#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা
রিয়াদের বোন আসেনি পুষ্পিতার জন্মদিনে। বলেছে,
“তোমার বাসায় বাইরের মানুষের জন্মদিনে আমি কেন যাব?”
তবে ওর বাবা, মা এসেছেন দু’দিন আগে। তারা প্রথমদিকে খানিকটা আপত্তি করেছিলেন বটে, কিন্তু যখন দেখলেন তাদের ছেলে খুশি তখন তারাও মেনে নিয়েছেন। পুষ্পিতার নিষ্পাপ মুখে তাকিয়ে তারা আপনও করে নিয়েছেন। ছেলের খুশিটাই তাদের কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
রিয়াদ, নওরীন আর পুষ্পিতা যখন একসাথে দাঁড়ায় তখন একটা সত্যিকারের পরিবারই তো মনে হয়। তাহলে তাদের আর আপত্তি কীসের!
***
লিলি লাল শাড়িটা পরেছে, চোখে কাজল, হাত ভরা কাচের চুড়ি, সদ্য এনে দেয়া বেলি ফুলের মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নায় দেখল। ততক্ষণে নেহাল ভেতরে চলে এসেছে। ওর মুগ্ধ দৃষ্টি লিলি অনুধাবন করছে।
সে উঠে গিয়ে একটা টিপ নেহালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা দিয়ে দাও। প্রথমবারেই যেন কপালের মাঝ বরাবর হয়।”
“তাহলে কি পুরষ্কার পাব?”
“পরে ভেবে দেখা যাবে।”
নেহাল উদ্ভাসিত হেসে টিপটা লিলির কপালে পরিয়ে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দিল।
“কী ম্যাডাম? পাস করলাম? পুরষ্কারটা কি পাচ্ছি?”
লিলি আয়নার মধ্যেই নেহালের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রেখে বলল, “না, একটুখানি বাঁকা হয়েছে।”
আরশিতে ওদের চোখে চোখে আলাপন চলছে, মুখে যা-ই ওরা বলুক, সেখানে চোখের ভাষা দু’জনেরই অন্যরকম। নেহালের মোহাবিষ্ট দৃষ্টিতে লিলির মধ্যে কোত্থেকে যেন অচেনা লজ্জা এসে আসন পেতেছে। এমন দৃষ্টি নতুন নয়, তবুও যতবার টের পায় ততবারই কেমন একটা শিহরণ বয়ে যায় সমস্ত হৃদয়ে।
নেহাল লিলির মুখটা ঘুরিয়ে দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালের ছোট্ট টিপটার ঠিক উপরেই আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। এরপর ফিসফিসিয়ে লিলির কানের কাছে এসে বলল,
“তুমি কৃপন, সব ফাঁকি দেবার ফন্দি। তাই পুরষ্কারটা নিজেই নিলাম৷ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে লিলি।”
নেহাল ঘুরে চলে যাচ্ছিল, লিলি ওর পাঞ্জাবির কোণা ধরে টান দিতেই সে ঘুরল।
লিলি কাজল থেকে আঙুল দিয়ে একটুখানি কাজল নিয়ে নেহালের মাথার চুল একটু উপরে উঠিয়ে সেখানে ছোট্ট করে ছুঁয়ে দিল।
“আরে, কী করছ?”
“ছেলেদেরকে এত সুন্দর লাগা ভালো নয়। বদ নজর লাগতে পারে। তাই সাবধানতা।”
“তাই নাকি? নজর কারা লাগাবে?”
“সেটা তুমিই জানো তোমার কত এডমায়ারার আছে। এখন চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বেরুবার আগে আগে ঠিক দরজার কাছে এসে নেহাল প্রশ্ন করল,
“লিলি, আমাকে নিয়ে তোমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই তো? বা পরে আফসোস হবে না তো?”
“নেহাল, এসব সংশয়, দ্বিধা আমি অনেক দূরে ফেলে এসেছি। তুমি বুঝতে পারোনি? আগেও তো বলেছি বোধহয়।” লিলির গলাটা কেমন আহত শোনায়।
“আমি তোমাকে ভীষনভাবে বুঝতে পারি লিলি। তবুও মুখে শুনতে ভালো লাগে।”
রোমেনা আর আশফাক সকালেই চলে গেছেন নওরীনের বাসায়। নেহালের জন্য অপেক্ষা করছিল লিলি, একসাথে যাবে বলে।
নওরীন নেহালকে ফোন করে এরইমধ্যে বেশ কয়েকবার ঝাড়ি দিয়েছে, এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
***
আজ শুক্রবার। তরী আর মিতুকে নিয়ে লিলি সকাল থেকে ছাদে নতুন ভিডিওর কাজ করছে। লিলি প্রায় দুই মাস পরে নতুন ভিডিওর জন্য রাজি হয়েছে। নেহালকেও ছাদে বসিয়ে রেখেছে।
ওরা কন্টেন্ট বানানোর পাশাপাশি খুঁনসুটি করছে ভালোই। নেহালকেও অবশ্য ছাড় দিচ্ছে না। যেমন একট আগেই তরী এসে বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া, আপনার কোনো ফ্রেন্ড আছে সিঙ্গেল?”
“কেন?”
“না মানে, আপনার মতোই কেয়ারিং হতো তাহলে।”
নেহাল এসব ঠাট্টার প্রতিউত্তর দিতে পারে না গুছিয়ে। লিলি এবার ওকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো।
“মঈনকে কল দিয়ে বলব নাকি যে ওর গার্লফ্রেন্ড ওকে ল্যাং মেরে নিজের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে।”
“ধূর, লিলি, তুই এমন হয়ে গেছিস কেন? কোথায় ভাইয়ার সাথে একটু মজা করব, তুই একেবারে পানি ঢেলে দিলি।”
মিতু বলল, “ভাইয়া, আমি কিন্তু সিঙ্গেল। আমার জন্য একটা…..”
“আমার সব বন্ধু বিবাহিত। আমি একা বাকি ছিলাম। তাও এখন সম্পন্ন। আমার ছোট ভাইও নেই।”
“ইশ, কপালই খারাপ।” মিতুর বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ফেলল। নেহালও খুঁনসুটিতে যোগ দিল এরপর। জড়তা কেটে গেছে।
ভিডিওর একেবারে শেষে লিলি বলছে, “অল্প কয়েকদিনের মধ্যে জীবন আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। আপনার জীবনে সময় হয়তো অল্প থাকে, এই সময় এবং সময়ের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে আমরা যেন একটু বুঝতে চেষ্টা করি। নইলে দেখা যাবে সময় আমাদের হাতে থেকেই যাবে, কিন্তু মানুষগুলো হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবার আগে নিজের সুপ্ত মনকে জাগাতে হবে। ভালো থাকবেন সবাই।”
ক্যামেরা বন্ধ হবার সাথে সাথে লিলি কান্নায় ভেঙে পড়ল। তরী আর মিতু সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেলে নেহাল ইশারায় নিষেধ করল। কান্না আটকে রাখলে কষ্টটা ভেতরে জমে থাকে। সেটাকে বের করে দিতে হয়।
নেহাল লিলির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল কেবল। একসময় কান্নার দমক শিথিল হয়ে এলো।
***
“তোরা বিয়ে করেছিস অনেকদিন তো হয়ে গেল। হানিমুনে যাবি না?”
রোমেনা সকালে নাস্তার টেবিলে সরাসরি প্রশ্ন করলেন লিলি আর নেহালকে।
নেহাল অপ্রতিভ গলায় বলল, “মা, তুমি…”
“আমি কী? তোদের হানিমুনের টিকিট কেটে দেব? এসব আমি পারব না। তোর জন্য ঘটকালি পর্যন্ত করেছি, এত চমৎকার একটা বউ এনে দিলাম। নিজে তো চাকরিও করিস। এখন এসব বলিস না যেন। আমার কান নাক সব কাটা যাবে।”
লিলি আর আশফাক শব্দ করে হেসে ফেলল। নেহাল মৃদু গলায় কেবল বলল, “আমার টিকিট আমি কাটতে পারি মা। তোমাকে এটা বলিনি।”
“তাহলে কী বলেছিস?”
“বলে লাভ নেই এখন।”
“অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ কর। কোথায় যাবি ঠিক কর।”
লিলি রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, “মা, আমি একটু আমাদের গ্রামের বাড়িতে আগে যেতে চাই। ওখানে জায়গাটা স্কুলের জন্য কতটা স্যুইটেবল দেখি। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের নিয়ে করতে চাইছিলাম। প্রসেসিং শুরু করলে অনুমোদন, এটা সেটা মিলিয়ে সময় লাগবেই অনেকটা।”
“হ্যাঁ, সেটা নিয়ে নেহাল উকিলের সাথে কথাও বলেছে। তুই চিন্তা করিস না৷ তুই তোর মতো পড়াশোনা কর। সময়মতো সব হয়ে যাবে। আর এখন সেখানে যেতে চাইলে ঘুরে আয়।”
তৌহিদা লিলির জন্য ভালো অংকের টাকা ব্যাংকে রেখে গেছেন। পুরো জীবনের সমস্ত সঞ্চয়। তবে নেহাল সেটায় হাত দিতে রাজি নয়। লিলি পড়াশোনা শেষ করে ওটা যা করতে চায় নিজেই নাহয় সিদ্ধান্ত নেবে।
***
“ইদানিং খুব চুপচাপ থাকো তুমি রুমু। বাইরে আগের মতোই, কিন্তু ভেতরে…”
“সত্যি বলতে তৌহিদার এভাবে হুট করে চলে যাওয়াটার সাথে আমি এখনো মানিয়ে নিতে পারিনি। বাইরে দেখাতে পারি না, লিলি আমার দায়িত্ব। আরও অনেককিছু আমাকে সামলাতে হয়। আমি ভাঙলে মেয়েটাও শেষ হয়ে যেত। তুমি ছাড়া এসব তো আর কেউ জানে না, দেখেও না। তাছাড়া তৌহিদা শুধু আমার খুব কাছের একজন বন্ধুই ছিল না, আত্মিক শান্তিরও একটা জায়গা ছিল। ওর…”
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রোমেনার বুক বেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবতায়।
“পুত্রদায়গ্রস্ত পিতামাতার তকমা তো আমাদের ঘুচল। ছেলেকে ঘুরতেও পাঠাচ্ছ, আমরা কি ঘুরতে যাব কোথাও?” আশফাকের কথায় সচকিত হলেন রোমেনা।
“কেন? তোমার বুড়ো বয়সে নতুন করে হানিমুনে যাবার শখ হলো নাকি?”
“হ্যাঁ। পুরনো বউয়ের সাথে নতুন করে হানিমুনে গেলে বিষয়টা মন্দ নয় নিশ্চয়ই।”
“ঢং, বুড়োর যত ভীমরতি দেখছি এখন।”
“কথায় কথায় বুড়ো বলো কেন বলো তো?”
“নইলে তোমার হুঁশ থাকে না যে বয়স হয়েছে। আমি ছাড়া কারোর পাত্তা পাবে না, পাছে হতাশ হবে, মন ভাঙবে। আমি কী করে তোমার মন ভাঙতে দেই বলো?”
আশফাক ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। এরপর বললেন,
“তুমিই বা আমাকে তেমন পাত্তা দিলে কই? আমি তো আজীবন কেবল তোমার পাত্তাই চেয়েছি।”
“এতগুলো বছর ধরে তোমার পাশে থেকে কাটিয়ে দিলাম, তবুও কম মনে হচ্ছে?”
“ভালোবাসার তৃষ্ণা কখনো মেটে না প্রিয়। সেটা যত পাই, ততই চাওয়া বেড়ে যায়।”
রোমেনা হাসলেন, অস্ফুটস্বরে বললেন, “ছেলেমানুষি।”
আসলেও কিছু তৃষ্ণা বাড়লেই ভালো, ভালোবাসার তৃষ্ণা বেঁচে থাকুক শেষ নিঃশ্বাস অব্দি। বয়স বাড়লে বাড়ুক, মন তো চিরসবুজ, সতেজ। মনের বয়স তারুণ্যে থেমে থাকুক।
***
লিলি আজও শাড়ি পরেছে। এটাও নেহালের দেয়া। একেবারে হালকা বেগুনি রঙের জামদানী শাড়ি। অনেকটা কচুরিপানা ফুলের মতো রঙ। আজ চুলগুলো খোলা। বাসের জানালায় হুহু করা বাতাস এসে হানা দিচ্ছে, তাতে লিলির খোলা চুল নেহালকে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
একবার চুল বাঁধতে চাইছিল, কিন্তু নেহাল বলল, “থাকুক৷ তোমার মতো চঞ্চল, তোমার চুলগুলো। ওদের আটকে রেখো না। উড়ুক।”
নেহাল যে চুলের পাশাপাশি লিলিকেও ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছে সেটা উপলব্ধি করে হাসল সে। রোদ উঠেছে আকাশে। বেশ কিছুদিন গোমোট পরিবেশ বিরাজ করেছে প্রকৃতিতে। ঠিক লিলির মনের মতো।
নেহালকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলল, “কী দেখছ?”
“রোদ।”
“সেটা তো জানালার বাইরে। তুমি তো আমার দিকে তাকিয়ে আছো।”
“কালো মেঘে ছেঁয়ে থাকা আকাশে যখন হঠাৎ রোদ খেলে যায়, তখনকার সৌন্দর্য এসে ভিড়েছে তোমার মধ্যে।”
লিলিকে ভীষণ স্পর্শ করল কথাটা। তৌহিদা যাবার পর থেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। সময়ের সাথে সাথে সেখানে ধীরে ধীরে প্রলেপ পড়ছে। যে এক চিলতে রোদের মতো আঁধার সরিয়ে দিচ্ছে, সে মানুষটা নেহাল। ওর মেঘলা জীবনের ঝলমলে রোদ মানুষটা।
স্কুলের জন্য নির্ধারিত জায়গাটা দেখে গ্রামের রাস্তায় হাঁটছিল দু’জন। একটা পুকুরে অনেকগুলো কচুরিপানা ফুল ফুটে আছে। নেহাল এগিয়ে অনেক কসরত করে পা না ভিজিয়ে একটা ফুল তুলে আনল।
লিলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “লিলি ফুল তো এখানে নেই। কী আর করা। আপাতত এটাই ভরসা।”
থেমে গিয়ে কিছু একটা এখনই বলতে হবে এমন ভঙ্গিতে নেহাল বলল, “আমি কিন্তু গুগলের সাহায্য নিইনি। তুমি এটাই বলতে তাই আগেই বলে দিলাম।”
লিলি ফুলটা হাতে নিয়ে বলল, “সাহস কিঞ্চিৎ বেড়েছে। বুদ্ধিও।”
“বুদ্ধি আমার বরাবরই বেশি। প্রেমে খানিক বোকামো বা হলে চলে? তাই একটু..”
এরপর হাস্যোজ্বল নেহালের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মানুষটার সৌন্দর্যের মধ্যে অদ্ভুত একটা সরলতা আছে। এই সরলতাই লিলিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে।
“এই যে বুড়ো খোকা, সবসময় এমন থাকবে তো?”
“পুঁচকে খুকী, আমি সবসময় তোমার পাশে থাকতে চাই।”
“পুঁচকে বললে কেন?”
“তুমিও তো বুড়ো বললে, তার বেলা?”
“মেয়েদের বেলায় সাত খু ন মাফ, তুমি জানো না?”
নেহাল আবারও হাসল সুন্দর শিশুসুলভ সরলতা মাখা হাসি। এক অপার্থিব সুখে লিলির চোখ ভিজে আসছিল। এত সুখের মাঝে ছোট্ট একটা বিষকাঁটা হয়ে বিঁধে রইল মা’য়ের এভাবে চলে যাওয়াটা৷
নিরবিচ্ছিন্ন সুখের মধ্যে ওটুকু বিষাদ নাহয় সে বইল আজীবন। সেই বিষাদেই তো মা মিশে রয়েছে।
নেহাল তখনো হাসছে, ঠিক দূর আকাশের ওই জ্বলজ্বলে সূর্যের মতো। সেই হাসিতে লিলির জন্য কেবলই ভালোবাসা আর প্রশ্রয়।
কান্নায় ভেজা এক টুকরো হাসি ফুটল লিলির মুখাবয়বে। লিলি মনে মনে প্রার্থনা করল,
“এই সুন্দর মুহূর্তের সুন্দর অনুভূতি বেঁচে থাকুক সবসময়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে।”
………..
(সমাপ্ত)