মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-২৫

0
3208

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২৫)
নুসরাত জাহান লিজা

সময় একটা অদ্ভুত মহৌষধ। দিন যায়, রাত আসে, রাতের শেষে আবারও সূর্যের হাসিমুখে সকাল হাসে। এভাবেই সময় গড়িয়ে যায়। ক্ষত একসময় শুকিয়ে আসে নিয়ম মেনে। কিন্তু সব ক্ষতে বোধহয় সময়ও প্রলেপ দিতে পারে না। শোক হালকা হয়, বিষাদ কেটে যায়, কিন্তু অব্যক্ত অপরাধবোধের বোঝা কখনো সময়ও কমিয়ে দিতে পারে না, এক্ষেত্রে সময় পরাস্ত হয়।

লিলির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রায় মাসখানেক সে কাটিয়ে দিয়েছে এই জগদ্দল পাথরের বোঝা বুকে নিয়ে। দমবন্ধ করা একটা হাহাকার ওকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে৷ রাতগুলো যে কী ভীষণ দুঃসহ অসহায়ত্ব নিয়ে লিলির জীবনে আসে! এর সবটা কি কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব!

তবুও নেহাল বুঝতে পারে, ওর কষ্টে কষ্ট পায়৷ রোমেনার মতো একজন মানুষও ধাক্কাটা সহজে সামলে উঠতে পারেননি। তবে অল্পবয়সী প্রিয়জন হারানো মেয়েটার অবস্থা দেখে প্রিয় বাল্য বন্ধু বিয়োগের ব্যথা লুকিয়েছেন। শক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আশফাকের সামনে গিয়ে ঠিকই যন্ত্রণা উগড়ে দিয়েছেন।

লিলি প্রায় এক মাস ওদের বাসাতেই ছিল। নেহাল সাথেই থেকেছে। বাকিরাও আগের মতোই আসা যাওয়া করেছে।

লিলি নিজের ঘরে, মায়ের ঘরে, পুরো বাড়িটাতে তৌহিদাকে অনুভব করার চেষ্টা করত। যেন তার স্পর্শ মাখা ফেলে যাওয়া সমস্ত কিছুতে তার গন্ধ, তার একটু ছোঁয়া যেন অনুভব করতে চাইত। পুরোনো ছবির এ্যালবামটা খুলে একদিন ফুঁপিয়ে উঠল। ওর ছেলেবেলার খেলনাগুলো কী যত্নে গুছিয়ে রেখেছিলেন তৌহিদা, এমনকি ভাঙা খেলনার টুকরোগুলোও। পুতুলের বিয়ে দেবার জন্য সুতোর ফুল দেয়া ছোট্ট কাঁথা পর্যন্ত রয়েছে। এটা মা’ই সেলাই করে দিয়েছিলেন।

চম্পার উপরে লিলি ভীষণ রুষ্ট হয়েছিল, ওকে মায়ের অসুখের কথা না জানানোয়। মেয়েটা বলেছিল,

“আমি তো কবার চাইসি আফা। খালাম্মায় না করসে। কইসে, হ্যার অসুখের কথা শুইন্যা আফনে হয়তো সব মাইন্যা লইবেন। কইসে, সময়ে আফনে নিজের মনেই বুঝবার পারবেন। তহন সব সুন্দর হইব।”

প্রথমদিকে খাওয়ায় অনিয়ম করছিল লিলি। নেহাল একদিন বলল, “লিলি, তুমি এখন যেই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছো, আমাকেও কি এমন অবস্থায় দেখতে চাও?”

লিলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলেছিল, “এমন কিছু আমি আমার শত্রুর জন্যও চাইব না কোনোদিন।”

“তুমি এমন করলে বাঁচবে? এভাবে বাঁচা যায়? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি…”

লিলি নেহালের মুখ চেপে ধরেছিল, বাকিটা শুনতে চায়নি।

নেহাল নিজের মুখ থেকে লিলির হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “লিলি, কিছু ক্ষতি অপূরণীয়। কিন্তু জীবনটা চলমান। শোকে থমকে থাকার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যেতে হয়। তোমার আশেপাশে যারা রয়ে গেছে, তারাও তো তোমার জীবনের একটা অংশ। তোমার কষ্টগুলো তারাও নিজেদের মধ্যে ধারণ করে। তাদের কথা ভাববে না? তোমার মা’য়ের কত স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে, সেসব পূরণ করবে না? তার স্বপ্ন পূরন করো, অন্তত চেষ্টাটুকু করো। দেখবে স্বস্তি পাবে। সেই ছুঁয়ে ফেলা স্বপ্নের মধ্যে তাকে অনুভব করতে পারবে। তার জন্য বেঁচে থাকতে হবে। তুমি অনেক স্ট্রং, আমি জানি, তুমি পারবে। আমি আছি, আমরা আছি।”

