মাইনাসে মাইনাসে প্লাস পর্ব-১৯+২০

0
3103

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১৯)
নুসরাত জাহান লিজা

মা মেয়েতে আরও অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, কিন্তু কী কথা তা নেহাল জানে না। তবে তৌহিদার মুখের অভিব্যক্তিতে এটুকু স্পষ্ট যে যাই হোক, সেটা সুখী সুন্দর কোনো কথা নয়। তার মুখ থমথমে। বেরিয়ে এসেই চলে যাবার জন্য তোরজোর শুরু করলেন৷ অনেক বলে-কয়ে খেয়ে যাবার জন্য রাজি করানো গেল।

সকলেই তৌহিদাকে থাকার জন্য অনুরোধ করলেও, লিলি একবারও কিছু বলেনি। নেহালের বিষয়টা একদমই ভালো লাগেনি। খাবার টেবিলে সমস্ত তদারকি রোমেনা করলেও এবার লিলি খানিকটা সরব হলো। সে মা’কে এটা সেটা তুলে দিল। তার কোনটা পছন্দ, কোনটা বেশি খাওয়া বারণ এসবে তীক্ষ্ণ নজর রাখল। ওর মা যেন তাতেই খুশি হলেন, তার মুখের থমথমে ভাব কিছুটা হলেও কাটল।

নেহাল এলো তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। সিএনজিতে বসে সে শাশুড়িকে বলল,

“আপনি আজ থেকে গেলে লিলির ভালো লাগত।”

“সুতো খানিকটা ঢিলে করে রাখতে হয়। যত শক্ত করে ধরবে তত ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবণা বেড়ে যাবে। আমি নাহয় সম্পর্কের অদৃশ্য সুতোটুকু আলগা করেই ধরে রাখি, তবুও বাঁধনটুকু থাকুক।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তৌহিদা।

নেহাল কথাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করল। লিলিকে সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। কখনো ভীষণ চপলতা ভরা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলা, কখনো ঠাট্টাচ্ছলে ওকে নিয়ে মেতে উঠা, কখনো ছেলেমানুষী জেদ, আবার কখনো অদ্ভুত শীতল কাঠিন্য। একই মানুষ অথচ একেকটা রূপে যেন আলাদা মানুষ। কোনটা আসল লিলি সে জানে না।

এই তো মনে হচ্ছিল লিলি বুঝি ধীরে ধীরে ওর কাছে চলে আসছে, আজকে নিজের মায়ের সাথে ওর আচরণে নেহাল যেন নিমিষেই কয়েক আলোকবর্ষ দূরে ছিটকে পড়ল। যদি ওকে মেয়েটা পছন্দই করতে শুরু করত, তাহলে নিশ্চয়ই এই কারণে মা’য়ের সাথে এমন আচরণ করত না। তবে কি সে ভুল পড়েছিল লিলিকে?

ওর যে মনে হয়েছিল রিনিকঝিনিক ছন্দ তুলে ওর হৃদয়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা, নেহাল তো তার শব্দও পেয়েছিল। হৃদয়ের দরজা খুলে নৈবেদ্য সাজিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কখন রাণী এসে প্রবেশ করবে ওর রাজ্যে, অধিকার করে নেবে সিংহাসন। অলংকৃত করবে নেহালকে! পুরোটাই কি কেবলই ভ্রম!

“বাবা, আমি একজন মা তো। স্বার্থপরের মতো নিজের দিকটা ভেবে তোমার জীবনকে বিরূপ করে দিলাম।”

“মা, এভাবে বলে আমাকে কষ্ট দেবেন না, প্লিজ। লিলি পুরোপুরি নিজের খেয়ালে চলে। এই কয়দিনে আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি ও ভীষণ অভিমানী আর জেদি। ভীষণ অকপট, যা মনে হয় কোনোকিছুই সে লুকিয়ে রাখে না। নিয়ন্ত্রণও করে না৷ আপনি আমার উপরে ভরসা রেখেছেন, দেখবেন ও খুব দ্রুত আপনার সাথে আগের মতো স্বাভাবিক হবে। ও চমৎকার একটা মেয়ে।”

নেহাল এই প্রথমবার মা বলে সম্বোধন করল তাকে৷ লিলি তো ওর মাকে এভাবেই বলে। সে-ও নাহয় এগিয়ে গেল। তাছাড়া তৌহিদার জন্য কষ্টও হচ্ছিল।

“আমি ভুল নির্বাচন করিনি। এটাই আমার জন্য স্বস্তির। পাগল মেয়েটাকে বুঝতে চেষ্টা করছো, এটাই সবচাইতে বড় ব্যাপার। লিলি যেদিন তোমাকে বুঝতে পারবে সেদিনটা যেন তাড়াতাড়ি আসে, এটাই দোয়া করি।”

“আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি সবসময় আছি।”

তৌহিদা স্নেহময় স্পর্শ করলেন নেহালের মাথায়৷ তাতে মিশে রইল একরাশ স্নেহ আর এক পৃথিবী শুভাশিস।

নেহালের ভালো লাগল সেটা। ফিরতে ফিরতে ওর মনে হলো লিলির ইচ্ছে কী সেটা জানতে হলে আগে লিলিকে পুরোপুরি বুঝতে হবে। মেয়েটার মধ্যে একটা জটিল গোলকধাঁধার বাস। সেই রহস্য আগে ভেদ করতে হবে! এটাই এখন ওর লক্ষ্য।

***
লিলি বিছানায় মনমরা হয়ে শুয়ে ছিল। খাবার পরে তৌহিদাকে বিদায় দিয়ে এসে শুয়েছে। নওরীন ধরে ধরে শুইয়ে দিয়ে গেছে। পায়ের ব্যথাটা বেড়ে গেছে অনেক। ফুলেও উঠেছে।

পুষ্পিতাকে নিয়ে নওরীন এপাশে রেখে তৈরি হতে গেল। তারাও চলে যাবে এখন।

লিলির মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বারবার চায় জড়িয়ে ধরে আগের মতো সমস্ত ভালোবাসা আর আদর গায়ে মাখবে। কিন্তু কেন যে সে কিছুতেই এটা পারছে না। ওর মনে হয় ওর আচরণে অতিষ্ট হয়ে শিক্ষা দেবার জন্য বিয়েটা দিয়েছে। এটাই ওকে তাতিয়ে দেয় বারবার। মনটা বিষিয়ে দেয়। কিছুই ভালো লাগে না। মনে হিয় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে কেবলই একা, নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। ও কারোর নয়, কেউ ওরও নয়।

“তোমার পায়ে কী হয়েছে?”

ছোট্ট মিষ্টি কণ্ঠের কথায় ওর সম্বিত ফিরল, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।” হেসে উত্তর দিল লিলি।

“আমার মতো দুষ্টুমি করতে গিয়ে?”

“তুমি অনেক দুষ্টু বুঝি?”

“মা বলত, দুষ্টুমি করলে আমাকে ফেলে যেদিকে চোখ যায় চলে যাবে। মায়ের যখন অসুখ হলো৷ তখন আমি আর দুষ্টুমি করিনি। তাও মা চলে গেল। কত ডাকি তাও ফেরে না।”

লিলির ভেতরে টনটনে ব্যথা হলো। নিজের মাকে আচমকা উপলব্ধি করল। সে আধশোয়া হয়ে বসে পুষ্পিতাকে ইশারায় কাছে ডাকল। এরপর দুই হাত ধরে বলল,

“তোমার নাম কী?”

“পুষ্পিতা।”

“পুষ্প মানে জানো?”

“জানি, ফুল।”

“বাহ্! তুমি তো অনেককিছু জানো। অনেক বুদ্ধি তোমার। বুদ্ধিমতী মেয়েরা কী করে জানো?”

“কী করে?” পুষ্পিতার মুখ এখনো কাঁদোকাঁদো।

“তারা মিষ্টি করে হাসে। দেখি একটু হাসো তো?”

পুষ্পিতা এক চিলতে হাসল।

“এই তো। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে।”

“তুমিও সুন্দর।”

“তাই নাকি। আমাকে আন্টি বলবে, কেমন?”

“কিন্তু মা তো বলল তুমি আমার মামি হও!” চিন্তিত হয়ে বলল পুষ্পিতা।

লিলি এই ধরনের বিবাহসম্পর্কিত ডাকগুলোর সাথে অভ্যস্ত নয় বলে একটু কেমন যেন লাগল। তবে নিষেধ করল না। বিছানার পাশের টেবিলে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে সে একটা চকলেট বের করে দিল পুষ্পিতাকে। মেয়েটাকে ওর ভালো লেগেছে। এত ভালো মেয়ে, অথচ কতটা কষ্ট পেয়েছে জীবনকে ঠিকঠাক চেনার আগেই।

“মামি, তোমার নাম কি?”

“লিলি।”

“লিলি ফুল?”

“হ্যাঁ। দেখেছো, আমাদের নামের মিল?”

পুষ্পিতা বুঝল কিনা লিলি জানে না, কিন্তু ঠিকই হেসে মাথা নাড়ল।

“আমি তোমাকে পুষ্প বলে ডাকব, কেমন?”

এই পর্যায়ে নওরীন ভেতরে এলো৷

“এরমধ্যে মামির সাথে ভাব হয়ে গেল বুঝি?”

“হ্যাঁ, মামি খুব ভালো।”

“আর মা?”

“মা’ও ভালো ছিল। তুমিও ভালো।”

নওরীন পুষ্পিতার হাত ধরে বললেন, “লিলি, আসি রে। বাসায় যাবি কিন্তু। আর সাবধানে চলাফেরা করিস।”

“আচ্ছা। তুমিও এসো পুষ্পকে নিয়ে।”

ওরা বেরিয়ে যেতেই লিলি নিজের জগতে ডুবে গেল। একটা মন খারাপের বাষ্প কোত্থেকে এসে ঢুকে পড়ল ওর মনে। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। অসুখে সে মা’কে ছাড়া কোনোদিন থাকেনি। কেন সে মা’কে যেতে দিল, এখন আফসোস হচ্ছে ভীষণ। একবার সে বললেই মা আজ থাকতেন, লিলি জানে। কিন্তু সে বলেনি। কীসের এত জেদ ওর? সে আসলে কী চায়!

নেহালকে তো ওর খারাপ লাগছে না। এবাড়ির প্রত্যেকেই এমন চমৎকার মানুষ! ওর অবারিত স্বাধীনতা আছে। তবুও কেন তার মনে এত দোলাচল! সে বুঝতে পারে না, অন্য লোক ওকে কী বুঝবে, সে নিজেই কি নিজেকে বুঝতে পারে!

***
“আয়, তোর চুলগুলো আঁচড়ে দেই।” নওরীন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই পুষ্পিতাকে নিয়ে পড়ল।

“ওই বাসায় ওই যে নতুন নানি আছে না? সে তো চুল বেঁধে দিলো।”

নওরীন নিজের অস্থিরতা লুকিয়ে রেখে বলল, “তাে কী হয়েছে? শোবার আগে আগে চুল ঠিকঠাক করতে হয়। তাহলে চুল অনেক বড় হয়।”

“তোমার চুলের সমান হবে?” এরইমধ্যে পুষ্পিতা ওকে আপন ভাবতে শুরু করেছে৷ অবশ্য হাসপাতালের দিনগুলোতেই সখ্যতা গড়ে উঠেছে, সাথে ভরসার জায়গা। এখন কী সুন্দর টুকটুক করে তুমি বলছে, মা ডাকছে! নওরীনের অপূর্ণ বুকটা যেন ভরে উঠছে প্রাপ্তিতে।

“হ্যাঁ, আরও বড় হবে।”

নওরীনের সামনে এসে বসে পুষ্পিতা বলল, “তাহলে চুলে চিরুনি করে দাও।”

নওরীন চিরুনী চালাচ্ছে, কিন্তু ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে৷ মনে হচ্ছে পুষ্পিতা যে জন্ম থেকেই ওর সন্তান। একে সে বুক দিয়ে আগলে রাখবে। কে কী বলল তাতে ওর কিছুই যায় আসে না।

রিয়াদের বাবা মা থাকেন গাজীপুরে। রিয়াদ কর্মসূত্রে এখানে। তারা স্বাভাবিকভাবেই সব নিয়েছেন। কিন্তু রিয়াদের বড় বোন নওরীনের প্রতি নাখোশ। বিশেষ করে এক্সিডেন্টের পরে থেকে। কখনো মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু তার হাবেভাবে সেটা ঠিকই বোঝা যায়। আজ রিয়াদকে কল করে বাচ্চা দত্তক নেয়া নিয়ে অনেক কথাই শুনিয়েছে। ওর কানেও এসেছে কথাগুলো।

শ্বশুর, শাশুড়ি ভিডিও কলে পুষ্পিতার সাথে ভালো মতোই কথা বললেন। রিয়াদ তো খুশি। ওর ননদ আছে একজন। সে পুষ্পিতাকে দেখার জন্য বাসায় আসবে। কিছুদিন মাস ছয়েক হয় ওর বিয়ে হয়েছে। সমস্যা শুধু একজনেরই।

নওরীন মনস্থির করল, পুষ্পিতাকে সে ভীষণ শক্ত মনের মানুষ হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করবে। যার মধ্যে মানবিকতাবোধ থাকবে, মমতা থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু দুর্বলতা থাকবে না একেবারেই৷

***
নেহাল ফিরে এসে দেখল লিলি ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। কেমন যেন জবুথবু লাগছে। নেহাল সাহস করে কাঁথাটা টেনে দিল গায়ে। সাথে সাথে লিলি চোখ মেলে তাকালো।

“আপনি কখন এলেন? আম্মু কিছু বলল আমাকে নিয়ে?”

“এমন অস্থিরতায় যদি ভুগবে, তাহলে ওমন করলে কেন?”

“জানি না। কিছু বলে থাকলে বলুন, না হয় এত কথার প্রয়োজন নেই। আমার জ্বর এসেছে। এত কথা ভালো লাগছে না।”

নেহাল তৎক্ষনাৎ সম্পূর্ণ অবচেতনেই নিজের হাতটা লিলির কপালে রাখল। জ্বর সত্যিই আছে। লিলির চোখে ওর চোখ পড়তেই সে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল। এরপর ইতস্তত করে বলল,

“তোমার জ্বর শুনে দেখলাম। কিছু মনে কোরো না প্লিজ।”

লিলি উত্তর দিল না, সে স্থির, ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে।

“ওষুধ খেয়েছো?”

“ব্যথার জন্য খেয়েছি যেগুলো ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেছে।”

“জ্বরের জন্য?”

“না।” নেহালকে উঠতে দেখে লিলি বলল,

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“মা’র ঘরে।”

“কেন, আপনার গুগল কাজ করছে না বুঝি?”

নেহাল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই মেয়ে এমন অসুস্থতা নিয়ে ওকে খোঁচা দিতে ছাড়ে না৷ কোন কুক্ষণে যে সে এই অকাজ করেছিল আল্লাহ জানে! মোক্ষম উত্তরও খুঁজে পায় না।

মেয়েটা আর কী বলে না বলে তার ঠিক নেই। সে পা বাড়ালো রোমেনার ঘরের দিকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোনোদিন কোনো বিষয়ে সে গুগলের সাহায্য নেবে না। সম্ভব হলে ফোন থেকেই এটা ভ্যানিস করে দেবে। গুগল ওর বিরুদ্ধ শক্তির হাতিয়ার। অথচ সে কিনা এখন অব্দি নিরস্ত্র।
……….
(ক্রমশ)

#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ২০)
নুসরাত জাহান লিজা

“আজকে তোমাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। ব্যাপার কী?” আশফাক পত্রিকা থেকে চোখ তুলে রোমেনাকে প্রশ্ন করলেন।

“খুশি হবো না? মেয়েটা আজ কতদিন পরে এতটা খুশি বলো তো? সবসময় যদিও হাসিখুশি থাকে, কিন্তু আমি তো বুঝি ওর মনের কষ্টটা। তুমিও তো বুঝতে বলো?”

“সন্তানের আনন্দ বিষাদ তো আমরাই বুঝব, সমব্যথী হব তাই না!”

দু’জনেই নির্মল হাসলেন। রোমেনার মুখে হঠাৎ খানিকটা বিষাদের ছাপ পড়ল,

আশফাক বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী হলো?”

“পুষ্পিতা আর ওর মায়ের কথা ভাবলাম৷ জীবনটা কত বিচিত্র তাই না? একজন পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল, সেটাই অন্য একজনের পূর্ণতা হয়ে ধরা দিল।”

“হ্যাঁ। আমার তো মেয়েটার জন্য খারাপ লেগেছে খুব। কিন্তু মানুষের হাতে তো এসব থাকে না।”

ঘরজুড়ে নীরবতা নেমে এলো সহসাই। রোমেনা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে প্রশ্ন করলেন,

“তোমার শরীরটা এখন কেমন?”

“সবার খুশি দেখে এখন ঝরঝরে মনে হচ্ছে নিজেকে।”

“খারাপ লাগলে বলো। দেখো, টেনশন করব ভেবে লুকাবে না কিন্তু!”

“আরে না। পুরোপুরি সুস্থ আমি।” হাসিমুখে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন আশফাক। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সাড়া দিলেন।

নেহাল ভেতরে এলো বিতৃষ্ণ মুখে। রোমেনা জিজ্ঞেস করলেন,

“তোর আবার কী হলো? মুখটা এমন তেতো বানিয়ে রেখেছিস কেন? মনে হচ্ছে কেউ জোর করে তোকে এক জগ চিরতার রস গিলিয়ে দিয়েছে।”

নেহাল মনে মনে বলল, “আমার জীবনে এখন চিরতার রস কেন, চিরতার আস্ত একটা বনের মালিক আছে। সেই বনের প্রত্যেকটা গাছ রোজ চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হয়।”

মুখে অবশ্য সেটা বলল না।

“লিলিকে একটু দেখে শুনে হাঁটতে চলতে বোলো তো মা। এখন আবার জ্বর বাধিয়ে বসে আছে।”

“এইজন্য তোর মন খারাপ?”

“হবে না? এমন কেয়ারলেস কেউ হয়?”

“তা বাপ, যার জন্য এত চিন্তা, তাকেই একটু সেটা দেখা না! তোর এমন চিন্তায় পাগল হবার দশা দেখলে তোর জন্য হলেও মেয়েটা একটু সাবধানে চলবে। মনে করবে ওর কিছু হলে আরেকজন পাগল হয়ে যাবে।”

নেহাল লজ্জা পেয়ে গেল। সে কোনোকিছু ভেবে এখানে আসেনি। মা-বাবার সাথে ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ সময় কাটানো আর সব শেয়ার করা হয়। তাই উদ্বেগটুকু প্রকাশ করে ফেলেছে।

ওর ভেতরটাকে মা এমনভাবে বুঝতে পারে যে জীবনে কোনো অনুভূতি সে আড়াল করতে পারেনি। এখন তো বিষয়টা হৃদয়ের, এটা কী করে চাপা থাকবে!

“তেমন কিছু না মা।”

“কেমন কিছু তাহলে?”

“ছেলেটাকে জ্বালাচ্ছ কেন বলো তো?” আশফাক রোমেনার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন, তার মুখে অবশ্য স্ত্রীর জন্য প্রশ্রয়ের আভাস।

“ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে, কিন্তু ওর অবস্থা দেখো। স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা প্রথমবার প্রেমে পড়লে যেরকম মেয়েদের স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দূর থেকে এক নজর দেখার জন্য। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে গলা কাঁপে, হাঁটু কাঁপে। বুক ফাঁটে তো মুখ ফুটে না অবস্থা। এরও সেম।”

“তোমরা কি একজোট হয়ে আমার পিছনে লেগেছ নাকি মা?” নেহাল নাখোশ গলায় প্রশ্ন করল।

রোমেনা হাসি চেপে রেখে প্রশ্ন করলেন, “আমি ছাড়া আমার ভালো ছেলেটার পেছনে আর কে লেগেছে শুনি?”

“তুমি তো আছোই। এখন আবার লিলি…” এটুকু বলে চট করে থেমে গেল। এরবেশি বললে সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে। মা খুঁচিয়ে মা”র”বেন।

“তাই নাকি? কী করেছে?”

“কী করবে আবার! কিছুই করেনি।”

রোমেনা সশব্দে হাসলেন, এরপর বললেন, “মিথ্যা বলার আর্টটা তুই শিখিসনি বাপধন। থাক, বলার প্রয়োজন নেই। সব কথা আমি জেনে কী করব। আয় লিলিকে দেখে আসি।”

রোমেনা সাথে এসে দেখলেন লিলি আধা অচেতনের মতো ঘুমুচ্ছে। জ্বর বাড়ছে, তিনি মাথায় পানি দিতে চাইলে নেহাল বলল,

“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা। অনেক ধকল গেছে সারাদিন। তাছাড়া বাবার শরীরটাও তো অসুস্থ। আমি সামলে নিচ্ছি।”

রোমেনা চলে গেলেন, ছেলে পারবে তিনি জানেন। নেহাল আর নওরীন যখন ছোট, তখন তিনি প্রায়ই অসুখে পড়তেন৷ তিনজন মিলে তখন থেকেই ছোট্ট সংসারের সব সামলে নিতে শিখেছে।

***
নেহাল বালতিতে করে পানি এনে বিছানার পাশে রেখে আলতো করে লিলিকে ডেকে এদিকে মাথা রেখে শুতে বলল। এরপর খুব যত্ন করে মাথায় পানি ঢালতে থাকল। মেয়েটা এখন জেগে আছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কোনো কথা বলছে না।

অনেকটা সময় নিয়ে মাথার পানিটুকু মুছে দিল, আবার না ঠান্ডা লেগে যায় ভেবে। লিলি উঠে বসে মাথায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে নিল।

“আমার জ্বর এলে কখনো মরার মতো ঘুমাই, আবার কখনো একফোঁটাও ঘুম আসে না। এখন ঘুম ভেঙে গেছে। আর আসবে না। আমি জেগে থাকলে আমার পাশে কেউ ঘুমিয়ে থাকলে ভীষণ একা একা লাগে। আম্মু সবসময় জেগে বসে থাকত, কখন আমার ঘুম ভাঙে সেজন্য।”

নেহাল বালতিটা বাথরুমে রেখে এসে অল্প পানি ফ্লোরে পড়েছে, সেটুকু মুছে বিছানায় পা তুলে লিলির পাশে বসল।

“আমি আছি লিলি। আজ আমার সাথে গল্প করলে চলবে?”

“হুম।”

“আচ্ছা, তোমার গল্প বলো।”

“আমার আম্মু ভীষণ একা, জানেন? আমাকে ঘিরেই তার পুরো পৃথিবী। উঠতি তারুণ্যের প্রভাবে কিছু বেপরোয়া কাজকর্ম করেছি। আম্মু কষ্ট পেয়েছে। আমি বুঝতাম সবই, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত চালচলনে অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমি আম্মুর পৃথিবীতে আরও কয়েকবছর তো থাকতে পারতাম। কিন্তু আমায় বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।”

“আসলেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে? একটু চিন্তা করে দেখো তো লিলি, তোমাদের পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না৷ তার কি তোমাকে এত দ্রুত হাতছাড়া করে ভালো থাকার কথা? তুমি যতটা তার কাছে যেতে চাও, থাকতে চাও, তিনিও ততটাই চান। তবুও তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলো তো? তার বয়স হয়ে যাচ্ছে, মা’র কাছে শুনলাম তাদের আরেকজন বান্ধবী ছিলেন আয়েশা আন্টি। চট্টগ্রামে থাকতেন। তিনি বছর দুই আগে মারা গেছেন। এতে তৌহিদা আন্টি ভয় পেয়েছেন নিজেকে নিয়ে। তোমাদের পৃথিবীতে তুমি একলা না হয়ে যাও, এই ভয় পেয়েছেন তিনি। কিংবা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি না তাকে একলা করে দাও। একজন মায়ের জন্য এই ভয়টা কি অমূলক? বলো তো? হয়তো তোমার সময় হয়নি, কিন্তু তিনি তোমার ভালো চান বলেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার কি কম কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছেড়ে থাকতে?”

লিলির পুরো মুখ থমথমে, কিন্তু চোখে ধীরে ধীরে জল জমছে। ভরে আসছে চোখ দুটো। মায়ের সাথে এখনই কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

“এখন কয়টা বাজে?”

নেহাল মোবাইলে সময় দেখে বলল, “একটা বায়ান্ন।”

“এখন তো আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি সকাল হলেই আম্মুর কাছে যাব।”

“তোমার পা…”

“এটা কোনো সমস্যা না। আমি আম্মুর সাথে অত্যন্ত বাজে আচরণ করেছি। আমি…”

প্রাণপণে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েটা।

“আমি নিয়ে যাব। তুমি চিন্তা করো না একদম। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো প্লিজ।”

“আমি ঘুমাব না। আমার ভেতরে কেমন অস্থির লাগছে। কান্না আসছে। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি না।”

নেহাল লিলির কোলের উপরে রাখা একটা হাত নিজের হাতে নিল। এরপর বলল,

“কান্না পেলে কাঁদতে হয় লিলি। দেখবে কষ্টগুলো বাষ্প হয়ে বেরিয়ে যায়। অনেকটা হালকা লাগে। একটু কেঁদে দেখো। কাঁদলেই লোকে দুর্বল হয়ে যায় না। এটা একটা মানবীয় অনুভূতি। নিজেকে হালকা করার জন্যও কখনো কখনো কাঁদতে হয়।”

লিলির কী হলো সে জানে না, আচমকা নেহালের বুকে মাথা রেখে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। মায়ের প্রতি রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সব যেন চোখের জলে ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে৷ লুকিয়ে লুকিয়ে সে কেঁদেছে অল্পস্বল্প। মা’য়ের কোলে মাথা রেখেও কেঁদেছে, আজ ভিন্ন একজনের বুকে মাথা রেখে নিজের মনের আগল খুলে দিলো লিলি।

নেহাল একটা হাত লিলির মাথায় রেখে আলতো করে সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। হাড় কাঁপানো শীতের সকালে এক চিলতে মিঠে রোদ্দুর যেমন করে শীতার্তের গায়ে পেলব স্পর্শ মেখে আদুরে অনুভূতি দিয়ে যায়, তেমনই নেহালের এই সান্ত্বনার স্পর্শটুকু লিলিকে যেন অদ্ভুত সঞ্জীবনী শক্তি যুগিয়ে দিল, ভরসা মেখে রইল।

না বলা এই স্পর্শটুকুতে যেন নেহালের অব্যক্ত একটা কথা মিশে রইল,

“লিলি, আমি আছি তো। এভাবেই থাকব। সবসময়।”

নৈশব্দের এই শব্দটুকু লিলি নিজেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে নিল। গত কিছুদিন মনে যে অন্তর্দাহ ছিল সেটুকু মিলিয়ে গেল বহুদূরে।

ওর সম্বিত ফিরলেও সে মাথা সরিয়ে নিল না৷ সেভাবেই বসে রইল। কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই জায়গাটুকু কেবলই ওর একান্ত নিজস্ব সম্পদ। মনে হলো এমন কারোর বুকে সে মাথা রেখেছে, সে মানুষটার জন্যই যেন ও জন্ম থেকে অপেক্ষায় ছিল। আরও একটা উপলব্ধি লিলির প্রগাঢ় হলো, আমৃত্যু সুখে দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে সে এভাবেই এখানে নিজের মাথা রেখে নিজের সুখটুকু খুঁজে নিতে চায়।

নেহালের চোখে লিলি মুগ্ধতা দেখেছে কেবল, তাতে মোহ কিছুটা থাকলেও লোলুপতা একবিন্দু ছিল না। সবচাইতে যেটা লিলিকে স্পর্শ করেছে, ওর হাজারটা বাড়াবাড়ি, অভিযোগ, অপমানের পরেও মানুষটা কখনো এটা ফেরত দেবার চেষ্টা করেনি। বরং ওকে বুঝতে চেষ্টা করেছে, ওর আচরণের পেছনের কারণটুকু অনুধাবন করেছে। আজ ওর কষ্টগুলোকেও ভাগ করে নিল।

কতক্ষণ সময় কাটল সে জানে না, ঘুম পেয়ে গেল লিলির। সে আলিঙ্গন মুক্ত করল নেহালকে, এরপর ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে বাসায় যেতে হবে মায়ের সাথে অভিমান চুকিয়ে দিতে, এই চিন্তা এবং পায়ের ব্যথায় সারারাত কাটল ছাড়া ছাড়া ঘুমের মধ্যে। তবে ঘুম ভেঙে নেহালকে জেগে বসে থাকতেই দেখেছে প্রতিবার। একবার মনে হলো ঘুমিয়ে পড়তে বলবে। কিন্তু ওর জন্য মা’য়ের পরে আরেকজন কেউ নির্ঘুম রাত পার করছে, এটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগল।

একটা রাত জাগুক নাহয় ওর জন্য। কী এমন ক্ষতি হবে!

এটাকেই কি ভালোবাসা বলে! ভালোবাসা এমন আচমকাই বুঝি হয়ে যায়! আলোকবর্ষ দূরত্ব কেমন এক নিমিষেই পাড়ি দিয়ে হৃদয়ের শক্ত কপাট ভেদ করে অনায়াসেই হৃদয়ে প্রবেশ করল লোকটা।

লিলির কঠিন হৃদয় কেমন তরল হয়ে এসেছে, তাতে নেহাল দ্রবীভূত হচ্ছে যেন ক্রমশ।
……..
(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে