#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২৩)
নুসরাত জাহান লিজা
লিলির বুক কেমন যেন মুচড়ে উঠল। সে কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে পারল,
“কী হয়েছে আম্মুর?”
রোমেনা এগিয়ে এসে গলায় সহানুভূতি ঢেলে বললেন, “আগে চল, যেতে হবে আমাদের।”
লিলির মনের উৎকন্ঠা প্রগাঢ় হচ্ছে। আজানা আশঙ্কা ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, রোমেনা ওকে ধরে সামলে নিলেন। বাইরে বেরিয়ে দেখলেন আশফাক সিএনজি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওরা তাতে চেপে বসল।
“বলো না, কী হয়েছে? আম্মুর তো আজ ফেরার কথা ছিল।”
“হ্যাঁ, ফেরার পরেই শরীর খারাপ করে। তোদের বাসায় যে মেয়েটা থাকে, সে আসার পরেই দেখে কেমন যেন করছিল। সে-ই সাথে সাথে তোদের ভাড়াটিয়ার সাহায্য নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। যেতে যেতে আমাকে কল দিয়ে জানালো। আমি তোদের ভাড়াটিয়া আরিফুল সাহেবের সাথে কথা বলেছি।”
লিলি আশ্বস্ত হতে পারল না কিছুতেই। কী হলো হঠাৎ, এই তো সকালেই অল্প হলেও কথা হলো। তখন তো সুস্থই ছিলেন। ওর চিন্তাভাবনা অসাড় হয়ে আসছিল। সময় যেন থমকে আছে, আরও দ্রুত কেন পৌঁছানো যাচ্ছে না! এক সেকেন্ডও ওর জন্য অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।
হাসপাতালে পৌঁছে নেহালকে পেল। সে অফিস থেকে খবরটা শুনেই এখানে চলে এসেছে। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে তৌহিদাকে এখানে আনা হয়েছে। ডাক্তার তাকে দেখেছে। নেহাল ওদেরকে এখানে রেখে ভেতরে গেল কথা বলতে।
“আমি যহন বাসাত আইলাম, তার এটটু আগ দিয়া খালাম্ম আইসে। আমারে কইল শইলডা ভাল্লাগতাসে না। পানি দে তো। আমি পানি নিয়া গেলাম৷ ফ্যান ঘুরতাসে তাও খালাম্মার শইল ঘাইম্যা পানি পরতাসিল। আমি কইলাম, ‘কী হইসে?’ কইল, ‘আমার কেমুন জানি অস্থির লাগতাসে। লিলিরে খবর দে।’ কইতে কইতে মনে হইল খিঁচ উইঠা পরসে। আমি ডরাইয়া দোর দিয়া নিচ তালার চাচা, চাচিরে নিয়ে আইলাম। এরপর আর কিছু কবার পাইতাসিলো না। গাড়িত উঠতে উঠতে এই খালাম্মারে কল দিলাম।”
তৌহিদার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা চম্পা বর্ণনা দিল। লিলিকে বসিয়ে দিয়েছেন রোমেনা। পাশে বসে ওর মাথাটা নিজের কাঁধে আগলে নিয়েছেন। মেয়েটা কাঁদছে ভীষণ। তিনি সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।
নেহাল চলে এসেছে ততক্ষণে। লিলি ছুটে গিয়ে নেহালের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে উন্মাদের মতো একটা কথাই জিজ্ঞেস করছিল,
“কী হয়েছে আম্মুর? কী বলল ডাক্তার? ডাক্তার কী বলল? বলো?”
নেহাল লিলির হাতের উপরে হাতটা রেখে বলল,
“লিলি, একটু শান্ত হয়ে বসো। মা’য়ের..”
“কী হয়েছে তাই তো জিজ্ঞেস করছি?”
“উনার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। রিপোর্ট পেতে আরেকটু সময় লাগবে। তবে এমনিতে প্রাথমিক অবস্থায় তারা ধারণা করছে স্ট্রোক হয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে। তবে অবস্থা…”
তৌহিদার অবস্থা অস্থিতিশীল এটা নেহাল কীভাবে লিলিকে বলবে বুঝতে পারছে না। যদি ফিরেও আসেন, তবুও ডান পাশের হাতে এবং মস্তিষ্কে প্রভাব থেকে যাবার সম্ভাবণা আছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ডাক্তার।
“স্ট্রোক…” অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল লিলি। এরপর তারস্বরে চিৎকার করে উঠল,
“কী হলো, কখন কথা বলতে পারব আম্মুর সাথে?” তাতে মিশে রইল আর্তনাদ।
“আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি লিলি এছাড়া…”
লিলি টলে উঠল, নেহাল ধরতে গেলে সে ছিটকে সরে গেল। এরপর মেঝেতেই বসে পড়ল।
করুণ আর্তিতে একটা শব্দ বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো, “আম্মু…”
সেই অসহায় আর্তি স্পর্শ করল বাকিদেরকেও। রোমেনা চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে নিলেন। তাকে এখন শক্ত হতে হবে। তবুও তিনি আজ পারছেন না, লিলির অসহায় আর্তনাদ তাকেও ভেঙে দিচ্ছে। তৌহিদা তার প্রাণের বন্ধু। সেই কবেকার পরিচয় তাদের, এরপর বন্ধুতা, কত সুখ দুঃখের কথোপকথন, কতটা পথ পাড়ি দেয়া। একই বয়স, অথচ আজ একজনের জীবন সংশয়ে।
চম্পার কাছ থেকে জানা গেল, তৌহিদা নাকি ইদানিং প্রায়ই বলতেন মাথা ঘোরানোর কথা। সকালে ঘুম ভাঙার পর উঠতে গেলে টলে উঠতেন। খাবার দাবারেও অনিয়ম করতেন। ঘুম হতো না। লিলির ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকতেন। গুছানো ঘর প্রতিদিন আবার গুছিয়ে রাখতেন। বলে বলে ওষুধ খাওয়াতে হতো। এরমধ্যে এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন লিলির কথা ভেবেই। প্রায়ই বলতেন,
“চম্পা, বুঝতে পারছি আমি আর বেশিদিন নেই। মেয়েটার জন্যই যত চিন্তা। কতই আর বয়স। এখনো জীবন দেখেনি। আমার সবকিছু ওর জন্য। মেয়েটাকে স্বাবলম্বী হয়ে যেতে দেখতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু নিজের কোনো ইচ্ছে যেন ওর অপূর্ণ না থাকে। সব ব্যবস্থা করে রাখছি। ওই বাড়ির কিছু আমার লাগবে না, কিন্তু লিলির বাবার ইচ্ছে ছিল গ্রামে তার সম্পত্তির অংশটুকুতে একটা স্কুল বানানোর। লিলিও চাইত আগে। ওর প্রাপ্যটুকু তো পাওয়া উচিত।”
ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ চলছে তৌহিদার। লিলি এখন পুরোপুরি স্থবির হয়ে আছে। নিস্পন্দ। যেন পাথরের মূর্তি, কোনো প্রাণ নেই যেন ওর শরীরে। কতক্ষণ অতিবাহিত হলো তাও জানে না। ওর পুরো দুনিয়াটা যেন আবদ্ধ হয়ে আছে ওই ছোট্ট কক্ষটায়।
নেহাল লিলিকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করে বিফল হলো।
“আমি আম্মুর কাছে যাব। আমাকে কেউ তার কাছে নিয়ে যাও। প্লিজ। আমার কত কথা তাকে বলার ছিল, আমাকে বলল বাড়ি থেকে এসে সব শুনব। আমি মনে মনে কত কথা গুছিয়ে রেখেছি। এখন ঘুমিয়ে আছে কেন? আমি তাকে ডাকব। আমি ডাকলে আম্মু ঠিক সাড়া দেবে। সবসময় সাড়া দিয়েছে। আমাকে নিয়ে যাও তোমরা প্লিজ।”
অনেকক্ষণ পরে লিলি তীব্র আকুতি মেখে অনুরোধ করল। কেমন অপ্রকৃতিস্থের মতো শোনালো কথাগুলো। চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন ওর গলায় অন্য কেউ কথা বলছে।
“অবশ্যই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে মা। তুমি দেখো।” নেহাল কিছুটা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।
“তুমি মিথ্যে বলছ কেন? আমি মাকে সারাজীবন জ্বালিয়েছি। তার কোনো কথাই শুনিনি। এখন তো রীতিমতো অন্যায় আচরণ করেছি। আমি এত সহজে পার পাব না। আমার শাস্তি এটা।”
“এসব কেন বলছ লিলি, প্লিজ এভাবে বলো না। এখানে তোমার কোনো হাত নেই। একটু ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অনেকক্ষণ পরে লিলির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
রোমেনা এসে নেহালকে ইশারায় কিছু বললেন। এরপর লিলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “যা তোর মাকে দেখে আয়।”
লিলি উঠে দাঁড়িয়ে নেহালের হাত চেপে ধরে বলল, “তুমিও চলো। আম্মু খুব খুশি হবে তোমার সাথে আমাকে দেখলে। এটাই তো দেখতে চেয়েছিল।”
নেহাল রোমেনার দিকে তাকালে তিনি চোখ মুছে ইশারা দিলেন। তৌহিদার তেমন কোনো সম্ভাবনা আর দেখছে না ডাক্তাররা। রোমেনা অনুরোধ করেছেন যেটুকু সময় পাওয়া যায়, যেন মেয়েকে তার মায়ের পাশে থাকার সুযোগ দেয়া হয়। নইলে মেয়েটা অপরাধবোধের যন্ত্রণাতেই শেষ হয়ে যাবে।
কিছু বিষয় বিবেচনা করে তারা অনুমতি দিয়েছে। লিলি নেহালের হাত ধরে ভেতরে যেতেই রোমেনার শক্ত আবরণটুকু খসে পড়ল। তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
***
লিলি নেহালের হাত ধরে মায়ের বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো।
“আম্মু একবার তাকাও, দেখো, তোমার কোনো পছন্দ আমার জন্য ভুল হতেই পারে না৷ তুমি আমাকে যত উপহার দিয়েছ, নেহাল এর মধ্যে বেস্ট। এটাই না তুমি এতদিন শুনতে চেয়েছিলে আমার কাছ থেকে। এটাই বলতে চেয়েছিলাম সেদিন। তুমি খুব খুশি হয়েছো না? বলো না! এই আম্মু!”
লিলি তৌহিদার একটা হাতের উপরে খুব সাবধানে আলতো করে হাত রাখল। এই হাত সারাজীবন ভরসা হয়ে ওর মাথার উপরে ছিল। হাতটা আজ একেবারে নিস্তেজ। লিলি অনুভব করল তোহিদার হাত যেন খানিকটা নড়ে উঠল। চোখ বন্ধ থাকলেও ঠোঁটের কোন যেন কিঞ্চিৎ চওড়া হলো। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখে গাঢ় শ্বাস পড়ল কয়েকটা। হাসি হাসি মুখে যন্ত্রণার ছাপ দেখা দিল। তারপর বাকিসব নিস্তেজ হয়ে এলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার ঘোষণা দিল সব শেষ। লিলির নিঃশ্বাস থমকে গেল। ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যেন। সে অপ্রকৃতস্থ আচরণ করছিল।
সব বাঁধ ভেঙে সে মা’য়ের গায়ের উপরে আঁছড়ে পড়ল। পাগলের প্রলাপের মতো করে সে বলতে থাকল,
“আম্মু, তুমি না চাইতে আমি ভদ্র হই। আমি তোমার সব কথা শুনব। তোমার অবাধ্য হব না কোনোদিন। যা বলবে, যেভাবে বলবে তাই করব। করল্লা ভাজি রান্না করলে না জ্বালিয়ে তাও খাব। পড়াশোনা করতে আমার ভালো লাগে না। আমি নিয়মিত পড়তে বসত আম্মু। তোমার অপছন্দের কারো সাথে মিশব না, ঠিক সময়ে বাসায় ফিরব। রাস্তায় গণ্ডগোলও করব না। আমি তো তোমার পছন্দ করা নেহালকেও এখন ভালোবেসে ফেলেছি। তবুও এত অভিমান কেন তোমার। আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি কোনোদিন। একবার দেখবে না আমাকে? তুমি ছাড়া আমি কীভাবে থাকব? তুমি স্বার্থপরের এভাবে ফাঁকি দেবে আমাকে? একবার একটা কথা বলার সুযোগ দেবে না? ওই আম্মু? আল্লাহ…”
……..
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২৪)
নুসরাত জাহান লিজা
নেহাল কোনোভাবেই লিলিকে সামলে নিতে পারছে না। অপ্রকৃতস্থের মতো বিলাপ করছে মেয়েটা। এই হারানোর শোক অসহনীয়, কোনো সান্ত্বনাই প্রলেপ দেবার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
তোহিদার প্রতি নেহালের এই কয়দিনে একটা বড় শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়েছিল। মেয়েকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন। মেয়ে যা-ই করুক, তিনি সর্বক্ষণ নেহালকে বলতেন, তার মেয়েকে যেন সে একটু বুঝতে চেষ্টা করে। মেয়েকে যেন ভালোবেসে আগলে রাখে।
একজন প্রায় নিঃসঙ্গ যো দ্ধা র একমাত্র অবলম্বন ছিল। আজ স্বয়ং যো দ্ধা নিজেই বিদায় নিয়েছেন। যাবার আগে দায়িত্বের গুরুভার অর্পণ করেছেন নেহালকে। সে সর্বস্ব দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করবে। কারণ যো দ্ধা র আগলে রাখা পরম সাধনার ধনকে তো সে-ও ভালোবাসে। নিজের জন্যই করবে নেহাল। লিলি ভালো না থাকলে সে ভালো থাকে না, ওর কষ্টগুলো নিজের কষ্ট বলে মনে হচ্ছে!
“একবার উঠে আমাকে ক্ষমা চাইবার সুযোগটুকু দিয়ে যাও আম্মু৷ আমার সমস্ত জীবনের সমস্ত অর্জনের বিনিময়ে হলেও একবার চোখ খুলে আমার দিকে তাকাও আম্মু। আমি শুধু একবার বলব, আমি ভুল করেছি, আমাকে মাফ করে দাও। তোমার প্রশ্রয়ে একবার তোমার হাতটা আমার মাথায় রাখো আম্মু৷ একবার।”
“লিলি, তুমি ক্ষমা না চাইতে পারলেও তিনি ঠিকই ক্ষমা করে দিয়েছেন। উনি হাসিমুখে চলে গেছেন। এভাবে কাঁদলে উনার কষ্ট হবে। তুমি দোয়া কোরো বেশি করে, এখন এটাই প্রয়োজন।” নেহাল লিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।
লিলি চোখ তুলে নেহালের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী করে জানলে?”
“মায়েরা সন্তানের সব ভুল ক্ষমা করে দেন। তারা কিছু মনে রাখেন না। মাকে নিয়ে যেতে হবে, লিলি৷ তার ব্যবস্থা হচ্ছে।”
লিলি যেন তখন এই পার্থিব জগতে নেই। সে যেন বহুদূর থেকে কথা বলছে, “আমার মা আমাকে কোনোদিন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তুমি তো স্বাক্ষী, তাই না? মা বলেছিল ফিরে এসে আমার সব কথা শুনবে? কই শুনল? যদি ক্ষমাই করবে তাহলে এভাবে ফাঁকি দিলো কেন?”
“এসবের উপরে আমাদের কন্ট্রোল নেই লিলি। উপরে যিনি বসে আছেন, তিনিই সব নির্ধারণ করেন। তিনি যেভাবে ইশারা করেন, সেভাবেই সব ঘটে। আল্লাহর কাছে দোয়া চাও মা’র জন্য। তুমি ছাড়া তো তার আর কেউ নেই।”
“আমারও তো কেউ রইল না। আমি কী করে থাকব? আমি কেন গেলাম না? আমি কেন রয়ে গেলাম?”
নেহাল কোনো উত্তর দিলো না, সে লিলিকে শক্ত করে ধরে রাখল। কখনো কখনো মুখে কিছু বলতে হয় না। পাশে থেকে সকল কষ্টের ভাগ নিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়, “তুমি একা নও। আমি আছি তো। তোমার সকল বেদনায়, কান্নায়, আনন্দে, সকল কিছুতে।”
নেহালও সেভাবেই যেন প্রায় সর্বস্বান্ত লিলিকে অনুভব করাতে চাইল সে এই বিশাল ভ্রম্মান্ডে লিলির পাশেই আছে। খুব কাছে আছে। যতটা কাছে থাকলে চোখের জলের ভাগ নেয়া যায়।
***
তৌহিদাকে যখন জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন লিলির আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। একসময় সে চেতনা হারিয়ে ফেলে।
নেহাল, আশফাক আর লিলির মামা, চাচা মিলে সব সম্পন্ন করল। রোমেনা বাড়ির সমস্তকিছু দেখাশোনা করল।
নওরীন পুষ্পিতাকে নিয়ে বসে রইল লিলির কাছে। ছোট্ট পুষ্পিতা কেঁদে উঠেছিল, নিজের মায়ের কথা মনে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সে একবার গিয়েছে। নওরীন ওকে রিয়াদের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। তারপর থেকে সে শান্ত হয়ে লিলির বিছানায় ওর পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে।
লিলি জেগে উঠল চিৎকার করে। বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
নওরীন ওকে আগলে নিল।
“আম্মু কোথায় নওরীন আপু? আমি খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আম্মুকে দেখলে শান্তি পাব। আমি আম্মুর কাছে যাই।”
নওরীন কী বলবে বুঝতে পারল না। ওর কেবল মনে হলো, এটা যদি সত্যিই দুঃস্বপ্ন হতো! লিলির কাছ থেকে সরে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল।
“লিলি, পানিটা খা।”
লিলি সেটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করল। মেয়েটার চোখ দুটো ফুলে আছে, লাল টকটকে হয়ে আছে কান্নার ফলে। মুখটা ভীষণ মলিন। সেভাবেই মৃদু হাসল, ভীষণ বিষন্ন সেই হাসি। মন কেমন করে উঠল নওরীনের। সেই সাথে বুঝতে পারল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে লিলির মধ্যে। এখানে ঠিক নিজের মধ্যে ফেরেনি মেয়েটা৷
“মাথাটা কেমন লাগছে। একটু আম্মুকে ডেকে দাও না।”
নওরীন বলল, “লিলি, আমি তোর জন্য খাবার আনি। কিছু খা। সেই সকালের পরে তোর খাওয়া হয়নি।”
“সকালে? এখন কয়টা বাজে?”
“সাতটা আটত্রিশ।”
অনেক মানুষের কথাবার্তা ভেসে আসছে। যারা দেখতে এসেছিল, তারা চলে যাচ্ছে। পাশের ঘরে কেউ কোরআন তেলাওয়াত করছে।
লিলি কিছু মনে করার চেষ্টা করল। এরপর চোখ বেয়ে অশ্রু নামল।
“আম্মুর…”
“হ্যাঁ, সব…” লিলি বলার আগেই নওরীন বুঝতে পেরে উত্তর দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলো।
“সব আমার জন্য হয়েছে। আমি আম্মুকে কোনোদিন শান্তি দেইনি। কোনো কথাও সেভাবে শুনিনি। আমার জন্য চিন্তা করতে করতে…” থেমে গিয়ে লিলির মুখে যন্ত্রণার ছাপ পড়ল,
“আমি নিজের হাতে তাকে মেরে ফেলেছি।”
রোমেনা আর নেহাল ভেতরে এলো এই সময়। রোমেনার হাতে খাবার।
“মা রে, আমাদের হাতে এত ক্ষমতা নেই। তৌহিদার অনেক স্বপ্ন ছিল তোকে নিয়ে। তৌহিদা নেই, ওর স্বপ্নগুলো তো রয়ে গেছে। তোর হাতে কতবড় দায়িত্ব, বল?”
কথা বলতে বলতে দুইবার মুখে ভাত তুলে দিলেন রোমেনা। কিন্তু এরপর আর সম্ভব হলো না। লিলি আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল।
“আমার মাকে কোথায় রেখে এসেছো, আমাকে সেখানে নিয়ে যাও।”
লিলিকে তৌহিদার কবরের পাশে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়ে সে শক্ত রইল। দোয়া পড়ল, দোয়া করল। এরপর ফিরে এলো।
***
রাতে লিলির একফোঁটা ঘুম এলো না। বলতে গেলে সারারাত প্রায় বসে রইল। একটু পরপর কেঁদে উঠছিল। নেহালও পুরো রাত জেগে রইল।
“আমি যদি আরেকটু আগে নিজেকে বুঝতাম, তাহলে আম্মু আজ আমার সাথে থাকতে পারত।”
নেহাল সযত্নে লিলির হাত দুটোকে নিজের মুঠোয় টেনে নিল, এরপর অন্য হাতে সে চোখের পানিটুকু মুছে দিল।
“লিলি, আমার মা একটা কথা মাঝেমধ্যে বলে, মানুষের জীবনটা খুব ছোট। এই আছি এই নেই। আমাদের সকলের প্রিয় মানুষের প্রতি রাগ হয়, অভিমান হয়। কিন্তু সেসবকে বাড়তে দিতে নেই। আমি সেটা খুব মেনে চলি।”
“আম্মু তো জানত আমি এমনই। আর একটু সুযোগ যদি আমাকে দিতো।”
“নিজেকে দোষ দিও না। আল্লাহ আমাদের একটা নির্দিষ্ট আয়ু দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান, সেটা ফুরিয়ে গেলে তিনিই একদিন তুলে নেন। আমরা কেবল যদি, কিন্তু, ইশ এসব বলে সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা অনেক সময় মানুষের ইনটেনশন বুঝতে পারি না। একটা কাজ হয়তো তোমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু সেটা যদি আমাদের ভালোর জন্য তারা করেন তাহলে মেনে নিতে না পারলেও বা কষ্ট হলেও তাদের কাছ এতটা দূরে যাওয়া উচিত নয়, যত দূরে গেলে হুট করে কাছে ফেরার মতো সময় পাওয়া যায় না। অন্তত বুঝতে চেষ্টা করতে পারি আমরা। যদি ইনটেনশন ভালো না হয়, সে অন্য কথা। এভাবেই একদিন সময় ফুরিয়ে যাবে, আর আমরা আমাদের আচরণ শুধরে নেবার সুযোগ হয়তো পাব কিন্তু সারাজীবনের জন্য ওই একটাবার কথা না বলতে পারার আক্ষেপ আমাদের পোড়াবে। তাই মান, অভিমান সবকিছুর একটা সীমারেখা টানতে শিখতে হয়। সময় এত দ্রুত চলে যায়, তার সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত নিজেকে বুঝতে জানতে হয়।”
লিলি চোখ ভরা জল নিয়ে অধোমুখে বসে রইল। নেহালের মনে হলো কথাগুলো আজকের জন্য একটু রূঢ় হয়ে গেল বোধহয়। তবে লিলি এতে খানিকটা শান্ত হয়ে এসেছে।
“লিলি, যা চলে যায় সেটা একেবারেই যায়। আর কখনো ফিরে আসে না। কিন্তু তোমার পুরো জীবনটা সামনে পড়ে আছে। তোমার সাথে আমিও আছি। আমরা সকলেই আছি। আমি হয়তো মা’র মতো করে ভালোবাসতে পারব না, কিন্তু আমি আমার সমস্তটা দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সবকিছু তে আমি আছি। আমার সমস্তটায় তুমি আছো। তাই এটা ভাববে না যে তুমি একা। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
লিলি সেভাবেই বসে রইল। শুধু চোখের পানি পড়া বন্ধ হলো। গাল বেয়ে পানির ছাপ শুকিয়ে এসেছে। এখন একেবারে প্রাণহীন পুতুল বলেই মনে হচ্ছে, যার চোখে মুখে অভিব্যাক্তির লেশমাত্র নেই। চোখের দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক শূন্যতা।
এই লিলি যেন ভীষণ অচেনা কেউ, অন্য মানুষ। একটা ধাক্কা ওকে যেন এই সামান্য কয়েক ঘণ্টায় সমূলে বদলে দিয়েছে।
নেহাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাতে মিশে রইল সহানুভূতি। সেও পাশে বসে রইল একরাশ চিন্তা নিয়ে।
…….
(ক্রমশ)