“আমি পারছি না। একটা পাকে আটকে গেছি। কিছুতেই বেরুতে পারছি না। আমি মাকে ভীষণ মিস করছি। নিজের খেয়ালখুশি সবসময় প্রাধান্য দিয়েছি। কোনোদিন তাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি।”

“একবার চেষ্টা করে দেখো লিলি, অন্তত আমার জন্য কিংবা মা’য়ের শেষ স্বপ্নগুলোর জন্য। প্লিজ!”

লিলি সেদিনও আকুল হয়ে কেঁদেছিল। তবে চেষ্টা করছিল। খেতে খেতে কেঁদে ফেলত, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠে বসত। আনমনে শূন্য দৃষ্টিতে মহাশূন্যে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত। এই অল্প দিনেই লিলি যেন আমূল বদলে গেছে।

লিলির উচ্ছ্বসিত হাসিমুখ, প্রাণচাঞ্চল্য, নেহালকে নাজেহাল করা খুঁনসুটি, বন্ধুদের আড্ডায় মাতোয়ারা লিলি, সব যেন বহুকাল আগের কথা। একটা বিশাল বড় ধাক্কা নিমিষেই মানুষের জীবনে কী আশ্চর্য পরিবর্তন নিয়ে আসে!

নেহালের মনে হলো, ভালোবাসার প্রিয় মানুষেরা যখন আশেপাশে বিচরণ করে তখন বোধহয় তাদের গুরুত্ব ততটা বুঝতে পারে না মানুষ। আচমকা চিরতরে হারিয়ে গেলে এক পৃথিবী শূন্যতা তৈরি হলেই যেন কেবল অনুধাবন করা যায়, তারা কতটা জুড়ে ছিল! সেই ভ্যাকুয়ামে কেবল যন্ত্রণা ছাড়া আর কিচ্ছু প্রবেশ করতে পারে না। শূন্যতাও যে এতটা ভারি হয়, সেটা লিলিকে না দেখলে নেহাল কোনোদিন জানতেও পারত না।

তরী, মিতুরাও নিয়মিত আসত, কিন্তু তাদেরকেও লিলি সময় দেয়নি। সে যেন জীবনের সমস্ত আকাঙ্খা মন থেকে হারিয়ে ফেলেছে। সেমিস্টার ফাইনাল আর দেয়া হয়নি এবার।

***
লিলি এই বাসায় ফিরেছে দুদিন হলো। এই পাশের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। পর্দা সরিয়ে গ্রিলে হেলান দিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে ছিল লিলি। রোমেনার গলায় সচকিত হলো,

“আসব?”

লিলি চমকে উঠে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “মা, এসো।”

রোমেনা বিছানায় বসে লিলিকে পাশে বসতে ইশারা করলেন। লিলি কোলে মাথা রেখে গা এলিয়ে দিল।

“তুমি তো আম্মুকে প্রায় ছেলেবেলা থেকে চিনতে, জানতে। তুমি আমাকে একটু বলবে আম্মু তখন কেমন ছিল?”

“তোর মা একজন ফাইটার ছিল। নরম নিরীহ কিন্তু ভীষণ দৃঢ় জীবনীশক্তি ছিল ওর। তোর বাবার সাথে যখন ওর বিয়ে হয়, কী ঝামেলা করেই না সেটা হলো। তৌহিদাকে দেখতে গিয়ে পছন্দ হলো। কথাও এগিয়ে গেল। কিন্তু যৌতুক চেয়ে বসায় তৌহিদা বিয়ে ভেঙে দিল। অন্যত্র মোটা অঙ্কের যৌতুকে তোর দাদি ছেলের বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেললেন। ওদিকে তার ছেলে তো আমার সখীতে মন হারিয়েছে, এসব লেনদেনও তার ভালো লাগেনি। ওই বিয়ে ভেঙে তোর নানুকে রাজি করিয়ে রাতারাতি ওদের বিয়েটা হয়ে গেল।”

এই গল্পটা লিলি জানে, তবুও মনোযোগ দিয়ে শুনছে। জানা গল্পও শুনতে ভালো লাগছে। রোমেনা বলে চলছেন,

“তাতেই তৌহিদা তাদের চক্ষুশূল হয়ে গেল। তোর বাবা মা সেই রাতেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ঢাকায় একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করল। দুজনেই টিউশনি করে, ওদিকে তৌহিদার বাবার দেয়া স্বল্প কিছু গয়না বিক্রি করে ছোট্ট একটা ব্যবসা শুরু করল। সেটা দিয়েই ঘষেমেজে চলছিল। এরমধ্যে তুই আসবি সুখবর এলো। ব্যবসায় বড় লাভ হলো হঠাৎ। তোর জন্ম হলো, ব্যবসাও মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেল। তৌহিদার স্কুলে চাকরি হলো। কয়েক বছরের মধ্যে তোদের বাড়িটা তৈরি হলো। যখন সুখের মুখ দেখতে শুরু হলো, তখনই তৌহিদা একা হয়ে গেল।”

এ পর্যন্ত বলে রোমেনা থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলতে শুরু করলেন, “আমরাও তখন এই বাড়িটা করলাম৷ নিয়মিত যাতায়াত তো আগে থেকেই হতো। সময়গুলো আমিও খানিকটা নিজের চোখে দেখেছি। কী ভীষণ সংগ্রামের মধ্যে পড়ে গেল! ওদিকে তোর চাচারা আসতে শুরু করল, সহানুভূতির নাম করে বছর দশেকের চেষ্টায় দাঁড় করানো ব্যবসাটা তৌহিদার হাতছাড়া হয়ে গেল। তোকেও নিয়ে যেতে চাইছিল। ওরা এরকমও বলেছিল, তাদের ভাই যখন নেই, যার জন্য তাদের ভাই তাদেরকে ত্যাগ করেছিল, তেমন কারোর কোনো কিছুতে অধিকার নেই, এমনকি মেয়েকে পাবারও নয়। তৌহিদা তখন বদলে গেল। ব্যবসা হাতছাড়া হলেও বাড়িটা আঁকড়ে ধরল। ওরা অবশ্য সেটা ধরে রাখতে পারেনি। অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয়। লোকসান গুণে পাততাড়ি গুটিয়ে তারা ফিরে গেল। ওই বাড়ি ভাড়া আর চাকরি এটুকু দিয়েই তোকে বড় করতে লাগল। কপর্দকহীন এক ছেলের হাত ধরে স্বপ্ন নিয়ে ঘরছাড়া সাদাসিধে তৌহিদা ততদিনে পুরোদস্তুর দৃঢ় সংগ্রামী একজন মানুষ। তোর চাচারা তবুও বহুদিন পিছে পড়েছিল। পরে অবশ্য তোর মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছে নিজেদের ভুলের জন্য। এখন তো তোর প্রাপ্যটুকুও বুঝিয়ে দিয়েছে।”

“মা রে, তোর মা সব হারিয়ে শুধু তোর জন্যই বেঁচে ছিল। মানুষের কতরকম চাওয়া পাওয়া থাকে। তৌহিদার সকল আকাঙ্খা কেবলই তোকে ঘিরে ছিল। এমন একটা ভয় ওর মধ্যে তৈরি হয়েছিল। তাই চেয়েছিল একটা ভরসার হাত, একটা সাপোর্টিভ পরিবার। আমার মনে হয়েছে এই ভরসার একটা মর্যাদা হয়তো নেহাল দিতে পারবে। নিজের ছেলেকে চিনি তো। তাই আমিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। তোর বয়সের জন্য নেহাল প্রথমে রাজি ছিল না, তুইও রাজি না। আমি জানি অংকের সূত্রে কখনো জীবন চলে না। তবুও একটা সিদ্ধান্তে তো আসাই যাই৷ তাই ওকে বুঝিয়েছিলাম, মাইনাসে মাইনাসে তো প্লাসই হয়। ও সবসময় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত কবে ফলাফল প্লাস হবে।”

লিলি অস্ফুটস্বরে কেবল বলল, “মাইনাসে মাইনাসে প্লাস তো ঠিকই হলো, কিন্তু অনেক বড় মাশুল গুণতে হলো। আগে জানলে…”

রোমেনা ডান হাতে পানির আভাস পেলেন, মেয়েটা কাঁদছে আবারও।
………
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে