাত ধরে ঘুরিস। রোমান্টিক লাগবে কিন্তু!”
কথাটা বলে সশব্দে হেসে ফেলে মুহূর্তেই সামলে নিল নওরীন। আরেকটু পরেই ওর ক্লাস আওয়ার শুরু হবে।
“তোর সাথে কথা বলাই বৃথা।”
“বলিস না। লিলির নাম্বার দেব? ওর সাথেই কথা বলিস।”
“লিলি কে?”
“তোর হবু বউ।”
নেহাল কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বুঝি। সে কল কেটে দিয়েছে। নওরীন মাকে কল করে কী হলো জানিয়ে দিল। পাকা কথা যত দ্রুত সম্ভব হয়ে যাওয়া ভালো। কবে না জানি মাথা বিগড়ে যায়!
***
তৌহিদা কথা দিয়েছেন, কিন্তু গতকাল থেকে লিলির আচরণে তিনি নিজেও দোদুল্যমান। তার মধ্যে আবার রোমেনা বললেন,
“দেখ, লিলি যদি রাজি না হয়, তাহলে বরং আলোচনা বন্ধ থাকুক।”
“না রে, আমি ওর অনেক উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। এবার সম্ভব না। তাছাড়া নেহাল পুরোপুরি সম্মতি না দিলেও তুই তো আত্মবিশ্বাসী।”
কথাটা বললেও তিনি যে দ্বিধাদ্বন্দে আছেন, তা নিজের পরের কথাতে নিজেই অনুধাবন করতে পারলেন তৌহিদা।
“রোমেনা, আমরা কি ঠিক করছি? ওদের কারো তো ইতিবাচক মনোভাব নেই রে।”
“যেহেতু চাইছিস এটা হোক, তাহলে আর মনে কোনো দ্বিধা সংকোচ রাখিস না।”
“কিন্তু ওরা দুইজন দুই রকম স্বভাবের মানুষ।”
“এটা তো ভালোই। দেখ, অপজিট এ্যাট্রাকশন বলে একটা বিষয় আছে।”
বন্ধুকে নিশ্চিন্ত করতে এবার তিনি বললেন, “লিলির সাথে আমি একবার কথা বলব আজ-কালের মধ্যে। শোন, চুম্বকের বিপরীত মেরু সবসময় আকর্ষণ করে। পড়িসনি?”
“ওরা তো চুম্বক না।”
“হু হু, দুটো মানুষের মধ্যে চৌম্বকীয় আকর্ষণ তৈরি হলেই তো ম্যাজিকটা হবে, নাকি!”
তৌহিদার আস্বস্ত হতে ইচ্ছে করে, “হলেই হয়। হোক সেটা সর্বান্তকরণে চাই। কিন্তু দুজনেরই এমন অমত…”
“দুদিকেই নেগেটিভ ফিডব্যাক, মানে ধরে নে মাইনাস। সূত্রমতে কিন্তু মাইনাসে মাইনাসেই প্লাস হয়! বুঝলি, তাই নো চিন্তা, ডু ফূর্তি সখী।”
আসলেই গাণিতিক সূত্র আর জীবনের সূত্র এক সুতোয় বাঁধা পড়বে তো! তৌহিদা নিঃশঙ্ক হতে পারছেন না পুরোপুরি। এই মেয়েটাই তো তার সব, তার সমস্ত পৃথিবী।
সব ভালো হোক, স্রষ্টার কাছে এটাই তার প্রার্থনা।
……..
(ক্রমশ)